বাংলা সাহিত্য-সঙ্গীতের অন্ধকার যুগ
(১২০৪-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ)


চর্যাগীতির পরে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে একটি বড় ধরনে ধাক্কা লাগে ইখতিয়ার উদ্দীন বখতিয়ার খিলজি বাংলা-অভিযানের মধ্য দিয়ে। ১২০৪-০৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকের এই বখতিয়ার খিলজির গৌড় দখলের পর, শুরু হয় বাংলার আর্থ-সামজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই অস্থিরতা ছিল অনুমানিক ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময়ে বাংলা সাহিত্য ও বাংলা গানের কোনো নমুনা পাওয়া যায় না। নমুনা না পাওয়ার সূত্রে এই সময়কে অন্ধকার যুগ বলা হলেও, এই সময়ে বাংলার লোকসমাজে গানের চর্চা একেবারই ছিল না, এ কথা মানা যায় না। তবে নমুনাবিহীন লোকসঙ্গীত সম্পর্কে এ বিষয়ে অনুমান করা যায় না। রাজা-রাজায় যুদ্ধে নাগরিক গান ক্ষতগ্রস্থ হয়েছিল এ কথা মানতেই হয়।

এর সূচনা হয়েছিল ইখতিয়ার উদ্দীন বখতিয়ার খিলজি বাংলা-অভিযানের মধ্য দিয়ে। ১২০৪-০৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি বাংলা আক্রমণের জন্য ঝাড়খণ্ডের ভিতর দিয়ে নদীয়ার দিকে অগ্রসর হন। এরপর তিনি বাংলার সেনবংশের রাজা লক্ষ্মণসেন-এর দ্বিতীয় রাজধানী নদীয়া আক্রমণ করে দখল করে নেন। ঘোরীর একটি স্বর্ণমুদ্রায় এর তারিখ উল্লেখ আছে ৬০১ হিজরী সনের ১৯শে রমযান। গ্রেগোরিয়ান পঞ্জিকা মতে সময়টা দাঁড়ায় ১০ই মে, ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ।

বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের অন্ধকারযুগের (১২০৪-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ), তুঘলকি শাসনামল (১৩২৮-১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দ) -কে সাধারণভাবে অরাজকতার কাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে মহম্মদ-বিন-তুঘলকে পরাজিত করে, ইলিয়াস শাহ তাঁকে পরাজিত করে লক্ষ্মণাবতীর সিংহাসনে বসেন। এই সূত্রে বাংলার ইতিহাস একটি নবতর রূপ লাভ করে। তাঁর মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইলিয়াস শাহী রাজবংশ। ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বাংলার রাজধানী গৌড় থেকে পাণ্ডুয়াতে স্থানান্তর করেন। উল্লেখ্য, ১৩৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ইলিয়াস শাহ মৃত্যুবরণ করেন।

এরপর বাংলার অধিকার নিয়ে দেড়শত বৎসর টানা হ্যাঁচড়া চলে। এরই ভিতর দিয়ে ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দ ইলিয়াস শাহ বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে রাজত্ব শুরু করেন। আর ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি বাংলাদেশের সিলেট থেকে উত্তরে বারাণসী এবং উত্তর-পূর্ব বঙ্গ সকল অঞ্চল জুড়ে তিনি তাঁর অধিকারে আনেন। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে এই সময় বাঙালি কবি চণ্ডিদাস জীবিত ছিলেন। এই সময় বাংলা সাহিত্যের চর্চা পুনরায় শুরু হয়। এই বিচারে ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে মোটা দাগে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ হলেও বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল পশ্চিমা মুসলমানদের ব্যবহৃত নানা ধরনের শব্দের দ্বারা। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা ভাষার শব্দ সম্ভারে ছিল, সংস্কৃত, অর্ধতৎসম, তদ্ভব ও দেশী শব্দের সমাহার। পশ্চিমা মুসলমান শাসকদের সূত্রে হয়তো কিছু কিছু আরবি, ফারসি, আফগানি ইত্যাদি ভাষার শব্দের অনুপ্রবেশ করেছিল। কিন্তু তার ব্যাপক প্রভাব বাংলা ভাষায় পড়ে নি। ১২০৫-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে এসকল ভাষার শব্দের ব্যাপকভাবে প্রবেশ করেছিল বাংলা কথ্য ভাষায়। যেহেতু এই সময়ের ভিতরে রচিত কোনো সাহিত্য নমুনা পাওয়া যায় নি, তাই এই বিষয়ে প্রমাণব্যতীত অনুমান ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

প্রথমদিকে রাজদরবারে বিদেশী মুসলমানরা নিজেদের ভাষায় কথা বলতো। কিন্তু তারা যখন প্রশাসনিক কাজে সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলতো, তখন বাংলাতে কথা বলার চেষ্ট করতো। দীর্ঘদিন বাংলা ভাষায় কথা বলার চেষ্টায়, তাদের ভিতরে একটি মিশ্র-বাংলার তৈরি হয়েছিল। অন্যদিকে ধর্মান্তরিত মুসলমানরা নামাজ, রোজা, আজান ইত্যাদি শব্দের বাইরে কিছু আরবি, ফার্সি শব্দ ব্যবহার করলেও তা বাংলা প্রধান ছিল। অভিজাত হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রথম প্রথম মুসলমানদের এড়িয়ে চলতো বটে, কিন্তু রাজশক্তিকে অগ্রাহ্য করে বেশি দিন থাকা যায় না। এই সময় অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা রাজ দরবারে কাজও করতো। ধীরে ধীরে এরা প্রশাসনের কর্মী হিসেবে বিদেশী শব্দ ব্যবহার করা শুরু করেছিল। গোড়ার দিকে বাংলা ভাষা সনাতন ধারা এবং মুসলমানী ধারায় হয়তো ভাগ করা যেতো দেড়শত বৎসর পরে বাংলা ভাষার ব্যবধান যে ঘুঁচে গিয়েছিল, তা লক্ষ্য করা যায়  সেকালের কবিদের আরবি, ফার্সি ইত্যাদি শব্দের ব্যবহারের পরিমাণ দেখে। কালক্রমে হিন্দু-মুসলমানের চেয়ে বড় পরিচয় দাঁড়িয়েছিল বাঙালি। দ্বিতীয় পর্যায়ে বাঙালির পরিচয় দাঁড়িয়েছিল বাঙালি মুসলমান কিম্বা বাঙালি হিন্দু।

বাংলা ভাষার এই অন্ধকারযুগেই রচিত হয়েছিল সংস্কৃত কাব্য গীতগোবিন্দ। কবি জয়দেবের রচিত এই কাব্যগ্রন্থ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতকে বিশেষভাবে উজ্জীবিত করেছিল। গীতিনাট্যের আদলে রচিত এই কাব্যে রয়েছে ২৪টি গান।

এই গানগুলো হলো-

১. প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসিবেদং। রাগ: মালবগৌড়। তাল: রূপক।
২. শ্রিতকমলাকুচমণ্ডল ধৃতকুণ্ডল কলিতললিতবনমাল। রাগ গুর্জরি। তাল নিঃসার
৩. ললিতলবঙ্গলতাপরিশীলনকোমলমলয়সমীরে। রাগ: বসন্ত। তাল যতি
৪. চন্দনচর্চ্চিতনীলকলেবরপীতবসনবনমালী। রাগ: রামকিরী। তাল: যতি
৫. সঞ্চরদধরসুধামধুরধ্বনি। রাগ গুর্জরি। তাল: যতি।
৬. নিভৃতনিকুঞ্জগৃহং গতয়া নিশি রহসি নিলয়ী বসন্তং। রাগ মালবগৌড়। একতালী
৭. মামিয়ং চলিতা বিলোক্য বৃতং বধূনিচয়েন। রাগ গুর্জরি। তাল যতি
৮. নিন্দতি চন্দনমিন্দুকিরণমনুবিন্দতি খেদমধীরং। রাগ: কর্ণাট।  তাল যতি
৯. স্তনবিনিহিতমপি হারমুদারং। রাগ: দেশাখ। তাল যতি
১০. বহতি মলয়সমীরে মদনমুপনিধায়। রাগ: দেশীবরাড়ী। তাল রূপক।
১১. রতিসুখসারে গতমভিসারে মদনমনোহরবেশং। রাগ: গুর্জরী। তাল: একতালী
১২. পশ্যতি দিশি দিশি রহসি ভবন্তং। রাগ: গোণ্ডকিরী। তাল রূপক।
১৩. কথিতসময়েহপি হরিরহ্হ ন যযৌ বনং। রাগ মালব।   তাল যতি
১৪. স্মরসমরোচিতবিরচিতবেশা। রাগ বসন্ত। তাল: যতি
১৫. সমুদিতমদনে রমণীবদনে চুম্বনবলিতাধরে। রাগ: গুর্জরী। তাল: একতালী।
১৬. অনিলতরলকুবলয়নেন। রাগ: দেশবরারড়ী। তাল: রূপক।
১৭. রজনিজনিতগুরুজাগররাগকষায়িতমলসনিমেষং। রাগ: ভৈরবী। তাল যতি।
১৮. হরিরভিসরতি বহতি মৃদুপবনে। রাগ: রামকিরী। তাল যতি।
১৯. বদসি যদি কিঞ্চিদপি দন্তরুচোকৌমুদী। রাগ: দেশবরারড়ী। তাল: অষ্টতাল।
২০. বিরচিতচাটুবচনরচনং চরণে রচিতপ্রণিপাতং। রাগ: বসন্ত। তাল যতি।
২১. মঞ্জুতরকুঞ্জতলকেলিসদনে। রাগ দেশবরাড়ী। তাল: রূপক
২২. রাধাবদনবিলোকনবিকসিতবিবিধবিকারবিভঙ্গং। রাগ বরাড়ী। তাল: রূপক
২৩. কিশলয়শয়নতলে কুরু কামিনি চরণনলিনীবিনিবেশ। রাগ: বিভাস। তাল: একতালা
২৪. কুরু যদুনন্দন চন্দনশিশিরতরেণ করেণ পয়োধরে। রাগ: রামকিরী। তাল যতি।

গীতগোবিন্দের রাগ ও তালের নাম পাওয়া যায় বটে, তবে এর সুরের সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দ গীতগোবিন্দের গানগুলোর স্বরলিপি করেছিলেন। কিন্তু গীতগোবিন্দে উল্লিখিত রাগ-তালের নামের সাথে ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর স্বরলিপির সাথে উল্লেখকৃত রাগ-তালের মিল পাওয়া যায় না। যেমন-  মূল গীতগোবিন্দে 'প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসিবেদং'-এর শীর্ষে  রাগের নাম মালবগৌড় এবং তালের নাম রূপক পাওয়া যায়। কিন্তু ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর স্বরলিপিতে রাগ ও তালের নাম পাওয়া যায় ভৈরবী-ঢিমা তেতালা। এরূপ অন্যান্য গানের ক্ষেত্রেও রাগ-তালের নামের ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়।


সূত্র :