চর্যাগীতি
৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে রচিত চর্যাপদ বা চর্যাগীতির সংকলন।

একটি ভাষার বিকাশ ঘটে মুখে মুখে। এর দ্বারা একটি সময়ের ভিতরে ভাষা একটি রূপ লাভ করে কথ্য ভাষা হিসেবে। মূলত ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারায় যে কোনো ভাষা কোনো পূর্বর্তী ভাষার রূপান্তরিত দশায় থাকে। এই দশায় একটি ভাষা যতটুকু স্থায়ীত্ব পায়, তারই উপর ভিত্তি করে নানা ধরনের উপাখ্যান, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি। এই সাহিত্য লিখিত বা অলিখিত হতে পারে। এর ভিতরে লিখিত রূপই একটি ভাষায় রচিত সাহিত্যকে স্থায়ীত্ব দিতে পারে।

বাংলা ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারার একটি বিশেষ অধ্যায় হলো- চর্যাপদ রচনার কাল। কারণ এটি বাংলা সাহিত্যের আদি নমুনা। তাই এর রচনাকাল নিরূপণ করাটা- বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ক্রমবিকাশের ধারা অনুসরণের জন্য জরুরি।

চর্যাপদের রচনাকাল
চর্যাপদ বা চর্যাগীতি নব্য ভারতীয় আর্যভাষার পূর্বাঞ্চলীয়  উপশাখার (পূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃত ভাষা) অন্তর্গত, বাংলা-অহমিয়া ভাষা গোষ্ঠীর স্বতন্ত্র ভাষা হিসেব বিবেচিত বাংলা ভাষা প্রাচীনতম নিদর্শন। প্রাকৃতজনের ভাষার সাথে সংস্কৃত ভাষার সংমিশ্রণে বাংলা ভাষার আদিরূপ সৃষ্টি হয়েছিল। এই আদিরূপটিই কালক্রমে স্বতন্ত্র রূপ লাভ করছিল। ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বাংলা ভাষার আদিম রূপটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে অন্যান্য ভারতীয় ভাষা থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিল। বাংলার এই স্বতন্ত্র আদিম রূপের একমাত্র নমুনা হিসেবে চর্যাগীতিকে আদর্শ বিবেচনা করা হয়। এই ভাষার কাঠামো চর্যাগীতির আদলে প্রকাশ পেয়েছিল খ্রিষ্টীয় ৫০০-৬০০ অব্দের দিকে। 

রচনাকাল :
বিভিন্ন গবেষকগণ এই পুথির পদগুলোর রচনাকাল সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য কিছু মত দেওয়া হলো। যেমন ‒ উল্লেখিত গবেষকদের মতামতের উপর ভিত্তি করে- চর্যাপদের প্রকৃত রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায় না। তাই মোটা দাগে আমরা ধরে নিতে পারি, এই গ্রন্থের পদগুলো রচিত হয়েছিল ৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে। এই কাল নিরুপণটা করা হয়ে থাকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পাওয়া চর্যাপদের সংকলন থেকে। এই সংকলনের মূল গ্রন্থে স্থান পেয়েছিল ৫০টি পদ। এই সামান্য কয়েকটি পদ নিয়ে চর্যাপদ-চর্চার কাল নিরূপণ করাটা সত্যাশ্রয়ী হয়ে উঠে না। ধারণা করা হয়, কোনো একজন সংকলক তাঁর পছন্দের পদগুলোকে একত্রি করে একটি গ্রন্থের রূপ দিয়েছিলেন মাত্র। যদি সংকলকের মতে এই পদগুলো শ্রেষ্ঠ বা সবচেয়ে পছন্দের হয়, তাহলে একথা মেনে নিতেই হয় যে, এই সময় আরও বহুজনের হাতে বহু পদ তৈরি হয়েছিল। শুধু তাই নয় বেশ আগে থেকে এই ধরনের পদ রচনার প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল, যা সংকলিত হয় নি বা সংকলিত হলেও তার সন্ধান পাওয়া যায় নি।

মৌখিক বা কথোপকথনের বিচারে ভাষায় যে অকৃত্রিম রূপ থাকে, সাহিত্য-অঙ্গনে এসে তা অনেকটাই কৃত্রিম হয়ে যায়। কবিতার ক্ষেত্রে এই সত্যটা সবচেয়ে বেশি খাটে। তাই চর্যাগীতির ভাষা সেকালের খাঁটি বাংলা হলেও কৃ্ত্রিম। এই ভাষার পদকর্তারা ছিলেন সেকালের শিক্ষিত ধর্মগুরু। তাঁরা ধর্মের নিগূঢ়তত্ত্ব রচনা করেছিলেন সুরে ও ছন্দে। সেখানে সাধারণ মানুষের লোকাচার বা সুখ-দুঃখ প্রাধান্য পায় নি। আলো-আঁধারি ভাষায় রচিত এই পদগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় নাগরিক গানের কথা। আরও বেশি করে এই ভাবনা জোরালো হয়ে ওঠে, যখন এই পদগুলোর শিরোদেশে রাগের নাম পাওয়া যায়।

এই সংকলনেরর পদগুলো রচনা করেছিলেন মোট ২৪ জন সিদ্ধাচার্য। এঁরা হলেন: লুইপা, কুক্কুরীপা, বিরুপাগুণ্ডরীপা, চাটিল্লপা, ভুসূকুপা, কাহ্নপা, কম্বলাম্বরপা, ডোম্বীপা, শান্তিপা, মহিত্তাপা, বীণাপা, সরহপা, শবরপা, আর্যদেবপা ঢেন্ঢণপা দারিকপা ভাদেপা, তাড়কপা, কঙ্কনাপা, জয়নন্দীপা, ধর্ম্মাপা, তান্তী পা, লাড়ীডোম্বী। এঁদের মধ্যে লাড়ীডোম্বীর পদটি পাওয়া যায়নি। ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক পদগুলি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুঁথিতে না থাকলেও ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচী আবিষ্কৃত তিব্বতি অনুবাদে এগুলির রচয়িতার নাম উল্লিখিত হয়েছে যথাক্রমে কাহ্ন, তান্তী পা ও কুক্কুরী।

অধিকাংশ গবেষক চর্যা-পদকর্তাদের ভিতরে লুইপাকে আদিসিদ্ধাচার্য হিসাবে উল্লেখ করে থাকেন। অবশ্য রাহুল সাংকৃত্যায়ন আদিসিদ্ধাচার্য হিসাবে সরহপাদ-কে বিবেচনা করেছেন। তিনি ঠিক কোন সময়ের কবি ছিলেন, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। ১ ও ২৯ সংখ্যক পদ দুটি তাঁর রচিত।

চর্যার পুঁথিতে সর্বাধিক সংখ্যক পদের রচয়িতা কাহ্নপা। তিনি কৃষ্ণাচার্য, কৃষ্ণপাদ ও কৃষ্ণবজ্র নামেও পরিচিত। পুঁথিতে তাঁর মোট ১১টি পদ (৭, ৯, ১১, ১২, ১৮, ১৯, ২৪, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫) পাওয়া যায়। ভুসূকুপা, রচিত পদের সংখ্যা আটটি (৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩, ৪৯)। এছাড়া সরহপা- এর চারটি পদ (২২, ৩২, ৩৮, ৩৯), কুক্কুরীপা-এর তিনটি পদ (২, ২০, ৪৮), শান্তিপা-এর ২টি পদ (১৫ ও ২৬), শবরপা-এর  দুইটি পদ (২৮ ও ৫০) রচনা করেন। অন্যান্য পদকর্তাদের একটি করে পদ এই সঙ্কলনে স্থান পেয়েছিল।

চর্যাপদের প্রাপ্তি
১৮৮২ সালে রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে প্রাপ্ত সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিভিন্ন বৌদ্ধপুথির একটি তালিকা প্রস্তুত করেন। এই তালিকাটির নাম ছিল- Sanskrit Buddhist Literature in Nepal রাজেন্দ্রলাল মিত্র  (২৬.৭.১৮৯১) মৃত্যুর পর তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বাংলা-বিহার-আসাম-উড়িষ্যা অঞ্চলের পুথি সংগ্রহের দায়িত্ব দেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে । এই সূত্রে তিনি ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে নেপালে যান। এটি ছিল তাঁর তৃতীয় অনুসন্ধান-ভ্রমণ। এই ভ্রমণের সময় তিনি নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থাগারে কিছু নতুন পুথির সন্ধান পান। এই পুথিগুলোসহ হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা- নামেএকটি সংকলন প্রকাশিত হয় ১৩২৩ বঙ্গাব্দে (১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দ)। এই সংকলনের একটি গ্রন্থ ছিল চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চিয়

গ্রন্থনাম:

১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে নেপালে প্রাপ্ত তালপাতার পুথি সম্পর্কে একটি তালিকা প্রকাশ করেন। এই তালিকার নাম ছিলো-
A Catalogue of Palm Leaf and selected Paper MSS belonging to the Durbar Library, Nepal । এর দ্বিতীয় খণ্ডের তালিকায় এই পুথির নাম হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন -চর্য্যাচর্য্যটীকা। এই নামটি পুথির মলাটে লিখা ছিল। কিন্তু ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা- নামক গ্রন্থের ভূমিকায় এই গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন- চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চিয়।  কেন তিনি গ্রন্থটির নাম পরিবর্তন করেছিলেন তার ব্যাখ্যা  হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দেন নি। এই পুথির বন্দনা শ্লোকে আছে
'শ্রীলূয়ীচরণাদিতিসিদ্ধরচিতেহপ্যাশ্চর্য্যাচেয়সদ্বার্ত্মাবগমায়নির্মলগিরাং...।
এই শ্লোকে উল্লিখিত 'আশ্চার্য্যচর্য্যাচয়' শব্দটিকে এই গ্রন্থের নাম হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন বিধুশেখর শাস্ত্রী। প্রবোধকুমার বাগচী এবং সুকুমার সেন গ্রন্থটির নামকরণ করেছিলেন- চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চিয়। এই গ্রন্থের মনুদত্তের তিব্বতী অনুবাদ অনুসরণে এই পুথির নাম চর্যাগীতিকোষবৃত্তি নামকরণের প্রস্তাব করেছেন। নামকরণের এই বিতর্ক থাকলেও সাধারণভাবে এই পুথি সাধারণভাবে চর্যাগীতি, চর্যাগীতিকা, চর্যাপদ ইত্যাদি নামেই পরিচিত।

চর্যাগীতির পদসংখ্যা

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক আবিষ্কৃত পুথিটিতে পূর্ণাঙ্গ পদ পাওয়া গেছে ৪৬টি। এই গ্রন্থের ২৩ সংখ্যক পদের অর্ধাংশ পাওয়া গিয়েছিল। বাকি ৩টি পদ (২৪, ২৫ ও ৪৮) ছিল না। ২৩ সংখ্যক পদের শেষাংশ এবং না-পাওয়া ৩টি পদ তিব্বতী অনুবাদ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন প্রবোধকুমার বাগচী। সব মিলিয়ে চর্যাগীতির পদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০টি।

চর্যাগীতির ভাষা
চর্যাপদের সংগ্রহ প্রকাশিত হওয়ার পর এর ভাষা নিয়ে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন ভাষাবাষীরা তাদের নিজ ভাষার প্রাচীনতম নমুনা হিসেবে দাবি করেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর সম্পাদিত হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা বৌদ্ধ গান ও দোহা গ্রন্থের ভূমিকায় চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদ ও কৃষ্ণাচার্যের দোহা এবং ডাকার্ণব-কে সম্পূর্ণ প্রাচীন বাংলার নিদর্শন বলে দাবি করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কর্তা ও সম্পাদক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভও তাঁর দাবিকে সমর্থন করেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে বিজয়চন্দ্র মজুমদার চর্যাগীতিকে বাংলার প্রাচীন নমুনা হিসেবে অস্বীকার করেছিলেন।  ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যাগান ও দোহাগুলির ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ ও ছন্দ বিশ্লেষণ করে‒  তাঁর
The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থে,  এইগুলিকেই প্রাচীন বাংলার নিদর্শন হিসাবে গ্রহণ করেন। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ'র প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয় Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha গ্রন্থে সুনীতিকুমারের মত গ্রহণ করেন। রাহুল সাংকৃত্যায়ন বা অন্যান্য ভাষার বিদ্বজ্জনেরা যাঁরা চর্যাকে নিজ নিজ ভাষার প্রাচীন নিদর্শন বলে দাবি করেছিলেন, তাঁরা এই রকম সুস্পষ্ট ও সুসংহত বৈজ্ঞানিক প্রমাণের দ্বারা নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন নি।

সন্ধ্যাভাষা
চর্যাপদগুলোর ভিতরে রয়েছে নানা ধরনের দুর্বোধ্য ভাব। এর আক্ষরিক অর্থের সাথে ভাবগত অর্থের ব্যাপক ব্যবধান আছে। ফলে এই পদগুলোতে বুঝা-না-বুঝার দ্বন্দ্ব রয়ে যায়। সেই কারণে চর্যায় ব্যবহৃত ভাষাকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন সন্ধ্যাভাষা। তাঁর মতে-
'সহজিয়া ধর্মের সকল বই-ই সন্ধ্যা ভাষায় লেখা। সন্ধ্যা ভাষার মানে আলো-আঁধারি ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিকটা বুঝা যায় না। অর্থাৎ, এই সকল উঁচু অঙ্গের ধর্মকথার ভিতরে একটা অন্য ভাবের কথাও আছে। সেটা খুলিয়া ব্যাখ্যা করিবার নয়। যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সে কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই।'
বজ্রযানী ও সহজযানী গ্রন্থকাররাও একে  'সন্ধ্যাভাষয়া বোদ্ধব্যম্' বলে এক রহস্যের ইঙ্গিত দিতেন। বজ্রযানী গ্রন্থগুলিতে 'সন্ধ্যাভাষা' শব্দটি বহুল-ব্যবহৃত। তিব্বতি ভাষায় 'সন্ধ্যাভাষা'র অর্থ 'প্রহেলিকাচ্ছলে উক্ত দুরুহ তত্ত্বের ব্যাখ্যা'। ম্যাক্সমুলার 'সন্ধ্যা'র অর্থ করেছিলেন 'প্রচ্ছন্ন উক্তি'
(hidden saying)

কাব্যিক এবং সন্ধ্যা ভাষার উপস্থাপনায় এক ধরনের কৃত্রিম ভাষারীতির সৃষ্টি হয়েছে। একথা বলার কারণ নেই যে, সেকালের বাঙালিরা এই ভাবে কথা বলতেন। তবে এই পদগুলোতে ব্যবহৃত শব্দের বিচারে, ভাষার শব্দগত একটি পরিচয় পাওয়া যায়। চর্যাপদে ব্যবহৃত শব্দগুলোকে যদি শব্দ-উৎসের বিচারে শ্রেণিবদ্ধ করা যায়, তাহলে মোটা দাগে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। ভাগগুলো হলো- চর্যাগীতির সাঙ্গীতিক বৈশিষ্ট্য
ভারতীয় সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তনের ধারায়- প্রথম উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়- প্রোটো-অস্ট্রালয়েড নৃগোষ্ঠীর সঙ্গীত। আফ্রিকা থেকে এই নৃগোষ্ঠী প্রায় ৫০-৬০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রায় ৪০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এরা সাগর পাড়ি দিয়ে অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশে প্রবেশ করেছিল। এরাই হলো অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী। এদেরকে সাধারণভাবে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড বলা হয়। ধারণা করা ভারতে প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২০-৬ হাজার বৎসরের ভিতরে। এদের আগমনের ফলে ভারতে আগত আদি নেগ্রিটো-রা অপ্রধান হয়ে পড়েছিল। হয়তো নেগ্রিটোরা আত্মরক্ষায় অপারগ হয়ে ক্রমে ক্রমে উত্তর ভারতে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। কিম্বা এরা দক্ষিণের দিকে সরে গিয়েছিল। কিম্বা এদের সাথে প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের সংমিশ্রণের ফলে নিজেদের জাতিগত স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য হারিয়েছিল। এই নৃগোষ্ঠীর উত্তর-পুরুষরাই হলো সাঁওতাল, ওঁরাও ইত্যাদি আদিবাসী।

উত্তর-ভারত থেকে নেগ্রিটিরা বহু আগে বিতারিত হয়ে গিয়েছিল, তাই বঙ্গদেশ-সহ উত্তর ভারতের সঙ্গীতের প্রভাব ততটা পড়েনি। তবে প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের ভাষা ও সঙ্গীত পরবর্তী মিশ্র জাতি সত্তার সাংস্কৃতিক বিকাশে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল এমনটা ধারণা করা হয়। এরপর খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ বৎসরের দিকে বিকশিত সিন্ধু সভ্যতার সূত্রে ভারতীয় সঙ্গীতের নব্যধারার সূচনা হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টব্দের ভিতরে বিকশিত হয়েছিল ভারতীয় আর্যদের বৈদিক গান। বৈদিক সামগান এবং লৌকিক গানের ধারায় বিকশিত হয়েছিল গান্ধর্ব বা মার্গ সঙ্গীত। ভারতীয় সঙ্গীত মূলত গন্ধর্বদের দ্বারা লৌকিক গান এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বিভাজিত হয়ে গিয়েছিল। এদের স্বরের কাঠামোগত বিন্যাসে গ্রাম সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর গ্রাম থেকে উদ্ভব হয়েছিল জাতিরাগ, ধ্রুবা গান, প্রবন্ধগান।

৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে রচিত চর্যাপদগুলো ছিল একাধিক চরণবিশিষ্ট, অন্ত্যমিলযুক্ত কবিতা এবং সুরসঙ্গের বিচারে গীত। গানের প্রকৃতি অনুসারে চর্যাগীত হলো বাংলা নাগরিক গান। বৌদ্ধ সহজিয়া মতাদর্শে সাধকশ্রেষ্ঠরা এই পদ রচনা করেছিলেন। তাঁরা তৎকালীন ভারতীয় রাগ সঙ্গীতে শিক্ষিত ছিলেন। রাগসঙ্গীতের বিবেচনায় এই পদগুলো হয়তো প্রাচীন প্রবন্ধগানের সঙ্গীতশৈলীতে বাঁধা হয়েছিল। পদগুলোর শীর্ষের লেখা রাগনাম থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, এই পদগুলো সেকালে সুরসহযোগে পরিবেশিত হতো। এই পদগুলোতে মোট ১৬টি রাগের নাম পাওয়া যায়। নিচে রাগানুসারে পদগুলোর তালিকা দেওয়া হলো।
  1. অরু: এই রাগে নিবদ্ধ গানের সংখ্যা ১টি। পদসংখ্যা- ৪
  2. কামোদ: এই রাগে নিবদ্ধ গানের সংখ্যা ৪টি। এই গানগুলো হলো- ১৩, ২৭, ৩৭ ও ৪২।
  3. গবড়া (গৌড়) :  চর্যাগীতিতে এই রাগের অপরাপর নাম হিসেবে গবড়া বা গউড়া উল্লেখ আছে।  এই রাগে নিবদ্ধ গানের সংখ্যা ৩টি। এই গানগুলো হলো-  ২, ৩, ১৮।
  4. গুঞ্জরী (গুর্জরী): চর্যাগীতিতে এই রাগের অপরাপর নাম হিসেবে গুর্জরী বা কাহ্ন-গুর্জরী ব্যবহার করা হয়েছে।  এই রাগে নিবদ্ধ গানের সংখ্যা ৪টি। এই গানগুলো হলো- ৫, ২২, ৪১ ও ৪৭।
  5. দেবক্রী দেবগিরি : চর্যাগীতিতে এই রাগের অপর নাম হিসেবে দেবক্রী উল্লেখ আছে। এই রাগে নিবদ্ধ গানের সংখ্যা ১টি। এই গানটি হলো- ৮
  6. দেশাখ : চর্যাগীতিতে এই রাগের অপর নাম হিসেবে দ্বেশাখ উল্লেখ আছে। এই রাগে নিবদ্ধ গানের সংখ্যা ২টি। এই গানগুলো হলো ‒ ১০ ও ৩২।
  7. ধানশী : চর্যাগীতিতে এই রাগের অপর নাম হিসেবে ধনসী উল্লেখ আছে। এই রাগে নিবদ্ধ গানের সংখ্যা ১টি। এই গানটি হলো- ১৪।
  8. পটমঞ্জরী । হরপ্রসাদ শাস্ত্রী-কর্তৃক উদ্ধারকৃত গ্রন্থে এই রাগের গান সংখ্যা ১১টি গান। তাতে ৪৮ সংখ্যক গানটি ছিল না। তিব্বতী অনুবাদ অনুসারে ৪৮ সংখ্যক গানটির শিরোনামে 'পটমঞ্জরী' রাগের নাম পাওয়া যায়। এই হিসাবে এই রাগে নিবদ্ধ গানের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২টি। এই গানগুলো হলো ১, ৬, ৭, ৯, ১১, ১৭, ২০, ২৯, ৩১, ৩৩, ৩৬ ও ৪৮।
  9. বঙ্গাল : এই রাগে নিবদ্ধ গানের সংখ্যা ১টি। এই গানটি হলো- ৩৩।
  10. বরাড়ী (বরাটী): চর্যাগীতিতে এই রাগের অপর নাম হিসেবে বলাড্ডী ব্যবহার করা হয়েছে।  এই রাগে নিবদ্ধ গানের সংখ্যা ৪টি। এই গানগুলো হলো- ২১, ২৩, ২৮ ও ৩৪।  হরপ্রসাদ শাস্ত্রী-কর্তৃক উদ্ধারকৃত গ্রন্থে এই ২৩ সংখ্যক গানের শেষাংশ ছিল না।
  11. ভৈরবী: এই রাগে নিবদ্ধ গানের সংখ্যা ৪টি। এই গানগুলো হলো- ১২, ১৬, ১৯ ও ৩৮।
  12. মল্লারী: হরপ্রসাদ শাস্ত্রী-কর্তৃক উদ্ধারকৃত গ্রন্থে এই রাগের গান সংখ্যা। এই রাগে নিবদ্ধ গানের সংখ্যা ৫টি। এই গানগুলো হলো-  ৩০, ৩৫, ৪৪, ৪৫ ও ৪৯।
  13. মালসী (মালশ্রী): চর্যাগীতিতে এই রাগে নিবদ্ধ গানের সংখ্যা ১টি। এই গানগুলো হলো-৩৯।
  14. মালসী গবুরা : চর্যাগীতিতে এই রাগে নিবদ্ধ গানের সংখ্যা ১টি। এই গানগুলো হলো-৪০।
  15. রামক্রী (রামকেলি) : চর্যাগীতিতে এই রাগের অপর নাম হিসেবে রামক্রী উল্লেখ আছে। এই রাগে নিবদ্ধ গানের সংখ্যা ২টি। এই গানগুলো হলো ‒  ১৫ ও ৫০।
  16. শবরী (সাবেরী): চর্যাগীতিতে এই রাগের অপরাপর নাম হিসেবে এই রাগে নিবদ্ধ গানের সংখ্যা ২টি। এই গানগুলো হলো- ২৬ ও ৪৬।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী-কর্তৃক উদ্ধারকৃত গ্রন্থে এই ২৩ সংখ্যক গানের শেষাংশ ছিল না। তিব্বতী নমুনা থেকে এই পদের রচয়িতা হিসেবে তান্তীর নাম পাওয়া যায়। কিন্তু তাতে রাগের নাম নেই। একইভাবে  হরপ্রসাদ শাস্ত্রী-কর্তৃক উদ্ধারকৃত গ্রন্থে এই ২৪ সংখ্যক গান ছিল না। তিব্বতী নমুনায় এই রাগের সাথে ইন্দ্রতাল উল্লেখ আছে। সুকুমার সেন এই রাগটিকে 'তাল' হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

চর্যাগীতির বিষয়াঙ্গ:
সাধারণভাবে বলা হয় বৌদ্ধ সহজিয়া মতবাদের আদর্শের চর্যপদগুলো রচিত হয়েছিল। ভারতবর্ষের ধর্মের ক্রমবিবর্তনের ধারাকে অনুসরণ করলে দেখা যায়, প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের সূত্রে ভারতবর্ষে কৃষির সূচনা হয়েছিল। এদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল কৃষিকভিত্তিক মৈথুনতত্ত্ব। এই তত্ত্ব পৌরাণিক কাহিনির ভিতর দিয়ে সনাতন হিন্দু ধর্মে স্থান পেয়েছিল। আদিবাসী এবং বঙ্গদেশের সনাতনবাদীদের ভিতরে এই ধারা এখনো প্রচলিত আছে। ভারতবর্ষের ধর্মীয় ধ্যানের অঙ্গ হিসেবে প্রাচীনতম পদ্ধতিটি হলো যোগশাস্ত্র।

সিন্ধু সভ্যতার নমুনাগুলো থেকে ধারণা করা যায় যে- যোগাসনের চর্চা ছিল ভারতবর্ষে আর্যদের আসার বহু আগে থেকে। হিসাবের নিরিখে তা প্রায় খ্রিষ্ট-পূর্ব ৫০০০ অব্দেরও আগে আরম্ভ হয়েছিল। এই সকল সভ্যতার ভারতীয় উত্তরপুরুষরাই পরবর্তী সময়ে এক একটি পৃথক শাস্ত্র রূপে পরিবেশন করেছেন মাত্র।  এই শাস্ত্র ভারতে আগত আর্য ভাষাভাষী গ্রহণ করেছিল ধ্যানের অঙ্গ হিসেবে। আর্যদের দ্বারা সৃষ্ট বৈদিকধর্মের বিকশিত হয়েছিল খ্রিষ্ট-পূর্ব ১২০০-৮০০ অব্দের ভিতরে। বৈদিক যুগের শেষের দিকে বা পৌরাণিক যুগের প্রারম্ভে কপিল মুনির সাংখ্যতত্ত্ব ভারতীয় দর্শনের একটি নতুন দিক উন্মোচিত হয়। পরবর্তী সময়ে পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক বিশ্বাসের সূত্রে তন্ত্র মতের সৃষ্টি হয়। মৈথুনতত্ত্ব, সাংখ্যতত্ত্ব, তন্ত্রমত এবং যোগশাস্ত্রের সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল গৌতমবুদ্ধের জন্মের আগে শৈব-শাক্ততন্ত্রের মতবাদ প্রচলিত ছিল।

সনাতন হিন্দু ধর্মই নবতর বা সংস্কারকৃত বৌদ্ধধর্মের আত্মপ্রকাশ করেছিল গৌতমবুদ্ধের মাধ্যমে। সনাতন ধর্মের মৈথুনতত্ত্ব, পুনর্জন্মবাদ, তান্ত্রিকেদের ষট্‌চক্র, সাংখ্য, যোগ এসব আত্মস্থ করে, নতুনভাবে বৌদ্ধধর্মকে সাজিয়েছিলেন গৌতমবুদ্ধ।

গৌতম বুদ্ধের নির্বাণলাভের (৫৬৩ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ) পর থেকে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধধর্মালম্বীরা কঠোরভাবে ধর্মচর্চা করতেন। এঁদের এই মৌলিক ধর্মীয় মতবাদকে বলা হয় থেরোবাদ। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর ভিতরে সংস্কৃত ভাষাভাষী-সহ অন্যান্য ভাষার মানুষ ত্রিপিটক পাঠ করার সুযোগ লাভ করে। এর ফলে বৌদ্ধ ধর্মের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এই সময়ে কিছু কিছু বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মনে করা শুরু করেন যে, থেরোবাদের কঠোর নিয়ম শিথিল করে বোধিসত্ত লাভের মধ্য দিয়ে নির্বাণলাভ সম্ভব। এই ভাবনা থেকে বৌদ্ধ ধর্মের যে নতুন ধারার সূচনা হয়, তাকেই বলা হয় মহাযান। এই মতে বোধিসত্তকে সাধনার আদর্শ এবং সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়ে থাকে। তাই মহাযানকে অনেক সময় বোধিসত্ত্বযানও বলা হয়। পরবর্তী সময়ে এই মতবাদ থেকেই উদ্ভব ঘটেছিল যোগতান্ত্রিক বৌদ্ধ মহাযান  মতাদর্শ। এই মতাদর্শ থেকে উৎপন্ন হয়ছিল বজ্রযান সম্প্রদায়।

বজ্রযান মতাদর্শে মূল লক্ষ্য 'বজ্র'। এর অর্থ হলো শূন্য বা নির্বাণ। তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের মন্ত্রযানের সঙ্গে মহাসুখবাদের সংযোগের ফলে এই মতবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। বঙ্গদেশের সমতট অঞ্চলে এই মতের প্রসার লাভ করেছিল। এই মতে পরমদেবতা হলেন আদিবুদ্ধ। এই পরমদেবতা হলেন আত্মা এবং পরমাত্মা। বজ্রযানের এই মত উপনিষদ থেকে গ্রহণ করা হয়েছিল। পরমব্রহ্মের মতো পরমদেবতা একই সাথে নির্গুণ এবং সগুণ। এই পরমদেবতার উদ্দেশ্যে একেকেন্দ্রিক ধ্যান হলো বোধিচিত্ত। কঠোর যোগাচারের দ্বারা ইন্দ্রিয়কে দমন করে চিত্তকে দৃঢ় করা হয়। এই অবস্থায় সাধক বোধিজ্ঞান লাভ করেন। বজ্রযান্রযানে বিশ্বাসীরা মনে করেন নির্বাণের পর শূন্য, বিজ্ঞান ও মহাসুখ লাভ হয়। তাই শূন্যতার পরম জ্ঞানই নির্বাণ। বজ্রযানে এই জ্ঞানকে বলা হয় নৈরাত্মা। এই নৈরাত্মার মধ্যে আত্মা লয়প্রাপ্ত হয়। বোধিচিত্ত যখন নৈরাত্মার আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে নৈরাত্মাতেই লীন হয়, তখন উৎপন্ন হয় মহাসুখ। এঁদের মতে চিত্তের পরমানন্দ ভাব সৃষ্টি হয় এককেন্দ্রিক ধ্যান থেকে। তাই এ জ্ঞান হলো বোধিচিত্ত। আর বোধিচিত্তই হলো বজ্র। কঠোর যোগের দ্বারা ইন্দ্রিয় দমিত হলে চিত্ত বজ্রের ন্যায় দৃঢ় হয়। এ অবস্থায় সাধক বোধিজ্ঞান লাভ করেন। আর এই বোধিজ্ঞানকে আশ্রয় করে নির্বাণ লাভের পথই হলো বজ্রযান।

বজ্রযান মতাদর্শীদের একাংশ ধরমাচরণে একটি ভিন্নতর পন্থা অনুসরণ করা শুরু করে। এই পথ অধিকতর সহজ বলে একে বলা হয়ে থাকে সহজিয়া মতাদর্শ। এই সাধন প্রক্রিয়ায় মূলে রয়েছে যাবতীয় প্রাণী ও জড় বস্তুর ভিতরে সমন্বয় এবং এর ভিতর দিয়ে জগৎকে গভীরভাবে উপলব্ধি করা। এই উপলব্ধির প্রণালীই হলো সহজপথ। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর দিকে বজ্রযানী বৌদ্ধ মতালম্বীদের ক্ষুদ্র একটি অংশ এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। কালক্রমে এই মতাদর্শ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তর ভারতের পূর্ব-মধ্যাঞ্চলে। এঁদের দ্বারাই ধীরে ধীরে বৌদ্ধ সহজিয়া মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এর ভলে বৌদ্ধ মতাদর্শ বজ্রযান এবং সহজযানে ভাগ হয়ে গিয়েছিল।

সেন আমলে ব্রাহ্মণ্য মতাদর্শ রাষ্ট্র ধর্মে পরিণত হলে, সহজিয়া বৌদ্ধরা আত্মরক্ষার জন্য হিন্দু দেবদেবী এবং আচার-অনুষ্ঠান গ্রহণ করে। বৌদ্ধদের এই নবতর ভাবনা থেকে উৎপন্ন হয়েছিল বৌদ্ধ নাথপন্থীদের। এইদের মতাদর্শকে  নাথধর্ম বা নাথপন্থ বলা হয়। খ্রিষ্টীয় ৮ম থেকে একাদশ শতাব্দীর ভিতরে মহাযান শাখার সাথে শৈবধর্ম যুক্ত হয়ে নাথধর্মের উদ্ভব হয়েছিল। আনুমানিক ১০৮৯ বা ১০৯০ খ্রিষ্টাব্দে গোপালভট্টের রচিত 'বল্লালচরিত্রম্'-এ নাথপন্থীদের উৎপত্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় যায়।

অন্যদিকে সহজিয়া বৌদ্ধদের মূলধারায় থাকা বৌদ্ধরা নিজেদের ধর্মচর্চা অব্যাহত রেখেছিল। চর্যাপদের পদকর্তারা ছিলেন এই সহজিয়া মতাদর্শের অনুসারী। তাই চর্যাপদের বিষয়াঙ্গকে বলা হয় বৌদ্ধ সহজিয়াদের মতাদর্শগত ভাব।

চর্যাগীতির বর্ণানুক্রমিক তালিকা

১. আই এ অণু অনা এ জগ রে [তথ্য] [পদ সংখ্যা ৪১] [তথ্য]
২. আধরাতি ভয় কমল বিকসিউ [তথ্য] [পদ সংখ্যা ২৭]
৩. আপণে নাহি মো কাহেরি সণ্‌কা [তথ্য] [পদ সংখ্যা ৩৭]
৪. আপণে রচি রচি ভব নির্ব্বাণা [তথ্য] [পদ সংখ্যা ২২]
৫. আলিএঁ কালিএঁ বাট রুন্ধেলা [তথ্য] [পদ সংখ্যা ৭]
৬. উষ্ণা উষ্ণা পাবত তহিঁ বসই সবরী বালী [তথ্য] [পদ সংখ্যা ২৮]
৭. এক সে শুন্ডিনী দুই ঘরে সান্ধই [তথ্য] [পদ সংখ্যা ৩]
৮. এতকাল হউঁ অচ্ছিলোঁ স্বমোহেঁ [তথ্য]  [পদ সংখ্যা ৩৫]
৯. এবংকার দিঢ় বাখোড় মোড়িউ [তথ্য][পদ সংখ্যা ৯]
১০. কমল কুলিশ মাঝেঁ ভইঅ মইলী [তথ্য][পদ সংখ্যা ৪৭]
১১. করুণা পীঢ়িহি খেলহুঁ নঅবলা [তথ্য] [পদ সংখ্যা ১২]
১২. করুণা মেহ নিরস্তর ফরিআ [তথ্য] [পদ সংখ্যা ৩০]
১৩. কাঅ ণাবড়ি খান্টি মণ কেড়ু আল [তথ্য] [পদ সংখ্যা ৩৮]
১৪. কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল [তথ্য] [পদ সংখ্যা ১]
১৫. কাহেরে ঘিনি মেলি আছহুঁ কীস [তথ্য] [পদ সংখ্যা ৬]
১৬. কুলিশ-ভর-নিদ বিআপিল [তথ্য] [পদ সংখ্যা ৪৮]
১৭. গঅণত গঅণত তইলা বাড়ী হিএঁ কুরাড়ী [তথ্য] [পদ সংখ্যা ৫০]
১৮. গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ [তথ্য] [পদ সংখ্যা ১৪]
১৯. চিঅ সহজ সুণ সংপুন্না  [তথ্য] [পদ সংখ্যা ৪২]
২০. জই তুম্‌হে ভুসূকু অহেরি [তথ্য] [পদ সংখ্যা ২৩]
২১. জইসে চান্দ উইআ হোই [তথ্য] [পদ সংখ্যা ২৪]
২২. জহি মণ ইন্দিঅ পবণ হোই ণঠা  [তথ্য] [পদ সংখ্যা ৩১]
২৩. জো মণ-গোঅর আলাজালা [তথ্য] [পদ সংখ্যা ৪০]
২৪. টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসী [তথ্য] [পদ সংখ্যা ৩৩]
২৫. তিয়ড়া চাপী জোইনি দে অঙ্কবালী [তথ্য] [পদ সংখ্যা ৪]
২৬. তিশরণ ণাবী কিঅ আঠক মারী [তথ্য] [পদ সংখ্যা ১৮]
২৭. তীণি ভূঅণ মই বাহিঅ হেলেঁ [তথ্য] [পদ সংখ্যা ১৩]
২৮. তীনিএঁ পাটেঁ লাগেলি রে অণহা কসণ ঘণ গাজই [তথ্য] [পদ সংখ্যা ১৬]
২৯. তূলা ধুণি ধুণি আঁসুরে আঁসূ [তথ্য] [পদ সংখ্যা ২৬]
৩০. দুলি দুহি পীঢ়া ধরণ ন জাই [তথ্য] [পদ সংখ্যা ২]
৩১. ধামহু পইঠা বাজঠাবি কহেই [তথ্য] [পদ সংখ্যা ২৫]
৩২. নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ [তথ্য] [পদ সংখ্যা ১০]
৩৩. নাড়ি শক্তি দিঢ় ধরিআ খাটে [তথ্য] [পদ সংখ্যা ১১]
৩৪. নাদন বিন্দুন রবি ন শশিমণ্ডল [তথ্য] [পদ সংখ্যা ৩২]
৩৫. নিসিত আন্ধারী মুসার চারা [তথ্য] [পদ সংখ্যা ২১]
৩৬. পেখু সুণেই আদসে জইসা [তথ্য] [পদ সংখ্যা ৪৬]
৩৭. বাজ ণাব পাড়ী পউআঁ খালেঁ বাহিউ  [তথ্য] [পদ সংখ্যা ৪৯]
৩৮. ভব নিব্বাণে পড়হ মাদলা [তথ্য] [পদ সংখ্যা ১৯]
৩৯. ভবণই গহণ গম্ভীর বেগেঁ বাহী [তথ্য] [পদ সংখ্যা ৫]
৪০. ভাব ন হোই অভাব ণ [তথ্য] [পদসংখ্যা ২৯]
৪১. মণ তরু পাঞ্চ ইন্দি তসু সাহা [তথ্য] [পদসংখ্যা ৪৫]
৪২. সঅ সম্বেঅণ সরুঅ বিআরেতে [তথ্য] [পদসংখ্যা ১৫]
৪৩. সহজ মহাতরু ফরিঅ এ [তথ্য]  [পদসংখ্যা ৪৩]
৪৪. সুনে সুন মিলিআ জবেঁ  [তথ্য] [পদসংখ্যা ৪৪]
৪৫. সূইণে হ অবিদার অরে [তথ্য] [পদসংখ্যা ৩৯]
৪৬. সূজ লাউ সসি লাগেলি তান্তী [তথ্য] [পদসংখ্যা ১৬]
৪৭. সূণ বাহ তথতা পহারী [তথ্য] [পদসংখ্যা ৩৬]
৪৮. সূনকরুণরে অভিন চারেঁ কাঅবাক্ চিএ [তথ্য] [পদসংখ্যা ৩৪]
৪৯. সোণে ভরিলী করুণা নাবী [তথ্য] [পদসংখ্যা ৮]
৫০. হউঁ নিরাসী খমণ ভতারী [তথ্য] [পদসংখ্যা ২০]

সূত্র :