সাংখ্যতত্ত্ব
বানান্ বিশ্লেষণ: স্+আ+ং+খ্+য্-ত্+অ+ত্+ত্+ব্+অ
উচ্চারণ:
ʃaŋ.kʰo-t̪ɔt̪.t̪o (শাঙ্.খো.তৎ. তো)
শব্দ-উৎস: সংস্কৃত সাংখ্যতত্ত্ব> বাংলা সাংখ্যতত্ত্ব
রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: সাংখ্যবিষয়ক+ তত্ত্ব/র্মধারয় সমাস
সমার্থক শব্দাবলি: সাংখ্য, সাংখ্যতত্ত্ব, সাংখ্যদর্শন, সাংখ্যসপ্ততি।
অর্থ: ভারতীয় ষড়দর্শনের অন্যতম প্রাচীন দর্শন। ঋষি কপিল এই দর্শন প্রণয়ন করেছিলেন। এই কারণে এই দর্শন কপিল-দর্শন নামেও পরিচিত।

ঋষি কপিল দুঃখে জর্জরিত মানুষের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে এই দর্শন দান করেছিলেন তাঁর শিষ্য আসুরিকে। আসুরির তাঁর শিষ্য পঞ্চশিখকে এই জ্ঞান দান করেন। এরপর পঞ্চশিখ তাঁর শিষ্যদের তা দান করেন। ক্রমে এই শিষ্যদের মাধ্যমে সাংখ্যদর্শন ছড়িয়ে পড়ে। এই দর্শন অনুসারে ঈশ্বরকৃষ্ণ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থের মোট শ্লোকের সংখ্যা ৭২। এর ভিতরে ৭০টি শ্লোকে তত্ত্বটিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ কারণে এই সাংখ্যকারিকা গ্রন্থটি ‘সাংখ্যসপ্ততি’ নামেও পরিচিত।

এখন পর্যন্ত এই গ্রন্থটিকেই সর্বপ্রাচীন প্রামাণিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ঈশ্বরকৃষ্ণ এই গ্রন্থের পরিচয় দিয়েছেন এই ভাবে-
এতৎ পবিত্রমগ্র্যাং মুনিরাসুরয়েহনুম্পয়া প্রদদৌ।
আসুরিরপি পঞ্চশিখায় তে চ বহুধা কৃতং তন্ত্রম্ ।।
(সাংখ্যকারিকা–৭০)
কপিল মুনি দয়াপরবশ হয়ে এই পবিত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট (জ্ঞান) আসুরিকে প্রদান করেন, আসুরিও পঞ্চশিখকে (এই জ্ঞান দান করেন) এবং তার (অর্থাৎ পঞ্চশিখ) দ্বারা সাংখ্যশাস্ত্র বহুভাবে শিষ্য মধ্যে প্রচার হয়েছিলো।

সাংখ্যদর্শনের রচনাকাল নিয়ে মতভেদ আছে। তবে এই দর্শনের উল্লেখ পাওয়া যায় শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ, মহাভারত ইত্যাদিতে। মহাভারতের শান্তিপর্বের ৩০২ অধ্যায়ে 'সাঙ্খ্যমতের সারসঙ্কলন' পাওয়া যায়।  মহাভারত রচনা কাল ধরা হয় প্রায় ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এই হিসেবে সাংখ্যদর্শন রচিত হতে পারে খ্রিষ্ট-পূর্ব ৫০০-৪০০ অব্দের ভিতরে। অনেকে মনে করেন, সাংখ্য–সম্প্রদায়ের প্রবর্তক কপিলের নাম থেকেই বুদ্ধের জন্মস্থান কপিলাবস্তুর নামকরণ হয়েছিলো। গৌতম বুদ্ধের জন্মকাল ধরা হয় ৫৬৭-৫৬৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। মৃত্যু ৪৮৭-৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এই বিচারে ধারণা করা যেতে পারে, এই দর্শনের রচনাকাল প্রায় ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে। তবে ঈশ্বরকৃষ্ণ  'সাংখ্যকারিকা' রচনা করেছিলেন আরও পরে। ধারণা করা হয়, ঈশ্বরকৃষ্ণ এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন খ্রিষ্টীয় তৃতীয় থেকে পঞ্চম শতাব্দির মধ্যবর্তী সময়ে।

সাংখ্যের নামকরণ
সাংখ্য মতাদর্শীদের মতে, তত্ত্বের সংখ্যা পঞ্চবিংশতি বা পঁচিশ।
এই পঁচিশটি তত্ত্বের যথার্থ জ্ঞানের মাধ্যমে জীবের মুক্তি বা মোক্ষলাভ হয়। সংখ্যাভিত্তিক এই দর্শন বলে এই দর্শনের নামকরণ করা হয়েছে সাংখ্যদর্শন। সাংখ্যদর্শনে প্রতিপাদ্য বিষয়কে ‘তত্ত্ব’ নামে অভিহিত করা হয়। এর মূলে রয়েছে নিত্য প্রকৃতি ও নিত্য পুরুষ নামক দুটি তত্ত্ব। এই প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগে সৃষ্টি হয় তেইশ প্রকার তত্ত্ব। এগুলো হলো-

এই মতাদর্শীদের কেউ কেউ মনে করেন- ‘সাংখ্য’ হলো এখানে সম্যক–জ্ঞান (সাং+খ্য = সম্যক+জ্ঞান) বা যথার্থ জ্ঞান। সাংখ্যমতে সমুদয় জ্ঞান দুই প্রকার। এর একটি তত্ত্বজ্ঞান, অপরটি ব্যবহারিক জ্ঞান। তত্ত্বজ্ঞানকে এই দর্শনে ‘বিবেকজ্ঞান’ বলা হয়। বিবেকজ্ঞানের মাধ্যমেই জীবের দুঃখনিবৃত্তি হয়। যেহেতু এ দর্শনে বিবেকজ্ঞানকেই মোক্ষের হেতু বলা হয়েছে, তাই এ দর্শনকে সাংখ্যদর্শন বলা হয়। এই মতে আত্মা বা পুরুষ নানা ধরনের মোহ দ্বারা আব্দ্ধ হয়ে পড়ে। এই মোহ থেকে মুক্তি হওয়াই মোক্ষ লাভ। এই দর্শনে কার্যত সকল জীবই আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক– দুঃখভোগ করে। মানুষ এই ত্রিবিধ দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায়ের সন্ধান করেছে যুগ যুগ ধরে। এর সব কিছু থেকে দিতে পারে তত্ত্বজ্ঞান বা বিবেকজ্ঞান। বিবেকজ্ঞানের দ্বারা পরমপুরুষার্থ কৈবল্য লাভ হয়, এই কারণে এই জ্ঞান ঐকান্তিক জ্ঞান। অন্যদিকে এই জ্ঞান সকল দুঃখের নিবর্তক। তাই একে বলা হয় আত্যন্তিক জ্ঞান। আবার যমনিয়মাদি সাধ্য বলে এই জ্ঞান শুদ্ধ এবং এর দ্বারা লব্ধ মুক্তি অবিনাশী। তাই এই জ্ঞানকে অক্ষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাংখ্য, বৌদ্ধ ও বেদান্ত দার্শনিকরা বিশ্বাস করেন যে, মোক্ষ প্রাপ্তির পর জীবের কোন দুঃখ থাকে না। কিন্তু সাংখ্য দার্শনিকরা এর বাইরে আরো মনে করেন যে, মোক্ষ বা মুক্তি কোনরূপ সুখ অনুভূতির অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে না। কারণ সুখ ও দুঃখ উভয়ই আপেক্ষিক শব্দ। যেখানে দুঃখ নেই সেখানে সুখ থাকতে পারে না। সাংখ্যমতে মোক্ষের দুটি দিক। একদিকে মোক্ষ বা মুক্তি বলতে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিকে বোঝায়। অন্যদিকে সাংখ্য দার্শনিকরা মোক্ষ বা মুক্তি সুখ–দুঃখের অতীত এক তৃতীয় অবস্থাকে মনে করেন।

সাংখ্যকারিকার তত্ত্বসমূহ

সাংখ্যমতের তত্ত্বজ্ঞান
সাংখ্যমতে তত্ত্বজ্ঞানকে বিবেক জ্ঞান বলা হয়। জ্ঞানের দ্বারাই জীব দুঃখ থেকে চিরনিবৃত্তি লাভ করতে পারে। ব্যক্ত জগৎ, অব্যক্ত প্রকৃতি এবং জ্ঞ বা পুরুষের স্বরূপ অনুধাবনের মাধ্যমেই দুঃখের হাত থেকে জীবের চিরনির্বত্তি লাভ হতে পারে। লৌকিক বা বৈদিক কোন প্রকার কর্মের দ্বারাই জীবের মুক্তিলাভ হতে পারে না। এ বিষয়ে ‘সাংখ্যকারিকা’র দ্বিতীয় শ্লোকে উল্লেখ আছে-

দৃষ্টবদানুশ্রবিকঃ স হ্যবিশুদ্ধিক্ষয়াতিশয়যুক্তঃ।
তদ্বিপরীতঃ শ্রেয়ান্ ব্যক্তাব্যক্তজ্ঞবিজ্ঞানাৎ।।’– (সাংখ্যকারিকা–২)

অর্থাৎ: বৈদিক যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপও লৌকিক উপায়ে মতো ত্রিবিধ দুঃখের ঐকান্তিক ও আত্যন্তিক নিবৃত্তি সাধনে অসমর্থ। সেই যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপ যেহেতু অবিশুদ্ধি, ক্ষয় ও অতিশয়যুক্ত, সেহেতু যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপের বিপরীত দুঃখ নিবৃত্তির সেই সাংখ্যশাস্ত্রীয় উপায় ব্যক্তাব্যক্তজ্ঞবিজ্ঞান–ই শ্রেয়। কারণ ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ–এর বিবেকজ্ঞান থেকে দুঃখের অবশ্যম্ভাবী ও চির নিবৃত্তি হয়।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে তত্ত্বের ২৫টি প্রতিপাদ্য আছে। এই কারণে তত্ত্বের সংখ্যাও ২৫টি ধরা হয়। এই তত্ত্বগুলোকে কার্যকারণের বিচারে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগগুলো হলো-

১. কেবল প্রকৃতি: একে বলা হয় মূল প্রকৃতি। মূল প্রকৃতি সত্ত্ব, রজঃ, ও তমঃ গুণের সাম্যাবস্থায় থেক। তাই এই প্রকৃতি ত্রিগুণাত্বক। সকল কার্যই প্রকৃতির ভিতর অব্যক্ত অবস্থায় থাকে। পরম প্রকৃতি উৎপত্তিহীন। এই প্রকৃতি এবং পুরুষের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় ২৩ প্রকার তত্ত্ব।

২. প্রকৃতি-বিকৃতি: মহৎ (বুদ্ধি), অহঙ্কার, অহংকার ও পঞ্চতন্মাত্র (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ) এর দ্বারা নিত্য-প্রকৃতির বিকৃতি ঘটে। সাংখ্যমতে প্রধান প্রকৃতি থেকে মহৎতত্ত্বের উৎপত্তি হয়, মহৎতত্ত্ব থেকে অহংকারের উৎপত্তি হয়, অহংকার থেকে একাদশ ইন্দ্রিয় (মন, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়) ও পঞ্চতন্মাত্রের উৎপত্তি হয় এবং পঞ্চতন্মাত্র থেকে পঞ্চমহাভূতের উৎপত্তি হয়।

৩. বিকার বা কেবল বিকৃতি : এই তত্ত্ব কোন তত্ত্বের কারণ নয়। কিন্তু অন্য কোন তত্ত্বের কার্যরূপে বিকৃতি ঘটায়। মোট ১৬টি তত্ত্বকে বিকার বিকৃতি বলা হয়। এগুলো হলো পঞ্চমহাভূত (ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ, ব্যোম্), পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক্), পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় (বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ) এবং মন।

৪. নিষ্ক্রিয় তত্ত্ব: যে তত্ত্ব প্রকৃতিও নয় এবং অন্য কোন তত্ত্বের কার্য বা বিকৃতিও নয়। এই বিচারে পুরুষ হলো নিষ্ক্রিয় তত্ত্ব। সাংখ্যমতে পুরুষ কারও কার্য বা কারণ হয় না। তাই একমাত্র পুরুষই নির্বিকার ও নিষ্ক্রিয় তত্ত্ব। মূলত চৈতন্য হলো পুরুষের স্বরূপধর্ম। পুরুষ হলো নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত স্বভাব। পুরুষের বন্ধনও নেই, মোক্ষও হয় না। পুরুষ চৈতন্যস্বরূপ বলে তার দেখার বা জানার শক্তি রয়েছে, কিন্তু তার ক্রিয়াশক্তি নেই।  প্রকৃতির রূপ দর্শনে পুরুষ সাক্ষী হলেও স্বভাবতই পুরুষ উদাসীন। চেতন পুরুষ কর্তা নয় এবং কর্তার বুদ্ধিও চেতন নয়।

সাংখ্যমতে পুরুষ সর্বব্যাপী ও সংখ্যায় বহু। অবিবেক-বশত পুরুষ বদ্ধাবস্থাপ্রাপ্ত হয়। বদ্ধ পুরুষকে তাই অবিবেকী বলা হয়। পুরুষের অবিবেক বিনাশ্য এবং তা বিনাশের মাধ্যমে পুরুষ মোক্ষ বা কৈবল্য লাভ করে।

পুরুষ ও প্রকৃতি আদি তত্ত্ব। উভয়ই অকারণ, অলিঙ্গ এবং নিত্য। পুরুষ প্রকৃতির পরিপূরক। প্রকৃতিতে যার অভাব দৃষ্ট্য হয়, তাই পুরুষে থাকে। সাংখ্যমতে চৈতন্যস্বরূপ পুরুষ যেমন সত্য, তেমনি জড় প্রকৃতিও সত্য। উভয়ই প্রপঞ্চময় জড়জগতের মূল ও আদি কারণ। এককভাবে কেউই জগতের কিছুই  সৃষ্টি করতে পারে না। পুরুষের সংস্পর্শে প্রকৃতির যে পরিণাম ঘটে, তাই জগৎ। আবার প্রলয়কালে এই জগৎ অব্যক্ত প্রকৃতিতেই লীন হয়ে যায়। সাংখ্য মতাদর্শে প্রকৃতি পুরুষকে মোহিত করে। প্রকৃতি হলো নারীর অনুরূপ। সে তার সকাম হাস্য, লাস্য, ভাব, অনুভাবের মধ্য দিয়ে পুরুষকে মোহিত করে যৌনাকাঙ্ক্ষায়। এর মধ্য দিয়ে সন্তান নামক ফলের লাভ করে। এই ফল সযত্নে লালন করে প্রকৃতি তথা নারী। সেখানে প্রকৃতি হয়ে উঠে মাতৃ স্বরূপা।

কার্য ও কারণ
কার্য ও কারণের মধ্য দিয়ে জগতের প্রকাশ। যা কিছু ঘটে বা যা কিছু উৎপন্ন হয় তার সবই কার্য বা কার্যের ফল। আর যা থেকে উৎপন্ন হয় তাই হলো কারণ। সাংখ্য মতে কারণের দুটি প্রকরণ রয়েছে, কারণ দুটি হলো উপাদান ও নিমিত্ত। উপাদান হলো- যা থেকে কোনো কার্য সৃষ্টি হয়। উপাদানকে কার্যের আশ্রয় বা অধিষ্ঠান বলা হয়। আর নিমিত্ত হলো- যে শক্তির দ্বারা কার্য সাধিত হয় এবং উপাদানকে আশ্রয় করে কার্য সম্পন্ন হয়। এই কার্য শক্তি বা নিমিত্তি কার্যের ফলফলের ভিতরে থাকে না। একটি মাটির কলসির মাটি হলো উপাদান, আর যে চক্রের সাহায্য কলসি তৈরি করা হয়েছে, তা হলো নিমিত্ত। আর মাটির কলসি হলো কার্য।

কার্যের উৎপত্তির পূর্বে কার্য-কারণ থাকে কিনা এ নিয়ে মতভেদ আছে। সৎকার্যবাদীরা বলেন কার্যকারণ ছাড়া কার্য হয় না এবং কার্যকারণ আগে থেকেই থাকে। শুরুতে কার্য অব্যাক্তাবস্থায় থাকে। অন্য দিকে অসৎকার্যবাদীরা মনে করেন, কার্যের কার্যকারণ থাকে না।  তাঁরা মনে করেন কার্য উৎপন্ন হওয়ার আগে  কার্যের কোন অস্তিত্বই থাকে না, কার্য সম্পূর্ণভাবে নতুন সৃষ্টি বা আরম্ভ। সাংখ্যমতে কোনো কার্য উৎপন্নের আগের কার্য, কোনো না কোনো উপাদানকে আশ্রয় করে গড়ে উঠে। তাই আগের উপাদান সত্য, উৎপন্নের পরের উপাদানও সত্য। সাংখ্য মতে 'সতঃ সজ্জায়ত’। অর্থাৎ, সৎ বস্তু থেকে সৎ বস্তু উৎপন্ন হয়। সাংখ্যকারিকার নবম কারিকায় পাঁচটি যুক্তি এই বিষয়টিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। 

অসৎ অকরণাৎ উপাদানগ্রহণাৎ সর্বসম্ভবাভাবাৎ।
শক্তস্য শক্যকরণাৎ কারণভাবাৎ চ সৎ কার্যম্’ ।। (সাংখ্যকারিকা–৯)

অর্থাৎ: যা নেই তাকে উৎপন্ন করা যায় না, কার্য উৎপাদনে সমর্থ বস্তু থেকেই উৎপাদনযোগ্য বস্তু উৎপন্ন হতে পারে, যে কোন কিছু থেকে যে কোন কিছু উৎপন্ন হয় না, একটি বস্তু যে কার্য উৎপাদনে সমর্থ সেই বস্তুটি কেবলমাত্র সেই কার্যই উৎপাদন করে এবং কার্য স্বরূপত কারণ থেকে অভিন্ন বলে একটি কার্য উৎপত্তির পূর্বে তার উপাদান কারণে অস্তিত্বশীল থাকে।

গুণ: সাংখ্য দর্শনে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই গুণত্রয়ের সাম্যাবস্থাকে প্রকৃতি বলা হয়েছে। এখানে গুণ হলো- জাগতিক যাবতীয় দ্রব্যের উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই গুণ দোষের বিপরীত শব্দ নয়। গুণ অপরের অর্থ বা প্রয়োজন সাধন করে।  এই গুণগুলি সুখ, দুঃখ ও মোহ রূপে পাওয়া যায়। এরা পরস্পর বিরুদ্ধ স্বভাব হলেও কার্যক্ষেত্রে পরস্পর পরস্পরের সহায়ক হয়।

গুণত্রয় পরিচয়
সত্ত্বগুণ:
  সুখাত্মক,
লঘু, স্বচ্ছ ও প্রকাশক। এই গুণ ক্রিয়াহীন। সত্ত্বগুণকে শ্বেতবর্ণের সাথে তুলনা করা হয়।

রজঃগুণ:  এই দুঃখাত্মক, উত্তেজক এবং ক্রিয়াশীল। জাগতিক সকল বস্তুর গতি, ক্রিয়া ও চঞ্চলতার জন্য রজোগুণই কারণ। রজগুণকে রক্রবর্ণের সাথে তুলনা করা হয়। এই গুণের প্রকাশ ঘটে প্রবৃত্তির ভিতর দিয়ে। তাই রজোগুণকে অন্য গুণের চালক বলা হয়। চলতে গিয়ে তমোগুণ দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে রজোগুণ সকল বিষয়ে সমানভাবে কার্যকর হয় না।

তমঃগুণ:  বিষাদাত্মক, গুরু এবং আবরক। এই গুণ সত্ত্বগুণের প্রকাশ এবং রজোগুণের প্রবৃত্তির নিবারণ করে। এই গুণ ক্রিয়াহীন। তমোগুণকে কালো বর্ণের সাথে তুলনা করা হয়।

সাংখ্য দর্শনে ঈশ্বরভাবনা
প্রাচীন আধ্যাত্মবাদী বা ব্রহ্মবাদী দার্শনিকদের কাছে সাংখ্য নিরীশ্বরবাদী বেদবিরোধী দর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। প্রাচীন সাংখ্য দার্শনিকদের মতে ঈশ্বর বলে কেউ নেই। প্রকৃতিই জগতের মূল কারণ। এই মতবাদ স্থাপনের জন্য তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষে কতকগুলি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। সাংখ্যমতে পরিণামী প্রকৃতিই জগতের মূল কারণঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করার পক্ষে কোন যুক্তি নেই। যে কোনো কার্য সম্পাদনের পিছনে একটি উদ্দেশ্য থাকে। ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা হলে জগৎ সৃষ্টির দ্বারা ঈশ্বরের কোন্ উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে, এ কথা স্বীকার করতে হয়। এক্ষেত্রে জগৎ সৃষ্টির দ্বারা ঈশ্বরের কোন উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে, তা জানা যায় না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করলে তাঁকে পুরুষ রূপেই স্বীকার করতে হয়। কিন্তু ঈশ্বর মুক্ত বা বদ্ধ কোন পুরুষ রূপেই স্বীকৃত হতে পারেন না। তিনি যদি বদ্ধ পুরুষ হন, তাহলে তিনিও দুঃখ–ত্রয়ের অধীন হবেন। কিন্তু ঈশ্বর কখনো দুঃখের অধীন হতে পারেন না। আবার ঈশ্বর যদি মুক্ত হন তাহলে তাঁকে নিত্য–মুক্তই বলতে হয়। তিনি যদি নিত্য–মুক্তই হন, তাহলে জগতের সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না।