সাংখ্যতত্ত্ব
[সাংখ্যতত্ত্ব (অভিধান)]

ভারতীয় ষড়দর্শনের অন্যতম প্রাচীন দর্শন। ঋষি কপিল এই দর্শন প্রণয়ন করেছিলেন। এই কারণে এই দর্শন কপিল-দর্শন নামেও পরিচিত।
ঋষি কপিল দুঃখে জর্জরিত মানুষের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে এই দর্শন দান করেছিলেন তাঁর শিষ্য আসুরিকে। আসুরির তাঁর শিষ্য পঞ্চশিখকে এই জ্ঞান দান করেন। এরপর পঞ্চশিখ তাঁর শিষ্যদের তা দান করেন। ক্রমে এই শিষ্যদের মাধ্যমে সাংখ্যদর্শন ছড়িয়ে পড়ে। এই দর্শন অনুসারে ঈশ্বরকৃষ্ণ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থের মোট শ্লোকের সংখ্যা ৭২। এর ভিতরে ৭০টি শ্লোকে তত্ত্বটিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ কারণে এই সাংখ্যকারিকা গ্রন্থটি ‘সাংখ্যসপ্ততি’ নামেও পরিচিত।

এখন পর্যন্ত এই গ্রন্থটিকেই সর্বপ্রাচীন প্রামাণিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ঈশ্বরকৃষ্ণ এই গ্রন্থের পরিচয় দিয়েছেন এই ভাবে-
এতৎ পবিত্রমগ্র্যাং মুনিরাসুরয়েহনুম্পয়া প্রদদৌ।
আসুরিরপি পঞ্চশিখায় তে চ বহুধা কৃতং তন্ত্রম্ ।।
(সাংখ্যকারিকা–৭০)
কপিল মুনি দয়াপরবশ হয়ে এই পবিত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট (জ্ঞান) আসুরিকে প্রদান করেন, আসুরিও পঞ্চশিখকে (এই জ্ঞান দান করেন) এবং তার (অর্থাৎ পঞ্চশিখ) দ্বারা সাংখ্যশাস্ত্র বহুভাবে শিষ্য মধ্যে প্রচার হয়েছিলো।

সাংখ্যদর্শনের রচনাকাল নিয়ে মতভেদ আছে। তবে এই দর্শনের উল্লেখ পাওয়া যায় শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ, মহাভারত ইত্যাদিতে। মহাভারত শান্তিপর্বের ৩০২ অধ্যায়ে 'সাঙ্খ্যমতের সারসঙ্কলন' পাওয়া যায়। মহাভারতের রচনা কাল ধরা হয় প্রায় ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এই হিসেবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যায় সাংখ্যদর্শন রচিত হতে পারে খ্রিষ্ট-পূর্ব ৫০০-৪০০ অব্দের ভিতরে। অনেকে মনে করেন, সাংখ্য–সম্প্রদায়ের প্রবর্তক কপিলের নাম থেকেই বুদ্ধের জন্মস্থান কপিলাবস্তুর নামকরণ হয়েছিলো। গৌতম বুদ্ধের জন্মকাল ধরা হয় ৫৬৭-৫৬৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। মৃত্যু ৪৮৭-৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এই বিচারে ধারণা করা যেতে পারে, এই দর্শনের রচনাকাল প্রায় ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে। তবে ঈশ্বরকৃষ্ণ 'সাংখ্যকারিকা' রচনা করেছিলেন আরও পরে, হয়তো খ্রিষ্টীয় তৃতীয় থেকে পঞ্চম শতাব্দির মধ্যবর্তী সময়ে।

প্রাচীন নানা গ্রন্থে সাংখ্যদর্শনের বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও আদি সাংখ্যদর্শনের নমুনা পাওয়া যায় নি। বর্তমানে সর্বপ্রাচীন সংখ্যা নমুনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়-ঈশ্বরকৃষ্ণ 'সাংখ্যকারিকা'

সাংখ্যের নামকরণ
সাংখ্য মতাদর্শীদের মতে, তত্ত্বের সংখ্যা পঞ্চবিংশতি বা পঁচিশ। এই পঁচিশটি তত্ত্বের যথার্থ জ্ঞানের মাধ্যমে জীবের মুক্তি বা মোক্ষলাভ হয়। সংখ্যাভিত্তিক এই দর্শন বলে এই দর্শনের নামকরণ করা হয়েছে সাংখ্যদর্শন। সাংখ্যদর্শনে প্রতিপাদ্য বিষয়কে ‘তত্ত্ব’ নামে অভিহিত করা হয়। এর মূলে রয়েছে নিত্য প্রকৃতি ও নিত্য পুরুষ নামক দুটি তত্ত্ব। পুরুষতত্ত্ব নির্গুণ, চেতন, বহু ও বিভু। অর্থে পুরুষ সর্বব্যাপী বিদ্যামান। প্রকৃতি অচেতন এবং পরিণাম-স্বভাবধর্মী। পুরুষ ও প্রকৃতির সম্মেলনে সৃষ্টি হয়। 'সত্ত্ব, রজঃ ও তম' এই তিনটি গুণের অধিকারিণী হলো প্রকৃতি। সত্ত্বের ধর্‌ম জ্ঞান ও সুখাদি, আর রজের ধর্ম দুঃখ ও প্রবৃত্তি। এবং তমের ধর্ম হলো মোহ ও আবরণ।

এই প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগে সৃষ্টি হয় তেইশ প্রকার তত্ত্ব। এগুলো হলো-

  • মহৎ বা বুদ্ধি
  • অহঙ্কার
  • মন
  • পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক)
  • পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় (বাক্, হাত, পা, পায়ু. উপস্থ)
  • পঞ্চসূক্ষ্মভূত (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ)
  • পঞ্চমহাভূত (ক্ষিতি, অপ, অগ্নি, মরুৎ ও আকাশ)
এই মতাদর্শীদের কেউ কেউ মনে করেন- ‘সাংখ্য’ হলো এখানে সম্যক–জ্ঞান (সাং+খ্য = সম্যক+জ্ঞান) বা যথার্থ জ্ঞান। সাংখ্যমতে সমুদয় জ্ঞান দুই প্রকার। এর একটি তত্ত্বজ্ঞান, অপরটি ব্যবহারিক জ্ঞান। তত্ত্বজ্ঞানকে এই দর্শনে ‘বিবেকজ্ঞান’ বলা হয়। বিবেকজ্ঞানের মাধ্যমেই জীবের দুঃখনিবৃত্তি হয়। যেহেতু এ দর্শনে বিবেকজ্ঞানকেই মোক্ষের হেতু বলা হয়েছে, তাই এ দর্শনকে সাংখ্যদর্শন বলা হয়। এই মতে আত্মা বা পুরুষ নানা ধরনের মোহ দ্বারা আব্দ্ধ হয়ে পড়ে। এই মোহ থেকে মুক্তি হওয়াই মোক্ষ লাভ। এই দর্শনে কার্যত সকল জীবই আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক– দুঃখভোগ করে। মানুষ এই ত্রিবিধ দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায়ের সন্ধান করেছে যুগ যুগ ধরে। এর সব কিছু থেকে দিতে পারে তত্ত্বজ্ঞান বা বিবেকজ্ঞান। বিবেকজ্ঞানের দ্বারা পরমপুরুষার্থ কৈবল্য লাভ হয়, এই কারণে এই জ্ঞান ঐকান্তিক জ্ঞান। অন্যদিকে এই জ্ঞান সকল দুঃখের নিবর্তক। তাই একে বলা হয় আত্যন্তিক জ্ঞান। আবার যমনিয়মাদি সাধ্য বলে এই জ্ঞান শুদ্ধ এবং এর দ্বারা লব্ধ মুক্তি অবিনাশী। তাই এই জ্ঞানকে অক্ষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাংখ্য, বৌদ্ধ ও বেদান্ত দার্শনিকরা বিশ্বাস করেন যে, মোক্ষ প্রাপ্তির পর জীবের কোন দুঃখ থাকে না। কিন্তু সাংখ্য দার্শনিকরা এর বাইরে আরো মনে করেন যে, মোক্ষ বা মুক্তি কোনরূপ সুখ অনুভূতির অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে না। কারণ সুখ ও দুঃখ উভয়ই আপেক্ষিক শব্দ। যেখানে দুঃখ নেই সেখানে সুখ থাকতে পারে না। সাংখ্যমতে মোক্ষের দুটি দিক। একদিকে মোক্ষ বা মুক্তি বলতে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিকে বোঝায়। অন্যদিকে সাংখ্য দার্শনিকরা মোক্ষ বা মুক্তি সুখ–দুঃখের অতীত এক তৃতীয় অবস্থাকে মনে করেন।

সাংখ্যকারিকার তত্ত্বসমূহের সূচি

সংখ্যাকারিক ১
সংখ্যাকারিক ২

সংখ্যাকারিক ৩
সংখ্যাকারিক ৪
সংখ্যাকারিক ৫
সংখ্যাকারিক ৬
সংখ্যাকারিক ৭
সংখ্যাকারিক ৯
সংখ্যাকারিক ১০
সংখ্যাকারিক ১১
সংখ্যাকারিক ১২
সংখ্যাকারিক ১৩
সংখ্যাকারিক ১৫
সংখ্যাকারিক ১৬
সংখ্যাকারিক ১৭
সংখ্যাকারিক ১৮
 
সংখ্যাকারিক ১৯
সংখ্যাকারিক ২০
সংখ্যাকারিক ২১
সংখ্যাকারিক ২২
সংখ্যাকারিক ২৩
সংখ্যাকারিক ২৪
সংখ্যাকারিক ২৫
সংখ্যাকারিক ২৬
সংখ্যাকারিক ২৭
সংখ্যাকারিক ২৮
সংখ্যাকারিক ৩৭
সংখ্যাকারিক ৩৮
সংখ্যাকারিক ৩৯
সংখ্যাকারিক ৫৬
সংখ্যাকারিক ৫৮
সংখ্যাকারিক ৫৯
সংখ্যাকারিক ৬৫
সংখ্যাকারিক ৭০
সংখ্যাকারিক ৭২

সূত্র: