শিখসঙ্গীত
গুরুনানকের  প্রবর্তিত শিখধর্মের সাথে সম্পর্কিত সঙ্গীত। এই ধর্ম প্রচারের শুরু থেকেই সঙ্গীত বিশেষ স্থান করে নিয়েছিল। ধর্ম সাধনার জন্য
তিনি স্ত্রীপুত্র ত্যাগ করে সত্যের সন্ধানে নানা জায়গায় ভ্রমণ করতে থাকেন। এক সময় তিনি ঈশ্বরের স্বরূপ অনুধাবন করতে সক্ষম হন এবং তাঁর বাণী প্রচার করা শুরু করেন। তিনি প্রচার করেন- "ঈশ্বর কেবল একজনই, তিনিই সত্য, তিনিই স্রষ্টা, তাঁর ভয় নেই, তাঁর ঘৃণা নেই, তিনি কখনও বিলীন হন না, তিনি জন্ম-মৃত্যু চক্রের উর্দ্ধে, তিনি অজ-অমর স্বয়ংপ্রকাশ। সাধনার দ্বারা প্রকৃত গুরুর মাধ্যমেই তাঁকে অনুধাবন করা যায়। তিনি আদিতে সত্য ছিলেন, তিনি কালের সূচনায় সত্য ছিলেন, চিরকালব্যাপী সত্য আছেন এবং তিনি এখনও সত্য।"

এরপর থেকে নানা দেশে ঘুরে ঘুরে ধর্ম প্রচার করা শুরু করেন। নানক তাঁর বাণী প্রচারের জন্য, 'রাবাব' (এক প্রকার বাদ্যযন্ত্র বিশেষ) বাদক মুসলমান বন্ধু মারদানাকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করেছেন। তিনি ভাই মারদানা পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

গুরুনানকের সময় (১৪৬৯-১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দ) ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল- ধ্রুপদ। ফলে এই ধারার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল আদি শিখ সঙ্গীতে। পরে শিখ সঙ্গীতের সুরাঙ্গে প্রভাব পড়েছিল
খেয়াল, টপ্পা এবং কাওয়ালি।

শিখসঙ্গীতের সাথে আদি সম্পর্ক ছিল রবাবের। এরপর ইরানী তারযন্ত্র তাউসকে ময়ুরের আকরের নব্যরূপ দিয়েছিলেন গুরু হরগোবিন্দ সিং। কথিত আছে দিলরুবা নামক তারযন্ত্রটি উদ্ভাবন করেছিলেন। গোড়ার দিকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্যগত আদর্শকে অক্ষুণ্ণ রেখে শিখ সঙ্গীতের বিকাশ হলেও ধীরে ধীরে এই রীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, ভজন ইত্যাদি সুরাঙ্গের সাথে যুক্ত হয়েছিল লোক-সুরাঙ্গ। সাধারণ মানুষকে সুরের মাধ্যমে কাছে টানার জন্য, শিখ সঙ্গীতে হাল্কা মেজাজের গান, চলমান চটুল চলচ্চিত্রের সুরও যুক্ত হয়েছে। এই সূত্রে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উপযোগী রবাব, তাউস, দিলরুবারর মতো যন্ত্র বাদ দিয়ে যন্ত্রানুসঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে- হারমোনিয়াম, গিটার, বেহালা, ম্যান্ডেলিন, কীবোর্ড ইত্যাদি।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত বিভাজনের কারণে অধিকাংশ মুসলমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব অংশে চলে যায়। এই রবাববাদক মুসলমান শিল্পীরা চলে গেলে, শিখসঙ্গীতের যন্ত্রানুসঙ্গে রবাবের ব্যবহার শিথিল হয়ে পড়ে। এর পরিবর্তে শিখসঙ্গীতে ব্যাপকভাবে সরোদ এবং অন্যান্য তারযন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়।


গুরুর স্তবগানকে শিখরা 'গুরবাণী' (গুরুর বাণী) নামে আখ্যায়িত করেন। আর গুরুবাণী গাওয়াকে বলা হয় শবদ কীর্তন। গুরু গ্রন্থসাহিবের সমগ্র অংশই কাব্যের আকারে রচিত। শাস্ত্রীয় সংগীতের নির্দিষ্ট ৩১টি গুরু গ্রন্থসাহিব গাওয়ার নিয়ম। তবে উক্ত গ্রন্থে উল্লিখিত সব কটি রাগের সঙ্গে পরিচিত এমন সংগীতজ্ঞ শিখদের মধ্যে কমই দেখা যায়। শবদ কীর্তন প্রথা চালু করেছিলেন গুরু নানক। ধ্যানের সময় কীর্তন শোনা এবং ভক্তিপূর্ণ চিত্তে সর্বোচ্চ সময়াতীত ঈশ্বরের মাহাত্ম্য কীর্তন করাকে তিনি ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সবচেয়ে কার্যকর উপায় মনে করতেন। শিখদের তিনটি প্রভাতী প্রার্থনা হল জপজি সাহিব, জাপ সাহিব ও তব-প্রসাদ সাভাইয়ে। দীক্ষিত শিখেরা খুব ভোরে উঠে ধ্যান করেন এবং তারপর প্রাতঃরাশের পূর্বে নিতনেমের পঞ্চ বাণীর সবগুলি আবৃত্তি করেন।