সোবা সিং অঙ্কিত গুরু নানকের ছবি

গুরু নানক
১৪৬৯-১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দ
শিখ ধর্মের প্রবর্তক।

বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের অন্তর্গত লাহোরের নিকটে অবস্থিত 'রায় ভর দি তালবন্দী' গ্রামে, ১৪৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল বেদী ক্ষত্রী গোত্রের এক হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।  তাঁর নামানুসারে তাঁর জন্মস্থানের নাম নানকানা সাহেব নামকরণ করা হয়েছে। তার জন্মস্থানে বর্তমানে শিখদের একটি বৃহৎ উপাসনালয় রয়েছে। উপাসনালয়টির নাম 'গুরুদুয়ারা জনম আস্থান'।

তাঁর বাবা মেহতা কল্যাণ দাস বেদী (মেহতা কালু নামে পরিচিত),  গ্রামের মুসলিম জমিদার রায় বুল্লারেরস ভূমি রাজস্ব বিভাগে কাজ করতেন। নানকের মায়ের নাম তৃপ্তা দেবী এবং তার এক বড় বোন ছিল যার নাম নানাকি।

তিনি অল্প কিছু লেখাপড়া শিখে প্রথমে স্থানীয় জমিদারীতে কেরানির কাজ শুরু করেন। এরপর তিনি সুলক্ষ্মণী নামক এক স্থানীয় নারীকে বিয়ে করেন। তাঁর দুই পুত্রের নাম  শ্রীচান্দ ও লক্ষ্মীচান্দ। এরপর তিনি স্ত্রীপুত্র ত্যাগ করে সত্যের সন্ধানে নানা জায়গায় ভ্রমণ করতে থাকেন। এক সময় তিনি ঈশ্বরের স্বরূপ অনুধাবন করতে সক্ষম হন এবং তাঁর বাণী প্রচার করা শুরু করেন। তিনি প্রচার করেন- "ঈশ্বর কেবল একজনই, তিনিই সত্য, তিনিই স্রষ্টা, তাঁর ভয় নেই, তাঁর ঘৃণা নেই, তিনি কখনও বিলীন হন না, তিনি জন্ম-মৃত্যু চক্রের উর্দ্ধে, তিনি অজ-অমর স্বয়ংপ্রকাশ। সাধনার দ্বারা প্রকৃত গুরুর মাধ্যমেই তাঁকে অনুধাবন করা যায়। তিনি আদিতে সত্য ছিলেন, তিনি কালের সূচনায় সত্য ছিলেন, চিরকালব্যাপী সত্য আছেন এবং তিনি এখনও সত্য।"

এরপর থেকে নানা দেশে ঘুরে ঘুরে ধর্ম প্রচার করা শুরু করেন। নানক তাঁর বাণী প্রচারের জন্য, 'রাবাব' (এক প্রকার বাদ্যযন্ত্র বিশেষ) বাদক মুসলমান বন্ধু মারদানাকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করেছেন। তিনি ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চল ভ্রমণ করেন। ভারতের বাইরে আরবের মক্কা, মদিনা, বাগদাদ, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি স্থানে স্থানীয় ভাষায় রাবাব বাদনের ছন্দে তাঁর বাণী প্রচার করেছেন। এই পরিভ্রমণকালে তাঁর ধর্মমত প্রচারের জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রচারকেন্দ্রও (মানজিস) স্থাপন করেন।

১৪৯৯ খ্রিষ্টাব্দে গুরু নানক নিজ ধর্মমত প্রচারের জন্য মিথিলা থেকে দিনাজপুরে আসেন এবং সেখানে কান্তজীর মন্দির পরিদর্শন করেন। এরপর তিনি কামরূপ ঘুরে সিলেটে যান। এখানে কিছুদিন কাটিয় নৌপথে ঢাকা আসেন। তিনি উত্তর ঢাকার শিবপুরে (বর্তমান রায়ের বাজার, ধানমণ্ডি এলাকার কোনো এক স্থানে) নৌকা থেকে অবতরণ করেন। শিবপুরের মানুষের পানীয় জলের অভাব দূর করার জন্য সে সময়ের শিবপুর গ্রামের জাফরাবাদ এলাকায় একটি কূপ খনন করিয়েছিলেন। পরে সেখানে বিদেশি অতিথিদের স্নানের সুবিধার্থে এক স্থানীয় শাসক পুকুর খনন করিয়েছিলেন। ১৯৫৯ অবধি সে কূপটি স্থানীয় শিখরা দেখভাল করতেন। পরে আবাসন প্রকল্পের জন্য সরকার জমি বণ্টন করে দিলে পুকুরটি ভরাট করা হয়। কথিত আছে নানকের এই কুয়াটি বর্তমানে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ২৬ নং সড়কের ২৭৮ বাড়িতে অবস্থিত। তিনি ঢাকার নীলক্ষেত (তৎকালীন সুজাতপুর মৌজার অন্তর্গত ছিল) অঞ্চলে একটি মাঞ্জি প্রতিষ্ঠা করে ধর্মীয় উপদেশ দেন। উল্লেখ্য, পাঞ্জাবি শব্দ মাঞ্জি-র অর্থ হলো— আধ্যাত্মিক আলোচনার কেন্দ্র। পরে এটাই গুরুদুয়ারা নানক শাহী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

পরে তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যান। গুরু নানক তাঁর সময়ে লঙ্গরের প্রচলন করেছিলেন। সেখানে সব ধর্মের, সব গোত্রের, সব লিঙ্গের, সমাজের সর্ব স্তরের মানুষেরা পাশাপাশি বসে আহার করেন। দ্বিতীয় শিখগুরু অঙ্গদ দেবের সময় থেকে লঙ্গরে মাংসের ব্যবহার বাতিল করা হয়। তখন থেকে লঙ্গরে নিরামিষ আহার বিতরণ শুরু হয়। ঐতিহাসিকদের মতে বৈষ্ণবদেরকে সম্পৃক্ত করার জন্যই এই ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। বর্তমানে প্রতিটি গুরদুয়ারায়ই লঙ্গরের ব্যবস্থা আছে।।

১৫০২ খ্রিষ্টাব্দে লাহোর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে জি টি রোডের ধারে এক প্রকাণ্ড জলাশয়ের ধারে, গুরুনানক একটি মন্দির গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। এই সময় তিনি এই জলাশয়ের নাম রাখেন অমৃত সায়র। তার থেকেই শহরের নাম হয় অমৃতসর। গুরু নানক জীবদ্দশায় তাঁর এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় নি। ১৫৮৮ খ্রিষ্টাব্দে শিখ গুরু অর্জুন সিং অমৃত সায়র-এর ধারে স্বর্ণ মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ধারণা করা হয়, অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দির বা হরিমন্দিরে প্রতিদিন ১ লক্ষ লোককে খাবার দেওয়া হয়। বিভিন্ন মানুষের দানেই এই লঙ্গর চলে। এই লঙ্গরকে বলে, 'গুরু কা লঙ্গর'। আর যাঁদের স্বেচ্ছাশ্রমে এই লঙ্গরগুলো চলে, তাঁদেরকে বলা হয় 'সেবাদার'।

মোঘল সম্রাট বাবরের রাজত্বকালে গুরু নানক ও তাঁর মুসলমান বন্ধু মারদানাকে কারাগারে অন্তরীণ করা হয়। কারা কর্মকর্তার মাধ্যমে গুরু নানক সম্পর্কে জানার পর, সম্রাট বাবর নানককে ডেকে পাঠান এবং তাঁর বাণী শুনে তাঁকে একজন বিশেষ ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি মনে করে তাঁকে মুক্ত করে দেন।

১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মে, বর্তমান ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের করতারপুর নামক স্থানে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। কথিত আছে, একদিন নানক তাঁর মুসলমান বন্ধু মারকানার সাথে বাইন নদীতে স্নান করতে গিয়ে ডুব দিয়ে হারিয়ে যান। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাঁর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নাই। এর তিনদিন পর নানক সবার সামনে উপস্থিত হয়ে বলেন, 'আমি ঈশ্বরের দেখা পেয়েছি, তিনি আমাকে তাঁর প্রেরিত গুরু হিসাবে উল্লেখ করেছেন'।
 


সূত্র :