ধ্রুপদ
ভারতীয় রাগসঙ্গীতের প্রাচীনতম একটি
ধারা। ধ্রুপদ অর্থ হলো ধ্রুব (নিশ্চল ও চিরস্থায়ী) পদ। সে অর্থে একমাত্র
ঈশ্বরই ধ্রূব, তাই তাঁর কীর্তনসূচক পদকে বলা হয় ধ্রূবপদ। প্রাচীন
গান্ধর্ব গান
ক্রমবিবর্তনের ধারায় আধুনিক ধ্রুপদের উৎপত্তি হয়েছে।
[দ্রষ্টব্য: ধ্রুপদের
ইতিহাস]
বর্তমানে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রধান দুটি ধারার একটি হলো ধ্রুপদ। উল্লেখ্য অপর ধারটির নাম
খেয়াল।
ধ্রুপদের বৈশিষ্ট্য
- ধ্রুপদ কোন একটি রাগে নিবদ্ধ।
- ধ্রপদের বিষায়াঙ্গ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভক্তি পর্যায়ের হয়ে থাকে। তবে এর বাইরে প্রাকৃতি রূপ বর্ণনা এতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে বর্ষার প্রাকৃতি রূপ বর্ণা বর্ণনা এই গানে পাওয়া যাব। চটুল ভাব বা ভাষা ধ্রুপদের জন্য অনুপযোগী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
- ধ্রুপদের প্রকৃতি
গম্ভীর। এই কারণে গম্ভীর প্রকৃতির রাগে ধ্রুপদ পরিবেশিত হয়ে থাকে।
সাধারণত ক্ষুদ্র পরিসরে ধ্রুপদ গান বাঁধা হয় না।
- ধ্রুবাগান
থেকে ; ধ্রুপদের উৎপত্তির সময় এর তুক দুটি বা তিনটি ছিল। বর্তমানে ধ্রুপদ চার তুকে হয়ে থাকে। এই চারটি তুক হলো- স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগ।
উৎপত্তির সময় এর তুক দুটি বা তিনটি ছিল। বর্তমানে ধ্রুপদ চার তুকে হয়ে থাকে। এই চারটি তুক হলো- স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগ।
- যে রাগে
ধ্রুপদের বাণীকে সুর দ্বারা বাঁধা হয়, সে রাগটিকে বিশুদ্ধরূপেই উপস্থাপন করা
হয়। শুরুতেই ওই রাগের উপর দীর্ঘ আলাপ করা হয়। সাধারণাত নোম, তোম্, তুম, ওম
ইত্যাদি ধ্বনিযুক্ত করে ধ্রুপদের আলাপ শুরু হয়। তালসহযোগে বাণী অংশে আসার পর,
আর বিস্তার করা হয় না। তালে তালযুক্ত বাণী
সঙ্গীত পরিবেশেনের সময় ধ্রুপদের স্থায়ী উপস্থাপন করা হয়। এরপর অন্তরা পরিবেশন
করে আবার স্থায়ীতে ফিরে আসতে হয়। এরপর সঞ্চারী ও আভোগ গেয়ে স্থায়ীতে ফিরতে হয়।
-
ধ্রুপদের একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে এর তালের লয়ের পরিবর্তন। প্রাথমিকভাবে
যে লয় দিয়ে ধ্রুপদ শুরু হয়, একটি নির্দিষ্ট বিধি অনুসরণে তালের লয়কে দুইগুণ,
আড়াইগুণ, তিনগুণ ইত্যাদি করা হয়।
-
খেয়ালের মতো ধ্রুপদে তান করা হয় না। সাতপ্রকার অলঙ্কার ধ্রুপদে ব্যবহৃত হয়। এই
অলঙ্কারগুলো হলো- আশ,
ন্যাস, মীড়, গমক, মূর্ছান, স্পর্শন ও কম্পন। এসকল অলঙ্কার যুক্ত হওয়ার পর,
ধ্রুপদের আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য ঋজু।
-
ধ্রুপদে লঘু তাল ব্যবহৃত হয় না। চৌতাল, আড়াচৌতাল, ঝাঁপতাল, ধামার, সুরফাঁক্তা ইত্যাদি
গুরুগম্ভীর তালে ধ্রুপদ বাঁধা হয়। তবে চৌতালকে ধ্রুপদের জন্য আদর্শ তাল ধরা হয়।
ধ্রুপদের তালে তালের অলঙ্করণ সাতটি। এগুলো হলো-
বিলম্বিত. মধ্য, দ্রুত, সম,
বিষম, অতীত ও অনাঘাত।
-
ধ্রুপদের একমাত্র উপযুক্ত তালবাদ্যযন্ত্র পাখোয়াজ।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত 'সঙ্গীত-প্রকাশিকা' পত্রিকার 'কার্তিক ১৩০৮
সংখ্যা'র ১৬ পৃষ্ঠায় 'ধ্রুপদ কাহাকে বলে' প্রবন্ধে ধ্রুপদের শ্রেণি বিভাজনে ৬টি নাম
পাওয়া যায়। এগুলো হলো- গীত, সঙ্গীত, ছন্দ, প্রবন্ধ, যুগল-বন্ধ ও ধারু। এই প্রবন্ধ
অনুসারে জানা যায় যে, ছন্দ শব্দের মাঝে মাঝে উল্লেখ করে ছন্দ-ধ্রুপদ পরিবেশন করা
হয়। একই ভাবে গোপাল নায়ক কর্তৃক উদ্ভাবিত ধারু শব্দের উল্লেখ করে ধ্রুপদ পরিবেশন
করলে তাকে বলা হয় ধারু ধ্রুপদ। কিন্তু প্রবন্ধ এবং যুগলবন্দী সম্পর্কে বিশেষ যে
তথ্য জানা যায়, তা হলো - যে ধ্রুপদে নানা প্রকার তাল পরিবর্তন হয়, তাহার নাম
প্রবন্ধ। আর যে ধ্রুপদ দুই জন পরিবেশন করেন। এর ভিতরে একজন বাণী অংশ পরিবেশন করেন
এবং অপরজন এর সাথে সরগম তাল লয় যোগে সুর পরিবেশন করেন। ধ্রুপদের এই পরিবেশনকে বলা
হয়ে যুগলবন্ধ।
ধ্রুপদের বাণী
ধ্রুপদের
বাণী বলতে বুঝায় ভাব ভাষা এবং গায়নশৈলীর ধারা। তানসেনের পরবর্তী সময়ে ধ্রুপদের
বাণীগত বিভাজন শুরু হয়েছে। এই বিভাজনের ধারা নানা অঞ্চলে নানাভাবে বিকশিত হয়েছে। এই
সকল ধারার ভিতর চারটি ধারাকে প্রধান ধারা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এগুলো হলো-
- গৌড়হার বাণী :
একে অনেক সময় গৌড়ী বাণী বলা হয়। আধুনিক ধ্রুপদের বিকাশ ঘটেছিলে রাজা মানসিংহ তোমর-এর
মাধ্যমে গোয়ালিয়রে।
পরবর্তী সময় একে বিশেষভাবে উৎকর্ষ রূপদান করেছিলেন তানসেন। তানসেনকৃত এই রূপটি
গৌরহার বাণী নামে অভিহিত হয়ে থাকে। এই কারণে বাণীকে আদি বাণী বা শুদ্ধ বাণী বলা
হয়।
এই বাণীর প্রকৃতি শান্ত। এতে অলঙ্কারের বাহুল্য নেই। স্পষ্ট এবং
সুনির্দিষ্টভাবে স্বরের প্রয়োগ করা হয়। তবে মীড়ের প্রয়োগ আছে। এই বাণীতে
ভক্তিভাবকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়।
- নওহার বাণী :
নওহারের অধিবাসী শ্রীচন্দ্র এই বাণীর উদ্ভাবক। নওহার নামক স্থানের নামানুসারে
এই বাণীর নামকরণ করা হয়েছে। অনেকে মনে করেন এই বাণীর সৃষ্টি করেছিলেন সুজন খাঁ।
- খাণ্ডার বাণী:খাণ্ডারের অধিবাসী সমোখন সিংহ
খাণ্ডারবাণীর উদ্ভাবক ছিলেন। উদ্ভাবকের নাম বা স্থানের নাম থেকে এই বাণীর
নামকরণ হয়েছে।
- ডাগর বাণী:
দিল্লির নিকটবর্তী ডাগর বা ডাগুর নামক স্থানের অধিবাসী ব্রিজচন্দ্র ডাগর এই
বাণীর প্রচলন করেন। অনেকে মনে করেন করেন ব্রিজচন্দ্র ডাগর রাজস্থানের অধিবাসী
ছিলেন। তবে উদ্ভাকের নাম ডাগর পদবী থেকে এই বাণীর নামকরণ হয়েছে।
এই বাণীতে বীররসের প্রাধান্য রয়েছে। এর সাথে যুক্ত করা হয় করুণ রসের। উভয় মিলে
এই বাণীর ধ্রুপদ মুধুর করে তোলে। এই বাণীতে নানা ধরনের আলঙ্করিক প্রয়োগ রয়েছে।
সুমিষ্ট গমক এই বাণীতে প্রধান অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সরল এবং বক্র মীড়ের
ব্যবহার হয়ে থাকে।
ধ্রুপদের তাল
সংস্কৃত ছন্দে নিবদ্ধ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কাল পেরিয়ে-
যথার্থ তালগুলো সৃষ্টি হয়েছিল ধ্রুপদের মাধ্যমে। ভারতের নানা
প্রান্তে ধ্রুপদের নানা রকম তৈরি হলেও আলাউদ্দীন খিলজি
দিল্লীর রাজত্বকালে (১২৯৬-১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দ) ধ্রুপদের একটি আদর্শরূপ লাভ করেছিল।
সেই সময়ে রচিত ধ্রুপদের যে সকল নমুনা পাওয়া যায়, তাতে যে সকল তালের নাম পাওয়া যায়,
তা হলো- আড়াচৌতাল,
চৌতাল,
ঝাঁপতাল, ঢিমা তেতালা,
তেওরা,
ধামার,
রূপক,
বিষ্ণু তাল,
ব্রহ্মতাল,
সওয়ারী, সুরফাঁকতাল।
সূত্র :
- রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসংগীত। দিলীপকুমার বিশ্বাস। দেশ সাহিত্য সংখ্যা
১৩৯৩।
- বাঙালির রাগসঙ্গীত চর্চা। দীলিপকুমার মুখোপাধ্যায়।
- ভারতীয় সঙ্গীতকোষ। বিমলাকান্ত রায়চৌধুরী/বৈশাখ ১৩৭২