খেয়াল
উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রের
প্রধান দুটি ধারার একটি। উল্লেখ্য এর অপর ধারাটির নাম ধ্রুপদ।
খেয়াল-এর নাম ও উৎপত্তি
খেয়ালের নাম এবং উৎপত্তি নিয়ে নানা ধরনের মতবাদ প্রচলিত আছে। যেমন−
আরবি খেয়াল শব্দের অর্থ হলো ইচ্ছা, খুশি। অনেকে মনে করেন, ধ্রুপদের কঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলা ভেঙে − এই ধারার গানে স্বাধীনভাবে রাগের নানা রূপচিত্র নির্মাণ করার স্বাধীনতা আছে, এই অর্থে খেয়াল শব্দটি এসেছে।
দিল্লির পাশর্ববর্তী অঞ্চলে কাওয়াল নামক যাযাবর সম্প্রদায় যে ভক্তিমূলক গান পরিবেশন করতো, তার নাম ছিল কাওয়ালি। এই কাওয়ালি থেকে খেয়াল গানের উদ্ভব এবং নামটিও এসেছে কাওয়ালি শব্দ থেকে।
প্রাচীন কৈবাড় নামক প্রবন্ধগান বা একতালী (রসিক গান) থেকে খেয়ালের উৎপত্তি ঘটেছিল।
প্রাচীন আক্ষিপ্তিকা নামক গান থেকে এই গানের উৎপত্তি।
গোয়ালিয়র ঘরানার ওস্তাদ বড়ে মুহম্মদ খাঁ (১৮২৪-১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দ)
চুট্কলা খেয়ালের কবিতা পাঠের অংশটুকু বাদ দেন।
তিনি তালে নিবদ্ধ দুই পংক্তির এক তুকের খেয়ালের সাথে তান ও বিস্তার যুক্ত করেন। এর
ফলে যে নতুন ধরনের খেয়াল তৈরি হয়েছিল, তা 'অস্তাঈ খেয়াল্'
নামে পরিচিতি লাভ করেছিল।
গোড়ার দিকে খেয়ালের একটি ঘরানা ছিল। একে বলা
হতো কওয়াল ঘরানা। এই ঘরানা আদি হলেও বর্তমানে এর অস্তিত্ব নেই। কালক্রমে সদারঙ্গ
এবং অদারঙের শিষ্যরা তাঁদের নবতর খেয়াল শৈলী নিয়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে
পড়েন। এঁরা তাঁদের নিজ নিজ বাসস্থানে এই গানের চর্চা করতে গিয়ে নানারকম উপকরণ এবং
গায়নশৈলী যুক্ত করেন। এঁদের শিষ্যরা আবার গুরুর গায়ন পদ্ধতি দীর্ঘদিন ধরে চর্চা
করার মধ্য দিয়ে পৃথক পৃথক শৈলীকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ফলে তৈরি হয় বিভিন্ন স্থানিক
ঘরানা। যদিও বর্তমানে বিভিন্ন ঘরানা মিলে মিশে একাকার হয়ে মিশ্র রীতির সৃষ্টি করে
চলেছে। একালের কোনো শিল্পীই নিষ্ঠার সাথে কোনো ঘরানাকে অনুসরণ করে চলছেন না।
সদারঙ্গের আমল থেকে এখন পর্যন্ত যে সকল ঘরানার নাম পাওয়া যায়, সেগুলোর
বর্ণানুক্রমিক তালিকা নিচে তুলে ধরা হলো।।
অত্রৌলী ঘরানা
আল্লাদিয়া খাঁর ঘরানা
আগ্রা ঘরানা
কিরনা ঘরানা
গোয়ালিয়ার ঘরানাজয়পুর ঘরানা
তিলমণ্ডী ঘরানা
দিল্লী ঘরানাপাঞ্জাব ঘরানা
পাতিয়ালা ঘরানাবারনসী ঘরানা
রঙ্গীলে ঘরানা
রামপুর ঘরানা
লক্ষ্ণৌ ঘরানা
সেকেন্দ্রাবাদ ঘরানা
হাপুর ঘরানা
খেয়াল-এর বৈশিষ্ট্য
খেয়ালের বাণী অংশ দুটি স্তবকে গঠিত হয়। এর প্রথমাংশকে স্থায়ী এবং দ্বিতীয়াংশকে অন্তরা বলা হয়।
পূর্ণাঙ্গ খেয়াল পরিবেশনে, প্রথমে সংক্ষেপে আলাপ করা হয়। এরপর কোনো তালের বিলম্বিত লয়ে একটি গান করা হয়। এতে থাকে রাগের দীর্ঘ বিস্তার, নানা ধরনের তান এবং নানা ধরনের আলঙ্করিক উপাদান। দ্বিতীয় স্তরে দ্রুত লয়ের গান উপস্থাপন করা হয়। এই অংশে বিস্তারের চেয়ে তানের প্রাধান্য থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছোটো খেয়ালে বিস্তারের পর লয় বাড়িয়ে তান অংশ করা হয়। শেষের দিকে যথাসম্ভব লয় বৃদ্ধি করে দ্রুত তান করা হয়। অনেকে ছোট খেয়ালের ভিতর তবলা বাদকের সাথে সওয়াল-জবাব নামক অংশ পরিবেশন করে ভিন্নতর রস উপস্থাপন করেন।
খেয়ালের অনুষঙ্গী তাল যন্ত্র হলো তবলা। এই গানের সাথে একতাল, ত্রিতাল, আড়াচৌতাল, ঝুমরা ইত্যাদি তাল ব্যবহার করা হয়। তবে খেয়াল গানে তবলা শুধু অনুষঙ্গী নয়। কখনো কখনো তবলাকে প্রধান বাদ্য যন্ত্র হিসেবে বাজানোর সুযোগ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে খেয়াল গায়ক বিশ্রাম নেন বা তবলা বাদককে তাল নির্দেশ দেন। তবলা বাদক এই সময়ে নানা রকম বাদনশৈলী প্রদর্শন করে থাকেন।
বাংলা খেয়াল
বাংলাদেশে খেয়াল গানের চর্চা শুরু করেছিলেন রঘুনাথ রায় (১৭৫০-১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দ)।
সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মেছিল পারিবারিক সূত্রে। তাঁর পিতা
দেওয়ান ব্রজকিশোর কালীভক্ত ছিলেন। তিনিও সঙ্গীতশিল্পী এবং রচয়িতা ছিলেন। তাঁর ১টি
গানের নমুনা পাওয়া যায়,
দুর্গাদাস লাহিড়ি'র সম্পাদিত
বাঙ্গালির গান গ্রন্থে। ব্রজকিশোরের বড় ছেলে দেওয়ান নন্দকুমারও সঙ্গীত রচনায়
বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। দুর্গাদাস লাহিড়ি'র সম্পাদিত বাঙ্গালির গান
গ্রন্থে ৪টি গানের নমুনা পাওয়া যায়। এই গানেগুলো ভৈরবী, বাগেশ্রী, মুলতান রাগে
নিবদ্ধ। তালের উল্লেখ রয়েছে ঠেকা ও একতালা।
রঘুনাথ রায়ের সঙ্গীতের পাঠ হয়েছিল তাঁর পিতা এবং বড় ভাইয়ের কাছে। পরবর্তী সময়ে সঙ্গীতশিক্ষা হয়েছিল বর্ধমান রাজদরবারে একাধিক পশ্চিমা ওস্তাদদের কাছে। পরবর্তী সময়ে তিনি বর্ধমান রাজদরবারের দেওয়ান পদ লাভ করেন। এই কারণে তিনি দেওয়ান রঘুনাথ রায় নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি হিন্দুস্থানী ওস্তাদদের কাছে খেয়াল শিখলেও নিজে বাংলা খেয়াল রচনায় হাত দেন। এই অনুপ্রেরণা তিনি লাভ করেছিলেন তাঁর বাবা এবং বড় ভাইয়ের কাছ থেকে।
ব্রজকিশোর, নন্দকিশোর এবং রঘুনাথ এঁরা রাগাশ্রয়ী গান নাকি খেয়ালের বন্দেশ তৈরি করেছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ জাগে। কারণ এঁদের গানগুলো চার তুকের। কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য রঘুনাথের গানকে খেয়াল নামেই অভিহিত করেছেন। কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গীতসূত্রসার গ্রন্থে খেয়াল গানের আলোচনায় লিখেছেন‒
'...ইহাতে দুই তুকের অধিক সচরাচর ব্যবহার হয় না, অর্থাৎ ইহাতে কেবল আস্থায়ী ও অন্তরা। কখন কখন ইহাতে তিন চারি কলিও থাকে। কিন্তু তাহাদের সুর সবই অন্তরার ন্যায়। খেয়ালীর সুরের কতকগুলি বাংলা গানে ধ্রুপদের ন্যায় চারি তুক আছে, অর্থাৎ চারি কলির বিভিন্ন প্রকার সুর। নদীয়া জেলার অন্তঃপাতী চুপি গ্রাম নিবাসী মৃত দাওয়ান রঘুনাথ রায় (যিনি 'অকিঞ্চন' বলিয়া খ্যাত) খাস হিন্দুস্থানী খেয়ালে বাংলায় ঐরূপ চারি তুকের অনেক শ্যামাবিষয়ক গান রচনা করিয়াছিলেন।' কৃষ্ণধনের বিবরণ থেকে মনে হয়ে রঘুনাথ খেয়ালের ধাঁচে শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। উল্লেখ্য রঘুনাথ পরবর্তীকালে বেশ কিছু কৃষ্ণবিষয়ক গানও রচনা করেছিলেন। দুর্গাদাস লাহিড়ি'র সম্পাদিত বাঙ্গালির গান গ্রন্থে রঘুনাথ রায়ের ৯৯টি গান সংকলিত হয়েছে।
রঘুনাথ রায়ের গানের রাগ ও তাল তালিকা নিচে দেওয়া হলো।
রাগ তালিকা: আড়ানা, আড়ানা বাহার, আলাইয়া, আলেয়া, ইমনকল্যাণ, কালাংড়া, কেদারা, গান্ধার, গৌরী, খাম্বাজ, ঝিঁঝিট, ঝিঁঝিট-খাম্বাজ, টোড়ি, টোড়ি বাগেশ্রী, দেশ, দেওগিরি, পরজ, পরজবাহার, পূরবী, বসন্ত-বাহার, বাগেশ্বরী, বাগেশ্রী, বাহার, বিভাস, বেহাগ, ভৈরবী, মালশ্রী, মুলতান, মেঘমল্লার, যোগিয়া, রামকেলি, ললিত-বিভাস, লুমঝিঁঝিট, শ্যামকল্যাণ, সারঙ্গ, সিন্ধু, সিন্ধু-ভৈরবী, সুরট, সুরটমল্লার, সোহিনী, হাম্বির।
তাল তালিকা: আড়া, আড়াঠেকা, একতালা, খয়রা, ছোট চৌতাল, ঝাঁপতাল, ঠেকা, তেওট, তেতালা, পোস্তা, মধ্যমান, যৎ।
রঘুনাথ রায়ের খেয়াল
সেকালে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তাঁর রচিত গীতাবলী 'দেওয়ান মহাশয়ের গান' নামেই
পরিচিত ছিল। সেকালের গায়করা বিভিন্ন আসরে পরিবেশন করতেন, শ্রোতাদের আগ্রহেই।
এই সময় ১৭৮০-৮১ খ্রিষ্টাব্দের
দিকে কালী
মীর্জা উত্তর ভারত থেকে সঙ্গীত শিক্ষা শেষে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে হুগলিতে
এসে বসবাস শুরু করেন। যদিও বাংলা টপ্পা গানের বিচারে, তাঁকে সবাই মান্য করেন।
কিন্তু টপ্পার পাশাপাশি তিনি পশ্চিমা খেয়াল গানও করতেন।
'বিষ্ণুপুর' ঘরানার বাংলা ধ্রুপদের প্রবর্তক
পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য (১৭৬১-১৮৫৩
খ্রিষ্টাব্দ), ধ্রুপদ ছাড়াও কয়েকটি খেয়াল গান রচনা করেছিলেন। রমেশচন্দ্র
বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'বিষ্ণুপুর' গ্রন্থে রামশঙ্করের রচিত দুটি খেয়াল গানের উল্লেখ
করেছেন। এই গান দুটি ইমন ও বাহারে রচিত।