খেয়াল
উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রের প্রধান দুটি ধারার একটি। উল্লেখ্য এর অপর ধারাটির নাম ধ্রুপদ।

 

খেয়াল-এর নাম ও উৎপত্তি

খেয়ালের নাম এবং উৎপত্তি নিয়ে নানা ধরনের মতবাদ প্রচলিত আছে। যেমন

বর্তমানে অধিকাংশ সঙ্গীতগবেষকরা মনে করেন− কাওয়ালি থেকে খেয়ালের উৎপত্তি হয়েছে। বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ হযরত আমির খসরু (১২৫৩-১৩২৫ খ্রিষ্টাব্দ) কাওয়ালি গানের সংস্কার করে খেয়াল গানের প্রাথমিক রূপদান করেছিলেন। 'আইন-ই-আকবরী' গ্রন্থ থেকে জানা যায়- দিল্লীতে কওল্ (কৌল্) ও তারানা নামক গানের প্রচলন ছিল। আমির খসর 'সমুৎ' এবং 'তাতার' নামক দু'জন গায়কের মুখে শোনা ফার্সি 'সাউৎ' ও 'নক্শ্' গান শোনেন। তিনি এই দুই ধরনের গানের সাথে 'কওল' ও 'তারানা'র গীত-শৈলী মিশ্রিত করে একটি নতুন গীতশৈলী 'খয়াল' প্রণয়ন করেন। পরবর্তী সময়ে লোকমুখে খয়াল শব্দটি খেয়াল নামে পরিচিত লাভ করে। ফকীর উল্লাহ্'র ‘রাগদর্পণ’ নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায় খেয়াল রচিত হতো দেশী বা আঞ্চলিক ভাষায়। এতে মাত্র দুটি মাত্র তুক্ থাকতো। মূলত এই গানের প্রচলন ছিল দিল্লী ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে।

আমির খসরু প্রাথমিকভাবে ছোট খেয়াল (দ্রুত খেয়াল)-এর প্রচলন করেছিলেন বলেই অনুমান করা হয়। খেয়াল গানের শুরুর দিকে মুসলমান গায়করা গান রচনা করতেন এবং পরিবেশনও করতেন মুসলমান গায়করা। সুলতান বা সম্রাটের মনোরঞ্জনের জন্য খেয়াল ছিল নবীর গুণকীর্তনমূলক। কৌল বা খয়াল গানের শিল্পীরা কওয়াল নামে অভিহিত হতেন। সম্রাট আকবর শাসনামলেও এঁরা কওয়াল বা খয়াল শিল্পী নামে পরিচিতি পেতেন।

ধীরে ধীরে খেয়ালের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকলে খেয়াল রচয়িতারা, নবীর গুণকীর্তনের পাশাপাশি নিজামুদ্দিন আওলিয়ার গুণকীর্তনও যুক্ত হতে থাকে। এ ছাড়া প্রকৃতি ও প্রেম-পর্যায়ের খেয়াল গানের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে।

সম্রাট আকবর শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ) স্থানীয় খেয়াল রচয়িতাদের অনেকে চার তুকের খেয়াল রচনা করেছিলেন।  খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতকে জৌনপুরের সুলতান হুসেন শাহ্‌ শর্কী বিলম্বিত তথা বড় খেয়াল গানের প্রচলন করেন।

পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে উত্তর প্রদেশের অন্তর্গত জৌনপুরের সংগীতজ্ঞ সুলতান হুসেন শর্কী তাঁর নিজ রাজ্যে প্রচলিত 'চুট্কল্' নামক একপ্রকার সংকীর্ণ শ্রেণীর প্রবন্ধ গানের সাথে আমির খসরুর খয়ালের মিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি করেছিলেন চুটকলা খেয়াল। এই খেয়াল ছিল চার তুকের। এর প্রম তুক্ ছিল রাগতাল নিবদ্ধ। কিন্তু এর দ্বিতীয়, তৃতীয়  চতুর্থ তুক্গুলি তাল ছাড়া পরিবেশন করা হতো। এক্ষেত্রে রাগের বিস্তার প্রাধান্য পেতো।

সম্রাট আকবর শাসনামলের পর সম্রাট শাহজাহানের শাসনমলের (১৬২৭-১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) মোগল রাজ দরবারে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা ছিল। এরপর আওরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ) শাসনামলে সঙ্গীত নিষিদ্ধ হয়। এই সময় সঙ্গীত শিল্পীরা জীবিকার সন্ধানে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে। মোগল দরবারে সঙ্গীতচর্চা না হলেও, দেশীয় রাজা বা নবাবদের দরবারে সঙ্গীতের চর্চা ছিল। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর  ১৭০৭ থেকে ১৭১৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সিংহাসনের অধিকার নিয়ে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। এই সময়ের ভিতরে মোগল সিংহাসনে আসেন পাঁচজন সম্রাট। এঁরা হলেন বাহাদুর শাহ প্রথম (১৭০৭-১৭১২ খ্রিষ্টাব্দ) জাহানদার শাহ (১৭১২-১৭১৩ খ্রিষ্টাব্দ), ফররুখশিয়ের (১৭১৩-১৭১৯খ্রিষ্টাব্দ), রাফি-উদ-দারাজাত (১৭১৯-১৭১৯খ্রিষ্টাব্দ) শাহজাহান দ্বিতীয় (১৭১৯-১৭১৯ খ্রিষ্টাব্দ)। ঘন ঘন সম্রাট পরিবর্তনের কারণে দরবারে শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতায় বিঘ্নের সৃষ্টি হয়। অবশেষে দ্বাদশ মোগল সম্রাট মুহাম্মদ শাহ ১৭১৯ দিল্লীর সিংহাসন লাভ করেন এবং ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সম্রাট হিসেবে রাজত্ব করেন। মুহাম্মদ শাহ সঙ্গীতে অনুরক্ত ছিলেন। তাঁর রাজদরবারের সভাগায়ক ও সঙ্গীত রচয়িতা হিসেবে স্থান পেয়েছিলেন তানসেন বংশীয় সদারঙ্গ (৬৭০-১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দ)।  তিনি খেয়ালের  উৎকর্ষতা দান করেন।  মূলত আধুনিক খেয়াল গানের জনক হিসেবে সদারঙ্গকে মান্য করা হয়। এরপর সদারঙ্গের উত্তরপুরুষ এবং শিষ্যরা খেয়ালের প্রচার ও প্রসার ঘটায়। বিশেষত সদারঙ্গের জ্যেষ্ঠপুত্র অদারঙ্গ খেয়াল গান প্রচারে বিশেষ অবদান রাখেন।

গোয়ালিয়র ঘরানার ওস্তাদ বড়ে মুহম্মদ খাঁ (১৮২৪-১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দ) চুট্কলা খয়ালের কবিতা পাঠের অংশটুকু বাদ দেন। তিনি তালে নিবদ্ধ দুই পংক্তির এক তুকের খেয়ালের সাথে তান ও বিস্তার যুক্ত করেন। এর ফলে যে নতুন ধরনের খেয়াল তৈরি হয়েছিল, তা 'অস্তাঈ খয়াল্' নামে পরিচিতি লাভ করেছিল।

গোড়ার দিকে খেয়ালের একটি ঘরানা ছিল। একে বলা হতো কওয়াল ঘরানা। এই ঘরানা আদি হলেও বর্তমানে এর অস্তিত্ব নেই। কালক্রমে সদারঙ্গ এবং অদারঙের শিষ্যরা তাঁদের নবতর খেয়াল শৈলী নিয়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। এঁরা তাঁদের নিজ নিজ বাসস্থানে এই গানের চর্চা করতে গিয়ে নানারকম উপকরণ এবং গায়নশৈলী যুক্ত করেন। এঁদের শিষ্যরা আবার গুরুর গায়ন পদ্ধতি দীর্ঘদিন ধরে চর্চা করার মধ্য দিয়ে পৃথক পৃথক শৈলীকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ফলে তৈরি হয় বিভিন্ন স্থানিক ঘরানা। যদিও বর্তমানে বিভিন্ন ঘরানা মিলে মিশে একাকার হয়ে মিশ্র রীতির সৃষ্টি করে চলেছে। একালের কোনো শিল্পীই নিষ্ঠার সাথে কোনো ঘরানাকে অনুসরণ করে চলছেন না। সদারঙ্গের আমল থেকে এখন পর্যন্ত যে সকল ঘরানার নাম পাওয়া যায়, সেগুলোর বর্ণানুক্রমিক তালিকা নিচে তুলে ধরা হলো।।

অত্রৌলী ঘরানা

আল্লাদিয়া খাঁর ঘরানা

আগ্রা ঘরানা

কিরনা ঘরানা
গোয়ালিয়ার ঘরানা

জয়পুর ঘরানা

তিলমণ্ডী ঘরানা
দিল্লী ঘরানা

াঞ্জাব ঘরানা
পাতিয়ালা ঘরানা

বারনসী ঘরানা

রঙ্গীলে ঘরানা

রামপুর ঘরানা

লক্ষ্ণৌ ঘরানা

েকেন্দ্রাবাদ ঘরানা

াপুর ঘরানা
 

খেয়াল-এর বৈশিষ্ট্য

বাংলা খেয়াল
বাংলাদেশে খেয়াল গানের চর্চা শুরু করেছিলেন রঘুনাথ রায় (১৭৫০-১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দ)। সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মেছিল পারিবারিক সূত্রে। তাঁর পিতা দেওয়ান ব্রজকিশোর কালীভক্ত ছিলেন। তিনিও সঙ্গীতশিল্পী এবং রচয়িতা ছিলেন। তাঁর ১টি গানের নমুনা পাওয়া যায়,
 দুর্গাদাস লাহিড়ি'র সম্পাদিত বাঙ্গালির গান গ্রন্থে। ব্রজকিশোরের বড় ছেলে দেওয়ান নন্দকুমারও সঙ্গীত রচনায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন।   দুর্গাদাস লাহিড়ি'র সম্পাদিত বাঙ্গালির গান গ্রন্থে ৪টি গানের নমুনা পাওয়া যায়। এই গানেগুলো ভৈরবী, বাগেশ্রী, মুলতান রাগে নিবদ্ধ। তালের উল্লেখ রয়েছে ঠেকা ও একতালা।

রঘুনাথ রায়ের সঙ্গীতের পাঠ হয়েছিল তাঁর পিতা এবং বড় ভাইয়ের কাছে। পরবর্তী সময়ে সঙ্গীতশিক্ষা হয়েছিল বর্ধমান রাজদরবারে একাধিক পশ্চিমা ওস্তাদদের কাছে। পরবর্তী সময়ে তিনি বর্ধমান রাজদরবারের দেওয়ান পদ লাভ করেন। এই কারণে তিনি দেওয়ান রঘুনাথ রায় নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি হিন্দুস্থানী ওস্তাদদের কাছে খেয়াল শিখলেও নিজে বাংলা খেয়াল রচনায় হাত দেন। এই অনুপ্রেরণা তিনি লাভ করেছিলেন তাঁর বাবা এবং বড় ভাইয়ের কাছ থেকে।

ব্রজকিশোর, নন্দকিশোর এবং রঘুনাথ এঁরা রাগাশ্রয়ী গান নাকি খেয়ালের বন্দেশ তৈরি করেছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ জাগে। কারণ এঁদের গানগুলো চার তুকের। কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য রঘুনাথের গানকে খেয়াল নামেই অভিহিত করেছেন। কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গীতসূত্রসার গ্রন্থে খেয়াল গানের আলোচনায় লিখেছেন

 '...ইহাতে দুই তুকের অধিক সচরাচর ব্যবহার হয় না, অর্থাৎ ইহাতে কেবল আস্থায়ী ও অন্তরা। কখন কখন ইহাতে তিন চারি কলিও থাকে। কিন্তু তাহাদের সুর সবই অন্তরার ন্যায়। খেয়ালীর সুরের কতকগুলি বাংলা গানে ধ্রুপদের ন্যায় চারি তুক আছে, অর্থাৎ চারি কলির বিভিন্ন প্রকার সুর। নদীয়া জেলার অন্তঃপাতী চুপি গ্রাম নিবাসী মৃত দাওয়ান রঘুনাথ রায় (যিনি 'অকিঞ্চন' বলিয়া খ্যাত) খাস হিন্দুস্থানী খেয়ালে বাংলায় ঐরূপ চারি তুকের অনেক শ্যামাবিষয়ক গান রচনা করিয়াছিলেন।' কৃষ্ণধনের বিবরণ থেকে মনে হয়ে রঘুনাথ খেয়ালের ধাঁচে শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। উল্লেখ্য রঘুনাথ পরবর্তীকালে বেশ কিছু কৃষ্ণবিষয়ক গানও রচনা করেছিলেন। দুর্গাদাস লাহিড়ি'র সম্পাদিত বাঙ্গালির গান গ্রন্থে রঘুনাথ রায়ের ৯৯টি গান সংকলিত হয়েছে।

রঘুনাথ রায়ের গানের রাগ ও তাল তালিকা নিচে দেওয়া হলো।

রাগ তালিকা: আড়ানা, আড়ানা বাহার, আলাইয়া, আলেয়া, ইমনকল্যাণ, কালাংড়া, কেদারা, গান্ধার, গৌরী, খাম্বাজ, ঝিঁঝিট, ঝিঁঝিট-খাম্বাজ, টোড়ি, টোড়ি বাগেশ্রী, দেশ, দেওগিরি, পরজ, পরজবাহার, পূরবী, বসন্ত-বাহার, বাগেশ্বরী, বাগেশ্রী, বাহার, বিভাস, বেহাগ, ভৈরবী, মালশ্রী, মুলতান, মেঘমল্লার, যোগিয়া, রামকেলি, ললিত-বিভাস, লুমঝিঁঝিট, শ্যামকল্যাণ, সারঙ্গ, সিন্ধু, সিন্ধু-ভৈরবী, সুরট, সুরটমল্লার, সোহিনী, হাম্বির।

তাল তালিকা: আড়া, আড়াঠেকা, একতালা, খয়রা, ছোট চৌতাল, ঝাঁপতাল, ঠেকা, তেওট, তেতালা, পোস্তা, মধ্যমান, যৎ।

রঘুনাথ রায়ের খেয়াল সেকালে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তাঁর রচিত গীতাবলী 'দেওয়ান মহাশয়ের গান' নামেই পরিচিত ছিল। সেকালের গায়করা বিভিন্ন আসরে পরিবেশন করতেন, শ্রোতাদের আগ্রহেই।

এই সময় ১৭৮০-৮১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কালী মীর্জা উত্তর ভারত থেকে সঙ্গীত শিক্ষা শেষে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে হুগলিতে এসে বসবাস শুরু করেন। যদিও বাংলা টপ্পা গানের বিচারে, তাঁকে সবাই মান্য করেন। কিন্তু টপ্পার পাশাপাশি তিনি পশ্চিমা খেয়াল গানও করতেন।

'বিষ্ণুপুর' ঘরানার বাংলা ধ্রুপদের প্রবর্তক পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য (
১৭৬১-১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দ), ধ্রুপদ ছাড়াও কয়েকটি খেয়াল গান রচনা করেছিলেন। রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'বিষ্ণুপুর' গ্রন্থে রামশঙ্করের রচিত দুটি খেয়াল গানের উল্লেখ করেছেন। এই গান দুটি ইমন ও বাহারে রচিত।