ধ্রুপদের ইতিহাস
ভারতীয় রাগসঙ্গীতের প্রাচীনতম একটি ধারা।  ধ্রুপদ অর্থ হলো ধ্রুব (নিশ্চল ও চিরস্থায়ী) পদ। সে অর্থে একমাত্র ঈশ্বরই ধ্রূব, তাই তাঁর কীর্তনসূচক পদকে বলা হয় ধ্রূবপদ। প্রাচীনকালে ঈশ্বরের গুণগাথায় ধ্রূবপদের ব্যবহার হতো।

ধ্রপদের আদি উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয় প্রাচীন গান্ধর্ব গানকে। গান্ধর্ব গান দুটি ধারায় বিকশিত হয়েছিল। এর একটি ধারার বিকাশ ঘটেছিল গ্রাম, মূর্চ্ছনা ও জাতিগানের ক্রমবির্তনের ধারায়। একে বলা হয়ে থাকে মার্গ সঙ্গীত বা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। অন্যটি ছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আর্যপল্লীর নাগরিক গান। এই গানকে বলা হয়েছে দেশী বা লৌকিক গান।

গান্ধর্ব গানের মার্গীয় ধারার ক্রমবিবর্তনে সৃষ্টি হয়েছিল  প্রবন্ধগান। এই  প্রবন্ধ গানের একটি ধারায় সুরেলা আবৃত্তির মতো করে গাওয়া হতো। এতে তাল বা ছন্দের ব্যবহার ছিল না। একে বলা হয়ে হতো অনিবদ্ধ প্রবন্ধগান। প্রবন্ধ গানের অপর ধারাটি ছিল তাল বা ছন্দে নিবদ্ধ। একে বলা হতো নিবদ্ধ  প্রবন্ধগান

নিবদ্ধ  প্রবন্ধগানে কালক্রমে নানা প্রকার পরিবর্তন ঘটেছিল। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত ভরতের নাট্যশাস্ত্র থেকে খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রচিত শার্ঙ্গদেবের রচিত সঙ্গীতরত্নকরের পাঠ অনুসরণ করলে দেখা যায়- প্রবন্ধ গান নানাভাবে বিকশিত হয়েছিল। এই সময়ের প্রবন্ধগানের সামগ্রিক রূপসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- নিবদ্ধ প্রবন্ধ গানে অর্থযুক্ত শব্দ বা বাণী থাকত এবং তালে নিবদ্ধ থাকত। এর স্তবক বিন্যাসকে ধাতু বলা হতো। নিবদ্ধ গানে মূলত চারটি ধাতু ব্যবহৃত হতো। এই চারটি ধাতুর নাম ছিল− উদ্‌গ্রাহ, মেলাপক, ধ্রুব এবং আভোগ। এছাড়া এতে ব্যবহৃত হতো ছয়টি অঙ্গ।


নিবদ্ধ গানের ধাতু
কোনো কোনো প্রবন্ধ গানে অন্তরা নামে অতিরিক্ত তুক থাকতো। এই তুকটি যুক্ত হতে গানের ধ্রুব ও আভোগের মধ্যে। ধারণা করা হয়, লৌকিক গানের প্রভাবে এই তুকটি প্রবন্ধগানে প্রবেশ করেছিল।

নিবদ্ধ গানের অঙ্গ: নিবদ্ধ জাতীয় প্রবন্ধ গানের উপস্থাপিত বিষয় এবং পরিবেশনের রীতি ছিল প্রবন্ধগানের অঙ্গ। এই অঙ্গ ছিল ৬ প্রকার। এগুলো হলো−

১. স্বর: প্রবন্ধগানের সুরের কাঠামো এবং বাহন হলো স্বর। মূলত শাস্ত্রসম্মত স্বরের উপর ভিত্তি করে গান উপস্থাপিত হবে।
২. বিরূদ: গানের স্তুতিবাচক ছন্দময় পদ হলো বিরুদ।
৩. পদ: কোনো বিশেষ বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ গান রচিত হবে। গানের বিষয়বস্তুই হলো- পদ।
৪. তেনক: গানের মঙ্গলবাচক ধ্বনিকে বলা হতো তেনক। যেমন ওঁ, ওম ইত্যাদি প্রতীকী মঙ্গলবাচক শব্দই তেনক নামে অভিহিত হতো। একে প্রবন্ধগানের চোখ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
৫. পাট: আনদ্ধ বাদ্যের বোলবাণী উচ্চারণকে বলা হতো পাট। প্রবন্ধগানে গানের মাঝখানে তালের বোলবাণী উচ্চারিত হতো।
৬. তাল: প্রবন্ধগানের ছন্দ রক্ষার উপাদান হিসেবে তালের ব্যবহার হতো।
সকল প্রবন্ধ বা নিবদ্ধ গানে সকল অঙ্গ ব্যবহৃত হতো না। প্রবন্ধগানে কমপক্ষে দুটি অঙ্গ থাকতে হতো। অঙ্গের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে প্রবন্ধগানের জাতি নির্ধারিত হতো। এই জাতিগুলো হলো-
১. তারাবলী: এই প্রবন্ধগানে২টি অঙ্গ থাকতো।
২. পাবনী (ভবানী): এই প্রবন্ধগানে ৩টি অঙ্গ থাকতো।
৩. দীপনী: এই প্রবন্ধগানে ৪টি অঙ্গ থাকতো।
৪. আনন্দিনী: এই প্রবন্ধগানে ৫টি অঙ্গ থাকতো।
৫. মেদিনী: এই প্রবন্ধগানে ৬টি অঙ্গ থাকতো।

প্রবন্ধ গানের বাণী ও সুরের বিন্যাসের উপর ভিত্তি করে প্রবন্ধগানকে প্রাথমিকভাবে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভাগগুলো হলো- সূড়, আলি (আলিসংশ্রয়) ও বিপ্‌রকীর্ণ। এই তিনটি ধারার সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছিল সালগ সুড় প্রবন্ধ। উল্লেখ্য 'সালগ' শব্দটি 'ছায়ালগ' শব্দ থেকে এসেছে। কল্লিনাথের মতে- যে সব গানে শুদ্ধ সঙ্গীতের ছায়াপাত ঘটেছে সেইগুলিকে 'ছায়ালগ' বলা যায়।

সালগসূড় প্রবন্ধ গানে- উদগ্রাহ (দুই অংশ), ধ্রুব ও আভোগের মাঝখানে একটি ভিতরে একটি অতিরিক্ত ধাতু ব্যবহৃত হতো। এই ধাতুটির নাম অন্তর। অন্তর অংশটুকু উচ্চস্বরে পরিবেশন করা হতো। এই গানের উদ্‌গ্রাহ দুটি খণ্ড এবং অন্তর দুইবার গাওয়ার রীতি ছিল। আবার আভোগের অংশ দুই ভাগে ভাগ করা হতো। এর প্রথম ভাগের চেয়ে দ্বিতীয় ভাগ উচ্চস্বরে গাওয়া হতো। সব মিলিয়ে সালগ সুড়ের ভাগগুলোর বিন্যাস দাঁড়িয়েছিল- উদ্‌গ্রাহ (দুই খণ্ড), অন্তর, এবং আভোগ (দুই খণ্ড। এই গানে মেলাপক নেই। কালক্রমে উদ্গ্রাহ বর্জন করে সরাসরি ধ্রুব গাওয়ার রীতি প্রচলিত হয়। ফলে ধ্রুব থেকেই এই গান শুরু করা হতো। এই ধ্রুব পদ থেকেই ধ্রুপদ নামক গানের  প্রচলন হয়। আর অন্তর অংশটুকুর নাম দাঁড়ায় অন্তরা। অন্যদিকে অাভোগের প্রথম খণ্ডের নামকরণ করা হয় সঞ্চারী। বাকিটুকু আভোগ নামেই থেকে যায়।

প্রাচীন প্রবন্ধ গান থেকে ধ্রুবা গানের উদ্ভব
খ্রিষ্টীয় ২০০ অব্দের দিকে ভরতের নাট্যশাস্ত্র রচনার সময় থেকে খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর উষালগ্নে, অর্থাৎ সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির  (রাজত্বকাল ১২৯৬-১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দ) শাসনামলের পূর্ব-কালে প্রবন্ধ গানের  রাজত্ব ছিল।  এই সময় ভারতীয় রাগশাস্ত্রে জনকরাগগুলো গ্রামরাগ হিসেবে পরিচিত ছিল। এই গ্রমারাগ থেকে উৎপন্ন হয়েছিল গীত-ভিত্তিক রাগ, ভাষা ও বিভাষা রাগগুলো। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত মতঙ্গের রচিত 'বৃহদ্দেশী' এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শার্ঙ্গদেবের রচিত সঙ্গীতরত্নাকরে এই রাগ গুলোর পরিচয় পাওয়া যায়। সঙ্গীতরত্নাকর রচনার সময় রাগের সংখ্যা ছিল ২৬৪টি। এই রাগগুলো মার্গসঙ্গীত বা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধারার অন্তর্গত ছিল। এই রাগগুলো ব্যবহারে প্রধান ক্ষেত্র ছিল প্রবন্ধ গান।

প্রাক্-সুলতানি আমলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তনের ধারায় সালগ সুড় প্রবন্ধ গানের একটি ধারা হিসেবে ধ্রুব গানের উৎপত্তি ঘটেছিল। ভরতের নাট্যশাস্ত্র থেকে জানা যায়- নাটকের ব্যবহারের জন্য যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধ্রুব গান পরিবেশিত হতো, তার নাম ছিল ধ্রুবা গান। এই গান নাটকের প্রয়োজন একক বা সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হতো। এই গানগুলো পরিবেশিত হতো বিভিন্ন রাগে এবং চচ্চৎপুট,  চাচপুট, পঞ্চপাণি  ইত্যাদি ছন্দে। এই গানের প্রধান তিনটি ধারা ছিল- ঋক্, পাণিকা এবং গাথা। এর বাইরে ছিল সপ্তগীত। এগুলো হলো- মদ্রক, উল্লপ্যক, অপরান্তক, প্রকরী, ওবেণক, রোবোন্দক ও উত্তর। এই সপ্তগীতের ছিল বহুবিধ অঙ্গ। নাটকে ব্যবহৃত ক্ষুদ্র অবয়বের ধ্রুবাগানে সকল অঙ্গ ব্যবহৃত হতো না। তবে এর বিশেষ একটি বা দুটি অঙ্গকে নানা ছন্দে পরিবেশিত করা হতো।

আলাউদ্দীন খিলজির রাজত্বকালে (১২৯৬-১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দ), রাজদরবারে বিশেষভাবে সম্মানিত হয়েছিলেন আমির খসরুর পাশাপাশি গোপাল নায়কবৈজু বাওরা।  বিভিন্ন গ্রন্থাদি অনুসরণে জানা যায়- সুলতানের রাজদরবারে গোপাল নায়কবৈজু বাওরা সালগসূড়ের ধ্রুবা গান পরিবেশন করতেন। অনেকের মতে এই ধ্রুবাগান অনুসরণে, বৈজু বাওরা ধ্রুপদের আদি রূপ তৈরি করেছিলেন।  বৈজু বাওরা গানের যে নমুনা অনুসরণ করলে দেখা যায়- তাঁর গানের ভাষা ছিল শুদ্ধ ব্রজভাষা। তাঁর গানের বাণী কাব্যিক ছন্দে গাঁথা। তাঁর গান ছিল পাঁচ বা চার তুকে নিবদ্ধ। এই তুকগুলো ছিল ধ্রুবা গানের মতো।

আলাউদ্দীন খিলজির আমলে- ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ধ্রুবাগানগুলো আঞ্চলিক গানে পরিণত হয়েছিল। ধ্রুবা আঙ্গিকের এ সকল  গানের ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিল। আবুল ফজল তাঁর রচিত আইন-ই- আকবরী গ্রন্থে থেকে জানা যায়- দাক্ষিণাত্যে ধ্রুবা গান ছিল মূলত প্রশংসাসূচক। তেলেগু ও কর্ণাটকী ভাষা এগুলোর নাম ছিল ধ্রুব। এই জাতীয় গানের বঙ্গদেশে বলা হতো- বাঙ্গালা', জৌনপুরে বলা হতো 'চুটকল'। দিল্লীর আশপাশ অঞ্লে এই গান 'কৌল' এবং 'তারণা' বলা হতো।  আমির খসরু দিল্লীর 'কৌল' এবং 'তারণা' গানের সাথে শমিত ও তাতার গানের সংমিশ্রণ নতুন ধারার গানের প্রবর্তন করেছিলেন। মথুরাতে এই গানের নাম ছিল 'বিষ্ণুপদ'। সিন্ধু প্রদেশে এর নাম ছিল 'লাচারী'। লাহোরের আশপাশের অঞ্চলে এই গানের নাম ছিল ছান্দ। আর গুজরাটে এর নাম ছিল জাক্রি।

বৈজুবাওরা এবং গোপাল নায়কের হাতে গড়ে উঠেছিল একালের ধ্রুপদের আদিরূপ।  এসকল ধ্রুপদের কিছু নমুনা এখানো পাওয়া যায়।  ধ্রুপদের আদি রূপের চর্চা ছিল জৌনপুরের শাসক সুলতান হুসেন শাহ শর্কী'র (১৪৫৮-১৪৮৬) আমলে। সম্ভবত সাহিত্য ও সঙ্গীতের অনুরাগের সূত্রে রাজা মানসিংহ তোমর-এর সাথে তাঁর বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তাই, ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দে হুসেন শাহ শার্কীকে বিতাড়িত করে বহুলুল লোদি যখন জৌনপুর দখল করেন, তখন তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন মানসিংহ তোমরকে। এরপর হুসেন শাহকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে বহুলুল্ লোদী গোয়ালিয়র আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের যুদ্ধের শেষে মানসিংহ পরাজয় মেনে নেন এবং প্রচুর অর্থ সম্পদ প্রদানের মাধ্যমে সন্ধি হয়।

গোয়ালিয়রকে তৎকালীন সঙ্গীত চর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। মানসিংহ নিজে সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তাঁর রাজসভায় বিশিষ্ট সভাগায়করা স্থান পেয়েছিলেন। বিভিন্ন গ্রন্থাদি থেকে তাঁর রাজসভার যে সকল সভাগয়কদের নাম পাওয়া যায়, তা হলো-

মানসিংহের রাজ দরবারে এসব সভাগায়করা যে গান করতেন, তা তিনি লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। এই সংকলন তৈরির সময় তিনি তাঁর সঙ্গীত সভার গুণী শিল্পীদের সাহায্য করেছিলেন। এই সহযোগিতায় তাঁত স্ত্রী মৃগনয়নার বিশেষ অবদান ছিল। এই সংকলনের নাম দেওয়া হয়েছিল- 'মানকতুহল'। এই গ্রন্থের অনুবাদ করেছিলেন ফকীরুল্লাহ। এই গ্রন্থে মোট ৬টি শুদ্ধ রাগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো- ভৈঁরো, মালকোষ, হিন্দোল, দীপক, শ্রী ও মেঘ।  এছাড়া এই রাগগুলোর রাগিণী এবং পুত্র হিসেবে পরিচিত রাগগুলোও প্রচলিত ছিল। স্বর সংখ্যাভিত্তিক তিনটি জাতির রাগ প্রচলিত ছিল। এই বিচারে রাগগুলোকে যেভাবে শ্রেণিকরণ করা হয়েছিল। যেমন-

সুলতান আলাউদ্দিনের সময়, আদি ধ্রুবাগানের সূত্রে ধ্রুপদের যে কাঠামো তৈরি হয়েছিল, মানসিংহ তার একটি সুনির্দিষ্ট রূপতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁর সভাগায়কদের সাহায্য নিয়ে। এদের মধ্যে তাঁর দরবারে বকসু ও মচ্ছু বা মামদকে বিশেষ অবদানের কথা জানা যায়- বিভিন্ন গ্রন্থসূত্রে।

মানসিংহের পরাজিত হওয়ার পর, তাঁর রাজ দরবারের সঙ্গীতজ্ঞরা নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।  এর ভিতরে রাজদরবারের অন্যতম সঙ্গীতজ্ঞ নায়ক বকসু প্রথমে কালীগঞ্জ রাজদরবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরে ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দে বাহাদুর শাহের রাজদরবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই রাজ-দরবারে থাকাবস্থায় তিনি তৈরি করেছিলেন বাহাদুরী টোড়ি।

মানসিংহের দরবারের অপর সঙ্গীতজ্ঞ ভানু বা ভন্নু কাশ্মীরে চলে যান। তাঁর পৌত্র এবং শিষ্য গুণসেন ধ্রুপদ শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। গুনসেন আফজাল পদবী গ্রহণ করেছিলেন।  ধারণ করা হয়, ভানুসেন বা তাঁর বংশধরেরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

ধ্রুপদের ক্রমবিকাশের ধারায় বৃ্ন্দাবন মথুরার 'বিষ্ণুপদ' নামক প্রবন্ধ গানের বিশাল ভূমিকা ছিল। এই অঞ্চলের নানা ধরনের 'বিষ্ণুপদ'-এর প্রচলন থাকলেও গোয়ালিয়ার এবং দিল্লির ধ্রুপদের প্রভাবে কালক্রমে স্বতন্ত্র ধরনের ধ্রুপদ হয়ে উঠেছিল।  একে বলা যায় আদি বৃন্দাবনী-ধ্রুপদ। এই সময় রূপ গোস্বামী এবং সনাতন গোস্বামী ধ্রুপদ শিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।  এছাড়া শ্রীচৈতন্য ধারার বৈষ্ণব দর্শনের গায়ক রামানন্দ সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এই ধারার  ধ্রুপদের ঐতিহ্যকে সম্প্রসারিত করেছিলেন  দামোদর কৃষ্ণদাস গোস্বামী। এরপরে বৃন্দাবনী ধ্রুপদের উৎকর্ষ সাধন করেছিলেন নরোত্তম ঠাকুর। গুরু-পরম্পরায় এই সময়ে সাতজন হরিদাসের নাম পাওয়া যায়।

খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর ভিতরে ভারতবর্ষে চারটি বৈষ্ণব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল। এগুলো হলো- রামানুজ, বিষ্ণুস্বামী, মাধ্বাচর্য ও নিম্বার্ক। এগুলোর ভিতরে হরিদাস স্বামী ছিলেন নিম্বার্ক দ্বৈতাদ্বৈত্বাবাদের অনুসারী।

রাজা মানসিংহ তোমরের সভাগায়কদের পরে মিঞা তানসেন (১৫০৫-১৫৮৫) ধ্রুপদ সঙ্গীতকে উৎকর্ষের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যান। কিন্তু আকবরের সভা বিশেষভাবে অলঙ্কৃত করেছিলন  হরিদাস স্বমীর শিষ্য মিয়া তানসেন। অধিকাংশ সঙ্গীত গবেষকদের মতে- হরিদাস স্বামী ছিলেন আকবরের সভাগায়ক তানসেনের গুরু।  সঙ্গত কারণেই বৃন্দাবন মথুরা অঞ্চলে প্রচলিত ধ্রুপদই আকবরের সভাগায়ক তানসেনের ধ্রুপদ ছিল। বর্তমানে উত্তরভারতে যে ধ্রুপদ প্রচলিত তার অধিকাংশই মিঞা তানসেন এবং তৎপরবর্তী গুণীমণ্ডলী কর্তৃক রচিত ও গীত হয়ে থাকে।

মূলত সম্রাট আকবরের আমলে ধ্রুপদ উত্তর ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয় সঙ্গীতে পরিণত হয়। পরবর্তী সময়ে তানসেনের পুত্রবংশীয়, কন্যাবংশীয় এবং শিষ্যদের দ্বারা ধ্রুপদ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

মথুরা ও বৃন্দাবন ধ্রুপদের বিকাশ ঘটেছিল বৈষ্ণব দর্শনের ধারয়।এক সময় বৃন্দাবন প্রবন্ধ গানের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে, বিষ্ণুপদ প্রবন্ধ গান এই অঞ্চলে ব্যাপক সাড়া ছিল। ১৫১৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বৃন্দাবন পরিভ্রমণে  আসেন। সে সময়ে বৃন্দবনে প্রবন্ধ গানের পাশাপাশি ধ্রুপদের চর্চা ছিল। এই ধ্রুপদের উৎস ছিল গোয়ালিয়র এবং দিল্লি। মূলত এই অঞ্চলের 'বিষ্ণুপদ' গানই ক্রমে ক্রমে ধ্রুপদে পরিণত হয়েছিল।

বঙ্গদেশের ধ্রুপদ চর্চা ও বিষ্ণুপুরী ঘরানা
বঙ্গদেশে ধ্রুপদের চর্চার আদিভূমি হিসেবে বিষ্ণুপুরকে উল্লেখ করা হয়। বিষ্ণুপুরে চর্চিত ধ্রুপদশৈলীকে বলা হয় বিষ্ণুপুরী ঘরানার ধ্রুপদ। প্রথম বাংলা ধ্রুপদগান রচনা করেছিলেন, ধ্রুপদের বিষ্ণুপুরী ঘরানার আদিকবি পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য । তিনি ধ্রুপদের পাঠ নিয়েছিলেন জনৈক হিন্দুস্থানী গুরুর কাছে। পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য তাঁকে পণ্ডিতজী নামে অভিহিত করতেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি গুরুর হিন্দুস্থানী ভাষায় রচিত ধ্রুপদ পরিবেশন করতেন। পরে তিনি ধ্রুপদের তিনি হিন্দুস্থানী ভাষা ত্যাগ করে বাংলাতে ধ্রুপদ রচনা শুরু করেন এবং তা তাঁর শিষ্যদের শেখান। মূলত তাঁর সূত্রেই ভারতবর্ষের রাগসঙ্গীত জগতে বিষ্ণুপুরে ঘরানার সৃষ্টি হয়েছিল।

তিনি আবাসিক ব্যবস্থায় গান শেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এই সূত্রে তিনি বেশ কিছু গুণী শিষ্য তৈরি করে যান। এঁদের ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছিলেন — ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, যদুভট্ট, রামকেশব ভট্টাচার্য, কেশবলাল চক্রবর্তী, রমাপতি বন্দ্যোপাধ্যায়, অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, কেশবলাল ভট্টাচার্য প্রমুখ। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য বিষ্ণুপুরে মৃত্যবরণ করেন। তিনি কখনো বিষ্ণুপরের বাইরে আসেন নি। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী সঙ্গীতে পেশ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এই উদ্দেশ্যে তিনি কলকাতায় আসেন। তাঁর সূত্রে কলকাতায় ধ্রপদ গানের প্রচার ঘটে। পরবর্তী সময়ে কলকাতা থেকে বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে এই গান ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে শৌরীন্দ্রমোহন 'বঙ্গসঙ্গীত বিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যালয়ে ক্ষেত্রমোহন শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এই বিদ্যালয়ে তিনি বিষ্ণুপুরী ঘরানার ধ্রুপদ শেখাতেন। এছাড়া রামশঙ্কর ভট্টাচার্য-এর তৃতীয় পুত্র রামকেশব ভট্টাচার্য সেকালের অন্যতম ধ্রুপদ শিল্পী হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর মাধ্যমেও এই ধ্রুপদ প্রচারিত হয়েছিল। রামকেশব কুচবিহার মহারাজ রামকেশব ভট্টাচার্যকে সভাগায়ক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর মাধ্যমে কুচবিহার অঞ্চলে বিষ্ণুপরী ঘরানার ধ্রুপদ ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে তিনি কলকাতায় ফিরে এসে তৎকালীন ধনাঢ্য ব্যক্তি সাতু বাবুর আসরে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন।

রামশঙ্কর ভট্টাচার্য-এর অপর শিষ্য কেশবলাল চক্রবর্তী ছিলেন অপর ধনাঢ্য ব্যক্তি তারকনাথ প্রামাণিকের সভাগায়ক ছিলেন। এই সভায় তিনি নিয়মিত বিষ্ণুপুরী ঘরানার ধ্রুপদ পরিবেশন করতেন। এমনি রামশঙ্করের শিষ্য এবং তাঁদের শিষ্যদের মাধ্যমে বিষ্ণুপুরী ঘরানার ধ্রুপদ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। তিনি হিন্দুস্থানী পণ্ডিতদের কাছে সঙ্গীতের পাঠ নিলেও, নিজে ধ্রুপদ রচনা করেছিলেন বাংলা ভাষায়। এই কারণে বাংলা ধ্রুপদের আদি রচয়িতা হিসেবে রামশঙ্কর ভট্টাচার্য-কে উল্লেখ করা হয়। ধ্রুপদের বৈশিষ্ট্য জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত 'সঙ্গীত-প্রকাশিকা' পত্রিকার 'কার্তিক ১৩০৮ সংখ্যা'র ১৬ পৃষ্ঠায় 'ধ্রুপদ কাহাকে বলে' প্রবন্ধে ধ্রুপদের শ্রেণি বিভাজনে ৬টি নাম পাওয়া যায়। এগুলো হলো- গীত, সঙ্গীত, ছন্দ, প্রবন্ধ, যুগল-বন্ধ ও ধারু। এই প্রবন্ধ অনুসারে জানা যায় যে, ছন্দ শব্দের মাঝে মাঝে উল্লেখ করে ছন্দ-ধ্রুপদ পরিবেশন করা হয়। একই ভাবে গোপাল নায়ক কর্তৃক উদ্ভাবিত ধারু শব্দের উল্লেখ করে ধ্রুপদ পরিবেশন করলে তাকে বলা হয় ধারু ধ্রুপদ। কিন্তু প্রবন্ধ এবং যুগলবন্দী সম্পর্কে বিশেষ যে তথ্য জানা যায়, তা হলো - যে ধ্রুপদে নানা প্রকার তাল পরিবর্তন হয়, তাহার নাম প্রবন্ধ। আর যে ধ্রুপদ দুই জন পরিবেশন করেন। এর ভিতরে একজন বাণী অংশ পরিবেশন করেন এবং অপরজন এর সাথে সরগম তাল লয় যোগে সুর পরিবেশন করেন। ধ্রুপদের এই পরিবেশনকে বলা হয়ে যুগলবন্ধ। 

ধ্রুপদের বাণী
ধ্রুপদের বাণী বলতে বুঝায় ভাব ভাষা এবং গায়নশৈলীর ধারা। তানসেনের পরবর্তী সময়ে ধ্রুপদের বাণীগত বিভাজন শুরু হয়েছে। এই বিভাজনের ধারা নানা অঞ্চলে নানাভাবে বিকশিত হয়েছে। এই সকল ধারার ভিতর চারটি ধারাকে প্রধান ধারা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এগুলো হলো- ধ্রুপদের তাল
সংস্কৃত ছন্দে নিবদ্ধ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কাল পেরিয়ে- যথার্থ তালগুলো সৃষ্টি হয়েছিল ধ্রুপদের মাধ্যমে। ভারতের নানা প্রান্তে ধ্রুপদের নানা রকম তৈরি হলেও আলাউদ্দীন খিলজি দিল্লীর রাজত্বকালে (১২৯৬-১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দ) ধ্রুপদের একটি আদর্শরূপ লাভ করেছিল। সেই সময়ে রচিত ধ্রুপদের যে সকল নমুনা পাওয়া যায়, তাতে যে সকল তালের নাম পাওয়া যায়, তা হলো- আড়াচৌতাল, চৌতাল, ঝাঁপতাল, ঢিমা তেতালা, তেওরা, ধামার, রূপক, বিষ্ণুতাল, ব্রহ্মতাল, সওয়ারী, সুরফাঁক্তা


সূত্র :
রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসংগীত। দিলীপকুমার বিশ্বাস। দেশ সাহিত্য সংখ্যা ১৩৯৩।
বাঙালির রাগসঙ্গীত চর্চা। দীলিপকুমার মুখোপাধ্যায়।
ভারতীয় সঙ্গীতকোষ। বিমলাকান্ত রায়চৌধুরী/বৈশাখ ১৩৭২