নিবদ্ধ গানের ধাতু
কোনো কোনো প্রবন্ধ গানে অন্তরা নামে অতিরিক্ত তুক থাকতো। এই তুকটি যুক্ত হতে গানের ধ্রুব ও আভোগের মধ্যে। ধারণা করা হয়, লৌকিক গানের প্রভাবে এই তুকটি প্রবন্ধগানে প্রবেশ করেছিল।সকল প্রবন্ধ বা নিবদ্ধ গানে সকল অঙ্গ ব্যবহৃত হতো না। প্রবন্ধগানে কমপক্ষে দুটি অঙ্গ থাকতে হতো। অঙ্গের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে প্রবন্ধগানের জাতি নির্ধারিত হতো। এই জাতিগুলো হলো-নিবদ্ধ গানের অঙ্গ: নিবদ্ধ জাতীয় প্রবন্ধ গানের উপস্থাপিত বিষয় এবং পরিবেশনের রীতি ছিল প্রবন্ধগানের অঙ্গ। এই অঙ্গ ছিল ৬ প্রকার। এগুলো হলো−
১. স্বর: প্রবন্ধগানের সুরের কাঠামো এবং বাহন হলো স্বর। মূলত শাস্ত্রসম্মত স্বরের উপর ভিত্তি করে গান উপস্থাপিত হবে।
২. বিরূদ: গানের স্তুতিবাচক ছন্দময় পদ হলো বিরুদ।
৩. পদ: কোনো বিশেষ বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ গান রচিত হবে। গানের বিষয়বস্তুই হলো- পদ।
৪. তেনক: গানের মঙ্গলবাচক ধ্বনিকে বলা হতো তেনক। যেমন ওঁ, ওম ইত্যাদি প্রতীকী মঙ্গলবাচক শব্দই তেনক নামে অভিহিত হতো। একে প্রবন্ধগানের চোখ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
৫. পাট: আনদ্ধ বাদ্যের বোলবাণী উচ্চারণকে বলা হতো পাট। প্রবন্ধগানে গানের মাঝখানে তালের বোলবাণী উচ্চারিত হতো।
৬. তাল: প্রবন্ধগানের ছন্দ রক্ষার উপাদান হিসেবে তালের ব্যবহার হতো।
১. তারাবলী: এই প্রবন্ধগানে২টি অঙ্গ থাকতো।
২. পাবনী (ভবানী): এই প্রবন্ধগানে ৩টি অঙ্গ থাকতো।
৩. দীপনী: এই প্রবন্ধগানে ৪টি অঙ্গ থাকতো।
৪. আনন্দিনী: এই প্রবন্ধগানে ৫টি অঙ্গ থাকতো।
৫. মেদিনী: এই প্রবন্ধগানে ৬টি অঙ্গ থাকতো।
প্রবন্ধ গানের বাণী ও সুরের বিন্যাসের উপর ভিত্তি করে প্রবন্ধগানকে প্রাথমিকভাবে তিনটি
ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভাগগুলো হলো- সূড়, আলি (আলিসংশ্রয়) ও বিপ্রকীর্ণ।
এই তিনটি ধারার সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছিল সালগ সুড় প্রবন্ধ।
উল্লেখ্য 'সালগ' শব্দটি 'ছায়ালগ' শব্দ থেকে এসেছে। কল্লিনাথের মতে- যে সব গানে শুদ্ধ
সঙ্গীতের ছায়াপাত ঘটেছে সেইগুলিকে 'ছায়ালগ' বলা যায়। উল্লেখ্য, শুদ্ধ গীতের ৮টি
প্রকার রয়েছে। এগুলো হলো- জাতি, কপাল, কম্বল, গ্রামরাগ, উপরাগ, ভাষা, বিভাষা, অন্তর ভাষা।
সালগসূড় প্রবন্ধ গানে- উদগ্রাহ (দুই অংশ), ধ্রুব ও আভোগের
মাঝখানে একটি ভিতরে একটি অতিরিক্ত ধাতু ব্যবহৃত হতো।
এই
ধাতুটির নাম অন্তর। অন্তর অংশটুকু উচ্চস্বরে পরিবেশন করা হতো। এই গানের উদ্গ্রাহ
দুটি খণ্ড এবং অন্তর দুইবার গাওয়ার রীতি ছিল। আবার আভোগের অংশ দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
এর প্রথম ভাগের চেয়ে দ্বিতীয় ভাগ উচ্চস্বরে গাওয়া হতো। সব মিলিয়ে সালগ সুড়ের
ভাগগুলোর বিন্যাস দাঁড়ায়- উদ্গ্রাহ (দুই খণ্ড), অন্তর, এবং আভোগ (দুই খণ্ড।
এই গানে মেলাপক নেই। কালক্রমে উদ্গ্রাহ বর্জন করে সরাসরি ধ্রুব গাওয়ার রীতি প্রচলিত
হয়। ফলে ধ্রুব থেকেই এই গান শুরু করা হতো। এই ধ্রুব পদ থেকেই ধ্রুপদ নামক গানের
প্রচলন হয়। আর অন্তর অংশটুকুর নাম দাঁড়ায় অন্তরা। অন্যদিকে অাভোগের প্রথম খণ্ডের
নামকরণ করা হয় সঞ্চারী। বাকিটুকু আভোগ নামেই থেকে যায়।
মুসলমানী শাসনামল ও আমির খসরু
খ্রিষ্টীয় ২০০ অব্দের দিকে ভরতের
নাট্যশাস্ত্র রচনার সময় থেকে খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর উষালগ্নে, অর্থাৎ
সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির (রাজত্বকাল
১২৯৬-১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দ)
শাসনামলের পূর্ব-কালে প্রবন্ধ গানের রাজত্ব ছিল। এই দীর্ঘ
সময়ের ভিতরে ভারতের ভারতে মুসলমানদের আগমন ঘটেছিল আরবীয় বণিকদের মাধ্যমে।
ভারত অধিকারের যুদ্ধযাত্রার প্রথম সফল অধিনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়- উমাইয়া
সেনাপতি মুহাম্মাদ বিন কাসিমকে। ৭০৮ থেকে ৭১১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সিন্ধু
বিজয়ের নেতৃত্ব দেন এবং বিজয় অর্জন হওয়ার পর তিনি সমগ্র অঞ্চলে ইসলামি শাসন
প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন অভিযানে মুসলমানরা উত্তরভারতের বিস্তীর্ণ
অঞ্চল অধিকার করে নেয়।
মুসলমান শাসকদের আমলে, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্প-সংস্কৃতির
ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছিল। এর ভিতরে সর্বাধিক প্রভাব ফেলেছিল সাহিত্য ও সঙ্গীতে।
পারশ্য, তুরস্ক, আরবীয় সঙ্গীতের সংমিশ্রণে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তনের
ধারায় নব রূপকার
আমির খসরুকে মান্য করা হয় এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিশেষ
সম্মানের জায়গা দেওয়া হয় খিলজি বংশের দ্বিতীয় সুলতান
আলাউদ্দীন খিলজিকে। তবে
আমির খসরুকে রাজদরবারের আনুকূল্য পেয়েছিলেন আরও আগে।
১২৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কি বংশোদ্ভুত গিয়াসউদ্দীন বলবন দিল্লীর
সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। এর কিছুদিন পরে
আমির খসরু এই সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। অল্প বয়সে কবিতা রচনা করে তিনি
শিক্ষিত সমাজে এবং রাজ দরবারে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। ১২৭১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম
কাব্যগ্রন্থ 'তুহফাতুস-সিঘ্র' রচনা করেন। ১২৭২ খ্রিষ্টাব্দে বলবনের ভ্রাতুষ্পুত্র
মালিক চর্জ্জুর সাথে তিনি সভাকবি পদে অধিষ্ঠিত হন।
১২৭৮ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গদেশের শাসনকর্তা তুঘ্রাল খাঁর বিরুদ্ধে গিয়াসউদ্দীন অভিযান
চালান। যুদ্ধে তুঘ্রাল ঘাঁ নিহত হলে, তিনি তাঁর পুত্র বঘরা খাঁকে বঙ্গদেশের শাসক
হিসেবে নিযুক্ত করেন। ১২৮৯ খ্রিষ্টাব্দে খসরু রচনা করেন 'ওয়াস্তুল হায়াত' নামক
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। এই বৎসরে বঘরা খাঁর অনুরোধে তিনি বঙ্গদেশ ভ্রমণ করেন এবং
তৎকালীন বাংলার রাজধানী লক্ষ্মণাবতীতে কিছুদিন কাটান।
১২৮৬ খ্রিষ্টাব্দে মোঙ্গলরা মুলতান আক্রমণ করে। সুলতান বলবন তাঁর পুত্র মহম্মদকে এই
আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য সেখানে পাঠান। এই যুদ্ধে মহম্মদের সাথে খসরুও যান।
যুদ্ধে মহম্মদ নিহত হন এবং আমির খসরু মোঙ্গলদের হাতে বন্দী হন। ১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দের
দিকে তিনি বন্দীদশা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। বলবন তাঁকে আগের মতই সমাদর করে
সভাকবি হিসেবে দরবারে স্থান দেন। পুত্রের মৃত্যু
শোকে বলবন ১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে সুলতান তাঁর দ্বিতীয়
পুত্র বঘরা খাঁকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। বঘরা খাঁ মূলত শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী
ছিলেন। ১২৮৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে খসরু রচনা করেন 'কিরানুস-স'দাইন' নামক
কাব্যগ্রন্থ।
রাজনৈতিক নানা ধরনের বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ১২৯০ খ্রিষ্টাব্দে
জালালউদ্দিন ফিরোজ খিলজি দিল্লির সিংহাসন অধিকার করেন। সিংহাসন দখলের পর
জালালউদ্দীন রাজদরবারের পুরানো অনেক কর্মীদের বরখাস্ত করলেও, আমির খসরু
সমাদরেই থেকে যান এবং দিল্লীর দরবারকে কাব্য ও সঙ্গীতে মুখর করে রাখেন। জালালউদ্দীন
খাল্জি তাঁর কাব্য ও সঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে "আমারত" উপাধিতে সম্মানিত করেন। তখন থেকেই
তিনি 'আমারত খসরু' বা 'আমির খসরু' নামে পরিচিত লাভ করেন। ১২৯০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
রচনা করেন 'মিফতাহুল ফুতুহ' নামক কাব্যগ্রন্থ। আর ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে রচনা করেন
'ঘিরাতুল-কামাল' নামক কাব্য।
১২৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর চাচা জালালউদ্দিনকে হত্যা করে,
আলাউদ্দীন খিলজি যখন নিজেকে সুলতান হিসেবে ঘোষণা দেন, তখন
আমির খসরু এই দরবারের সভকবি ছিলেন।
আলাউদ্দীন খিলজির শাসনামল (১২৯৬- ১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে
কুতুবুদ্দীন মুবারক শাহ (১৩১৬-১৩২১ খ্রিষ্টাব্দ) এবং গিয়াসউদ্দীন তুঘলক (১৩২১-১৩২৫
খ্রিষ্টাব্দ) রাজত্বকাল পর্যন্ত তিনি রাজসভার প্রধান সভাকবি ও সঙ্গীত সাধক হিসেবে
অধিষ্ঠিত ছিলেন।
আমির খসরু কাব্যগ্রন্থ রচনা করে হিন্দি এবং ফার্সি
ভাষাকে তিনি সমৃদ্ধ করেন।
সেতার ও
তবলা
আবিষ্কার করেন বলেও অনেক গবেষক দাবি করেন। এ দুটির বাদনশৈলীর আদিরূপ আমির খসরু তৈরি
করেছিলেন। প্রাচীন ভারতের
মূর্চ্ছনা সূত্রে প্রাপ্ত ৭টি শুদ্ধ স্বর ও ৫টি বিকৃত স্বরের বিন্যাসিত করে ১২
স্বরের কাঠামোকে সুনির্দিষ্ট করেছিলেন আমির খসরু। তাঁর আমলে দিল্লির নিকটবর্তী
অঞ্চলে আঞ্চলিক কাওয়াল গানের সাথে রাগের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে খেয়াল গানের আদি রূপ তৈরি
করেছিলেন।
প্রাচীন ভারতের মূর্চ্ছনা সূত্রে প্রাপ্ত ৭টি শুদ্ধ স্বর ও ৫টি বিকৃত স্বরের
বিন্যাসিত করে ১২ স্বরের কাঠামোকে সুনির্দিষ্ট করেছিলেন আমির খসরু। তাঁর আমলে
দিল্লির নিকটবর্তী অঞ্চলে আঞ্চলিক কাওয়াল গানের সাথে রাগের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে খেয়াল
গানের আদি রূপ তৈরি করেছিলেন।
প্রাচীন প্রবন্ধ গান থেকে ধ্রুবা গানের উদ্ভব
প্রাক্-সুলতানি আমলে
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তনের ধারায় সালগ সুড় প্রবন্ধ
গানের একটি ধারা হিসেবে
ধ্রুব গানের উৎপত্তি ঘটেছিল। ভরতের নাট্যশাস্ত্র থেকে জানা
যায়- নাটকের ব্যবহারের জন্য যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধ্রুব গান পরিবেশিত হতো, তার নাম
ছিল ধ্রুবা গান। এই গান নাটকের প্রয়োজন একক বা সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হতো। এই গানগুলো
পরিবেশিত হতো চচ্চৎপুট বা চাচপুট ছন্দে। এই গানের প্রধান তিনটি ধারা ছিল- ঋক্,
পাণিকা এবং গাথা। এর বাইরে ছিল সপ্তগীত। এগুলো হলো- মদ্রক, উল্লপ্যক, অপরান্তক,
প্রকরী, ওবেণক, রোবোন্দক ও উত্তর। এই সপ্তগীতের ছিল বহুবিধ অঙ্গ। নাটকে ব্যবহৃত
ক্ষুদ্র অবয়বের ধ্রুবাগানে সকল অঙ্গ ব্যবহৃত হতো না। তবে এর বিশেষ একটি বা দুটি
অঙ্গকে নানা ছন্দে পরিবেশিত করা হতো।
আলাউদ্দীন খিলজির রাজত্বকালে (১২৯৬-১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দ), রাজদরবারে বিশেষভাবে
সম্মানিত হয়েছিলেন
আমির খসরুর পাশাপাশি
গোপাল নায়ক
ও
বৈজু বাওরা।
বিভিন্ন গ্রন্থাদি অনুসরণে জানা যায়- সুলতানের রাজদরবারে
গোপাল নায়ক ও
বৈজু বাওরা
সালগসূড়ের ধ্রুবা গান পরিবেশন করতেন। অনেকের মতে এই ধ্রুবাগান
অনুসরণে,
বৈজু বাওরা
ধ্রুপদের আদি রূপ তৈরি করেছিলেন।
বৈজু বাওরা
গানের যে নমুনা অনুসরণ করলে দেখা যায়- তাঁর গানের ভাষা ছিল
শুদ্ধ ব্রজভাষা। তাঁর গানের বাণী কাব্যিক ছন্দে গাঁথা। তাঁর গান ছিল পাঁচ বা চার
তুকে নিবদ্ধ। এই তুকগুলো ছিল
ধ্রুবা গানের মতো।
গোপাল নায়ক ও বৈজু বাওরার আদি ধ্রুপদের তাল
সংস্কৃত ছন্দের বন্ধন ভেঙে কখন থেকে উত্তরভারতীয় ধ্রুপদের তালগুলোর উৎপত্তি ঘটেছিল
তার সুনির্দিষ্ট তালের ইতিহাস জানা যায় না। মূলত
ধ্রুবা গানের চলন ছিল সংস্কৃত ছন্দ-নির্ভর তাল। এ সকল গানে
ছিল বাণী অংশের ধ্বনি প্রবাহের দোলা। সুরের অবাধ স্বাধীনতায় সঙ্গীতের দোলাগুলোকে
গুচ্ছবদ্ধ করে তৈরি হয়েছিল ছন্দ। আর সম-সময়ে সম-প্রকৃতির ছন্দের আবর্তন যে, তাল হয়ে
উঠে, তার বিকাশ ঘটেছিল ধ্রবাগানের বিবর্তিত ধারায়। ধ্রুপদ ও খেয়ালে এসে তা পূর্ণতা
লাভ করেছিল।
গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংকলিত ও
সম্পাদিত সঙ্গীতচন্দ্রিকা গ্রন্থে-
গোপাল নায়ক
ও
বৈজু বাওরা-এর
রচিত ধ্রুপদে যে সকল তালের উল্লেখ পাওয়া যায়, তা হলো-
চৌতাল,
তেওরা,
সুরফাঁকতাল
ইত্যাদি।
এই সময়ের দিল্লির সন্নিকটে কাবাল নামক একটি
সম্প্রদায়ের ভিতরে নিজস্ব লোকসঙ্গীতের ছিল কাওয়ালি। এই কাওয়ালি গানের সাথে
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সংমিশ্রণে খেয়াল গানের উদ্ভব হয়েছিল। ধারণা করা হয়, এই মিশ্রণের
কাজটি করেছিলেন
আমির খসরু। গোড়ার দিকে খেয়ালের চলন
ছিল ধ্রুপদের কাছাকাছি। এই সময়ের কিছু ধ্রুপদ বিলম্বিত ত্রিতালে রচিত হয়েছিল। যখন
ধ্রুপদের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে খেয়াল স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে বিকশিত হলো- তখন ত্রিতাল,
একতাল, রূপক, ঝাঁপতাল, খেয়াল গানের তাল হয়ে উঠেছিল।
বৈজু বাওরা
ধ্রবাগান থেকে ধ্রুপদের বিকাশকাল
আলাউদ্দীন খিলজির রাজত্বকালে শুধু দিল্লি নয়- গোয়ালিয়র,
জৌনপুর, মথুরাবৃন্দবনে প্রবন্ধগান এবং ধ্রুবা গানের প্রচলন ছিল। এই সূত্রে আদি
ধ্রুপদের আদি রূপের সৃষ্টি হয়েছিল।
জৌনপুরের শাসক সুলতান হুসেন শাহ শর্কী'র
(১৪৫৮-১৪৮৬) আমলে এই আদি ধ্রুপদের চর্চা ছিল। সম্ভবত সাহিত্য ও সঙ্গীতের অনুরাগের
সূত্রে রাজা মানসিংহ তোমর-এর সাথে তাঁর বিশেষ বন্ধুত্ব
গড়ে উঠেছিল। তাই, ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দে হুসেন শাহ শার্কীকে বিতাড়িত করে বহুলুল লোদি
যখন জৌনপুর দখল করেন, তখন তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন
মানসিংহ তোমরকে। এরপর হুসেন শাহকে
আশ্রয় দেওয়ার কারণে
বহুলুল্
লোদী গোয়ালিয়র আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের যুদ্ধের শেষে
মানসিংহ পরাজয় মেনে নেন এবং প্রচুর অর্থ সম্পদ প্রদানের মাধ্যমে সন্ধি হয়।
গোয়ালিয়রকে তৎকালীন সঙ্গীত চর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। মানসিংহ নিজে সঙ্গীতজ্ঞ
ছিলেন। তাঁর রাজসভায় বিশিষ্ট সভাগায়করা স্থান পেয়েছিলেন। বিভিন্ন গ্রন্থাদি থেকে
তাঁর রাজসভার যে সকল সভাগয়কদের নাম পাওয়া যায়, তা হলো-
মানসিংহের রাজ দরবারে
এসব সভাগায়করা যে গান করতেন, তা তিনি লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। এই সংকলনের নাম দেওয়া
হয়েছিল- 'মানকতুহল'। এই গ্রন্থের অনুবাদ করেছিলেন ফকীরুল্লাহ। এই গ্রন্থে মোট ৬টি
শুদ্ধ রাগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো- ভৈঁরো, মালকোষ, হিন্দোল, দীপক, শ্রী
ও মেঘ।
সুলতান আলাউদ্দিনের সময়, আদি ধ্রুবাগানের সূত্রে ধ্রুপদের যে কাঠামো তৈরি হয়েছিল,
মানসিংহ তার একটি সুনির্দিষ্ট রূপতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁর সভাগায়কদের সাহায্য নিয়ে।
এদের মধ্যে তাঁর দরবারে বকসু ও মচ্ছু বা মামদকে বিশেষ অবদানের কথা জানা যায়- বিভিন্ন
গ্রন্থসূত্রে।
রাজা মানসিংহ তোমরের সভাগায়কদের পরে মিঞা তানসেন
(১৫০৫-১৫৮৫)
ধ্রুপদ সঙ্গীতকে উৎকর্ষের সর্বোচ্চ
পর্যায়ে নিয়ে যান। বর্তমানে উত্তরভারতে যে ধ্রুপদ প্রচলিত তার অধিকাংশই মিঞা তানসেন
এবং তৎপরবর্তী গুণীমণ্ডলী কর্তৃক রচিত ও গীত হয়ে থাকে।।
মূলত সম্রাট আকবরের আমলে ধ্রুপদ উত্তর ভারতে অত্যন্ত
জনপ্রিয় সঙ্গীতে পরিণত হয়। পরবর্তী সময়ে তানসেনের পুত্রবংশীয়, কন্যাবংশীয় এবং
শিষ্যদের দ্বারা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
বঙ্গদেশের ধ্রুপদ চর্চা ও বিষ্ণুপুরী
ঘরানা
বঙ্গদেশে ধ্রুপদের চর্চার আদিভূমি
হিসেবে বিষ্ণুপুরকে উল্লেখ করা হয়। বিষ্ণুপুরে চর্চিত ধ্রুপদশৈলীকে বলা হয়
বিষ্ণুপুরী ঘরানার ধ্রুপদ। প্রথম বাংলা ধ্রুপদগান রচনা করেছিলেন,
ধ্রুপদের বিষ্ণুপুরী ঘরানার আদিকবি
পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য। তিনি ধ্রুপদের পাঠ
নিয়েছিলেন জনৈক হিন্দুস্থানী গুরুর কাছে।
পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য তাঁকে পণ্ডিতজী নামে অভিহিত করতেন। প্রাথমিক
পর্যায়ে তিনি গুরুর হিন্দুস্থানী ভাষায় রচিত ধ্রুপদ পরিবেশন করতেন। পরে তিনি
ধ্রুপদের তিনি হিন্দুস্থানী ভাষা ত্যাগ করে বাংলাতে ধ্রুপদ রচনা শুরু করেন এবং তা
তাঁর শিষ্যদের শেখান। মূলত
তাঁর সূত্রেই ভারতবর্ষের রাগসঙ্গীত জগতে
বিষ্ণুপুরে ঘরানার সৃষ্টি হয়েছিল।
তিনি আবাসিক ব্যবস্থায় গান শেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এই সূত্রে তিনি
বেশ কিছু গুণী শিষ্য তৈরি করে যান। এঁদের ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছিলেন—
ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী,
যদুভট্ট,
রামকেশব ভট্টাচার্য, কেশবলাল চক্রবর্তী, রমাপতি বন্দ্যোপাধ্যায়, অনন্তলাল
বন্দ্যোপাধ্যায়, কেশবলাল ভট্টাচার্য প্রমুখ।
১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে
পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য বিষ্ণুপুরে মৃত্যবরণ করেন। তিনি কখনো
বিষ্ণুপরের বাইরে আসেন নি। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে
ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী সঙ্গীতে পেশ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এই উদ্দেশ্যে তিনি
কলকাতায় আসেন। তাঁর সূত্রে কলকাতায়
ধ্রপদ গানের প্রচার ঘটে। পরবর্তী সময়ে কলকাতা থেকে বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে এই গান
ছড়িয়ে পড়ে।
১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে
শৌরীন্দ্রমোহন
'বঙ্গসঙ্গীত বিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যালয়ে ক্ষেত্রমোহন শিক্ষক হিসেবে
যোগদান করেন। এই বিদ্যালয়ে তিনি বিষ্ণুপুরী ঘরানার ধ্রুপদ শেখাতেন। এছাড়া
রামশঙ্কর ভট্টাচার্য-এর তৃতীয় পুত্র রামকেশব ভট্টাচার্য সেকালের অন্যতম
ধ্রুপদ শিল্পী হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর মাধ্যমেও এই ধ্রুপদ প্রচারিত
হয়েছিল। রামকেশব কুচবিহার মহারাজ রামকেশব ভট্টাচার্যকে সভাগায়ক হিসেবে নিযুক্ত
করেছিলেন। তাঁর মাধ্যমে কুচবিহার অঞ্চলে বিষ্ণুপরী ঘরানার ধ্রুপদ ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে
তিনি কলকাতায় ফিরে এসে তৎকালীন ধনাঢ্য ব্যক্তি সাতু বাবুর আসরে সঙ্গীত পরিবেশন
করেছেন।
রামশঙ্কর ভট্টাচার্য-এর অপর শিষ্য কেশবলাল চক্রবর্তী ছিলেন অপর ধনাঢ্য ব্যক্তি
তারকনাথ প্রামাণিকের সভাগায়ক ছিলেন। এই সভায় তিনি নিয়মিত বিষ্ণুপুরী ঘরানার ধ্রুপদ
পরিবেশন করতেন। এমনি রামশঙ্করের শিষ্য এবং তাঁদের শিষ্যদের মাধ্যমে বিষ্ণুপুরী
ঘরানার ধ্রুপদ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। তিনি হিন্দুস্থানী পণ্ডিতদের কাছে সঙ্গীতের
পাঠ নিলেও, নিজে ধ্রুপদ রচনা করেছিলেন বাংলা ভাষায়। এই কারণে বাংলা ধ্রুপদের আদি
রচয়িতা হিসেবে
রামশঙ্কর ভট্টাচার্য-কে উল্লেখ করা হয়।
সূত্র :
রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসংগীত। দিলীপকুমার বিশ্বাস। দেশ সাহিত্য সংখ্যা
১৩৯৩।
বাঙালির রাগসঙ্গীত চর্চা। দীলিপকুমার মুখোপাধ্যায়।
ভারতীয় সঙ্গীতকোষ। বিমলাকান্ত রায়চৌধুরী/বৈশাখ ১৩৭২