এই ছন্দের বড় ছক হয়েছে ৬টি দোলা দিয়ে। এই ৬টি দোলা বিভাজিত হয়েছে ৩টি দোলার দ্বারা। কবিতার ক্ষেত্রে ৬ মাত্রার দোলার খণ্ডিত অংশগুলোকে বলা হয় পর্ব। গানের ক্ষেত্রে এর নাম পদ। ছন্দের পর্ব বা পদগুলো নানা ধরনের দোলায় সাজানো যেতে পারে। এরই সূত্রে ছন্দের প্রকৃতি পালটে যায়। ৬টি দোলা নিয়ে তৈরি ছন্দ হতে পারে- ।৬।, ২/৪, ৩/৩, ৪/২ ইত্যদি।১ ২ ৩। ৪ ৫ ৬।
৭ ৮ ৯। ১০ ১১ ১২।
১৩ ১৪ ১৫। ১৬ ১৭ ১৮।
১৯ ২০ ২১। ২২ ২৩ ১৪।
সময়ের নিরিখে ছন্দের মানকে প্রাথমিকভাবে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হলো- অনিয়মিত ও নিয়মিত।
দোলার নিয়মিত বা অনিয়মিত গুচ্ছব্দ্ধ রূপই ছন্দের রূপকে প্রকাশ করে। শিল্পকর্মের প্রকরণভেদে ছন্দের প্রকাশিতরূপে ভিন্নতা তৈরি করে। যেমন গানের ছন্দ, কবিতার ছন্দ, চিত্রকর্মের ছন্দ দোলার আদর্শিক রূপ এক হলেও শিল্পকর্মের মাধ্যমের বিচারে তা ভিন্ন ভিন্ন মনে হয়।
সুরের ছন্দ
সুরের ছন্দ তৈরি হয় সুরের প্রবাহের সূত্রে। সুরের মৌলিক ধ্বনিগত উপাদন হলো স্বর, আর
সময় মাপক একক হলো মাত্র।
ধরা যাক, বংশীবাদক ১৬টি আনন্দদায়ক সুর বাজালেন। এই স্বরগুলো হতে পারে−
সা দা পা দা মা পা জ্ঞা মা পা মা জ্ঞা মা জ্ঞা ঋ সা সা।
এই স্বরগুলোর প্রতিটির ভিতরের সময় দূরত্ব যদি সমান হয়, তা হলে প্রতিটি স্বরের সমন্বয়ে একটি দোলা কাজ করবে। এই দোলার নকশা নিচের চিত্রের মতো হতে পারে।
প্রতিটি স্বরের মধ্যবর্তী সময় যতটা ছোটো হবে, তার দোলাও ততট কম হবে। এই কারণে
রাগসঙ্গীতে দ্রুত সপাট তান যান্ত্রিক মনে হয়। কিন্তু বহু আনন্দ মিলে একটি মিশ্র
আনন্দের জন্ম দেয়। ফলে সপাট তান শুনে কান জুড়িয়ে যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে 'আমি' এই
দোলাকে অনুভব করতে পারে না। ছন্দের খেলা অনুভব করা যায় বড় বড় দোলে। কারণ আমি তাকে
শনাক্ত করতে পারে স্বস্তির সাথে।
দোলাকে অনুভব করতে হলে, প্রতিটি দোলার ভিতরে একটি বিরতি রাখা দরকার। এই বিরতি
আনন্দের এক ঘেঁয়েমি থেকে মুক্তি দিয়ে, বৈচিত্র্য প্রদান করে। শিল্পী এই কাজটি করবেন
সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য। সৌন্দর্যের উপাদানসমূহের ভিতরে বিরতি থাকাটা দরকারি।
চিত্রশিল্পে দর্শন-বিরাম যেমন দরকার, সঙ্গীতের ক্ষেত্রের শ্রবণ-বিরামটা দরকার। এর
জন্য স্বর-উৎপাদন বন্ধ করার প্রয়োজন হতে পারে। কণ্ঠের উচ্চতা-সামান্যতা বা
স্বরক্ষেপণ কৌশল দিয়েও তৈরি করা যায়। সঙ্গীতে স্বরসমূহের দ্বারা যে সৌন্দর্য তৈরি
করা হয়, তাতে বৈচিত্র্য আনার জন্য, আনন্দের ছোটো ছোটো গুচ্ছ তৈরি করা হয়। এর ফলে বড়
বড় দোলার সৃষ্টি হয়। ধরা যাক উপরের স্বরগুলোর ভিতর থেকে চারটি করে স্বর নিয়ে চারটি
দল করা হলো। এক্ষেত্রে এর রূপ হবে−
সা দা পা দা | মা পা জ্ঞা মা | পা মা জ্ঞা মা | জ্ঞা ঋা সা সা।
এর ফলে চারটি দোলা নিয়ে চারটি দল তৈরি হবে। একে বলা যেতে পারে গুচ্ছদোলা। গানের পরিভাষায় হবে চার মাত্রার দল। এর দ্বারা হবে চতুর্মাত্রিক দোলা। সুরের বিচারে চতুর্মাত্রিক ছন্দ। এক্ষেত্রে নকশাটা একটু পাল্টে যাবে।
নন্দনতত্ত্বের বিচারে সময়ের ভিত্তিতে স্বরে পরিবর্তনের গুচ্ছদোলা তৈরি করবে আনন্দের দোলা। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বলা হবে মাত্রাগুচ্ছের দোলা তৈরি করবে ছন্দের দোলা। তালের বিচারে এই গুচ্ছবদ্ধ দোলাকে বলা হবে পদ।
কবিতার ছন্দ
কবিতার ছন্দ হলো- কবিতার ধ্বনিসমূহের শৃঙ্খলিত নান্দনিক রূপবিন্যাস। কবিতার
প্রতিটি চরণে যে বর্ণসমূহ রয়েছে, তার উচ্চারণে ধ্বনি-দোলা তৈরি করে। এই দোলাসমূহ
গুচ্ছবদ্ধ করে ছন্দ তৈরি করে। ধরা যাক একটি কবিতার চরণ- .মহাভারতের কথা অমৃত সমান'।
ম | হা | ভা | র | তে | র | ক | থা | অ | মৃ | ত | স | মা | ন |
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ |
এখানে ১৪টি ধ্বনি নিয়ে ধ্বনিগুচ্ছ তৈরি হয়েছে, তা হবে একটি অখণ্ড ছন্দ। এর প্রতিটি দোলাকে বলা হবে মাত্রা। এবার ১৪ মাত্রার এই ছন্দের মধ্যে একটি বিরতি দিয়ে ছন্দটিকে ভাগ করা যায়, তাহলে এর লিখিত রূপ হবে-
ম | হা | ভা | র | তে | র | ক | থা | । | অ | মৃ | ত | স | মা | ন |
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ |
এক্ষেত্রে কবিতার প্রতিটি ধ্বনিগুচ্ছ দুটি ছন্দে বিভাজিত হয়ে যাবে। পুরো বাক্যটি হবে ৬/৪ ছন্ধে নিবদ্ধ। কবিতার ক্ষেত্রে প্রতিটি ভাগকে বলা হয় পর্ব। এই বিচারে কবিতার এই চরণটির ছন্দ হিসেবে বলা হবে- ৬/৪ পর্বের ছন্দ। ছন্দের বিরতিকে বলা হবে 'ছন্দ-যতি'। সাধারণ কবিতার মাঝের যদি হয় অল্পক্ষণের জন্য। একে বলা হয় অল্প-যতি। কিন্তু কবিতার একটি চরণ শেষ হওয়ার পর একটু বড় যতি নেওয়া হয়। একে বলা হয় দীর্ঘ যতি। কবিতার হ্রস্ব যতি নেওয়া অংশকে বলা হয় পর্ব। কবিতার পর্বগুলো উচ্চারণের সময় পর্বের প্রথম বর্ণের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। একে বলা হয় শ্বাসাঘাত। এই বিচারে মহাভারতের কথা অমৃত সমান'-এর ধ্বনিলিপি হবে-
১ | ২ | |||||||||||||
ম | হা | ভা | র | তে | র | ক | থা | । | অ | মৃ | ত | স | মা | ন |
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ |
কবিতার মাত্রা নির্ধারণে ধ্বনি-ঝোঁক একটি বড় ভূমিকা রাখে। এই ধ্বনি-ঝোঁককে বলা হয় অক্ষর। উল্লেখ্য, কবিতায় বর্ণ আর অক্ষর সমার্থক নয়। এখানে বর্ণ হলো- ধ্বনির মৌলিক ধ্বনিসংকেত। অ, আ, ক্, খ্, গ্ ইত্যাদি হলো বর্ণ। পক্ষান্তরে অক্ষর হলো- স্বল্পতম প্রয়াসে বা এক ঝোঁকে শব্দের যে অংশটুকু উচ্চারিত হয়। এর সমার্থক ইংরেজি শব্দ হলো- syllable। বিষয়টি নির্ভর করে ধ্বনিটি কিভাবে উচ্চারিত হবে। ধরা যাকটি শব্দ 'আঁধার'।
কবিতার মাত্রার সময়, গানের মাত্রার সময়ের মতো কঠোর নিয়মে বাঁধা নয়। কবিতার
মাত্রা নির্ধরিত হয়-এক বর্ণ বা একক অক্ষরের বিচারে। এতে প্রতিটি বর্ণ বা অক্ষর যে
একই সময় বিরতীতে উচ্চারিত হবে এমন বাঁধাধরা নিয়ম নেই।
সাধারণভাবে অক্ষর এই নির্ধরিত হলেও বাংলা কবিতায় ছন্দের পাঠ একই রকমের হয় না। বর্ণ
বা অক্ষরের এককের বিচারে বাংলা কবিতাকে ৩টি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ তিনটি হলো-
স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত।
ভারতীয় কাব্যশাস্ত্রের ক্রমবিকাশের ধারা
ভারতীয় আর্যদের কাব্য ও সঙ্গীতের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয় বেদকে। এর শুরু হয়েছিল
খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ অব্দের দিকে ঋগ্বেদের আদি সূক্তের মাধ্যমে। এই সময় আর্যপল্লীর
লৌকিক গান এবং অনর্যদের লোকসঙ্গীতের ছন্দ কিরূপ ছিল- প্রমাণাভাবে তা জানা যায় না।
তাই ভারতীয় কাব্যশাস্ত্রের ছন্দের প্রামাণ্য রূপ হিসেবে- বেদের ছন্দকেই উল্লেখ করতে
হয়।
ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারায় বৈদিক ভাষা রূপান্ত্রিত হয়েছিল সংস্কৃত ভাষায়। একই সাথে
সংস্কৃত ভাষার সাথে অনার্যভাষার সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল প্রাকৃত ভাষার। ভারতের
বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতি ভাষাগুলো থেকে জন্ম নিয়েছিল বাংলা, হিন্দ, অহমিয়া, উড়িয়া
ইত্যাদি স্বতন্ত্র ভাষা। ভারতীয় ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারায়- ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের
ছন্দবদ্ধ লোকসাহিত্যের ধারায় সৃষ্টি হয়েছিল স্বতন্ত্র ছন্দ। এই ছন্দগুলোকে শনাক্ত
করার জন্য আমরা প্রায়ই ব্যবহার করে থাকি ভাষার নামে। যেমন- বাংলা ছন্দ, মৈথিলি
ছন্দ, হিন্দি ছন্দ ইত্যাদি।
বাংলা কাব্যের ছন্দের সূচনা হয়েছিল চর্যাপদের মধ্য দিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে তৈরি
হয়েছিল বাংলার আদি ছন্দগুলো। সেখানে সংস্কৃত ছন্দের অক্ষর ও তার মাত্রাভিত্তিক
বিন্যাসের কোনো প্রভাব নেই। যদিও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতো কেউ কেউ সংস্কৃত ছন্দের
আদলে বাংলা কবিতা রচনা করেছিলেন, কিন্তু তা শেষ প্রযন্ত প্রতিষ্ঠা বা জনপ্রিয় হয়ে
ওঠে নি।
সংস্কৃত ছন্দের অক্ষরভিত্তিক ছন্দবিন্যাসের আদলে নজরুল রচনা করেছিলেন ৯টি তাল। এই
তালগুলোর প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গেলে- সংস্কৃতি ছন্দ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা
আবশ্যক। আবার বাংলার গানের ছন্দ বুঝতে গেলে- বাংলা কাব্যের ছন্দ সম্পর্কে কিছুটা
জানা থাকা প্রয়োজন। কারণ রবীন্দ্রসৃষ্ট তালের মূলে ছিল বাংলা কবিতার ছন্দানুসারে
গানে তালের ব্যবহার।