এই ছন্দের বড় ছক হয়েছে ৬টি দোলা দিয়ে। এই ৬টি দোলা বিভাজিত হয়েছে ৩টি দোলার দ্বারা। কবিতার ক্ষেত্রে ৬ মাত্রার দোলার খণ্ডিত অংশগুলোকে বলা হয় পর্ব। গানের ক্ষেত্রে এর নাম পদ। ছন্দের পর্ব বা পদগুলো নানা ধরনের দোলায় সাজানো যেতে পারে। এরই সূত্রে ছন্দের প্রকৃতি পালটে যায়। ৬টি দোলা নিয়ে তৈরি ছন্দ হতে পারে- ।৬।, ২/৪, ৩/৩, ৪/২ ইত্যদি।১ ২ ৩। ৪ ৫ ৬।
৭ ৮ ৯। ১০ ১১ ১২।
১৩ ১৪ ১৫। ১৬ ১৭ ১৮।
১৯ ২০ ২১। ২২ ২৩ ১৪।
সময়ের নিরিখে ছন্দের মানকে প্রাথমিকভাবে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হলো- অনিয়মিত ও নিয়মিত।
দোলার নিয়মিত বা অনিয়মিত গুচ্ছব্দ্ধ রূপই ছন্দের রূপকে প্রকাশ করে। শিল্পকর্মের প্রকরণভেদে ছন্দের প্রকাশিতরূপে ভিন্নতা তৈরি করে। যেমন গানের ছন্দ, কবিতার ছন্দ, চিত্রকর্মের ছন্দ দোলার আদর্শিক রূপ এক হলেও শিল্পকর্মের মাধ্যমের বিচারে তা ভিন্ন ভিন্ন মনে হয়।
সুরের ছন্দ
সুরের ছন্দ তৈরি হয় সুরের প্রবাহের সূত্রে। সুরের মৌলিক ধ্বনিগত উপাদন হলো স্বর, আর
সময় মাপক একক হলো মাত্র।
ধরা যাক, বংশীবাদক ১৬টি আনন্দদায়ক সুর বাজালেন। এই স্বরগুলো হতে পারে−
সা দা পা দা মা পা জ্ঞা মা পা মা জ্ঞা মা জ্ঞা ঋ সা সা।
এই স্বরগুলোর প্রতিটির ভিতরের সময় দূরত্ব যদি সমান হয়, তা হলে প্রতিটি স্বরের সমন্বয়ে একটি দোলা কাজ করবে। এই দোলার নকশা নিচের চিত্রের মতো হতে পারে।
প্রতিটি স্বরের মধ্যবর্তী সময় যতটা ছোটো হবে, তার দোলাও ততট কম হবে। এই কারণে
রাগসঙ্গীতে দ্রুত সপাট তান যান্ত্রিক মনে হয়। কিন্তু বহু আনন্দ মিলে একটি মিশ্র
আনন্দের জন্ম দেয়। ফলে সপাট তান শুনে কান জুড়িয়ে যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে 'আমি' এই
দোলাকে অনুভব করতে পারে না। ছন্দের খেলা অনুভব করা যায় বড় বড় দোলে। কারণ আমি তাকে
শনাক্ত করতে পারে স্বস্তির সাথে।
দোলাকে অনুভব করতে হলে, প্রতিটি দোলার ভিতরে একটি বিরতি রাখা দরকার। এই বিরতি
আনন্দের এক ঘেঁয়েমি থেকে মুক্তি দিয়ে, বৈচিত্র্য প্রদান করে। শিল্পী এই কাজটি করবেন
সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য। সৌন্দর্যের উপাদানসমূহের ভিতরে বিরতি থাকাটা দরকারি।
চিত্রশিল্পে দর্শন-বিরাম যেমন দরকার, সঙ্গীতের ক্ষেত্রের শ্রবণ-বিরামটা দরকার। এর
জন্য স্বর-উৎপাদন বন্ধ করার প্রয়োজন হতে পারে। কণ্ঠের উচ্চতা-সামান্যতা বা
স্বরক্ষেপণ কৌশল দিয়েও তৈরি করা যায়। সঙ্গীতে স্বরসমূহের দ্বারা যে সৌন্দর্য তৈরি
করা হয়, তাতে বৈচিত্র্য আনার জন্য, আনন্দের ছোটো ছোটো গুচ্ছ তৈরি করা হয়। এর ফলে বড়
বড় দোলার সৃষ্টি হয়। ধরা যাক উপরের স্বরগুলোর ভিতর থেকে চারটি করে স্বর নিয়ে চারটি
দল করা হলো। এক্ষেত্রে এর রূপ হবে−
সা দা পা দা | মা পা জ্ঞা মা | পা মা জ্ঞা মা | জ্ঞা ঋা সা সা।
এর ফলে চারটি দোলা নিয়ে চারটি দল তৈরি হবে। একে বলা যেতে পারে গুচ্ছদোলা। গানের পরিভাষায় হবে চার মাত্রার দল। এর দ্বারা হবে চতুর্মাত্রিক দোলা। সুরের বিচারে চতুর্মাত্রিক ছন্দ। এক্ষেত্রে নকশাটা একটু পাল্টে যাবে।
নন্দনতত্ত্বের বিচারে সময়ের ভিত্তিতে স্বরে পরিবর্তনের গুচ্ছদোলা তৈরি করবে আনন্দের দোলা। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বলা হবে মাত্রাগুচ্ছের দোলা তৈরি করবে ছন্দের দোলা। তালের বিচারে এই গুচ্ছবদ্ধ দোলাকে বলা হবে পদ।
কবিতার ছন্দ
কবিতার ছন্দ হলো- কবিতার ধ্বনিসমূহের শৃঙ্খলিত নান্দনিক রূপবিন্যাস। কবিতার
প্রতিটি চরণে যে বর্ণসমূহ রয়েছে, তার উচ্চারণে ধ্বনি-দোলা তৈরি করে। এই দোলাসমূহ
গুচ্ছবদ্ধ করে ছন্দ তৈরি করে। ধরা যাক একটি কবিতার চরণ- .মহাভারতের কথা অমৃত সমান'।
ম | হা | ভা | র | তে | র | ক | থা | অ | মৃ | ত | স | মা | ন |
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ |
এখানে ১৪টি ধ্বনি নিয়ে ধ্বনিগুচ্ছ তৈরি হয়েছে, তা হবে একটি অখণ্ড ছন্দ। এর প্রতিটি দোলাকে বলা হবে মাত্রা। এবার ১৪ মাত্রার এই ছন্দের মধ্যে একটি বিরতি দিয়ে ছন্দটিকে ভাগ করা যায়, তাহলে এর লিখিত রূপ হবে-
ম | হা | ভা | র | তে | র | ক | থা | । | অ | মৃ | ত | স | মা | ন |
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ |
এক্ষেত্রে কবিতার প্রতিটি ধ্বনিগুচ্ছ দুটি ছন্দে বিভাজিত হয়ে যাবে। পুরো বাক্যটি হবে ৬/৪ ছন্ধে নিবদ্ধ। কবিতার ক্ষেত্রে প্রতিটি ভাগকে বলা হয় পর্ব। এই বিচারে কবিতার এই চরণটির ছন্দ হিসেবে বলা হবে- ৬/৪ পর্বের ছন্দ। ছন্দের বিরতিকে বলা হবে 'ছন্দ-যতি'। সাধারণ কবিতার মাঝের যদি হয় অল্পক্ষণের জন্য। একে বলা হয় অল্প-যতি। কিন্তু কবিতার একটি চরণ শেষ হওয়ার পর একটু বড় যতি নেওয়া হয়। একে বলা হয় দীর্ঘ যতি। কবিতার হ্রস্ব যতি নেওয়া অংশকে বলা হয় পর্ব। কবিতার পর্বগুলো উচ্চারণের সময় পর্বের প্রথম বর্ণের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। একে বলা হয় শ্বাসাঘাত। এই বিচারে মহাভারতের কথা অমৃত সমান'-এর ধ্বনিলিপি হবে-
১ | ২ | |||||||||||||
ম | হা | ভা | র | তে | র | ক | থা | । | অ | মৃ | ত | স | মা | ন |
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ |
কবিতার মাত্রা নির্ধারণে ধ্বনি-ঝোঁক একটি বড় ভূমিকা রাখে। এই ধ্বনি-ঝোঁককে বলা হয় অক্ষর। উল্লেখ্য, কবিতায় বর্ণ আর অক্ষর সমার্থক নয়। এখানে বর্ণ হলো- ধ্বনির মৌলিক ধ্বনিসংকেত। অ, আ, ক্, খ্, গ্ ইত্যাদি হলো বর্ণ। পক্ষান্তরে অক্ষর হলো- স্বল্পতম প্রয়াসে বা এক ঝোঁকে শব্দের যে অংশটুকু উচ্চারিত হয়। এর সমার্থক ইংরেজি শব্দ হলো- syllable। বিষয়টি নির্ভর করে ধ্বনিটি কিভাবে উচ্চারিত হবে। ধরা যাকটি শব্দ 'আঁধার'।
কবিতার মাত্রার সময়, গানের মাত্রার সময়ের মতো কঠোর নিয়মে বাঁধা নয়। কবিতার
মাত্রা নির্ধরিত হয়-এক বর্ণ বা একক অক্ষরের বিচারে। এতে প্রতিটি বর্ণ বা অক্ষর যে
একই সময় বিরতীতে উচ্চারিত হবে এমন বাঁধাধরা নিয়ম নেই।
সাধারণভাবে অক্ষর এই নির্ধরিত হলেও বাংলা কবিতায় ছন্দের পাঠ একই রকমের হয় না। বর্ণ
বা অক্ষরের এককের বিচারে বাংলা কবিতাকে ৩টি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ তিনটি হলো-
স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত।
ভারতীয় কাব্যশাস্ত্রের ক্রমবিকাশের ধারা
ভারতীয় আর্যদের কাব্য ও সঙ্গীতের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয় বেদকে। এর শুরু হয়েছিল
খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ অব্দের দিকে ঋগ্বেদের আদি সূক্তের মাধ্যমে। এই সময় আর্যপল্লীর
লৌকিক গান এবং অনর্যদের লোকসঙ্গীতের ছন্দ কিরূপ ছিল- প্রমাণাভাবে তা জানা যায় না।
তাই ভারতীয় কাব্যশাস্ত্রের ছন্দের প্রামাণ্য রূপ হিসেবে- বেদের ছন্দকেই উল্লেখ করতে
হয়।
ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারায় বৈদিক ভাষা রূপান্ত্রিত হয়েছিল সংস্কৃত ভাষায়। একই সাথে
সংস্কৃত ভাষার সাথে অনার্যভাষার সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল প্রাকৃত ভাষার। ভারতের
বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতি ভাষাগুলো থেকে জন্ম নিয়েছিল বাংলা, হিন্দ, অহমিয়া, উড়িয়া
ইত্যাদি স্বতন্ত্র ভাষা। ভারতীয় ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারায়- ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের
ছন্দবদ্ধ লোকসাহিত্যের ধারায় সৃষ্টি হয়েছিল স্বতন্ত্র ছন্দ। এই ছন্দগুলোকে শনাক্ত
করার জন্য আমরা প্রায়ই ব্যবহার করে থাকি ভাষার নামে। যেমন- বাংলা ছন্দ, মৈথিলি
ছন্দ, হিন্দি ছন্দ ইত্যাদি।
বাংলা কাব্যের ছন্দের সূচনা হয়েছিল চর্যাপদের মধ্য দিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে তৈরি
হয়েছিল বাংলার আদি ছন্দগুলো। সেখানে সংস্কৃত ছন্দের অক্ষর ও তার মাত্রাভিত্তিক
বিন্যাসের কোনো প্রভাব নেই। যদিও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতো কেউ কেউ সংস্কৃত ছন্দের
আদলে বাংলা কবিতা রচনা করেছিলেন, কিন্তু তা শেষ প্রযন্ত প্রতিষ্ঠা বা জনপ্রিয় হয়ে
ওঠে নি।
সংস্কৃত ছন্দের অক্ষরভিত্তিক ছন্দবিন্যাসের আদলে নজরুল রচনা করেছিলেন ৯টি তাল। এই
তালগুলোর প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গেলে- সংস্কৃতি ছন্দ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা
আবশ্যক। আবার বাংলার গানের ছন্দ বুঝতে গেলে- বাংলা কাব্যের ছন্দ সম্পর্কে কিছুটা
জানা থাকা প্রয়োজন। কারণ রবীন্দ্রসৃষ্ট তালের মূলে ছিল বাংলা কবিতার ছন্দানুসারে
গানে তালের ব্যবহার।
সঙ্গীতের তাল ও ছন্দ
সম-সময়ে সম-প্রকৃতির ছন্দের আবর্তিত প্রবাহকে সঙ্গীতশাস্ত্রে তাল বলা হয়। সুরের ছন্দিত প্রবাহকে শৃঙ্খলিত করা জন্য, তালের ব্যবহার করা হয়। অসীম গুচ্ছদোলার প্রবাহে সৃষ্ট ছন্দ, কিছু বিধি দ্বারা শৃঙ্খলিত এবং রূপান্তরিত দশায় সঙ্গীতে তাল হয়ে ওঠে। সঙ্গীতের তাল এ ক্ষেত্রে যে বিধিগুলো দ্বারা শৃঙ্খলিত হয়, তা হলো-
১. তাল ধ্বনিময়। একে কখনো কখনো ইশারায় প্রকাশ করা যায় বটে, কিন্তু ধ্বনি ছাড়া তা পূর্ণাঙ্গতা পায় না।
২. তালের রয়েছে সুনির্দিষ্ট ছন্দ, যা সম-সময়ে আবর্তিত হয়।
৩. আবর্তিত ছন্দসমূহ প্রবাহিত হয়, সুরের প্রবাহকে সুষম গতির শৃঙ্খলে।
৪. তালের মাত্রাসমূহের সময় মানকে বলা হয় লয়। একটি সুনির্দিষ্ট লয়ে বাঁধা তালকে কখনো কখনো দ্বিগুণ, তিনগুণ, চারগুণ ইত্যাদি করা যায় বটে, তবে আদি লয়ের আদর্শে করা হয়।
তালের ছন্দ হলো- কিছু দোলার সমষ্টি।
যেমন ১, ২, ৩, ৪,
৫, ৬... একটি দোলা প্রবাহ। এই দোলা প্রবাহী অসীম। এই
দোলা প্রবাহ থেকে সুনির্দিষ্ট সংখ্যক দোলা নিয়ে যখন গুচ্ছবদ্ধ একটি বড় দোলার তৈরি
করা হয়, তখন তা ছন্দে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে আমরা ছন্দের দোলাকে দুটি ভাগে ভাগ করতে
পারি।
১. মৌলিক দোলা: এই দোলা স্বাধীনভাবে একক সত্তা নিয়ে অবস্থান করে।
২. যৌগিক দোলা: যা একাধিক দোলার সমন্বয়ে বড় দোলার সৃষ্টি করে।
এক্ষেত্রে যৌগিক দোলা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি যতি বা বিরাম তৈরি করতে হয়। যেমন- একটি
অসীম দোলা থেকে যদি তিনটি দোলা নিয়ে একটি দোলাগুচ্ছ তৈরি করা যায়, তবে তা হবে-
|১, ২, ৩|
এই দোলাগুচ্ছ একটি ছন্দ তৈরি করবে। এই অসীম দোলা প্রবাহকে একটি ছকে ফেলে দেবে। আর
এই ছক তৈরি হবে একটি যতির মাধ্যম। যেমন-
|১, ২, ৩| ৪, ৫, ৬| ৭, ৮, ৯| ১০, ১১, ১২|.....অসীম
এক্ষেত্রে প্রতিটি ৩টি দোলাবিশিষ্ট দোলাগুচ্ছের পর একটি করে যতি দিতে হবে, তাহলেই
৩টি দোলাবিশিষ্ট বড় দোলাটি ছন্দে পরিণত হবে। এই বড় দোলাটি যখন আবর্তিত হবে,
তখন তা তালে পরিণত হবে।
চিত্রের ছন্দছন্দ: ধা গে তে টে। না ক ধি না।
এখানে ছন্দ আছে কিন্তু আবর্তন নেই। তাই এটি তাল নয়।
তাল: ধা গে তে টে। না ক ধি না। ধা
এখানে ৪।৪ মাত্রার ছন্দকে আবর্তনের পথ দেখিয়েছে 'ধা'।
ধরা যাক, একটি সাদা কাগজে চোখে পড়ার মতো একটি কালো বিন্দু আছে। কেউ যখন এই বিন্দুর দিকে তাকাবে তখন সাদা প্রেক্ষাপটে কালো বিন্দুটি ভালো লাগবে। অবশ্য সাদা রঙের সাথে কালোরঙের বিন্দু দেখার যুগপৎ একটি গতি পাওয়া যাবে। কিন্তু বিন্দুর বিচারে দৃশ্যটি হবে প্রকৃতই স্থির। সাদা রঙকে অগ্রাহ্য করলে এই একটি বিন্দু হবে স্থির এবং একাগ্রতার প্রতীক। এবার যদি পাশাপশি দুটি বিন্দু আঁকা যায়। তাহলে দৃষ্টি দুদিকেই যাওয়া আসা করবে। ফলে একটি আনোগোনার গতি সঞ্চারিত হবে। এর ভিতর দিয়ে একধরনের রৈখিক গতি লাভ করবে। এই রৈখিক গতিই জন্ম দেবে একটি কল্প রেখা। বিন্দু নানাভাবে মনকে রেখা আঁকতে সাহায্য করে। ধরা যাক দুটি অনুভূমিক বিন্দুর নিচে আর একটি বিন্দু আঁকা হয়েছে। দৃষ্টি তিনটি বিন্দুকেই দেখবে একটি চলমান প্রক্রিয়ায়। দৃষ্টির গতির সূত্রে তিনটি রৈখিক গতির সৃষ্টি হবে।
রাতের আকাশে যে বিন্দু বিন্দু তারার আলো ফুটে থাকে,
জ্যোতির্বিজ্ঞানীর তার অনেকগুলো তারার বিন্দুকে রৈখিক অনুভূতি দিয়ে নান রকম চিত্র
কল্পনা করে নিয়েছেন। এর কোনোটি মেষের মতো কোনোটি ষাঁড়ের মতো। এই সব বিন্দু মূলত
দেখার ভিতরে গতির সঞ্চার করে। এবং এর ভিতর দিয়ে মনের প্রেক্ষাপটে রেখার জন্ম দেয়।
সাধারণ জ্যামিতিতে রেখাকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এর একটি সরল, অপরটি বক্র।
সরলরেখার গতি একমুখি, তাই তার ছন্দটা ধরা পড়ে না। কিন্তু চলমান
সরলরেখার গতিপথের দিক পরিবর্তন ঘটলে, ছন্দটা অনুভব করা যায়। সমদূরত্বে যদি গতিপথের
পরিবর্তন ঘটে তাহলে একটি সমদোলার সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ হতে পারে
জিগজ্যাগ রেখা
![]() |
![]() |
![]() |
প্রজাপতির ছবি আঁকতে গেলে, শিল্পী এই ভার সাম্য রাখেন প্রকৃতিকে অনুসরণ করে। কিন্তু নানা রকমের বস্তু দিয়ে শিল্পী যখন একটি চিত্রকর্ম করেন, তখন ভারসাম্যটা তিনি রাখেন, ছবির ছন্দপতন রোধ করার স্বার্থে। এই ভারসাম্যকে মূলত তিনটি সূত্রে রক্ষা করা হয়। এগুলো হলো −
- প্রত্যক্ষ ভারসাম্য (Formal balance): এই জাতীয় ভারসাম্যের কেন্দ্রের দুই পাশে সম আকার এবং সম ওজনের বস্তু রাখা হয়। এর ফলে একটি সুষম ছন্দের সৃষ্টি হয়।
অপ্রত্যক্ষ ভারসাম্য (Informal balance): কোনো কেন্দ্রের দুই পাশে যদি দুটি অসম আকার এবং অসম ওজনের বস্তু রাখা হয়। তাহলে একটি ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়। এই অসুবিধা দূর করার জন্য প্রথমে পুরো চিত্রের একটি কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়। এরপর হাল্কা বা ছোটো বস্তুকে রাখা হয় কেন্দ্র থেকে দূরে এবং ভারি বা বড় বস্তুকে রাখা হয় কেন্দ্রের কাছে। তবে কেন্দ্র থেকে উভয় বস্তুর কোনটি কতদূরে রাখা হবে, তা নির্ধারণ করবেন শিল্পী তার ছন্দবোধ থেকে।
উপরের ছবির মতো করে শিল্পী ছবির কেন্দ্রকে চিহ্নিত করে দেন না। অভিজ্ঞ দর্শক এই জাতীয় ছবির কেন্দ্র কোথায় হতে পারে বিবেচনা করে নেন। একটি নদীর ছবিতে একটি নৌকা কোথায় আঁকলে ছবির ভারসাম্য রক্ষা পাবে, তা শিল্পী মাত্রই জানেন। কিন্তু সেই সাথে দর্শকের যদি এ বিষয়ে ধারণা থাকে, তা হলে ছবি, শিল্পী এবং দর্শক একই ছন্দের তরঙ্গে অবগাহন করতে পারবেন।
অক্ষীয় ভারসাম্য (Radial Balance): উপরের দুটি ভারসাম্য বিবেচনা করা হয়, দৈর্ঘ্য-প্রস্থের বিচারে। কিন্তু বৃত্তাকার বস্তুর ভারসাম্য বিবেচনা করা হয়, বৃত্তের কেন্দ্রের বিচারে।
সজ্জাশৈলী
(arrangement
style)
প্রকৃতির ছন্দের আদলে মানুষ যে ছন্দ তৈরি করে, তাকে কৃত্রিম ছন্দ
বলা যায়। কৃত্রিম ছন্দশিল্পী প্রথমে মনের প্রেক্ষাপটে আঁকেন,
তারপর তাকে বাস্তব কোনো প্রেক্ষাপটে চিত্রিত করেন।
নানাভাবে শিল্পী চিত্রের ছন্দকে উপস্থাপন করেন। যেমন−
পুনরাবৃত্তিজনিত ছন্দ: এক্ষেত্রে একই চিত্রকে বার বার ব্যবহার করে, দৃষ্টির মধ্যে গতি আনা হয়। এর ফলে একটি ছন্দের সৃষ্টি হয়। পুনরাবৃত্তির প্রকৃতির উপর নির্ভর করে, ছন্দের নানা প্রকরণ হতে পারে। যেমন−
সম-পুনরাবৃত্তিজনিত ছন্দ: এক্ষেত্রে একই চিত্রের অভিমুখ না পাল্টিয়ে বার বার ব্যবহার করে, দৃষ্টির মধ্যে গতি আনা হয়। এর ফলে একটি সুষম ছন্দের সৃষ্টি হয়। বাড়ির দেওয়ালে কোনো মূল চিত্রের চারাপাশে বা আল্পনাতে এই পুনরাবৃত্তিজনীত ছন্দ লক্ষ্য করা যায়। পুনরাবৃত্তির প্রকৃতির উপর নির্ভর করে, ছন্দের নানা প্রকরণ হতে পারে। যেমন−
|
- ক্রমবৈপরীতের পুনরাবৃত্তিজনীত ছন্দ: এক্ষেত্রে একই চিত্রের অভিমুখ পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন করে ছন্দ তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে একটি চিত্রের অভিমুখ পাল্টিয়ে দৃষ্টিতে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করা হয়। ফলে একঘেয়েমি থেকে চোখ কিছুটা বিরাম পায়। ক্রমবৈপরীত্যের সৃষ্ট চিত্রকল্পে ছন্দের দোলা চলে উলম্ব এবং অনুভূমিক দিকে পর্যায়ক্রমিক দোলে। কিন্ত একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, দুটি বিপরীতমুখী লক্ষ্যবস্তু একটি 'একক' সৃষ্টি করে এবং এই 'একক'টিরই পুনরাবৃত্তি ঘটে। এই ক্ষেত্রে দুই ধরনের ছন্দ সচল থাকে। ফলে কোন ছন্দটি সে গ্রহণ করবে, তা বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে দর্শকের। নিচে এর একটি নমুনা দেওয়া হলো।
ক্রমোন্নতির ছন্দ: এক্ষেত্রে একটি চিত্রের অভিমুখ ঠিক রেখে পর্যায়ক্রমে আকার পরিবর্তন করে ছন্দ তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রেও একঘেয়েমি থেকে চোখ কিছুটা মুক্তি দেয়, কিন্তু ছন্দ একটি অসীম লক্ষ্যের দিকে ছুটে চলে।
ঘ্রাণের ছন্দ:: ঘ্রাণের অনুভূতি মানুষ
পায় বস্তুর
সূক্ষ্ম উদ্বায়ু অংশের সংস্পর্শে। যে সকল বস্তু থাকে কোনো উদ্বায়ু অংশ বের হয়
না, সেসকল বস্তুর গন্ধ মানুষ পায় না। বস্তুর উদ্বায়ু অংশের কমবেশি উপস্থিতির
কারণে গন্ধের হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে। বস্তু থেকে উদ্গত উদ্বায়ু অংশ সমানভাবে ছড়িয়ে
পড়ে না। এর পিছনে থাকে বস্তু থেকে উৎপন্ন উদ্বায়ু অংশের পরিমাণ এবং বায়ু
প্রবাহ। এই দুইয়ের সংমিশ্রণে কোনো বস্তু থেকে আগত গন্ধ মানুষ একই তীব্রতায় পায়
না। অপ্রিয় গন্ধ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য মানুষ নিজেকে সরিয়ে নেয় বা নাকে
কাপড় চাপা দেয়। তাই অপ্রিয় গন্ধের ছন্দের অনুভব বিচারের যথাযথভাবে ধরা পড়ে না।
কিন্তু সুগন্ধ মানুষকে আনন্দিত করে। ধরা যাক কোনো ফুলের বাগানের পাশে আপনি
দাঁড়িয়ে আছেন। বাতাসের ঢেউয়ে ভর করে সুগন্ধ আপনার নাকে এসে পৌঁছুলো। এর ফলে
স্বাভাবিক ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের স্বস্তি-অস্বস্তি বোধের ভাব থেকে মোহন অনুভূতির
দ্বারা আবেশিত হয়ে আনন্দে পৌঁছে যাবেন। এরপর বাতাসে গন্ধদ্রব্যের উপাদান কমে
গেলে সে আনন্দে ভাটা পড়বে। গন্ধ পাওয়া না পাওয়ার সূত্রে ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের ছন্দের
সৃষ্টি হবে। অবিরাম গন্ধের উপস্থিতি ঘ্রাণের ছন্দকে নষ্ট করে। কারণ
অবিরাম গন্ধ-প্রবাহের কারণে,
ঘ্রাণ-সংগ্রাহক স্নায়ুগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে কোনো গন্ধের
অনুভব প্রথমে যতটা তীব্রভাবে ধরা পড়ে, কিছু সময় পরে তা আর থাকে না। অনেক সময় এই
তীব্রতা কমে গিয়ে গন্ধহীন দশায় উপনীত হয়। তাই ঘ্রাণের ছন্দ পেতে গেলে, বিরতি
দিয় গন্ধ নিতে হয়। মানুষ এই কারণে ফুলকে মাঝে মাঝে নাকের কাছে এনে ফুলের গন্ধ
নেয়। অনেকে নিজের শরীর প্রচুর গন্ধদ্রব্য ঢেলে সুগন্ধী করেন। এরফলে এক সময় নিজে
ওই গন্ধ অনুভব করেন না, কিন্তু আশপাশের মানুষ তা তীব্রভাবে পায়।
স্পর্শের ছন্দ:
মানুষের বহিরাবরণ এবং এর সাথে যুক্ত নখ, চুল স্পর্শ করলে, যে
উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়, তার ভিতর দিয়ে সৃষ্টি হয় স্পর্শের ছন্দ।
স্পর্শমানের প্রকৃতি
অনুসারে মস্তিষ্কে নানা ধরনের অনুভূতির জন্ম দেয়। এই প্রকৃতি নির্ধরিত হয়,
স্পর্শের স্থানের চাপ, তামামাত্রার মান, বেদনা বা সুখানুভূতি।
কঠিন, কোমল, বায়বীয়,
মসৃণ, কর্কশ ইত্যাদির অনুভূতি।
ত্বকের স্নায়ুকোষে আনন্দ, বেদনা, তাপ ও শৈত্য, শুষ্ক ও সিক্তের পৃথক পৃথক বিন্দু
আছে। কোনো গরম দ্রব্য শৈত্যবিন্দুতে স্পর্শ করলে গরম অনুভূত হবে না। তাই
মস্তিষ্কে যে অনুভূতির জন্ম দেয় সেটাই বড় কথা।
স্পর্শের তীব্র এবং হ্রাসকৃত অবস্থার মধ্য দিয়ে যে অনুভূতির তরঙ্গ সৃষ্টি হয়,
তা হলো স্পর্শের ছন্দ। মানুষ অস্বস্তির অনুভূতি থেকে স্বস্তির অনুভূতিতে আসতে
চায় তার সহজাত প্রবৃত্তিতে। স্বস্তি-অস্বস্তির গড় মানে তৈরি হয় স্বাভাবিক
ভালোলাগার অনুভূতি। এই দুই দশার তীব্রতায় সৃষ্টি হয় আনন্দ-বেদনা। এই দুই বিপরীত
মেরুর অনুভূতির উত্থান পতনে তৈরি হয় স্পর্শের ছন্দ। কোনো বিশেষ অনুভূতির
তীব্রতর দশা তৈরি করে এর শীর্ষবিন্দু আর নিম্নতম দশা সৃষ্টি করে পাদবিন্দু। যখন
পর্যায়ক্রমে এই দশার পরিবর্তন ঘটতে থাকে, তখন সেখানে স্পর্শের ছন্দ তৈরি হয়।
কোন এক গরমের দিনে, প্রবাহিত ঠাণ্ডা বাতাস শরীরের স্বস্তির অনুভব সৃষ্টি করে।
খোলা মাঠে বাতাসে পর্যায়ক্রমিক প্রবাহে এই জাতীয় অনুভব ধরা পরে। এর মধ্য দিয়ে
স্পর্শের ছন্দ তৈরি হয়। তবে এই ছন্দ অনিয়মিত। একইভাবে শীতকালে গরম বাতাস,
সুখদায়ক নরম বিছানা, প্রিয়জনের স্পর্শ অনিয়মিত ছন্দে উপস্থাপিত হয়। মানুষের
যৌনকর্মে রয়েছে এমনি স্পর্শের ছন্দ।