সাইকি
গ্রিক
saɪki>
ইংরেজি
Psyche>বাংলা সাইকি।

সাইকির পাথরের মূর্তি

পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক রূপকথাধর্মী গ্রিক ও রোমান সাহিত্যের একটি চরিত্র। গ্রিক লোককথায় আদি দেবতা এরসকে এ্যাফ্রদাইতি'র পুত্র এবং প্রেমের দেবতা হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই কাহিনীগুলোতেই পাওয়া যায় অজ্ঞাত পরিচয় রাজার কন্যা সাইকির সাথে এরসের রোমান্টিক গল্প রোমান সাহিত্যে এই গল্পটি বিস্তরিতভাবে পাওয়া যায়। কিন্তু সত্যিকার অর্থে- এই গল্পটি পূর্ণাঙ্গরূপে পাওয়া যায়, ল্যাটিন ভাষায় Lucius Apuleius কর্তৃক লিখিত The Golden Ass (Asinus aureus) নামক উপন্যাসে। সাধারণভাবে এই গল্পকে চিহ্নিত করা হয় 'The Tale of Amour and Psyche and The Tale of Eros and Psyche' নামে।

William Adolphe Bouguereau কর্তৃক অঙ্কিত ছবি

এই রূপকথা অনুসারে জানা যায়,  সাইকি ছিলেন একজন অজ্ঞাত পরিচয় রাজার কন্যা। এঁরা ছিলেন তিন বোন। ইনি এতটাই রূপবতী ছিলেন যে, অনেকে মনে করতেন যে, প্রেমের দেবী এ্যাফ্রদাইতি সাইকির ছদ্মবেশে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন। যুবকরা তাঁর কাছে প্রেম নিবেদনের পরিবর্তে দেবী মনে করে তাঁকে পূজা করতেন। ক্রমে ক্রমে তাঁর সৌন্দর্যের খ্যাতি চারিদিক ছড়িয়ে পড়লে, সাধারণ মানুষ এ্যাফ্রদাইতি'র বদলে তাঁকেই পূজা করা শুরু করে। ফলে এ্যাফ্রদাইতি সাইকির প্রতি অত্যন্ত ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। তাই তিনি সাইকিকে শাস্তি দেবার জন্য তাঁর পুত্র এরসকে (রোমান নাম কিউপিড) ডেকে বললেন, তুমি সাইকির মনে এমনভাবে প্রেমের সঞ্চার করো, যেন সাইকি একটি অজ্ঞাতকুলশীল, অখ্যাত, দুর্ভাগা, নির্বোধ, ভীরু মানুষের প্রতি আসক্ত হয়। যার ফলে সাইকি তাঁর সকল গৌরব হারায়। এরস তাঁর মায়ের আদেশে সাইকির কাছে এসে, তাঁর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন এবং সাইকির প্রেমে পড়ে যান। এই কারণে, ইনি এ্যাপোলো'র সাহায্য কামনা করেন।

এদিকে সাইকির পিতা সাইকির স্বামী কে হবেন তা জানার জন্য
, মাইলিটাস-এর
এ্যাপোলোর মন্দিরে যান। এরসকে সহায়তা করার জন্য, এ্যাপোলো সাইকির পিতাকে জানান যে পাহাড়ের চূড়ায় একটি ভয়ঙ্কর দৈত্যের সাথে তাঁর বিবাহ হবে।   

John William Waterhouse -অঙ্কিত ছবি। সাইকি এরসের (কিউপিড) বাগানে প্রবেশ করেছেন।

William Adolphe Bouguereau -অঙ্কিত ছবি।

সাইকির পিতা অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত মনে এই বাণী মেনে নিয়ে সাইকিকে পাহাড়ের চূড়ায় রেখে আসেন। সাইকি অত্যন্ত ভয় ও হতাশায় এই পাহাড়ের চূড়ায় বসে কাঁদতে থাকেন। এই সময় এরস পশ্চিমা বাতাসের দেবতা জেফিরাস-এর সাহায্য নেন। জেফিরাস সাইকিকে অচেতন করে শূন্যে তুলে ধরেন এবং একটি নির্জন উপত্যাকায় এরসের  তৈরি প্রাসাদে নিয়ে আসেন। জেফিরাস সাইকিকে একটি পুষ্পশয্যায় রেখে চলে যান। সাইকি জেগে উঠে তাঁর নূতন অবস্থান দেখে আশ্চর্য হন এবং একই সাথে অজ্ঞাত দানবের ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে তার প্রতীক্ষা করতে থাকেন। সাইকি কৌতুহলী হলে, প্রাসাদ ভ্রমণ করতে থাকলেন, কিন্তু কারও দেখা পেলেন না। একসময় অজ্ঞাত এক কণ্ঠস্বর তাঁকে জানালো যে, এই প্রাসাদ তাঁর (সাইকির) জন্য নির্ধারিত হয়েছে। কণ্ঠস্বরের নির্দেশ মতো সাইকি  স্নান ও খাদ্যগ্রহণ ইত্যাদি শেষ করে বিবাহের উপযোগী সাজে নিজেকে সজ্জিত করলেন। তারপর বিশ্রামের জন্য শয়নকক্ষে গেলেন এবং অচিরেই ঘুমিয়ে পড়লেন। রাত্রির অন্ধকারে সাইকি অজ্ঞাত পুরুষের স্পর্শে জেগে উঠলেন। উল্লেখ্য এই পুরুষই ছিলেন এরস

এরস তাঁর বাক্য ও আচরণের দ্বারা সাইকির মনের ভয় দূর করলেন। অন্ধকারের ভিতর  সাইকি দানব স্বামীর চিন্তা ক্রমে দূর হয়ে গেল। ইনি কল্পনার চোখে এরসকে হৃদয়বান ও সুদর্শন স্বামী হিসাবে গ্রহণ করলেন এবং এরসের সাথে মিলিত হলেন। বাসরশয্যা শেষে রাত্রির অন্ধকার থাকতেই এরস চলে গেলেন। সেই কারণে সাইকি তাঁর স্বামীকে দেখতে পেলেন না। এই ভাবে প্রতিরাত্রেই সাইকি এরসের সাথে মিলিত হতেন এবং রাত্রি শেষে এরস সাইকিকে দেখা না দিয়েই চলে যেতেন।

কিছুদিন এইভাবে কেটে যাবার পর
, সাইকি নিজেকে একটি অতুলনীয় প্রাসাদে বন্দী আছেন ভেবে কষ্ট পেতে লাগলেন। একই সাথে তিনি তাঁর দুই বোনকে দেখার জন্য উতলা হয়ে উঠলেন। ইনি
এরসের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন এবং তাঁকে দেখার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। এরস তাঁর পরিচয়ও দিলেন না বা তাঁর দেখাও দিলেন না। এরপর সাইকি তাঁর বোনদের সাথে দেখা করিয়ে দেবার জন্য এরসকে বললেন। উত্তরে এরস বললেন যে, তাঁর বোনদের সাথে দেখা হলে তাঁর ফলাফল শুভ হবে না। কিন্তু সাইকির ক্রমাগত তাড়নায় একসময় এরস সাইকির সাথে তাঁর বোনদের দেখা করার ব্যবস্থা করে দিলেন।

পরদিন জেফিরাস
সাইকির বোনদের প্রাসাদে নিয়ে এলেন। দীর্ঘদিন পর বোনদের সাথে দেখা হওয়ায় সাইকি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। কিন্তু বোনরা আনন্দিত হলেন না। কারণ, এই অতুলনীয় প্রাসাদ দেখে তাঁরা অত্যন্ত ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠলেন। তাঁরা সাইকির স্বামীর কথা জিজ্ঞাসা করলেন। সাইকি যখন রাত্রের অন্ধকারে স্বামী-সমাগমের কথা জানালেন এবং তাঁকে সাইকি কখনো দেখেন নি জানালেন, তখন দুই বোন আরও বেশি বিস্মিত হলেন। প্রথমবারের এই ভ্রমণ শেষে বোনরা চলে গেলে, সাইকি আবার নিসঙ্গ হয়ে পড়লেন। দ্বিতীয়বারের মতো তাঁর বোনরা সাইকিকে দেখতে এসে বললেন যে, এ্যাপোলোর ভবিষ্যৎ বাণী অনুসারে সাইকির স্বামী একজন দানব ছাড়া কিছুই নয়। এই জন্য সে রাতের অন্ধকার ছাড়া দিনের আলোয় দেখা দেয় না। এরপর দুই বোন মিলে এই দানবের কাছ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সাইকিকে বিভিন্ন রকমের পরামর্শ দিলেন। অবশেষে বোনদের পরামর্শে সাইকি শয়ন কক্ষে বাতি ও একটি চাকু লুকিয়ে রাখলেন। উদ্দেশ্য হলো, রাতের বেলা এরস ঘুমিয়ে পড়লে সাইকি বাতি জ্বেলে তাঁকে দেখবেন এবং তাঁর স্বামী যদি সত্যিই দানব হয় তবে চাকু দিয়ে তাকে হত্যা করবেন।

যথারীতি সে রাতে
এরস সাইকির কাছে এলেন এবং আগের মতোই তাঁর দীর্ঘ সময় ধরে পরস্পরকে উপভোগ করলেন এবং অন্যান্য রাত্রি মতোই এক সময় এরস সাইকির বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লেন। এই সুযোগে সাইকি বাতি জ্বালিয়ে বিছানার কাছে এসে সর্পাকৃতির কোন দানবের পরিবর্তে সুদর্শন এরসকে দেখতে পেয়ে বিহ্বল হয়ে পড়লেন। তারপরেও ইনি এরসের তীরের ধার পরীক্ষা করার জন্য, আঙুল দিয়ে তীরের অগ্রভাগে চাপ দিলেন। এর ফলে তাঁর আঙুল থেকে একফোটা রক্ত বেড়িয়ে এলো। প্রেমের এই তীর বিদ্ধ হওয়ার পর সাইকির ভিতর তীব্র যৌনাকাঙ্ক্ষাসহ ভালবাসার সৃষ্টি হলো। ইনি হিতাহিত জ্ঞান শূন্যহয়ে এরসের দিকে অগ্রসর হলেন। এই সময় তাঁর হাতের বাতি ছিটকে গিয়ে এরসের কাঁধ স্পর্শ করলো। এর ফলে এরস জেগে উঠলেন এবং কোন কথা না বলে দ্রুত তাঁর পাখা প্রসারিত করে চলে যাবার উদ্যোগ নিয়ে শূন্যে উঠে পরলেন। কিন্তু সাইকি এরসের পা জড়িয়ে ধরলে, এরস পুনরায় মাটিতে নেমে এলেন। পরে ইনি সাইকির প্রতি এ্যাফ্রদাইতির ঈর্ষা, এ্যাফ্রদাইতির নির্দেশ উপেক্ষা করে সাইকির প্রতি তাঁর প্রেম ইত্যাদি বললেন। এরপর এরস পাখা মেলে সাইকির কাছ থেকে বিদায় নিলেন। এই সময় এই প্রাসাদ ও তার সকল উপকরণ অদৃশ্য হয়ে যায়।

এরপর সাইকি সেই উপত্যকা থেকে তাঁর বড়বোনের কাছে চলে আসেন। উল্লেখ্য তাঁর বড় বোন ছিলেন শ্যাবি রাজ্যের রাণী। এখানে তাঁর বোন আশ্রয় না দিলে ইনি আবার পাহাড়ের উপর উঠে আসেন। এরপর
এরস এবং এ্যাফ্রদাইতির সাহায্য চান। এরস সাইকির বোনদের শাস্তি প্রদান করেন। এরপর সাইকি এরসের সন্ধানে বিভিন্নস্থানে ভ্রমণ করতে থাকেন। এই সময় এরসের প্রেম-রোগে আক্রান্ত হয়ে নিজেকে স্বর্গে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। এর ফলে, পৃথিবী ক্রমান্বয়ে নিরানন্দে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এই সময় সন্তান, বন্ধু, প্রেমাস্পদ ইত্যাদির প্রতি ভালবাসা কমে গিয়েছিল।

এ্যাফ্রদাইতি তাঁর পুত্রের এই অবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রকৃত ঘটনা জানতে পারলেন। তিনি যখন জানতে পারলেন যে, এরসের প্রেমিকা হলেন তাঁরই বিরাগভাজন সাইকি, তখন ইনি অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন। সেই কারণে ইনি সাইকিকে শাস্তি দিতে মনস্থির করলেন। প্রথমে ইনি সাইকিকে ধরে দেবার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করলেন।  অবশেষ ওল্ড হ্যাবিট নামক জনৈক লোক সাইকিকে ধরে এ্যাফ্রদাইতির হাতে তুলে দেন। এ্যাফ্রদাইতি সাইকিকে পুত্রবধু করার জন্য কয়েকটি শর্ত আরোপ করলেন। এক্ষেত্রে প্রথম শর্ত হিসাবে তিনি সাইকিকে কিছু মিশ্রিত শস্য দিয়ে তা সূর্যাস্তের আগেই তা পৃথক করতে বললেন। কিন্তু কিছু পিঁপড়ার সহায়তায় কাজটি শেষ করতে সক্ষম হলেন। এরপর সাইকিকে একপাল হিংস্র জাদুর ভেড়ার সোনালী পশম সংগ্রহ করতে বললেন। এক জলপরীর সহায়তায় ইনি এ কাজটিও শেষ করতে সক্ষম হলেন। এরপর তাঁকে ড্রাগন পরিবেষ্ঠিত এক স্টিক্স ঝর্না থেকে পানি আনতে হবে। এক্ষত্রে জিউসের ঈগল তাঁকে সাহায্য করলেন। এরপর এ্যাফ্রদাইতি তাঁকে পাতালের মৃত্যুপুরীর রানী পার্সেফনির রূপের বাক্স আনার কাজ দিলেন। উল্লেখ্য পার্সেফনি তাঁর রূপের কিছু অংশ একটি বাক্সের ভিতর রাখতেন। প্রয়োজনীয় মুহুর্তে ইনি এই বাক্স খুলে তাঁর রূপ বৃদ্ধি করতেন। 

John William Waterhouse -অঙ্কিত ছবি। সাইকি পার্সেফোনির দেওয়া রূপের বাক্স খুলছেন।

সাইকি প্রথমে ভাবলেন, একটি টাওয়ার থেকে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে সরাসরি মৃত্যুপুরীতে পৌছে যাবেন। কিন্তু টাওয়ার তাঁকে এক কাজ করতে নিষেধ করলেন এবং মৃত্যু পুরীতে যাবার পথ বলে দিলেন। ইনি পাতালের কুকুরকে সন্তুষ্ট করার জন্য মধুতে ভিজিয়ে বার্লির রুটি নিলেন। এছাড়া পাতালের প্রবেশ পথের নদীর মাঝি ক্যারোনকে ঘুষ দেবার জন্য দুটি মুদ্রা নিলেন। সাইকি একটি মুদ্রা ক্যারোনকে দিয়ে নদী পার হলে নরকের দরজার কাছে এলেন। সেখানে প্রহরী কুকুরকে পিঠা দিয়ে দরজা পেরিয়ে পার্সেফনির কাছে এলেন। পার্সেফনি তাঁকে বসার জন্য একটি কুশনযুক্ত চেয়ার এগিয়ে দিলেন। কিন্তু ইনি টাওয়ারের পরামর্শ অনুসারে চেয়ারে না বসে পার্সেফনির সামনে মাটিতে বসলেন। কারণ যদি কেউ মৃত্যুপুরীর এই চেয়ারে উপবেশন করে, তবে সে তার অতীত জীবনের সকল কথা ভুলে যায়। এরপর পার্সেফনি তাঁর সামনে খাবার পরিবেশন করলে, সাইকি তা প্রত্যাখ্যান করলেন। কারণ যদি কেউ মৃত্যুপুরীর খাবার গ্রহণ করে, তাহলে তাঁকে চিরকাল মৃত্যুপরীতে থেকে যেতে হয়। এরপর পার্সেফনি সাইকির মৃত্যুপুরীতে আসার  কারণ জিজ্ঞাসা করলে, সাইকি সকল বিষয় তাঁকে বলেন। সবশুনে পার্সেফনি তাঁর রূপের বাক্সটি সাইকি উপহার হিসাবে প্রদান করেন। মৃত্যুপুরী থেকে ফেরার পথে, সাইকি তাঁর সৌন্দর্যকে বৃদ্ধির জন্য এই রূপের কৌটা খুললেতিনি এর ভিতরে কোন সৌন্দর্যের সামগ্রী দেখতে পেলেন না। পক্ষান্তরে ইনি গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লেন। এরপর এরস সাইকির অচেতন দেহের কাছে এসে, তাঁকে তীরের আঘাতে জাগরিত করলেন। এরস এ্যাফ্রদাইতি'র ভয়ে অত্যন্ত চিন্তান্বিত হয়ে পড়েন। পরে তিনি সাইকিকে নিয়ে দেবরাজ জিউস-এর কাছে গেলেন। যদিও জিউস অনেক বার এরসের তীরের আঘাতে উত্তেজিত হয়ে অপদস্ত হয়েছেন, তারপরেও এই বিবাহে তিনি অনুমতি দিলেন। জিউস সাইকিকে অমরত্ব দান করে দেবী হিসাবে স্বীকৃত দেওয়ার জন্য দেবসভা আহ্বান করলেন। দেবসভার সম্মতিতে সাইকি অমরত্ব লাভ করেন এবং এরসের সাথে তাঁর বিবাহ হয়।


সূত্র :

http://www.paleothea.com/
greek myth
/Robert Graves, cassel & comoany, fourth edition 1995
Mythology/Edith Hamilton/New American Library, 1969
http://www.pantheon.org/areas/mythology/europe/greek/