সত্যবতী
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা { পৌরাণিক সত্তা | কাল্পনিকসত্তা | কল্পনা | সৃজনশীলতা | দক্ষতা | জ্ঞান | মনস্তাত্ত্বিক বিষয় | বিমূর্তন | বিমূর্ত-সত্ত | সত্তা |}

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিতে এই নামে একাধিক চরিত্র পাওয়া যায়।
. মহাভারতের একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র বিশেষ
অন্যান্য নাম: গন্ধবতী, মৎস্যগন্ধা, যোজনগন্ধা।

আদিতে ইনি মৎস্যগন্ধা নামে পরিচিতা ছিলেন পরে সত্যবতী নাম প্রাপ্ত হন চেদিরাজ উপরিচরের বীর্যে মৎস্যরূপী অদ্রিকার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে

ইনি অত্যন্ত সুন্দরী হলেও গায়ে ছিল মাছের গন্ধ সেই কারণে ইনি মৎস্যগন্ধা নামে পরিচিতা হন সত্যবতী শৈশব থেকেই জেলেদের সাথে যমুনানদীতে খেয়া পরাবারে কাজ শুরু করেন যৌবনে উপনীত হলে পারাপারে কাজটি তিনি একাই করতেন এই সময় একদিন পরাশর মুনি তীর্থ শেষ করে ঘুরতে ঘুরতে যমুনা তীরে আসেন এবং অপর পারে পৌঁছার জন্য সত্যবতীর নৌকায় উঠেন সত্যবতীর সৌন্দর্যে মুনি মোহিত হয়ে তাঁর কাছে সঙ্গম প্রার্থনা করেন। সত্যবতী প্রকাশ্যে এরূপ মিলনে আপত্তি জানালে, মুনি সাথে সাথে নদীতে কুয়াসার সৃষ্টি করে আবরণ সৃষ্টি করলেন সত্যবতী নিজেকে অবিবাহিতা এবং পিতার অধীন হিসাবে নিজের পরিচয় দিলেন এবং সঙ্গমে তাঁর কন্যাভাব দুষিত হওয়ার কথা বলে আপত্তি করেন কিন্তু পরাশর জানান যে, তাঁর সাথে মিলিত হলে কন্যাভাব নষ্ট হবে না এরপর সত্যবতী তাঁর শরীরের দুর্গন্ধ দূর করে দেওয়ার কথা বললে, পরাশর তাঁর দেহ সুগন্ধে পূর্ণ করে দেন এরপর সত্যবতী সম্মতি প্রদান করলে, পরাশর তাঁর সাথে মিলিত হন পরবর্তীকালে সত্যব্তীর সুগন্ধী গাত্রঘ্রাণ প্রাপ্তির কারণে ইনি গন্ধবতী নামে খ্যাত হন আবার এক যোজন দূর থেকে এঁর গায়ের গন্ধ পাওয়া যেতো বলে, এর অপর নাম ছিল যোজনগন্ধা

পরাশরের সাথে মিলনের ফলে, সত্যবতী  গর্ভবতী হন পরে যমুনা'র একটি দ্বীপে তিনি একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেন। এই সন্তানের গায়ের রঙ কালো এবং যমুনার দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন বলে এর নাম রাখা হয় কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন এই পুত্রই পরে ব্যাসদেব নামে খ্যাত হনউল্লেখ্য, পরাশর মুনির বরে সন্তানপ্রসবের পরেও সত্যবতী পুনরায় কুমারীতে রূপান্তরিত হন

[সূত্র : মহাভারতআদিপর্ব। ত্রিষষ্টিতম অধ্যায়। মৎস্যগন্ধার উৎপত্তিব্যাসের জন্মবৃত্তান্ত]

এর কিছুদিন পর হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনু ভ্রমণ করতে করতে সত্যবতীর শরীরের গন্ধ পান উক্ত গন্ধ অনুসরণ করে ইনি সত্যবতীর বাসস্থানে আসেন এবং   সত্যবতীর পরিচয় পেয়ে শান্তনু তাঁকে বিবাহ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন সত্যবতীর পালক পিতা শর্তসাপেক্ষে বিবাহে রাজি হন শর্তটি ছিল সত্যবতীর গর্ভজাত সন্তানকে রাজ্যদান করতে হবে শান্তনু তাতে রাজী হলেন না, কারণ তাঁর প্রথমা স্ত্রী'র গর্ভজাত পুত্র ভীষ্মই ছিল রাজ্যের প্রকৃত দাবিদার রাজপুত্র ভীষ্ম পিতার মন খারাপের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করে প্রকৃত বিষয় জানতে পেরে নিজে উদ্যোগী হয়ে তাঁর পিতার বিবাহের আয়োজন করেন ইনি নিজে সত্যবতীর পালক পিতার কাছে প্রতিজ্ঞা করেন রাজ্যের অধিকার সত্যবতীর পুত্রদের জন্য দান করবেন এবার ইনি বলেন যে, ভীষ্ম এই অধিকার ছাড়লেও ভবিষ্যতে ভীষ্মের পুত্ররা এই অধিকার নিয়ে উপস্থিত হতে পারে তখন ভীষ্ম দ্বিতীয় প্রতিজ্ঞা করে বলেন যে, ইনি কখনো বিবাহ করবেন না এরপর সত্যবতীর সাথে শান্তনুর বিবাহ হয় এই বিবাহের ফলে সত্যবতী'র চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে দুটি পুত্র জন্মে ছোট ছেলের জন্মের অল্পকিছুকাল পরে শান্তনু মৃত্যুবরণ করেন
   
ভীষ্ম সত্যবতীর অনুমতি নিয়ে চিত্রাঙ্গদকে সিংহাসনে বসান চিত্রাঙ্গদের সাথে গন্ধর্ব চিত্রাঙ্গদের যুদ্ধ হলে সত্যবতী-পুত্র চিত্রাঙ্গদ নিহত হন।  এরপর ভীষ্ম সত্যবতীর অনুমতি নিয়ে বিচিত্রবীর্যকে সিংহাসনে বসান বিচিত্রবীর্যের বিবাহের জন্য ভীষ্ম কাশীরাজের তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে হরণ করে আনেন এরমধ্যে অম্বিকা ও অম্বালিকার সাথে বিচিত্রবীর্যের বিবাহ হয়  
   
উভয় স্ত্রীর সাথে অমিত যৌনাচারে বিচিত্রবীর্য অপুত্রক অবস্থায় যক্ষ্মরোগে মৃত্যুবরণ করেন ফলে বংশরক্ষার জন্য সত্যবতী ভীষ্মকে এই বিধবা বৌ-দের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করতে বলেন ভীষ্ম প্রতিজ্ঞার কথা উল্লেখ করে এই প্রস্তাবে রাজি না হলে সত্যবতী তাঁর প্রথম পুত্র ব্যাসদেবের দ্বারা এই দুই পুত্রবধূর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুকে জন্মগ্রহণ করান এই দুই পুত্র বিশেষ কারণে পরিপূর্ণ সুস্থ না হওয়ায় সত্যবতী তৃতীয়বার ব্যাসদেবকে পুত্রবধূদের কাছে প্রেরণ করেন এবার বধুরা কৌশলে ব্যাসদেবের কাছে একজন দাসীকে পাঠান এই দাসীর গর্ভে বিদুরের জন্ম হয় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পূর্বে ব্যাসদেবের প্রেরণায় সত্যবতী বনবাসিনী হয়ে তপস্যা শুরু করেন এবং এই ভাবে ইনি তাঁর বাকি জীবন অতিবাহিত করেন

ঋচীক মুনির স্ত্রী ও জমদগ্নির মা কুশিক-পুত্র গাধি বনে তপস্যা করার কালে সত্যবতী নামক এই কন্যার জন্ম হয় ঋচীক নামক এক ঋষি এই কন্যাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিলে, গাধি কন্যা পণ হিসাবে এক হাজার কালো ঘোড়া দাবি করেন ঋচীক বরুণ দেবতাকে সন্তুষ্ট করে এক হাজার ঘোড়া সংগ্রহ করে গাধির কাছে এলে, গাধি ঋচীকের হাতে কন্যা সমর্পণ করেন ঋচীকের পিতা ভৃগু পুত্রবধু সত্যবতীকে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে বর প্রদান করতে ইচ্ছা করলে সত্যবতী তাঁর নিজের জন্য তপোনিষ্ঠ পুত্র ও তাঁর মায়ের জন্য অমিত বলশালী পুত্র প্রার্থনা করেন ভৃগু তথাস্তু' বলে লাল ও সাদা রঙের দুটি চরু দান করে বলেন যে ঋতু স্নান শেষে তুমি ও তোমার মা এই চরু আহার করবে এই চরু দুটির মধ্যে সাদা রঙেরটি ছিল সত্যবতীর জন্য এবং লাল রঙেরটি ছিল তাঁর মায়ের জন্য কিন্তু সত্যবতীর মায়ের কৌশলে এই চরু বদল করে গ্রহণ করে পরে ভৃগু এই বিষয় অবগত হয়ে জানান যে সত্যবতীর পুত্র হবে ক্ষত্রিয়চারী ব্রাহ্মণ এবং তাঁর মায়ের পুত্র হবে ব্রাহ্মণচারী ক্ষত্রিয় পরে সত্যবতী জমদগ্নির জন্ম দেন এবং সত্যবতীর মায়ের গর্ভে জন্ম হয়েছিল বিশ্বামিত্র।  ঋচীকের ঔরসে সত্যবতীর গর্ভে আরো দুটি পুত্র জন্মেছিল এঁরা হলেন শুনঃশেফ ও শুনঃপুচ্ছ স্বামী ঋচীকের সশরীরে স্বর্গে যাবার পর ইনি লোকের উপকারের জন্য কৌশিক বা কুশী নদী হয়ে হিমালয় থেকে প্রবাহিত হচ্ছেন

. ইনি দেবর্ষি নারদের মা কথিত আছে, ব্রহ্মার অভিশাপে নারদকে মানুষ হিসাবে জন্মগ্রহণ করতে হয়েছিল সেই সময় নারদ এই নারীর গর্ভে জন্মেছিলেন


সূত্র :
মহাভারত বেদব্যাস বিরচিত গ্রন্থ। কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত। তুলি-কলম। জ্যৈষ্ঠ, ১৩৯৪। জুন, ১৯৮৭।