কৃষ্ণদ্বৈপায়ন
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা {হিন্দু
পৌরাণিক মানব|
হিন্দু পৌরাণিক সত্তা |
ভারতীয় পৌরাণিক সত্তা |
পৌরাণিক সত্তা |
অতিপ্রাকৃতিক সত্তা |
কাল্পনিক সত্তা |
কল্পনা
|
সৃজনশীলতা |
কর্মক্ষমতা |
জ্ঞান |
মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা |
বিমূর্তন
|
বিমূর্ত-সত্তা |
সত্তা | }
অন্যান্য নাম: কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন,
দ্বৈপায়ন,
বাদরায়ণ,
বেদব্যাস, ব্যাস।
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে— ঋষি বিশেষ। ইনি
পৌরাণিক
মহাকাব্য মহাভারত,
অষ্টাদশ
মহাপুরাণ ও উপপুরাণ,
বেদান্তদর্শন,
ভাগবত
প্রভৃতির রচয়িতা এবং বেদের বিভাগকর্তা ঋষি।
যমুনানদীতে খেয়া নৌকার ভিতর
পরাশর
মুনি
সত্যবতী'র
(মৎস্যগন্ধা) সাথে মিলিত হলে,
সত্যবতী
গর্ভবতী হন।
পরে যমুনা'র
একটি দ্বীপে এঁর জন্ম হয়।এই
সন্তানের গায়ের রঙ কালো এবং
যমুনার দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন বলে এর নাম রাখা হয়
কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন।
এঁর মাথায় কপিল বর্ণের জটা ছিল।
তাঁর চোখ ছিল উজ্জ্বল ও মুখে পিঙ্গল বর্ণের দাড়ি ছিল।
তিনি তপস্যাবলে মহর্ষিত্ব প্রাপ্ত হয়ে বেদকে চার ভাগে ভাগ করেছিলেন।
এই কারণে ইনি বেদব্যাস বা ব্যাস নামে পরিচিত হন।
জন্মের পরপরই তিনি তাঁর মায়ের অনুমতি নিয়ে তপস্যার জন্য যাত্রা করেন।
এঁর তপস্যার স্থান ছিল বদরিকাশ্রম।
এই কারণে তিনি বাদরায়ণ নামেও পরিচিত ছিলেন।
[সূত্র :
মহাভারত
।
আদিপর্ব।
ত্রিষষ্টিতম অধ্যায়।
ব্যাসের জন্মবৃত্তান্ত]
মহাভারতের মতে–
তিনি মহাভারত লিপিবদ্ধ করার জন্য ব্রহ্মার কাছে একজন লিপিকার নিয়োগের পরামর্শ গ্রহণ
করতে গেলে, ব্রহ্মা গণেশকে নিয়োগ করতে বলেন।
গণেশ এই শর্তে লিপিকার হতে সম্মত হলেন যে,
লিপিবদ্ধ করার
সময় তিনি ক্ষণমাত্রও থামবেন না।
ব্যাস তাতে রাজী হয়ে অপর একটি শর্ত জুড়ে দিয়ে বললেন যে,
গণেশ
কোন বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণ না বুঝে লিপিবদ্ধ করতে পারবেন না।
এরপর গণেশ এই শর্তে রাজী হলে–
মহাভারত লিখা শুরু হয়।
ব্যাসদেব তাঁর শ্লোক রচনার মাঝে মাঝে কিছু জটিল শ্লোক রচনা করেতন- গণেশ এই
শ্লোকগুলির অর্থ বুঝে লিখতে যে সময় ব্যয় করতেন,
সেই
সময়ের মধ্যে ব্যাসদেব আরও অনেক শ্লোক বানিয়ে ফেলতেন।
[সূত্র :
মহাভারত।
আদিপর্ব।
অনুক্রমণিকাধ্যায়।
ভারতলেখনার্থ গণেশের স্মরণ
]
এঁর মা- সত্যবতী'র
সাথে পরবর্তী সময়ে শান্তনু নামক এক রাজার বিবাহ হয়।
সত্যবতীর গর্ভে চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে দুই সন্তান জন্মের পর শান্তনুর
মৃত্যু হয়।
এরপর সত্যবতীর সৎপুত্র ভীষ্ম,
তাঁর বৈমাত্রেয়
এই ভাই দুটিকে লালন পালন করেন।
ভীষ্ম চিত্রাঙ্গদকে সিংহাসনে বসান।
তিন বৎসর রাজত্ব করার পর চিত্রাঙ্গদ, এক গন্ধর্বের সাথে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন।
এরপর ভীষ্ম বিচিত্রবীর্যকে সিংহাসনে বসান।
ভীষ্ম কাশীরাজের তিন কন্যাকে স্বয়ংবর সভা থেকে অপহরণ করে,
দুই
কন্যার (অম্বিকা ও অম্বালিকা।)
সাথে তাঁর বিবাহ দেন।
ইন্দ্রিপরায়ণ
বিচিত্রবীর্য এই দুই স্ত্রীর সাথে অপরিমিত যৌনাচারে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং অকালে
নিঃসন্তান অবস্থায় যক্ষ্মারোগে মৃত্যুবরণ করেন।
বংশ লোপ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায়,
সত্যবতী ভীষ্মকে
এই বিধবাদের
গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য অনুরোধ করলে- ভীষ্ম সত্য রক্ষার্থে সে অনুরোধ
প্রত্যাখান করেন।
এরপর ভীষ্মের কাছে অনুমতি নিয়ে সত্যবতী তাঁর প্রথম পুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়নকে (ব্যাস) আহ্বান করেন।
[সূত্র :
মহাভারত।
আদিপর্ব।
পঞ্চাধিকশততম অধ্যায়। কুরুবংশরক্ষার্থ ব্যাসের আহ্বান]
মাতৃআজ্ঞায় প্রথমে অম্বিকার সাথে মিলিত হন।
মিলনকালে ব্যাসদেবের ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে অম্বিকা সবসময় চোখ বন্ধ করে ছিলেন।
সেই কারণের অম্বিকার গর্ভে উৎপন্ন সন্তান ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হন।
এরপর মাতৃআজ্ঞায় ব্যাসদেব আবার অম্বালিকার সাথে মিলিত হন।
এবার সন্তান অন্ধ হওয়ার ভয়ে অম্বালিকা সব সময় তাকিয়ে রইলেন।
কিন্তু ভয়ে অম্বালিকা পাণ্ডুবর্ণ হন। এই কারণে অম্বালিকা একটি পাণ্ডুবর্ণের সন্তান
প্রসব করেন।
এই সন্তানের নামও রাখা হয়েছিল পাণ্ডু।
এরপর সত্যবতী অম্বিকাকে পুনরায় ব্যাসের কাছে যাওয়ার আদেশ করলে- অম্বিকা তাঁর এক
রূপসী দাসীকে ব্যাসের কাছে পাঠান।
ব্যাসের ঔরসে এই দাসীর গর্ভে বিদুরের জন্ম হয়।
এই দাসী ব্যাসদেবের সাথে সানন্দে মিলিত হন।
ফলে বিদুর হয়েছিল শারীরিকভাবে ত্রুটি মুক্ত।
[সূত্র :
মহাভারত।
আদিপর্ব।
ষড়ধিকশততম অধ্যায়।
ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম।
পাণ্ডুর জন্ম। বিদুরের জন্ম।]
ব্যাসদেব একটি
পুত্র লাভের আশায় সুমেরু পর্বতে মহাদেবের তপস্যা করতে থাকেন।
শতবর্ষ আরাধনার পর মহাদেব তাঁকে পুত্রলাভের বর দেন।
এরপর ইনি সুমেরু পর্বত থেকে নিজ আশ্রমে ফিরে আসেন।
ইনি আশ্রমে যখন হোমের আয়োজন করছিলেন,
সে সময় ঘৃতাচী
নামক এক অপ্সরা উপস্থিত হন।
ঘৃতাচীকে দেখে ইনি অত্যন্ত কামাবিষ্ট হন।
ব্যাসদেবের এরূপ অবস্থা দেখে ঘৃতাচী শূকপাখির রূপ ধরে পলায়ন করেন।
কিন্তু ব্যাসদেবের প্রবল কামনার কারণে তাঁর বীর্যস্খলন হয় এবং তা অরণির উপর পতিত হয়।
ব্যাসদেব উক্ত অরণি মন্থন করতে থাকলে একটি পুত্রের জন্ম হয়।
ঘৃতাচী শূক পাখির রূপ ধরে পলায়ন করেছিলেন বলে- ব্যাসদেব এর নাম রাখেন শূক।
কুরুক্ষেত্রের
যুদ্ধের সময় ব্যাসদেবের বরেই সঞ্জয় দিব্যচক্ষু লাভ করেন।
এই দৃষ্টির বলে তিনি অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধের যথাযথ বিবরণ দিতে সমর্থ হয়েছিলেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর কুরু-পাণ্ডব রমণীদের ইনি জাহ্নবী থেকে উত্থিত মৃত
আত্মীয়-স্বজনদের প্রত্যক্ষ করান।
জ্ঞাতিবধের পাপস্খলনের জন্য ইনি যুধিষ্ঠিরকে অশ্বমেধ-যজ্ঞ করতে উপদেশ দেন।
গৌতমের রচিত
ন্যায়শাস্ত্রের ত্রুটি ধরার কারণে,
গৌতম ক্রুদ্ধ
হয়ে বলেছিলেন যে,
চোখ দিয়ে
ব্যাসদেবের মুখ দেখবেন না।
পরে ব্যাস অনুনয়-বিনয় দ্বারা গৌতমকে প্রসন্ন করলে,
তিনি
ব্যাসদেবের মুখদর্শনের ইচ্ছা পোষণ করেন।
কিন্তু প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হবে,-
এই বিবেচনায়
গৌতম তাঁর পায়ে চোখ স্থাপন করে ব্যাসদেবের মুখ দেখেছিলেন।
সেই থেকে গৌতমের অপর নাম অক্ষপাদ।
মহাভারতের
আদিপর্বের সপ্ততিতম অধ্যায় (কণ্ব মুনির আশ্রমসমৃদ্ধি) থেকে জানা যায়- রাজা দুষ্মন্ত
কণ্ব মুনির আশ্রম পরিদর্শন করেন। এই অধ্যায় থেকে উক্ত আশ্রমের পরিবেশ সম্পর্কে একটি
চমৎকার বিবরণ পাওয়া যায়। এই বিবরণ থেকে জানা যায়- '...এবং বৌদ্ধমতালম্বী
লোকেরা নিজ ধর্মের আলোচনা করিতেছেন।' উল্লেখ্য বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা
বুদ্ধের (গৌতম) জীবনকাল ধরা হয়-
জন্ম: ৫৬৭-৫৬৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ, মৃত্যু ৪৮৭-৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।
বুদ্ধের মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্যরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটায়।
কণ্বমুনির আশ্রমে বৌদ্ধমতালম্বীদের
ধর্মালোচনা প্রসঙ্গে
কৃষ্ণদ্বৈপায়নের মহাভারতে পাওয়া যায়। এই সূত্রে অনুমান করা যায়,
মহাভারতের রচয়িতা
হিসেবে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে জীবিত ছিলেন।
বেদকে বিভাজিত করে- তিনি বেদব্যাস উপাধি পেয়েছিলেন। যদি বেদবিভাজক এবং মহাভারতের
প্রণেতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ একই ব্যক্তি হন, তাহলে- ধরে নেওয়া যায়- খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০
থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের ভিতরে রচিত শ্রুতিসমূহের বিভাজন করেছিলেন। ধারণা করা
হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৪০০ অব্দের ভিতরে রামায়ণ রচিত হয়েছিল। তাই বলা যায় ৬০০ থেকে
৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে রচিত পৌরাণিক ভাবধারায় পুষ্ট বহু শ্রুতি বেদে স্থান
পেয়েছিল।
সূত্র :
মহাভারত।
বেদব্যাস বিরচিত
গ্রন্থ। কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত।
তুলি-কলম। জ্যৈষ্ঠ, ১৩৯৪। জুন,
১৯৮৭।