এনুমা এলিস
Enūma Eliš
ব্যাবিলন বা মেসোপটেমিয়ার সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কিত পৌরাণিক কাহিনি। ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে নিনেভ নগরীর
আসুরবনিপলের লাইব্রেরির ধ্বাংসাবশেষ থেকে, এই পৌরাণিক কাহিনিটি আবিষ্কার
করেছিলেন ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ অস্টিন হেনরি লেয়ার্ড। এই কাহিনিটি ১৮৭৬
খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল, ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ জর্জ
স্মিথ-এর তত্ত্বাবধানে।
ধারণা করা হয় রচিত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে। পরবরতী সময়ে
এনুমা এলিস সাতটি মাটির ফলকে লিখিত হয়েছিল। এত প্রায় হাজার খানেক পঙক্তি ছিল।
প্রতিটি ফলকে ১১৫ থেকে ১৭০টি পঙ্ক্তি ছিল। কাহিনিটি লেখা হয়েছিল সুমেরো-আক্কাদিয়ান
কীলকলিপিতে। এই ফলকে লেখা হয়েছে পৃথিবীর সৃষ্টিতত্ত্ব, মানুষের সৃষ্টিতত্ত্ব,
মেসোপটেমিয়ামের দেবদেবী সম্পর্কে। এই মূল রচনা থেকে পরবর্তী সময়ে ব্যাবিলন এবং
আসিরিয়া পৌরাণিক কাহিনিতে গৃহীত হয়েছিল।
আসুরবনিপলের লাইব্রেরিতে এর একটি সংস্করণ সংগৃহীত হয়েছিল, খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম
শতাব্দীতে। এর আগে এই কাহিনিটি মারদুক দেবতার পুরোহিত বেরোস্সাস খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয়
শতাব্দীতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই গ্রন্থটি আলেক্সান্ডার পোলিহিস্টরের রচিত ক্যালডিয়ান ইতিহাসে যুক্ত হয়েছিল।
পরে কাহিনিটি ইউসেবিয়াসের রচিত ক্রিনিকন-এর প্রথম গ্রন্থে স্থান পেয়েছিল।
৭টি মাটির ফলকে এই গ্রন্থের যে বিবরণ পাওয়া যায়,
তা হলো-
- প্রথম ফলক: সৃষ্টির আদিতে, শুধু
আপসু এবং
তিয়ামৎ
নামক দুটি সত্তা ছিলেন। এছাড়া কোনো বস্তু বা তাদের নিয়ন্ত্রক দেবতা
ছিল না। এদের মিলনের ফলে জন্মগ্রহণ করেছিল
লাহ্মু এবং
লাহামু জন্মগ্রহণ।
এরপর জন্মগ্রহণ করেছিল
আনশার ও
কিশার (লাহ্মু এবং লাহামুর
পুত্র কন্যা)।
এরপর আনশার জন্ম দেন আনু এবং নুডিম্মুদ।
এতসব সন্তানাদি যখন বড় হয়ে উঠলো, তখন এদের কোলাহলে এবং পরস্পরের দ্বন্দ্বে
স্বর্গে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলে,
তিয়ামৎ এবং
আপসু এদের প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে পড়েন। সে সময়
তিয়ামৎ এবং
আপসু পাতালে বাস করতেন। উভয়ই স্বর্গের
দেবতাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নেন। তাতে ব্যর্থ হয়ে, এঁরা দেবতাদের হত্যা
করার পরিকল্পনা করেন। এই সময় তিনি এর প্রতিকারের জন্য, তার উপদেষ্টা
মুম্মুর
শরণাপন্ন হন। মুম্মু এদের হত্যা করার জন্য পরামর্শ দেন।
এরপর
আপসু এই বিষয়ে কথা বলার জন্য তিয়ামতের কাছে মুম্মুকে পাঠান। তিয়ামৎ এই
হত্যাকাণ্ডে অনিচ্ছুক ছিলেন। তা সত্ত্বেও আপসু মুম্মুকে হত্যাকাণ্ড চালানোর
নির্দেশ দেন। এই সংবাদ জানতে পেরে অন্যান্য দেবতারা শঙ্কিত হয়ে পড়েন।
এরপর জলের দেবতা এনকি মন্ত্রের সাহায্যে আপসুকে ঘুম পাড়িয়ে বন্দী করেন। মুম্মু
আপসুকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এনকি এই অবস্থায় আপসুকে হত্যা করে
এবং মুম্মুকে বন্দী করে শৃঙ্খলিত করে। এরপর আপসুর দেহ দিয়ে দিয়ে তৈরি করে এনকি
এবং তাঁর স্ত্রী দামকিনি'র বসবাসের জন্য প্রাসাদ। এনকি এবং দামকিনি আপসুর
হৃদপিণ্ড থেকে তৈরি করে দেবতা মারদুক-কে। অচিরেই মারদুক শক্তিতে এনকি এবং
অন্যান্য দেবতাদের থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠলেন।
এরপর আনু চার ধরনের বাতাস তৈরি করলেন। এই অবস্থায় অন্যান্য দেবতারা তিয়ামৎকে
তীব্র কটাক্ষ করে বললেন- যখন আপনার স্বামী আপসুকে হত্যা করা হলো, তখন আপনি
বাতাসের কাছে অভিযোগ করা ছাড়া, নিজে কোনোই অভিযোগ করেন নি।
স্বামীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিয়ামৎ দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা
করেন। তিয়ামৎ স্বামীর মৃত্যুর পর, তাঁর পুত্র কিঙ্গুকে বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু
প্রথম স্বামী আপসুর হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কিছু ১১ জন পৌরাণিক-যোদ্ধা তৈরি
করলেন এবং এই দলের কিঙ্গুকে এই বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিলেন।
প্রথম ফলকের পিছনে- গ্রন্থটির পরিচয়জ্ঞাপ ৯টি লাইন ছিল।
দ্বিতীয় ফলক:
এনকি তিয়ামতের এই যুদ্ধের আয়োজনের কথা জানত পেরে, তাঁর পিতামহ আনশারকে বলেন যে,
বহু দেবতা তিয়ামতের কারণে ভিন্ন পথে চলে গিয়েছিল। তাই তিনি এগারটি যুদ্ধের
উপযোগী দানব তৈরি করেছিলেন। এবং 'Tablet of Destinies'.
অনুসারে দানবদের পরিচালনা জন্য এদের কিঙ্গুকে তাদের নেতা বানিয়ে
বানিয়েছিলেন। আনসার এতে বিরক্ত হয়ে আনুকে তিয়ামতকে শান্ত করতে বলেন। কিন্তু আনু
তিয়ামতের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত সে
যুদ্ধ না করে ফিরে এসেছিল। এই ঘটনার পর, আনসার আরও ভীত হয়ে পড়েন। তিনি মেনে
নিলেন যে, তিয়ামৎকে প্রতিরোধ করার মতো আর কোনো দেবতা নেই। শেষ পর্যান্ত তিনি
দায়িত্ব দেওয়ার জন্য মারদুককে ডাকলেন। মারদুক আনসারকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, কোন
কোথায় এবং কোন দেবতার সাথে যুদ্ধ করতে হবে। আনসার বললেন, এই যুদ্ধ হয়ে দেবতার
সাথে নয়, দেবীর সাথে। তিনি এই দৃঢ়তার যুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের প্রত্যাশা ব্যক্ত করলেন,
কিন্তু আনসারের কাছে এই প্রতিশ্রুতি চাইলেন যে, তাকে পরম -ঈশ্বরে পদ দিতে হয়ে।
এবং তাঁর কর্তৃত্ব থাকবে সকল দেবতার উপর, এমন কি আনসারের উপরও।
তৃতীয় ফলক:
আনশার গাগার সাথে কথা বললেন। গাগা তাকে পরামর্শে তিনি লাহমু এবং লাহামুর
সাথে কথা বলেন। এবং তিয়ামতের যুদ্ধে পরিকল্পনা তাদেরকে বলেন। লাহমু এবং লাহামু এবং অন্যান্য ইগিগি (স্বর্গীয় দেবতা)
মারদুকের এই দাবীতে কষ্ট পেয়েছিলেন। তারপরে তারা একসঙ্গে মদ্যপান করে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিলেন। অবশেষে মারদুকের সাথে চুক্তি অনুমোদন করেছিলেন।
চতুর্থ ফলক
মারদুক সিংহাসন গ্রহণ করার পর, তাঁকে যারা দেবতাদের রাজা
হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন, তাঁদের নিয়ে পরামর্শ করলেন। মারদুককে একটি রাজদণ্ড এবং পোশাক, সেইসাথে তিয়ামতের সাথে লড়াই করার জন্য অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল।
এই অস্ত্রের মধ্যে ছিল, ধনুক, তূণ, গদা এবং বজ্রদণ্ড, চারটি বাতাসের নিয়ন্ত্রণ।
চারটি বাতাস ব্যবহার করে তিনি তিয়ামতকে আটকে দেন। এরপর এর সাথে যুক্ত করেম একটি ঘূর্ণিবায়ু, একটি ঘূর্ণিঝড় এবং ইমহুল্লু ("অশুভ বাতাস")।
মারদুক এই সাতটি বায়ু তিয়ামতকে আলোড়িত করেছিল। চারটি প্রাণীর দ্বারা টানা তাঁর যুদ্ধ রথে তিনি অগ্রসর হন। তিনি তিয়ামাতকে চ্যালেঞ্জ করেন, এই বলে যে তিনি অন্যায়ভাবে কিংগুকে তার সহধর্মিণী বানিয়েছেন, তাকে এই সমস্যার উৎস হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন।
ক্ষুব্ধ হয়ে তিয়ামাত একা মারদুকের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। অনুর কাছ থেকে একটি উপহার
হিসেবে একটি জাল দিয়ে মারদুক তিয়ামতকে আটকানোর জন্য অগ্রসর হলেন। কিন্তু তিয়ামাত মারদুককে গিলে ফেলার চেষ্টা করলো:
এই সময় মারদকের সাথের 'অশুভ বাতাস'- তিয়ামতের মুখ ভরে গিয়েছিলে। সেই সাথে তার
সাথের মধ্যে বাতাসের ঘূর্ণিতে তার মুখ বাঁকা হয়ে গেল। এই অবস্থায় মারদুক তীর ছুড়ে তার হৃদয়ে আঘাত করে।
এর ফলে তিয়ামতের মৃত্যু হয়।
এই সময় তিয়ামতের সহযোগী অন্যান্য দেবতারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে, মারদুক তাদের জাল ফেলে তাদের বন্দী করে, তাদের অস্ত্র ভেঙ্গে
দেয়। এই সময় মারদুক তিয়ামতের এগারো দানব এবং তাদের দলনেতা কিংগুকে বন্দী করে।
এই সময় তার কাছ থেকে 'ট্যাবলেট অফ ডেসটিনিস' নেওয়া হয়েছিল। এরপর মারদুক তার গদা দিয়ে তিয়ামতের মাথা থেঁতলে দেয়। তার রক্ত উত্তর বাতাসে বয়ে যায়।
মারদুক তিয়ামতের অবশিষ্টাংশকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। এক অর্ধেক থেকে তিনি আকাশ তৈরি করেছেন; এটিতে তিনি অনু, এনলিল এবং ইএর জন্য জায়গা তৈরি করেছিলেন।
পঞ্চম ফলক
মারদুক নক্ষত্রপুঞ্জের দেবতাদের উপমা তৈরি করেছিলেন এবং তাদের থেকে বছরের দিনগুলি সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। তিনি রাত, দিন, চন্দ্র মেঘ ও
বৃষ্টি সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি পানি দিয়ে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস তৈরি করেছেন । তিনি অনুকে 'ট্যাবলেট অফ ডেসটিনিস' দেন।
তিয়ামতের এগারো দানবের মূর্তি তৈরি ও স্থাপন করা হয়েছিল অপসুর গেটে ।
ষষ্ঠ ফলক
মারডুক তখন ইএ (নুদিম্মুদ)র সাথে কথা বলেছিল, সে বলেছিল যে সে মানুষ তৈরি
করার জন্য সে তার নিজের রক্ত ব্যবহার করবে, সে সব মানুষ দেবতাদের সেবা করবে। ইএ দেবতাদের একজনকে বলি হিসাবে বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। ইগিগি কিংগুকে বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেন।
তার রক্ত তখন মানুষ সৃষ্টিতে ব্যবহার করা হয়।
মারদুকের প্রস্তাবে ইট-সহ ব্যাবিলন নগরীর নির্মিত হয়েছিল।
মারদুক তখন দেবতাদেরকে উচ্চ এবং নিম্ন পদমর্যাদা অনুসারে দুটি ভাগে ভাগ করেন।
উচ্চ পদমর্যাদার ৩০০ দেবতা স্বর্গে, নিম্ন মর্যাদার ৬০০ দেবতা পৃথিবীতে স্থান
লাভ করে।
দেবতারা তখন তার জন্য একটি সিংহাসন বা মন্দির নির্মাণের প্রস্তাব দেন; মারদুক তাদের ব্যাবিলন নির্মাণ করতে বলেছিলেন।
এই ইট তৈরি করতে দেবতাদের এক বছর অতিবাহিত হয়েছিল। তারা মারদুক, ইএ এবং
উচ্চভূমিতে এনলিলের জন্য একটি জায়গা তৈরি করে এসাগিলা (মারদুকের মন্দির)।
তারপর দেবতার একটি ভোজসভার আয়োজন করে। এই সভায় যোগদান করেছিলেন পঞ্চাশজন মহান দেবতা। অনু এনলিলের ধনুক এবং তারপর মারদুকের প্রশংসা করেন।
এই সভয়া মারদুকের প্রথম নয়টি নাম বা উপাধি দেওয়া হয়েছিল।
সপ্তম ফলক
মারদুকের বাকি পঞ্চাশটি নাম বা উপাধি পড়া হয়েছিল।