রেকর্ড
[রেকর্ড অভিধান]

শ্রাব্য বা দৃশ্য-শ্রাব্যের ধারণকৃত উপকরণ। সাধারণভাবে শ্রাব্যবিষয়ের ধারণকৃত বিশেষ উপকরণ রেকর্ড বলা হলেও, সঙ্গীত এবং চলচ্চিত্রের ধারণকৃত উপকরণ হিসেবে রেকর্ড চিহ্নিত হতে পারে। এই জাতীয় রেকর্ড বলতেই সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, গানের রেকর্ড এবং যা একটি সমতলীয় চাকতির মতো উপকরণ।

শব্দ ধারণ করা এবং তা শ্রাবণ করা, এই আকাঙ্ক্ষা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল শব্দধারণ এবং তা শ্রবণের উপযোগী যান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ের ধারাবাহিক গবেষণার সূত্রে রেকর্ডে উদ্ভব হয়েছে। শব্দকে যথাযথভাবে যন্ত্রের সাহায্যে বারবার বাজানোর উপযোগী প্রথম যন্ত্র হলো টিউনিং ফর্ক (tuning forks) । ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দে এই যন্ত্রটি প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন ইংরেজ বিজ্ঞানী থমাস ইয়ং। কিন্তু যন্ত্রের কাঁটাকে এমনভাবে তৈরি করা হতো। যাতে আঘাত করলে সুনির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের শব্দ তৈরি হয়। এতে কোনো শব্দকে গ্রহণ করে ধারণ করা যায় না। এখনো পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাগারে এই যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত এই ফোনোটোগ্রাফের পিপার মতো অংশটি তৈরি হয়ে প্যারিস অফ প্লাস্টার দ্বারা প্রকৃত শব্দধারণ করার প্রথম যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন ফরাসি বিজ্ঞানী Édouard-Léon Scott de Martinville

বর্তমানে রেকর্ডের সাধারণ নাম হলো- গ্রামোফোন রেকর্ড। মূলত এই নামটি এমিল বার্লিনার (Emile Berliner) ।উন্নয়নকৃত গ্রামোফোন কোম্পানির থালা সদৃশ্য রেকর্ডের নাম ছিল গ্রামোফোন রেকর্ড। পরে নানা রেকর্ড কোম্পানি রেকর্ড তৈরি করলেও গ্রামোফোন শব্দটি রেকর্ডের সমার্থক শব্দের অধিকার লাভ করে।

রেকর্ড মূলত এম একটি উপকরণ, যাতে ধ্বনি তরঙ্গের রূপরেখা খোদিত থাকে। এই চাকতি ঘূর্ণায়মান অবস্থায় উক্ত খোদিত রেখার পিনের স্পর্শে ধ্বনি পুনরুদ্ধার হয় এবং শব্দবর্ধক যন্ত্রের সাহায্য ধ্বনি শ্রবণযোগ্য হয়ে উঠে। আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের বিচারে রেকর্ডকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। ভাগ তিনটি হলো-

রেকর্ডিং পদ্ধতি
টিনের পাতে বা মোমের প্রলেপযুক্ত রেকর্ডে যখন স্টাইলাস শব্দের কম্পাঙ্ক অনুসারে রেখা অঙ্কন করে, রেখাগুলো খোদিত হয়। এই খোদিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞানীরা দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। ভাগ দুটি হলো- পার্শ্বিক কর্তন (
Lataral Cut) । ও উলম্ব কর্তন (Vertical Cut)। এডিসনের টিনের পাতের কর্তন ছিল উল্মম্ব কর্তন। ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এমিল বার্লিনার যখন নতুন করে রেকর্ড ব্যবস্থার উন্নয়ন করেন, তখন তিনি ব্যবহার করেছিলেন উলম্ব কর্তন। তিনি সরাসরি শব্দের কম্পাঙ্ক গ্রহণ করে, তাকে ছাপ দেওয়ার জন্য ধাতব সিলমোহর তৈরি করেছিলেন প্রক্রিয়ার উন্নয়ন করেছিলেন। এর মাধ্যমে ধারণকৃত শব্দের ছাপ থেকে একাধিক রেকর্ড তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। রেকর্ডের গতি
রেকর্ডে শব্দ গ্রহণ করার সময় একটি বিশেষ গতিতে ঘূর্ণিত হয় এবং গতিতে বাদিত হলে যথাযথ শব্দমান পাওয়া যায়। এর পরিমাপ হয় ঘূর্ণ/প্রতিমিনিট
(Revolutions per minute) , আন্তর্জাতিক পরিমাপ পদ্ধতিতে এর শব্দসংক্ষেপ rpm, RPM, rev/min, r/min । রেকর্ড আবিষ্কারের প্রথম দিকে বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন গতির রেকর্ড তৈরি করতো। এর মান ছিল ৬০ থেকে ১৩০ আরপিএম-এর ভিতরে। ফলে এক কোম্পানির রেকরড অন্য কোম্পানির বাদন যন্ত্রে যথাযথ মানে শোনা যেতো না। পরে অবশ্য এই আদর্শিক গতি মান নির্ধারণ করা হয়েছে।

১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বার্লিনারের আদি গ্রামোফোন রেকর্ডের গতি ছিল ৭০ আরপিএম।
১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে গ্রামোফোন কোম্পানি ৭৮ আরপিএম-এর একটি আদর্শিক মানের রেকর্ড প্রকাশ করেছিল।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে আরসিএ ভিক্টর লেবেল প্রকাশিত হয়েছিল ৩৩.১/৩ (
(33⅓ ) আরপিএম রেকর্ড।
১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে আরসিএ ভিক্টর লেবেল প্রকাশিত হয়েছিল ৪৫ আরপিএম রেকর্ড
রেকর্ডের আকার:
সিলিন্ডার রেকর্ড ও ডিস্ক রেকর্ডের বিচারে আকারের পার্থক্য রয়েছে। যেহেতু সিলিন্ডার রেকর্ডে, একটি সিলিন্ডারকে পাতলা টিনের পাত দ্বারা মোড়ানো হতো, তাই এর পরিমাপের জন্য দৈর্ঘ্য ও ব্যাসের পরিমাপটা মুখ্য বিষয় ছিল। কিন্তু থালার মতো ডিস্ক রেকর্ডর পরিমাপ করা হয় এর ব্যাসের দ্বারা।

  • সিলিন্ডার রেকর্ডের পরিমাপ: এর আদর্শিক মাপ ছিল ৪.২৫ ইঞ্চি লম্বা এবং ব্যাস ২.১৮৭৫ ইঞ্চি। ঘূর্ণন গতি ছিল ১২০ আরপিএম। এর দাম ছিল ৫০ সেন্ট। এর বাদনকাল ছিল ২ মিনিট। এই রেকর্ডের বড় অসুবিধা ছিল, এর একাধিক কপি করা যেতো না। ফলে প্রতিবার নতুন ক্রেতার জন্য শিল্পীরা নতুন করে রেকর্ড করতেন। এর ফলে এর দাম কমানো সম্ভব হতো না। তা ছাড়া প্রতিবার রেকর্ড করার জন্য অনেক সময় ব্যয় হতো।

    ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে এডিসন বাজারে ছাড়েন কনসার্ট ফোনোগ্রাফ। এর দাম রাখা হয়েছিল ১২০ ডলার। এর দৈর্ঘ্য ছিল ৪.২৫ ইঞ্চি এবং দৈর্ঘ্য ছিল ৫ ইঞ্চি। এর শব্দে মান ভালো ছিল। তবে দাম বেশি হওয়ার জন্য যথেষ্ঠ ক্রেতা পাওয়া যেতো না। ফেলে ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে এর ঊৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

    ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে এডিসন আবিষ্কার করেন একাধিক সিলিন্ডার তৈরির কৌশল। এই কৌশলে স্টাইলাস দ্বারা লিখনের পরিবর্তে ছাপের পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। এছাড়া এত শক্ত মোম ব্যবহারের কারণে ব্যবহার জনীত ক্ষয় কম হতো। এতে স্বর্ণ ইলেক্ট্রোড পদ্ধতিতে স্বর্ণবাষ্প ব্যবহার করা হতো। এই কারণে, এর নাম দেওয়া হয়েছিল
    New High Speed Hard Wax Moulded Records । ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে এর নাম সংক্ষিপ্ত রাখা হয়েছিল Gold Moulded । এই পদ্ধতিতে ১২০ থেকে ১৫০ টি সিলিন্ডার কপি করা যেতো। ফলে নির্মাণ খরচ কমে গিয়েছিল। সে সময়ে প্রতিটি সিলিন্ডার বিক্রয় হতো ৩৫ সেন্ট। এই সিলিন্ডারগুলো ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে।
     
  • ডিস্ক রেকর্ডের পরিমাপ:
    ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এমিল বার্লিনারের তৈরিকৃত গ্রামোফোন রেকর্ডের তখন এই রেকর্ডের ব্যাস ছিল ৫ ইঞ্চি (১৩ সেন্টিমিটার)। এরপর এই রেকর্ড ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠলে, বিভিন্ন কোম্পানি বা ব্যক্তি ডিস্ক রেকর্ডের ব্যবসায়ে আসেন। এরা নিজদের যন্ত্রের প্রকৃতি অনুসারে বিভিন্ন মাপের রেকর্ড তৈরি করা শুরু করেছিল।

    ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে বার্লিনারের গ্রামোফোন কোম্পানি ১০ ইঞ্চি ব্যাসের রেকর্ড বাজারজাত করে। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে ভোল্টা গ্রামোফোন কোম্পানি ভেঙে যায়। পরে এই কোম্পানি নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করে। এই সময় এই কোম্পানি ১০ ইঞ্চি ব্যাসের রেকর্ড বাজারজাত করে। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে এরা বাজারজাত করে ১২ ইঞ্চি ব্যাসের রেকর্ড। এই সকল রেকর্ডের বাদনকাল ছিল ২ মিনিট।