যিশু খ্রিষ্টের জন্মকাল
খ্রিষ্টাব্দের বিচারে এই ধারণাই জন্মে যে, যিশু ১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাইবেল -এর নতুন নিয়মের মথি ২.১ থেকে জানা যায়, হেরোদ রাজার শাসনামালে পূর্বদেশ থেকে কয়েকজন পণ্ডিত নক্ষত্র দেখে যিশুকে দেখতে এসেছিলেন। অর্থাৎ যিশুর জন্মের সময় আকাশে নতুন তারার উদ্ভব হয়েছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আকাশে এরূপ নক্ষত্র সংযোগ ঘটেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৭ অব্দের ১৫ সেপ্টেম্বরে। যদি হ্যালির ধূমকেতুকে এই সংযোগের আওতায় আনা যায়, তবে তার সময় দাঁড়ায় খ্রিষ্টপূর্ব ১২ অব্দে। এই সূত্রে ধারণা করা যায় যিশু খ্রিষ্টপূর্ব ৭-১২ অব্দের মধ্য জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
 

মথি ১৩-১৭ থেকে জানা যায় যিশুর জন্মের কথা জেনে হেরোদ ওই এলাকার দুই বৎসর বা তার চেয়ে কম বয়সী শিশুদের আদেশ দেন। কিন্তু প্রভুর দূত স্বপ্নে যোশেপকে শিশুযিশুসহ দেশ ত্যাগ করেন। হেরোদ এই হত্যাকাণ্ডের কিছু পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। Blackburn এবং Holford-Strevens নামক দুইজন গবেষকের মতে হেরোদের মৃত্য হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৪ অব্দের দিকে।

লুক ২.১-৭ থেকে জানা যায় যিশুর জন্মের সময় সুরিয়ার শাসন কর্তা ছিলেন কুরীণি ছিলেন। এই সময় লোকগণনা শুরু হয় এবং কুরীণি প্রথম লোক গণনা খাতায় নাম লেখান। ইতিহাসবেত্তা জোশেফাস (Josephus) তাঁর Antiquities of the Jews গ্রন্থে লিখেছেন ৬-৭ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে লোক গণনা শুরু হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধারণার সাথে মেলে না, আবার মথি'র সুসমাচারের তথ্যের সমন্বয় করা যায় না। লুক ৩-২৩ পাঠে যিশুর বয়সকে ৩০ বৎসর উল্লেখ করেছেন। এই সময় টিবেরিয়াস সিজারে ১৫তম রাজত্বকাল চলছিল। টিবেরিয়াস ১২ বৎসর বয়সে তাঁর পিতা অগাস্টাসের সাথে রাজত্ব করা শুরু করেন। এই বিচরে টিবিয়াসের এই সময়ের বয়স ছিল ২৬ বা ২৭ বৎসর। ২৬ বা ২৭ খ্রিষ্টাব্দে যিশুর বয়স ৩০ হলে, তাঁর জন্ম হয়েছিল অন্তত খ্রিষ্টপূর্ব ৫ বা ৪ অব্দে (উল্লেখ্য এই বৎসর গণনায় ০ বৎসর বলে কিছু নেই)।

এই বৎসর গণনায় ০ বৎসর বলে কিছু না থাকায়- ১ খ্রিষ্টাব্দের আগের বছর হয় খ্রিষ্টপূর্ব ১ অব্দ।

ইহুদি পঞ্জিকা : হিব্রু বাইবেলের হিব্রু Masoretic text অনুসারে ইহুদি রাব্বি  Jose ben Halafta সদাপ্রভু আদমকে সৃষ্টি করেছিলেন  খ্রিষ্টপূর্ব ৩৭৬০ অব্দে। শেষ পর্যন্ত এই গণনা সকল ইহুদি পণ্ডিতের কাছে গৃহীত হয় নি। ১১৭৮ খ্রিষ্টাব্দে হিব্রু পঞ্জিকা সংশোধন করেছিলেন মেইমোনিদেস (Maimonides)। তাঁর মতে  পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯২৫ অব্দে। বর্তমানে এই সংশোধিত পঞ্জিকা ইহুদিরা মান্য করে থাকেন। 

খ্রিষ্টান পঞ্জিকা : বাইবেলের পুরাতন নিয়মের গ্রিক সংস্করণের  Septuagint অধ্যায় অনুসারে, খ্রিষ্টান পাদরিরা সৃষ্টিকালকে নির্ধারণ করা চেষ্টা করেছিলেন। এর সূত্রপাত ঘটেছিল জুলিয়াস আফ্রকানাস (Julius Africanus ২০০-২৪৫ খ্রিষ্টাব্দ) -এর হাতে। তাঁর মতে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল  খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫৩৭ অব্দে। আর অন্টিওকের ষষ্ঠ বিশপ থিওফিলাস (Theophilus ১১৫-১৮১ খ্রিষ্টাব্দ) -এর মতে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫২৯ অব্দে। সেরাফিম রোজ (Seraphim Rose) একে সংশোধন করে উল্লেখ করেছেন খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫৩০ অব্দ। ইউসেবাসের ক্রোনিকন (Chronicon of Eusebius) এবং জেরোম (Jerome) একে পুনরায় সংশোধন করে নির্ধারণ করেন খ্রিষ্টপূর্ব ৫১৯৯ অব্দ। খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরা গোড়ার দিকে বহুদিন এই মতে বড়দিন পালন করতেন।

বাইজেন্টেনিয়ান পঞ্জিকা :  এই পঞ্জিকা তৈরি হয়েছিল জুলিয়ান পঞ্জিকা'কে ভিত্তি করে। তবে এই পঞ্জিকা সাথে পার্থক্য ছিল বৎসরে শুরুর সময় নিয়ে। জুলিয়ান পঞ্জিকা- বৎসরের শুরু দিন ছিল ১ জানুয়ারি, পক্ষান্তরে বাইজেন্টেনিয়ান পঞ্জিকার মাস গণনা হতো ১ সেপ্টেম্বর থেকে। আর বৎসর গণনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো Anno Mundi পঞ্জিকার খ্রিষ্টান রীতি। সব মিলিয়ে এই পঞ্জিকা মতে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০৯ অব্দের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০৮ অব্দের ৩১শে আগষ্টের মধ্যে।
 

বাইজেন্টাইন Anno Mundi পদ্ধতির বর্ষ গণন পদ্ধতিকে পূর্বাঞ্চলীয় অর্থডক্স চার্চ ৬৯১ খ্রিষ্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেছিল। এবং ১৭২৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এরা এই পঞ্জিকা অনুসরণ করতো। দশম শতাব্দীর শেষের দিকে এই পঞ্জিকাতে সৃষ্টিকাল গ্রহণ করা হয়েছিল ১লা সেপ্টেম্বর খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০৯ অব্দ। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে ৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছে। রাশিয়াতে এই পঞ্জিকা ১৭০০ অব্দ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।