জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী
১৯০২-১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দ
সঙ্গীতশিল্পী।

১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর বিষ্ণুপুরের শাঁখারি বাজারের নিকটস্থ গোস্বামী পাড়ায় এক ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত-পরিবারের জন্মগ্রহণ করেছিলেন।পিতার নাম বিপিনচন্দ্র গোস্বামী। তিনি ছিলেন শ্রীচৈতন্যের অন্যতম পার্ষদ শ্রীনিবাস আচার্যের বংশধর। তাঁর পিতামহ জগৎচাঁদ গোস্বামী ছিলেন বিষ্ণুপুরের স্বনামধন্য পাখোয়াজ-বাদক। জগৎচাঁদের পাঁচ পুত্রেরা সকলেই ছিলেন যন্ত্র এবং কণ্ঠসঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন। জগৎচাঁদের দ্বিতীয় সন্তান বিপিনচন্দ্রের পুত্র জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ।

পারিবারিকভাবে সঙ্গীতের প্রতি তাঁর অদম্য আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্থানীয় সঙ্গীতগুরু লোকনাথের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাঠ গ্রহণ করা শুরু করেন।

১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। এই সময় তাঁর কাকা রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী ছিলেন বহরমপুরে মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন। রাধিকাপ্রসাদ তাঁকে বহরমপুরে নিয়ে যান। এরপর তিনি রাধিকাপ্রসাদের কাছে তিনি  ধ্রুপদ ও খেয়াল শেখেন।
 

১৯১৯-২০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে রাধিকাপ্রসাদ বহরমপুর সঙ্গীত বিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পরে, তিনি জ্ঞানেন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে তিনি কলকাতার পাথুরিয়াঘাটায় আসেন এবং সেখানকার সঙ্গীতের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ ঘোষের বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে রাধিকাপ্রসাদের মৃত্যু হয়। এরপর থেকে তিনি ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ ঘোষের আশ্রয়েই থেকে যান।

১৯২৩-২৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বিষ্ণুদিগম্বর পলুস্করের বিদ্যায়তন তাঁর লাহোর ও মুম্বাইয়ের বন্ধ হয়ে যায়। ঋণগ্রস্থ বিষ্ণুদিগম্বর পলুস্কর পাথুরিয়া ঘাটার  সঙ্গীতগুরু ভূপেন্দ্রকৃষ্ণের বাড়িতে থাকা শুরু করেন। এই সময় বিষ্ণুদিগম্বর জনসমক্ষে গান গাওয়া বা অনুষ্ঠান করা ছেড়ে দিয়েছিলেন। চোখেও দেখতে পেতেন না। তবে তিনি প্রতিদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে ঘুম থেকে উঠে তিনি গলা সাধতেন। ঘরের দরজা বন্ধ থাকায় জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ সেই ঘরের চৌকাঠে মাথা পেতে দিনের পর দিন গান শোনার চেষ্টা করতেন। পরে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদকে সঙ্গীতের পাঠ দিয়েছিলেন।

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে বিষ্ণুপুরের অভয়পদ মল্লিকের কন্যা গৌরীদেবীকে বিবাহ করেন। বিবহের পর কিছুদিন ভূপেন্দ্রকৃষ্ণের বাড়িতে থাকার পর, তিনি মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের একটি বাড়িতেসপরিবারে উঠেন। পরে তিনি বিভিন্ন সময়ে আমহার্স্ট স্ট্রিট, মহাকালী পাঠশালা, বিবেকানন্দ রোড এবং হেমন্তকুমারী স্ট্রিটে বসবাস করেন।

১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে এইচএমভি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রথম রেকর্ড। গান দু’টি ‘বরষ বরষ থাকি চাহিয়া’ এবং ‘একি তন্দ্রা বিজড়িত আঁখিপাতে’। মেগাফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত ‘অনিমেষ আঁখি আমার’ এবং ‘মুরলীর ধনী কার বাজে’। ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত ‘আমায় বোলো না ভুলিতে’ (বেহাগ) ও ‘আজি নিঝুম রাতে কে বাঁশি বাজায়’ (দরবারী কানাড়া) সাড়া ফেলেছিল।

১৯৩৩-৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ফৈয়াজ খান তিনি ফৈয়াজের কাছে নাড়া বেঁধে ধ্রুপদ, খেয়ালের তালিম নেওয়া শুরু করেন। তখন মহিষাদল রাজবাড়ির সঙ্গীতগুরু ও সভাগায়ক ছিলেন। সেখানেই তৎকালীন রাজমাতার বিশেষ অনুরোধে তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র দেবপ্রসাদ গর্গকে সঙ্গীতের তালিম দিতেন। প্রতি মাসে একবার মহিষাদলে যেতেন এবং সেখানে কিছু দিন থাকতেন।  

১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানিতে কাজী নজরুল ইসলামের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল। এই সূত্রে নজরুলের সাথে তাঁর বিশেষ বন্ধুত্ব হয়েছিল। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে এইচএমভি থেকে প্রকাশিত নজরুল ইসলামে রচিত শূন্য এ-বুকে পাখী মোর আয় ানটির রচনা নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। গল্পটি হলো- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অল্প লইয়া থাকি তাই’ গানটি জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের খুব প্রিয় ছিল। ওই গানটি রেকর্ড করার ইচ্ছে প্রকাশ করলেও তার অনুমতি মেলেনি। এর পরে ভারাক্রান্ত মনে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ এইচএমভি'র মহড়া কক্ষে আসেন। তখন সেখানে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম ও জমিরুদ্দিন খান। ঘটনাটি শুনে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথের গানটি শুনতে চান। এরপর তিনি ওই সুরে তিনি রচনা করে দিয়েছিলেন ' শূন্য এ-বুকে পাখী মোর আয়'। এছাড়া তাঁর গাওয়া অনেক গান জনপ্রিয় হয়েছিল।

জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ মূলত ছিলেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিল্পী এবং সঙ্গীতগুরু। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে ধীরেন ঘটক, জয়কৃষ্ণ সান্যাল, সত্যেন ঘোষাল প্রমুখ সুনাম অর্জন করেছিলেন।

ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ ঘোষের ইচ্ছেতেই জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ নিখিল বঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলনে প্রথম থেকেই যুক্ত ছিলেন। এই সম্মেলনে ধ্রুপদ গেয়ে শ্রোতাদের মন জয় করেছিলেন। এই সম্মেলনে কোনো এক অনুষ্ঠানে ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের কণ্ঠে ‘বাগেশ্রী’ শুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। সেবার আব্দুল করিম খাঁ যতদিন কলকাতায় ছিলেন, ততদিন জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ তাঁর কাছে যেতেন এবং সেই সূত্রে তিনি কিছু গান শেখার সুযোগ লাভ করেছিলেন।

১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্কে গানবাজনার আসরও ক্ষীণ হতেথাকে। এ অবস্থায় জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদকলকাতা ত্যাগ করেন। প্রথমে তিনি
সিমলাপাল রাজপরিবারের রাজা শ্যামসুন্দর সিংহের সিমলাপাল রাজবাড়িতে কিছু দিন ছিলেন।উল্লেখ্য, শ্যামসুন্দর সিংহ তাঁর শিষ্য ছিলেন।
সেখানে নিয়মিত গানের আসর বসত। রাজার ছোট ভাই হরসুন্দর সিংহ ঠাকুর তাঁর কাছে সঙ্গীতের তালিম নেন। সিমলাপাল থেকে মাঝেমধ্যে বিষ্ণুপুরে এসেও তিনি গানের আসরে যোগ দিতেন। তবে রাজা শ্যামসুন্দর সিংহের অকালমৃত্যুর পরে তিনি ফিরে এসেছিলেন বিষ্ণুপুরে।

১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।