কমলা ঝরিয়া
(১৯০৬-১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দ)।
কণ্ঠশিল্পী।
১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে কমলা ঝরিয়া ভারতের তৎকালীন বেঙ্গাল প্রেসিডেন্সি'র অন্তর্গত বিহার
রাজ্যের ঝরিয়া নামক কয়লাখনির অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মূল নাম ছিল কমলা সিং।
কমল তাঁর পিতামাতার সাথে মহারাজ শিবপ্রসাদ রাজবাড়ির সন্নিকটে থাকতেন। তাঁর পিতা সম্ভবত রাজবাড়িতে কাজ করতেন।
অনেকের মতে তাঁর পিতা ঠাকাদারি ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন।
হয়তো এই কারণেই রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁদের একটি সহজ যোগাযোগ গড়ে ওঠেছিল। সেই সূত্রে রাজবাড়িতে তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল।
রাজদরবারে গানের আসরে গান শোনার সূত্রে ছোটো বেলা থেকে কমলার
সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ গড়ে উঠেছিল।
একবার মহারাজ শিবপ্রসাদ তাঁর বিবাহ বার্ষিকীতে সেকালের প্রখ্যাত গায়ক
কাসেম মল্লিককে
তাঁর দরবারে সঙ্গীত পরিবেশনের
আমন্ত্রণ জানান। মল্লিকের গান শুনে মহারাজ এতটাই মুগ্ধ হন যে, তিনি
কাসেম মল্লিককেতাঁর দরবারের সভাগায়ক হিসেবে থাকার
অনুরোধ করেন। এই সূত্রে কে. মল্লিক প্রায় ৭-৮ বছর এই রাজদরবারের সভাগায়ক হিসেবে কাটান। এই সময় ঘটনাক্রমে
কাসেম মল্লিক কমলার গান শুনে মুগ্ধ হন এবং মহারাজের অনুমতি নিয়ে, তাঁকে গান শেখানো শুরু করেন। এরপর তিনি ঝরিয়া
-রাজদরবারের আরেক সংগীতগুণী শ্রীনাথ দাসনন্দীর কাছে শাস্ত্রীয়সংগীত শিখতের শুরু করেন।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে
কাসেম মল্লিক কমলা ঝরিয়াকে কলকাতায় নিয়ে আসেন এবং এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।
তিনি প্রথম গান রেকর্ড করেন হিজ মাস্টার্স ভয়েসে। এই
রেকর্ডটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে (ভাদ্র-আশ্বিন ১৩৩৭)।
এই রেকর্ডে ২টি গান ছিল। এগুলো হলো-
রেকর্ড নম্বর এন
৩১৩৭
A. প্রিয়
যেন প্রেম ভুলো না এবং একটি গজল। এই গানটির রচয়িতা
ছিলেন
ধীরেন্দ্রনাথ দাস।
B নিঠুর নয়ন-বাণ কেন হান এবং একটি দাদরা
এই গান দুটির রচয়িতা
ছিলেন
প্রণব রায় এবং সুরকার ছিলেন তুলসী লাহিড়ি। এই চারটি গানের জন্য তিনি
পেয়েছিলেন ৬৫ রুপি।
গানের রেকর্ড সম্পন্ন হওয়ার পর, কমলা দেশে ফিরে যান। রেকর্ড কোম্পানি গান রেকর্ডের
সময় শিল্পীর নাম হিসেবে শুধু কমলা লিখে রেখেছিল। রেকর্ড প্রকাশের সময় পূর্ণ নাম না
পাওয়ায় প্রথমে নাম রাখা হয় মিস্ কমলা। কিন্তু এই নামে এই সময়ে আরও একজন শিল্পী
ছিলেন, তাই কমলার বাসস্থানের নাম বন্ধনীর ভিতরে যুক্ত করে- নাম রাখা হয় মিস্ কমলা (ঝরিয়া)।
কালক্রমে বন্ধনীর ভিতরে রাখা ঝরিয়া সরাসরি নামের সাথে যুক্ত হয়ে দাঁড়ায় কমলা ঝরিয়া।
এরপর কমলা ধীরে ধীরে ওস্তাদ উজির খানের কাছে ঠুমরি, জমিরউদ্দীন খানের কাছে গজল ও
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাইরে তিনি অন্যান্য গানের
তালিম নেন কে মল্লিকম সতীশ ঘোষ এবং শ্রীনাথ দাশ নন্দীর কাছে। এরপর তিনি
কাজী নজরুল ইসলাম এবং তুলসী দাসের তত্ত্বাবধানে নজরুল সঙ্গীত ও বাংলা চলচ্চিত্রের গানের রেকর্ড
করেন।
নজরুল ইসলামের
গান গেয়ে বেশ সুনাম অর্জন করেন করেন
তিনি। নজরুলের গানের ক্ষেত্রে তাঁকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন স্বয়ং
নজরুল এবং তুলসী লাহিড়ী এ বিষয়ে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন-
'তা গেয়েছি, তবে গোড়ার জীবনে। পরে
লাহিড়ী মশাই আমাকে আলাদা করে তালিম দিয়েছেন, কত কী শিখিয়েছেন! পরে তো আমি
বেশিরভাগ ওঁর গানই গেয়েছি। তবে কাজীদার দানও ভুলবো না। কত বড়ো মানুষ, কত
অফুরন্ত ওঁর গানের ভাণ্ডার। কথায় কথায় মুখে মুখে গান বাঁধতে পারতেন, এমন
ক্ষমতা' (শ্যামল ঘোষ : ‘স্মৃতি সত্তা নাট্য’, কলকাতা, জানুয়ারি ২০০৩; পৃ. ১৮৫)।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম
চলচ্চিত্রের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর অভিনীত প্রথম ছবিটি ছিল
Blood
Feud
। পরিচালক ছিলেন
হীরালাল। এই ছবিতে হরিপ্রসন্ন দাসের সঙ্গীত পরিচালনায় কণ্ঠ দান করেছিলেন।
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে
এইচএমভি থেকে পাঞ্জাবি, উর্দু ও হিন্দি ভাষায় রচিত ১০টি গানের রেকর্ড প্রকাশিত
হয়েছিল। এর ভিতরে ছিল গজল, গজল-কাওয়ালি, ও দাদরা অঙ্গের গান। এই বছরে ৪টি বাংলা
গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল। এর ভিতরে একটি গানের রচয়িতা ছিলেন ধীরেন মুখোপাধ্যায়।
অপর তিনটি গান ছিল কাজী নজরুল ইসলামের।
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে
এইচএমভি ছাড়াও টুইন কোম্পানি থেকে তাঁর রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল। এর বেশির ভাগই ছিল-
হিন্দি ও উর্দু গজল, ভজন, ঠুমরি ইত্যাদি অঙ্গের গান। এরপর তাঁর কিছু গানের রেকর্ড
প্রকাশ করেছিল সেনোলা, পাইওনিয়র, মেগাফোন ও কলম্বিয়া। এই বছরে তিনি প্রথম বাংলা
সিনেমা 'যমুনা পুলিনে' -এ কণ্ঠ দান করেন। বাংলা গানে তিনি বিশেষভাবে সুপরিচিতা
হয়ে উঠেছিলেন নজরুলের গান, কীর্তন ও রামপ্রসাদী গানের জন্য।
১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রিয়নাথ এন
গাঙ্গুলি পরিচালিত 'পাতাল পুরী'
নামক ছায়াছবিতে টুমনির প্রতিবেশিনী চরিত্রে অভিনয় করে। এছাড়া তিনি দুটি গান
গেয়েছিলেন। গান দুটি হলো- দিনের আলো ফুরায়ে
যায় ও বল গো তায় ফিরে যেতে।
১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে অন্নপূর্ণার মন্দিরে কণ্ঠদান করেন। এই ছবিতে
তাঁর গাওয়া 'বঁধু তুমি যে আমার প্রাণ' বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রগুলো হলো-
- Blood
Feud [১৯৩১।
চরিত্রের নাম জানা যায় নি। এছাড়া এই ছবিতে গান গেয়েছিলেন]
- যমুনা পুলিনে
[১৯৩৩। চরিত্র: রাণী বিশাখা। এছাড়া এই ছবিতে গান গেয়েছিলেন]
- মাস্তুতো ভাই
[১৯৩৪। চরিত্রের নাম জানা যায় নি]
- পাতালপুরী [১৯৩৫।
চরিত্র: তুম্নী'র প্রতিবেশিনী]
- মন্ত্রশক্তি [১৯৩৫।
চরিত্র: রাণী বাঈজী]
- সোনার সংসার [১৯৩৬।
চরিত্র: বৈষ্ণবী]
- বাঙ্গালী [১৯৩৬।
চরিত্রের নাম জানা যায় নি]
- তরুবালা [১৯৩৬।
চরিত্রের নাম জানা যায় নি]
- দেবযানী [১৯৩৯।
চরিত্র: ছন্দা]
- ঠিকাদার (১৯৪০)
- বিজয়িনী (১৯৪১)
গানের সূত্রে তুলসী লাহিড়ীর সাথে তাঁর প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ নিয়ে পারবারিক
অশান্তি শুরু হলে, তুলসী লাহিড়ী তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী শান্তিলতা এবং চার পুত্র ও দুই কন্যাকে ছেড়ে কমলার সঙ্গে থাকা শুরু করেন। পরে অবশ্য দুজনের এই সম্পর্ক তুলসী লাহিড়ীর পরিবার মেনে নিয়েছিলেন।
তুলসী লাহিড়ী কমলাকে নিয়ে নানা ভাড়াবাড়িতে থাকার পর শেষে তাঁকে কলকাতার
১৫৮/সি রাসবিহারী এভিনিউয়ের একেবারে সদর রাস্তার পাশে একটি তিনতলা বাড়ি কিনে দেন।
ঝরিয়া থেকে কমলার এক ভাই এসে সপরিবার এই বাড়িতে ওঠেন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তুলসী লাহিড়ির মৃত্যু হয়।
তুলসী লাহিড়ীর মৃত্যুর পর কমলা গানের জগৎ থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নেন।
অনেকটাই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন তিনি, বাইরের যোগাযোগও কমে আসে। এরপর তাঁর আর কোনো নতুন
রেকর্ড বের হয়েছে বলে জানা যায় না। মৃত্যুর বছর তিনেক আগে শেষ বড়ো কোনো অনুষ্ঠানে
উপস্থিত ছিলেন, যখন গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইন্ডিয়া লিমিটেডের পক্ষ থেকে তাঁকে
'গোল্ডেন ডিস্ক' দিয়ে
সম্মানিত করা হয়।
১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
কমলা ঝরিয়ার গাওয়া নজরুলসঙ্গীতের তালিকা
- কেন করুণ সুরে হৃদয় পুরে [তথ্য]
[এচএমভি। জুন ১৯৩২। এন ৭০০১]
- পরদেশী দেশী বঁধুয়া [তথ্য]
সূত্র: