মুন্সী মহম্মদ কাসেম
(
১৮৮৫-১৯৫৯)
সঙ্গীতশিল্পী। কাসেম মল্লিক বা কে. মল্লিক নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। রেকর্ডের গানগুলোতে তাঁর নাম ছাপা হয়েছে নানা নামে। যেমন- কে মল্লিক, কাশেম মল্লিক, পণ্ডিত শঙ্কর মিশ্র এবং মুন্সী মোহাম্মদ কাসেম।

১২৯৫ বঙ্গাব্দের ১২ জ্যৈষ্ঠ ( বৃহস্পতিবার ২৪ মে ১৮৮৮ খ্রি ষ্টাব্দে) ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজের বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার মন্তেশ্বর থানার কুসুম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মুনশী মুহম্মদ ইসমাইল।

কাশেমের চাচাতো ভাই ছিলেন তৎকালীন মালদার বিখ্যাত জমিদার ইব্রাহিম মুন্সী। তিনি সঙ্গীতপ্রতিভার জন্য কাশেমকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তিনিই আদর করে কাশেমের নাম দেন 'মানু'। জমিদার ইব্রাহিম কাশেমকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। সে সময়ে জমিদারবাড়িতে গান শেখাতে আসতেন সঙ্গীতশিল্পী সতীশ চক্রবর্তী। কাশেম সেখানে গান শিখতে শিখতে সতীশবাবুর স্নেহধন্য হয়ে ওঠেন। হঠাৎ কলেরা রোগে ইব্রাহিম মুন্সীর মৃত্যু হলে, কাশেম ও তাঁর পরিবার অভাবে পড়ে যায়। এরপর বালক বয়সে কাশেম, সতীশবাবুর সঙ্গে এক দিন বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় আসেন। এই সময় তিনি কলকাতার তুলাপট্টিতে চামড়ার গুদামে সামান্য মাইনেতে কাজ করা শুরু করেন। সে সময়ে তাঁর রাত কাটানোর মতো কোনো ভালো ঘর ছিল না। তাই অধিকাংশ রাত তিনি কাটিয়েছেন ফুটপাতে।

সঙ্গীতের প্রতি তাঁর অদম্য আগ্রহ ছিল। সঙ্গীতশিক্ষা এবং একটু ভালো মাইনের চাকরি পাবারা আশায় তিনি কানপুরে চলে যান। সেখানে তিনি র‌্যালি ব্রাদার্স কোম্পানিতে চাকরি নেন। এই সময় তিনি কানপুরের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ আবদুল হাই হাকিম-এর কাছে শাস্ত্রীয়সংগীতের শিক্ষা লাভ করেন। এরপর গঙ্গাতীরের পাগলা ফকিরদের আশীর্বাদ এবং অনুমতি নিয়ে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং কুড়ি টাকা মাইনের একটি কাজ জোগাড় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এই সময় কলকাতার  রেকর্ডিং কোম্পানিগুলো বিভিন্ন শিল্পীদের গান রেকর্ড করে এবং তা বাজারজাত করে সঙ্গীতের বাণিজ্যিক ক্ষেত্রকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। কোম্পানিগুলো নতুন শিল্পীর সন্ধানে ছিল। কলকাতায় ফেরার পর তাঁর বন্ধুবান্ধবদের তাড়নায় প্রায়ই কাশেম সঙ্গীতের আসর করতেন। কলকাতার তালপট্টি মোড়ে আয়োজিত এক আসরে কাশেমের গান পরিবেশনের সময় রাস্তায় যানজটের সৃষ্টি হয়। এই যানজটে পড়েছিলেন জার্মান রেকর্ড কোম্পানি বেকা-এর মালিক। পরে উক্ত মালিক ওই আসরেই কাশেমকে রেকর্ডে কণ্ঠদানের অনুরোধ করেন। এরপর তিনি একটি রেকর্ডে হিন্দু ভক্তিসঙ্গীত গান। হিন্দু ভক্তি সঙ্গীত মুসলমান শিল্পী পরিবেশন করলে, বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে ভেবে  গোরাচাঁদ মল্লিক এবং শান্তি মল্লিকের নামানুসারে ' মুন্সী মহম্মদ কাসেম' নাম রাখা হয় 'কে মল্লিক'। এই কে. মল্লিক নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।  এই কে. মল্লিক নামেই তিনি খ্যাতির শীর্ষে উঠে যান। মোট বারোটি শ্যামাসংগীত রেকর্ড এর মাধ্যমে তিনি গ্রামোফোন শিল্পীরূপে আত্মপ্রকাশ করেন। উল্লেখ্য এই সময় তিনি রেকর্ডে গান গাওয়ার জন্য পেয়েছিলেন তিনশো টাকা।রেকর্ডের গানে জনপ্রিয়তার সূত্রে তিনি থিয়েটারে এবং বেতারে গান পরিবেশনে গান গাওয়া শুরু করেন।

রেকর্ডের নজরুল ইসলামের গানের ক্ষেত্রে ছিলেন তৃতীয় সঙ্গীত শিল্পী। নজরুলের গান প্রথম রেকর্ডে গেয়েছিলেন হরেন্দ্রনাথ দত্ত। দ্বিতীয় শিল্পী ছিলেন আঙ্গুরবালা। নজরুলের গানের চতুর্থ রেকর্ডের তৃতীয় শিল্পী হিসেবে দুটি গজল গেয়েছিলেন কাসেম। এই গান দুটি হলো- এই দুটি গান কাশেমকে শিল্পী হিসেবে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। রেকর্ড কোম্পানিগুলোও তাঁকে বিশেষভবে সম্মানিত করেছিল। গ্রামোফোন কোম্পানিতে সে সময় নতুন গানের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব ছিলেন- কমল দাশগুপ্ত, ধীরেন দাস ও জমিরুদ্দিন খাঁ। কিন্তু  নতুন শিল্পীদের সুর ও তাল দিয়ে গান রেকর্ড করানোর, আগে সব দিক বিবেচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল কে মল্লিককে। এই সূত্রে আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালাদের মতো শিল্পীদেরকে ও কে মল্লিকের কাছে তালিম প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল।

ভারতের তৎকালীন বেঙ্গাল প্রেসিডেন্সি'র অন্তর্গত বিহার রাজ্যের ঝরিয়া‌র  মহারাজ শিবপ্রসাদ তাঁর বিবাহ বার্ষিকীতে সেকালের কে. মল্লিককে তাঁর দরবারে সঙ্গীত পরিবেশনের আমন্ত্রণ জানান। মল্লিকের গান শুনে মহারাজ এতটাই মুগ্ধ হন যে, তিনি তাঁকে তাঁর দরবারের সভাগায়ক হিসেবে থাকার অনুরোধ করেন। এই সূত্রে কে. মল্লিক প্রায় ৭-৮ বছর এই রাজদরবারের সভাগায়ক হিসেবে কাটান। এই সময় ঘটনাক্রমে কে.মল্লিক কমলা ঝরিয়া‌র গান শুনে মুগ্ধ হন এবং মহারাজের অনুমতি নিয়ে, তাঁকে গান শেখানো শুরু করেন। এরপর তিনি ঝরিয়া -রাজদরবারের আরেক সংগীতগুণী শ্রীনাথ দাসনন্দীর কাছে শাস্ত্রীয়সংগীত শিখতের শুরু করেন।

ইসলামি গান লেখাশুরু করলে তিনি ইসলামি গান গাইতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁর এই আগ্রহের কথাআব্বাসউদ্দিন আহমদের মাধ্যমেনজরুলকে জানালে, নজরুলতার জন্য ইসলামি গান লেখার অঙ্গীকার করেন।কিন্তু কে. মল্লিকের নামে ইসলামি গান রেকর্ড করলে, শ্যামাসংগীত রেকর্ড বিক্রয় কমে যাবে, এই আশঙ্কায় গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল ইনচার্জ ভগবতী ভট্টাচার্য তাতে রাজি হন নি। ভগবতীবাবুর মৃত্যুর পর দায়িত্বে আসেন শ্রীহেমচন্দ্র সোম। তার সম্মতিতে নজরুল শিল্পীর জন্য ইসলামি গান লিখেন এবং ‘মুন্সী মহাম্মদ কাসেম’ নামেই তা রেকর্ড করা হয়।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে কে. মল্লিককে কমলা ঝরিয়াকে কলকাতায় নিয়ে আসেন এবং এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি প্রথম গান রেকর্ড করেন হিজ মাস্টার্স ভয়েসে।

এরপর হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ তার গান রেকর্ড করে। তিনি ‘পণ্ডিত শঙ্কর মিশ্র’ নামে হিন্দি গানও রেকর্ড করেন।

 ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ কে মল্লিক তাঁর অর্থ যশ খ্যাতির সঙ্গীতজগৎ ছেড়ে জন্মস্থান কুসুমগ্রামে চলে আসেন। এখানে কিছু জমি ও পুকুর কিনে একটি ছোট একতলা বাড়ি তৈরি করে বসবাস করতে থাকেন। এই সময় গরিব কৃষক মজুরদের বিনা পয়সায় গান শোনাতেন এবং গান শেখাতেন।

১৩৬৬ বঙ্গাব্দে (১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে) তিনি কুসমগ্রামে পরলোকগমন করেন।

বৈবাহিক অবস্থা: কাসেম মল্লিকের গাওয়া রেকর্ডে নজরুল সঙ্গীত