বিষয়: নজরুল সঙ্গীত।
শিরোনাম: জয়, আনন্দ-ভৈরব ডমরু পিনাক-পাণি
জয়, আনন্দ-ভৈরব ডমরু
পিনাক-পাণি,
গঙ্গাধর চন্দ্র চূড় শিব তীব্র-ধ্যানী॥
তব সূর্যকান্তি রাগে
প্রাণে প্রভাত-শান্তি জাগে,
পর প্রধান পূর্ণরূপ, হে শুদ্ধ জ্ঞানী॥
সরল মতি শঙ্কর হে, নাচো গরল পিয়ে,
আশুতোষ তুষ্ট তুমি বিল্বদল নিয়ে।
মৃত্যু-ভীত বিশ্বজনে
তমসা মগন ভুবনে,
শোনাও আনন্দিত মাভৈঃ অভয়বাণী॥
-
ভাবসন্ধান: নজরুল গানটি রচনা করেছিলেন বেতারে
প্রচারিত 'হারমণি'র এবং
'ষট্ভৈরব' সঙ্গীতালেখ্যের 'আনন্দভৈরব' রাগের জন্য। এই গানটি মূলত 'আনন্দভৈরব'
রাগের 'লক্ষণ-গীত'। কিন্তু
শিববন্দনার রূপকতার মধ্য দিয়ে তিনি এই রাগের প্রকৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
ফলে এই গানের ভাবে চলে এসেছে দ্ব্যর্থক আলোছায়ার খেলা। সাহিত্যের পারিভাষিক অর্থে
বলা যায় সন্ধ্যা ভাষা। তাই ভাবানুসারে গানটির দুটি ব্যাখ্যা দেওয়া হলো।
পৌরাণিক ভাব:
পৌরাণিক আখ্যানের বিচারে কবি, এই গানের সূত্রপাত করেছেন- ডমরু ও
ত্রিশূলধারী শিবকে 'আনন্দ-ভৈরব' নামে 'জয়' ধ্বনি দিয়ে। শিবের অপর নাম ভৈরব, তাই
আনন্দ-ভৈরবের সমার্থক শব্দ হলো সদানন্দ শিব। দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে কবি,
শিবের অন্যান্য বিশেষণবাচক নামকে উপস্থাপন করেছেন। যেমন- স্বর্গ থেকে পতিত
গঙ্গাকে মস্তকে ধারণ করেছিলেন বলে তিনি গঙ্গাধর, তাঁর মাথায় শোভিত রয়েছে
চন্দ্র- তাই তিনি চন্দ্রচূড়, গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকেন বলে তিনি তীব্র-ধ্যানী।
কবি শিবের রূপকে সূর্যকান্তি রাগ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য এখানে রাগ শব্দটি রঙ
অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রভাতের অরুণকান্তির মতো শিবের দেহশোভার মধ্যে কবি খুঁজে পেতে চেয়েছেন
প্রভাতের সৌম্য ধ্যানগম্ভীর এবং স্নিগ্ধ রূপকে। শিবের অপর নাম মহাদেব।
তাই তিনি সকল দেবতাদের মধ্যে পূর্ণ এবং শুদ্ধজ্ঞানী বা পরমজ্ঞানী।
পৌরাণিক আখ্যানে সূত্রে গানটির সঞ্চারীতে কবি আবার ফিরে এসেছেন
শিববন্দনায়। সত্য-সুন্দরের প্রতীক শিব। কুটিলতা বর্জিত বলে তিনি সরল। সমুদ্র
মন্থনে সৃষ্ট বিষ পান করে তিনি নীলকণ্ঠ হয়ে নৃত্য করেছিলেন।
তিনি
জগতের সকল কলুষতা, কুটিলতা গরল আত্মস্থ করেই
কলুষমুক্ত জগত প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্দাম ধ্বংসের তাণ্ডবনৃত্যে
মাতেন। তিনি শুধু বেলপাতার নিবেদনে তিনি রুদ্ররোষকে সংযমন করেন। অল্পে
সন্তুষ্ট বলে তিনি আশুতোষ। সবশেষে কবি নৈরাশ্য ও বেদনাকারে
নিমগ্ন সমগ্র জগতের মুক্তির
প্রার্থনা রেখেছেন শিবের কাছে। প্রার্থনা করেছেন
তাঁর
কল্যাণময় অভয়বাণী, যেন সে বাণীতে রুদ্র শিব হয়ে উঠুক
আনন্দ-ভৈরব।
লক্ষণগীত
আনন্দ ভৈরব (শিবের অপর নাম ভৈরব)। অর্থাৎ এই রাগটিতে প্রকাশ পায় ভৈরবের
আনন্দময় রূপ। এই রাগে ধা নি (শুদ্ধ ধৈবত ও নিষাদ) ব্যবহৃত হয়।
তাই শিব (সদানন্দ শিব বা আনন্দ ভৈরব)-রূপী রাগের শুদ্ধ ধৈবত ও নিষাদকে তীব্র-ধ্যানী
উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে তীব্র ধৈবত ও নিষাদ-ই একালের
শুদ্ধ ধৈবত ও শুদ্ধ নিষাদ।
রাগের বিচারে কবি 'আনন্দ-ভৈরব'
রাগকে ডমরু-ত্রিশূলধারী সদানন্দ শিবের সাথে তুলনা করে 'জয়' ধ্বনি উচ্চারণ
করেছেন।
কবি এই গানের
অন্তরাতে প্রভাতের রাগ 'সূর্যকান্তি'র সাথে তুলনা করেছেন।
'মা'রিফুন্নাগমাত' নামক সঙ্গীতগ্রন্থে উল্লেখ আছে- যদি এই
রাগে তীব্র ধৈবত ব্যবহার করা যায় তাহলে এই রাগটি গ্রন্থে বর্ণিত 'সূর্যকান্ত'
রাগে পরিণত হয়।' এই বিচারে আনন্দ-ভৈরব এবং সূর্যকান্ত রাগ অভিন্ন রাগ হিসেবে
অভিহিত করা যায়। উল্লেখ্য, দক্ষিণভারতে সূর্যকান্তা নামে একটি রাগের নাম পাওয়া যায়।
এছাড়া কবি অন্তরাতে এই রাগের কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন- 'পর প্রধান
পূর্ণরূপ, হে শুদ্ধ জ্ঞানী'। এখানে 'পর প্রধান' হলো- প
(পঞ্চম) এবং র (ঋষভ)। নজরুলের
পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায় বাদী: অষ্টম (ষড়জ থেকে অষ্টম স্বর হলো পঞ্চম)
এবং সমবাদী রেখাব। আবার প্রসঙ্গক্রমে নজরুলের পাণ্ডুলিপি থেকে জানা যায়- '...কেহ
কেহ বক্রভাবে কোমল ধৈবত লাগান। ইহাতে এই রাগিণী মধুরতর শোনায়।... এই মতের যাহারা
পরিপোষক, তাহারা মধ্যমকে বাদী ও ষড়জবাদী করিয়া রাগিণী আলাপ করেন।' গ্রন্থভেদে
এই রাগের বাদী ও সম্বাদী নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। তাই মোটা
দাগে বলা যায়- পর (পা রে) প্রাধান্য পায়। রাগটি 'পূর্ণরূপ'
অর্থাৎ জাতি সম্পূর্ণ-সম্পূর্ণ। আর শুদ্ধ জ্ঞানী হলো-
এই রাগে শুদ্ধ গা (গান্ধার) এবং শুদ্ধ নি (নিষাদ) ব্যবহৃত হয়।
গানটির সঞ্চারীতে রাগ বর্ণিত হয়েছে রূপকতার মধ্য দিয়ে। রাগের গতি সরল। বক্রস্বর ব্যবহার হয় না ।
এ বিচারে রাগটি সরল। বিলাবল ঠাটের একটি বিশেষ রাগ শঙ্করা। এর
আরোহণ
: স গ প ন ধ র্স।
অবরোহণ: র্স ন প, ন ধ র্স ন, প, গ প, গ, র স। ভৈরবের সাথে উত্তরাঙ্গে
শঙ্করার (অবশ্যই বিলাবল অঙ্গ) মিশ্রণ ঘটেছে। তাই হয়তো নজরুল শঙ্কর (পুংলিঙ্গে) শব্দ
ব্যবহার করেছেন। আর এই মিশ্রণের ফলে গরল (ভেজাল বা বিষ) ধারণ করতে হয়েছে
'আনন্দ-ভৈরব'-কে। তারপরও রাগটি পরিবেশনায় ন্যাস,
অপন্যাসের বিন্যাসে মধুর সুরের বিন্যাস ও ছন্দ খুঁজে
পাওয়া যায়। তাই রাগটি গঠনের বিচারে গরল
হলেও, এর সুর ও ছন্দ মনে নৃত্যের নান্দনিক রূপকে উদ্ভাসিত করে। অতি সহজে এই
রাগের রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ রাগটি সহজে ধরা দেয়, এই অর্থে আনন্দ-ভৈরব আশুতোষ।
গানটির শেষাংশে কবি শিব এবং আনন্দ-ভৈরবকে
সমার্থক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি শিবের কাছে যে
অভয়বাণীর প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। তেমনি এই রাগ
পরিবেশনে অভয়বাণী ছড়িয়ে পড়ুক সেটাও কামনা করেছেন।
-
রচনাকাল ও স্থান: গানটির
রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না।
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৪ নভেম্বর (শনিবার ১৮ কার্তিক ১৩৪৬), সন্ধ্যা ৭টা-১৫ মিনিটে, বেতারের 'হারামণি' নামক অনুষ্ঠানে
দ্বিতীয় পর্বে আনন্দ ভৈরব রাগে নিবদ্ধ নজরুলের রচিত এই গানটি প্রথম সম্প্রচারিত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪০ বৎসর
৫ মাস।
- গ্রন্থ:
- নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ, (নজরুল ইনস্টিটিউট, মাঘ ১৪১৮। ফেব্রুয়ারি ২০১২) -এর ১৩৯৭ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ৪২২।
- নজরুল গীতি, অখণ্ড (আব্দুল আজীজ আল-আমান, সম্পাদিত)। [হরফ প্রকাশনী, মাঘ ১৪১০। জানুয়ারি ২০০৪]। রাগ-প্রধান গান। গান-৮৫০। পৃষ্ঠা: ২১৭।
- বেতার
-
হারামণি-২।
কলকাতা বেতার কেন্দ্র [৪ নভেম্বর ১৯৩৯ (শনিবার ১৮ কার্তিক ১৩৪৬)। সান্ধ্য অনুষ্ঠান। ৭.২০-৮.৩৯ মিনিট। শিল্পী: কাজী নজরুল ইসলাম]
- সূত্র:
- বেতার জগৎ। ১০ম বর্ষ ২১শ সংখ্যা। পৃষ্ঠা:
৮৩৫
- The Indiann-Listener. 4
November 1939/Vol. IV No. 21. Page 1495
- একক অনুষ্ঠান: শিল্পী গীতা
বসু। কলকাতা বেতার কেন্দ্র-১ [মঙ্গলবার,
১ জুলাই ১৯৪১ (১৭ আষাঢ় ১৩৪৮)। প্রথম অধিবেশন।
সকাল ৭.৩০-৮.৭.৩৯।
সূত্র:
- বেতার জগৎ। ১২শ বর্ষ ৩য় সংখ্যা। পৃষ্ঠা:
৭৫৪
- The
Indian listener. Vol VII. No 3, page 31
- ষট ভৈরব
(ছয়টি ভৈরব অঙ্গের রাগ নিয়ে সৃষ্ট
সঙ্গীতানুষ্ঠান)। কলকাতা বেতার কেন্দ্র। ১৩ জুলাই ১৯৪১ (রবিবার ২৯ আষাঢ়। ১৩৪৮)। প্রচার সময়: ৮.২৫-৯.০৪।
[সূত্র:
- বেতার জগত [১২শ বর্ষ ১৩শ সংখ্যা, মঙ্গলবার, ১
জুলাই ১৯৪১, ১৭ আষাঢ় ১৩৪৮ পৃষ্ঠা ৭৭৮]
- The Indiann-Listener [22 Sepetember
1939/Vol. VI No. 13. Page 79]
- সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম
- বিষয়াঙ্গ: ভক্তি [আনন্দ-ভৈরবের লক্ষণগীত বা শিব-বন্দনা]
- সুরাঙ্গ:
ধ্রুপদাঙ্গ