ধ্রুপদের বৈশিষ্ট্য
ধ্রুপদাঙ্গের গানের বৈশিষ্ট্য
বাংলা
ধ্রুপদাঙ্গের গানের ইতিহাস
প্রথম বাংলা ধ্রুপদগান রচনা করেছিলেন, ধ্রুপদের বিষ্ণুপুরী ঘরানার আদিকবি
পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য। তিনি ধ্রুপদের পাঠ
নিয়েছিলেন জনৈক হিন্দুস্থানী গুরুর কাছে।
পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য তাঁকে পণ্ডিতজী নামে অভিহিত করতেন। প্রাথমিক
পর্যায়ে তিনি গুরুর হিন্দুস্থানী ভাষায় রচিত ধ্রুপদ পরিবেশন করতেন। পরে তিনি
ধ্রুপদের তিনি হিন্দুস্থানী ভাষা ত্যাগ করে বাংলাতে ধ্রুপদ রচনা শুরু করেন এবং তা
তাঁর শিষ্যদের শেখান। মূলত
তাঁর সূত্রেই ভারতবর্ষের রাগসঙ্গীত জগতে
বিষ্ণুপুরে ঘরানার সৃষ্টি হয়েছিল।
১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য বিষ্ণুপুরে মৃত্যবরণ করেন। তিনি কখনো বিষ্ণুপরের বাইরে আসেন নি। তাঁর শিষ্যদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ধ্রুপদ চর্চার প্রসার ঘটে। তাঁর শিষ্যদের ভিতরে এক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, যদুভট্ট, কেশবলাল চক্রবর্তী, রামশঙ্কর ভট্টাচার্য-এর তৃতীয় পুত্র ও শিষ্য রামকেশব ভট্টাচার্য, অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য এবং শিষ্যরা মূলত বাংলা ধ্রুপদের চর্চা করেছিলেন। তাঁদের গানগুলো ধ্রুপদাঙ্গের ছিল না। ধ্রুপদাঙ্গের গানের সাথে জড়িয়ে রয়েছে রাজা রাজা রামমোহন রায় এবং তাঁর প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের জন্য লিখিত ব্রহ্মসঙ্গীত।
রাজা রামমোহন রায়
বিস্তর পড়ালেখার সূত্রে তিনি ক্রমে ক্রমে একেশ্বরবাদী হয়ে উঠেন। যে সকল উপনিষদ ও
বেদান্তসূত্র একশ্বেরবাদ সমর্থন করে, সেগুলোর প্রচারণ শুরু করেন। ১৮১৫ থেকে ১৮১৯
খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিনি বেদান্তগ্রন্থ, বেদান্তসার, কেনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ,
কঠোপনিষদ, মাণ্ডূক্যোপনিষদ ও মুণ্ডকোপনিষদ বাংলা অনুবাদসহ প্রকাশ করেন। এর ফলে
রক্ষণশীল ব্যক্তিরা ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর লেখার প্রতিবাদ করতে থাকেন। এই সকল প্রতিবাদ
ছিল কটুক্তিপূর্ণ এবং বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। কিন্তু রামমোহন এসবের প্রতিবাদ করতেন
যুক্তি দিয়ে ও ভদ্রভাষায়। প্রতিবাদ-কর্তাদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান ছিলেন
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, এঁর গ্রন্থের নাম 'বেদান্তচন্দ্রিকা'। বেদান্তচন্দ্রিকা'র
প্রতিবাদে রামমোহন ভট্টাচার্যের তীব্রভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন।
ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের শুরুতে ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন 'আত্মীয় সভা'।
যতদূর জানা যায়, 'আত্মীয় সভা'র জন্য তিনি প্রথম ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেন ১৮১৬
খ্রিষ্টাব্দের দিকে। গানটি হলো- 'কে ভুলালো হায়' (পাঠভেদ : মন তোরে কে ভুলালে হায়)।
এই গানটি ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত 'আত্মীয় সভা'য় গীত হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে
তাঁর রচিত আরও একটি ব্রহ্মসঙ্গীত পরিবেশিত হয়েছিল। গানটি হলো 'ভয় করিলে যাঁরে না
থাকে ভয়'।
১৮২১ খ্রিষ্টাব্দে
রামমোহন রায় ইউনিটোরিয়ান
কমিটি নামে ধর্মসভা স্থাপন করেন। পত্রিকার স্বাধীনতা হরণের প্রতিবাদে তিনি মীরাৎ-উল-আখ্বার বন্ধ করে দেন। ১৮২৩
খ্রিষ্টাব্দের ১১ ডিসেম্বরে তিনি নিজ খরচে এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান স্কুল
স্থাপন করেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায়
১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে ২০ আগষ্ট তারিখে
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অন্যান্য বিশিষ্ট
ব্যক্তিদের নিয়ে ব্রাহ্মসমাজ গঠিত হয়। ব্রাহ্মধর্মের
অঙ্গ হিসেবে বাংলা সঙ্গীতজগতে একটি নতুন ধারার সূচনা করেন।
ব্রহ্মের
উদ্দেশ্যে নিবেদিত এই গান বর্তমানে
ব্রহ্মসঙ্গীত নামে
পরিচিত।
শুরু থেকেই
ব্রহ্মসঙ্গীত-এর
সুর ছিল রাগাশ্রয়ী। বাংলার লোকসুরের প্রভাব তাতে একেবারেই নেই।
কালী মীর্জা'র
একমাত্র নির্ভরযোগ্য পুস্তক গীতলহরীতে থেকে জানা যায়, আদি টপ্পাগানের শিল্পী
কালী মীর্জা'র
কাছে
রামমোহন রায় রাগসঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন। কিন্তু ব্রহ্মসঙ্গীতে
তারও প্রভাব নেই। সে সময়ে কলকাতার
ধনীব্যক্তিদের সঙ্গীত সভায় টপ্পা এবং
বিষ্ণুপুরী ঘরানার ধ্রুপদের কদর ছিল প্রচুর।
রামমোহন রায়
ব্রহ্মসঙ্গীতের টপ্পা এবং ধ্রুপদের প্রভাব ছিল। রামোহন
রায়ের গ্রন্থাবলীর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ সংস্করণে ৩২টি গান পাওয়া যায়। এর ভিতর ১৩টি
গান আড়াঠেকা, ২টি ঝাঁপতাল, ২টি একতাল, ১টি কাওয়ালি, ১টি তেওট, ২টি ঠুংরি, ২টি
ঝাঁপতাল ও একটি ধামার। এই গানগুলোর তাল দেখে মনে হয়, এর অধিকাংশই টপ্পা অঙ্গের গান।
প্রকৃত ধ্রুপদাঙ্গের গান ছিল ৩টি। এ গানগুলো হলো
২টি ঝাঁপতাল ও একটি ধামার। এর ভিতরে আবার 'পরমাত্মায়
হও রে মন রত' গানটি দুই তুকের। সে কারণে এ গানটি প্রকৃত ধ্রুপদাঙ্গের কিনা তা নিয়ে
সন্দেহ জাগে।
রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদাঙ্গের গান
সূত্র :
রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসংগীত। দিলীপকুমার বিশ্বাস। দেশ সাহিত্য সংখ্যা
১৩৯৩।
রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রসঙ্গ দ্বিতীয় খণ্ড। প্রফুল্লকুমার দাস। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪১১৪।
২৪ নভেম্বর ২০০৭।
বাঙালির রাগসঙ্গীত চর্চা। দীলিপকুমার মুখোপাধ্যায়।