দোলন-চাঁপা বনে দোলে দোল্-পূর্ণিমা-রাতে চাঁদের সাথে।
(শ্যাম) পল্লব-কোলে যেন দোলে রাধা লতার দোলনাতে॥
(যেন) দেব-কুমারীর শুভ্র হাসি
ফুল হয়ে দোলে ধরায় আসি'
আরতির মৃদু জ্যোতি প্রদীপ-কলি দোলে যেন দেউল-আঙিনাতে॥
বন-দেবীর ওকি রূপালী ঝুম্কা চৈতি সমীরণে দোলে,
রাতের সলাজ আঁখি-তারা যেন তিমির-আঁচলে।
ও যেন মুঠিভরা চন্দন-গন্ধ
দোলে রে গোপিনীর গোপন আনন্দ,
ও কি রে চুরি করা শ্যামের নূপুর, চন্দ্রা-যামিনীর মোহন হাতে॥
গানটির সাথে রাগের আরোহ-অবরোহ, বাদী, সম্বাদী উল্লেখের সাথে সাথে রাগের প্রকৃতি বর্ণিত হয়েছে, এই ভাবে-ফিরে আসিল না আর বনের কিশোর
ঘরে ফিরিল না আর বনের কিশোরী
মাধুরী চাঁদের বুকে কৃষ্ণ লেখা হয়ে
দেখা দেয় আজো সেই কিশোরের ছায়া।
কাঁদে চাঁদ সেই বিরহীরে বুকে ধরি
আনন্দে কলঙ্কী নাম করিল বরণ।
বনের কিশোরী চন্দ্রা সেই চাঁদ পানে
চাহিয়া বনের বুকে বিসরিয়া তনু
ধরিল দোলনচম্পা রূপ এ ধরায়
জনম লভিয়া পুন হেরিতে কিশোর।
আজো দোল পূর্ণিমার রাতে বিকশিয়া
ঝরে যায় বিরহের প্রখর বৈশাখে
বারে বারে জন্ম লভে মরে বারে বারে
তবু তার প্রেমের সে অনন্ত পিপাসা
মিটিল না মিটিবে না বুঝি কোন কালে
অনন্ত এ বিরহের রাস মঞ্চে তার
অচ্ছেদ্য মিলন লীলা চলে অনিবার॥'ইহাতে হাম্বীর, কামোদ ও নট রূপ মাঝে মাঝে উঁকি দেয়, কিন্তু ইহার গতি অত্যন্ত দোলনশীল বলিয়া ঐ সব রাগের আভাস দিয়াই ছুটিয়া পালাইয়া যায়।নব রাগমালিকার অন্যান্য গানের মতোই এই গানটিও 'দোলনচাঁপা' রাগের রূপক-লক্ষণগীত। এরপরেও এই গানে একটি স্বতন্ত্র অর্থ পাওয়া যায়।
আরোহণে পূর্ববর্ত্তী সুরকে ধরিয়া 'ঝুলনা' বা দোলাই ইহার প্রধান বিশেষত্ব, দক্ষিণ সমীরণে দোলনচম্পার দোলনের সঙ্গে ইহার গতির সামঞ্জস্য হইতে ইহার নাম "দোলন-চম্পা" হইয়াছে। তীব্র মধ্যম ও গা মা নি ধা-য় চাঁপা ফুলের সুরভির তীব্রতা ও মাধুর্য ফুটিয়া উঠে।'দোলনচাঁপা সকল আনন্দের এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের তরঙ্গ। দোলন-চাঁপা রাগের অপরূপ দোল- যা হাম্বীর, কামোদ ও নট-এর রূপকে ভাগিয়ে দিয়ে আপন মহিমায় দুলে উঠে আপন মহিমায়। এই দোলনের আনন্দই এই গানের রাগের মূল সৌন্দর্য।
গানের স্থায়ীতে দোলনের আনন্দকে কবি দেখাতে চেয়েছেন- যেনো, দোল্-পূর্ণিমারাতে চাঁদের সাথে দোলন-চাঁপা ফুল দোল খায়। দোল-পূর্ণিমায় শ্যামের সাথে রাধা যেমন দোলনায় দোলে, তেমনি দোলন-চাঁপাও সবুজ-পাতার কোলে লতার দোলনাতে দোলে।
দেব-কুমারীর নির্মল হাসিই যেন দোলন-চাঁপা ফুল হয়ে পৃথিবীতে এসে দোলা খায়। যেন পূজার আরতি-প্রদীপের মৃদু জ্যোতি ফুলের কলির মতো মন্দিরের আঙিনাতে দোলে।
কবি দোলন-চাঁপার রূপে মুগ্ধ। তিনি ভাবেন বনদেবীর কানের দুলই যেনো চৈতালি চাদনী রাতে রূপালী ঝুমকা হয়ে দুলছে, যেন রাতের গোপন আনন্দের সলাজ আঁখিতারা অন্ধকারের আবরণের ভিতর দিয়ে আনন্দতরঙ্গে দুলছে।
দোলন চাঁপায় যেনো একমুঠি চন্দনের গন্ধের মতো, যা গোপিনীর গোপন আনন্দে দোলে। চন্দ্রশোভিত রাত্রিতে যেন মন চুরি করা শ্যামের নূপুর ধ্বনির ছন্দ, গোপিনীকে আন্দোলিত করে।
ত্রিতালে নিবদ্ধ খেয়ালাঙ্গের এই গানটি দুলে দুলে চলে। সুর চলে বক্রগতিতে দুলে দুলে। ফলে সরল ছন্দের ত্রিতাল চলে দোল্-পূর্ণিমারাতের দোলার ছন্দে। ছন্দের সরল দোলায় তানধর্মী অলঙ্কার এসে বিঘ্ন ঘটায় না।