বিষয়: নজরুল সঙ্গীত।
শিরোনাম: নৃত্যকালী শঙ্কর সঙ্গে নাচে অতি
রুদ্র-বিহঙ্গে
রাগ : বাঙাল ভৈরব, তাল : ঝুম্রা
নৃত্যকালী শঙ্কর সঙ্গে নাচে অতি
রুদ্র-বিহঙ্গে
ছন্দ ঝরে ঝর্ঝর ধারায় মন্দাকিনী গঙ্গা তরঙ্গে॥
মুক্তবেণী ধূর্জটি-জটা বিধূনিত অম্বরে দোলে
সসাগরা ভীতা পৃথ্বী কাঁপে মহাবিষ্ণুর কোলে,
বাজে ঘোর ডম্বরু শিঙ্গা উল্কা ছোটে ভ্রুকুটি ভঙ্গে॥
দ্বাদশ রবি-গ্রহ-শশী-তারা গ্রাসে দোঁহে ভৈরব রভসে,
মৃত্যূ-ক্ষুধা জাগিল একি রে, সৃষ্টি-স্থিতি সংহার মানসে।
পঞ্চভূত চিত্ত অহঙ্কার ব্রহ্মা-হরি লয় হ'ল ব্রহ্মে
উগ্র তারা রুদ্রের আবরি' নাচে একা উন্মাদ দম্ভে,
একি হেরি মূর্ছিতা শক্তি সোহম্ শিব আমারি অঙ্গ॥
-
ভাবার্থ:
এটি
ষট্— ভৈরব গীতি-আলেখ্যের পঞ্চম গান। শিব-ও দুর্গার অশুভ শক্তির বিনাশের শক্তি হিসেবে শুরু হলেও- সকল শক্তির উৎস হিসেবে উপনিষদে বর্ণিত পরমব্রহ্মের কথা বলা হয়েছে। গানের আভোগীতে কবি বলেছেন- পঞ্চভূত চিত্ত অহঙ্কার ব্রহ্মা-হরি লয় হ'ল ব্রহ্মে।
সনাতন হিন্দুধর্মে অশুভ শক্তির বিনাশের আদ্যাশক্তি দুর্গা এবং ধ্বংসের দৈবশক্তি হিসেবে পূজ্য। অশুভ অসুর বিনাশের লীলায় দুর্গা হয়ে ওঠেন ধ্বংসের দেবী নৃত্যকালী এবং ধ্বংসের লীলায় শিব হয়ে ওঠেন রুদ্র। অশুভ শক্তি বিনাশে শিব ও দুর্গা উভয়ই সহযোদ্ধা। এই গানে কবি নৃত্যকালী (দুর্গা) ও শঙ্কর (শিব)ধ্বংস-নৃত্যের অংশভাগী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। আকাশবিহারী বিহঙ্গ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো- পাখি বা মেঘ। অতি রুদ্র রূপে বিহঙ্গের মতো- মহাকাশব্যাপী শিব-দুর্গার ধ্বংস-নৃত্যের বিহার। তাই বলা হয়েছে-
'অতি রুদ্র বিহঙ্গে'।
এই নৃত্যের কারণে স্বর্গের মন্দকিনী নদীতে নৃত্যের ছন্দ ঝরে,গঙ্গায় তরঙ্গ ওঠে। রুদ্র তাণ্ডবের সহশিল্পী নৃত্যকালীর মুক্ত বেণী এবং শিবের জটা কম্পিত (বিধূনিত) আকাশে দোল খায়। আর সসাগরা পৃথিবী জগৎরক্ষাকারী মহাবিষ্ণুর কোলে আশ্রয় নিয়েও ভয়ে কাঁপে।ধ্বংসের উন্মত্ততায় বেজে ওঠে ভয়ঙ্কর ডমরু ও রণশিঙ্গা। শিবের ভ্রূকুটিতে উল্কাপাত হয়।
আদি সূর্যদেবতা আদিত্য নামে পরিচিত ছিলেন। অদিতির ১২জন পুত্রকে বলা হয় দ্বাদশ আদিত্য বা দ্বাদশ রবি। এঁরা হলেন- অর্যমা, পূষা, ত্বষ্টা, সবিত্র, ভগ, ধাত্রী, দক্ষ, বিষ্ণু, বরুণ, মিত্র, অংশ, বিবস্বান বা সূর্য। শিব-দুর্গার প্রলয়ঙ্করী নৃত্যে এই দ্বাদশ রবি, গ্রহ এবং নক্ষত্রসমূহ ধ্বংসে নিপতিত হয়। সৃষ্টি এবং স্থিতি-ধ্বংসী নৃত্যরূপ দেখে কবি হাহাকারে স্বগোক্তিতে বলেন-
'মৃত্যূ-ক্ষুধা জাগিল একি রে'।
উপনিষদের মতে- পরমব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয় সত্তা। জগৎ ব্রহ্মা থেকে উৎপন্ন হয় এবং ব্রহ্মতে লীন হয়ে যায়। পরমব্রহ্মে অধিষ্ঠিত শিব-দুর্গার ধ্বংসযজ্ঞে ব্রহ্মা, হরি এবং স্বয়ং শিব-দুর্গা লীন হয়ে যায়। এই
ধ্বংসলীলা উগ্রতারা (দুর্গার একটি রূপ), রুদ্রকে আবরিত করে নৃত্যকালী রূপে অদ্বিতীয়ার অহঙ্কারে নাচে। পরক্ষণে এই অহঙ্কার বিসর্জিত হয়, যখন সে অনুভব করেন, শিব রয়েছে তাঁরই সর্বাঙ্গ জুড়ে। তিনি অনুভব করেন- বৈদিক দর্শনে সোহম বা সোহং শব্দের অর্থ হলো- আমিই তিনি, আমিই ব্রহ্ম। এই গানের সোহম শিব হলো আমিই শিব।
বাঙাল ভৈরব রাগে নিবদ্ধ এই গানটির তাল ঝুমরা। ৩/৪/৩/৪ বিষম ছন্দের এই তালে ফুটে উঠেছে নৃত্যের ছন্দবৈচিত্র্য। চলনের বিচারে এটি খেয়ালাঙ্গের গান।
-
রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই এপ্রিল (বুধবার, ২৮ চৈত্র ১৩৪৬), কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হারামণি'র সপ্তম অনুষ্ঠানে গানটি প্রথম প্রচারিত হয়েছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪০ বৎসর ১০ মাস।
- গ্রন্থ:
- নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ (নজরুল ইনস্টিটিউট, মাঘ ১৪১৮। ফেব্রুয়ারি
২০১২) -এর ১৫০৪ সংখ্যক গান। রাগ : বাঙাল ভৈরব, তাল: ঝুম্রা। পৃষ্ঠা: ৪৫২।
- একশো গানের নজরুল স্বরলিপি, দশম খণ্ড, (হরফ প্রকাশনী, পৌষ ১৪০৬। জানুয়ারি ২০০০) -এর ৩০ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ৭৬-৭৭।
- শ্রেষ্ঠ নজরুল স্বরলিপি, (হরফ প্রকাশনী, Deluxe Edition : July 2011)
-এর ৩১৮ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ৭৯৯-৮০০।
- নজরুল গীতি, অখণ্ড (আব্দুল আজীজ আল-আমান, সম্পাদিত)। [হরফ প্রকাশনী, মাঘ ১৪১০। জানুয়ারি ২০০৪]। রাগ-প্রধান গান। গান-৮৮৭। পৃষ্ঠা: ২২৪।
- বেতার:
- ষট ভৈরব
(ছয়টি ভৈরব অঙ্গের রাগ নিয়ে সৃষ্ট
সঙ্গীতানুষ্ঠান)। কলকাতা বেতার কেন্দ্র। ১৩ জুলাই ১৯৪১ (রবিবার ২৯ আষাঢ়। ১৩৪৮)।
সান্ধ্য অধিবেশন। ৮.২৫-৯.০৪।
- সূত্র:
- বেতার জগৎ [১২শ বর্ষ ১৩শ সংখ্যা, মঙ্গলবার, ১
জুলাই ১৯৪১, ১৭ আষাঢ় ১৩৪৮ পৃষ্ঠা ৭৭৮]
- The Indiann-Listener [22 Sepetember
1939/Vol. VI No. 13. Page 79]
- হারামণি-৭
। কলকাতা বেতার কেন্দ্র। ১০ই এপ্রিল ১৯৪০
(বুধবার, ২৮ চৈত্র ১৩৪৬)। সান্ধ্য অধিবেশন। ৭.১৫-৭.৩৪।
শিল্পী-নজরুল।]
সূত্র: বেতার জগৎ ১১শ বর্ষ, ৭ম সংখ্যা
[পৃষ্ঠা: ৩৪০, ৩৭৬]
- সুরকার:
কাজী
নজরুল ইসলাম
- স্বরলিপিকার:
- ড. . ব্রহ্মমোহন ঠাকুর। [একশো গানের নজরুল স্বরলিপি, দশম খণ্ড, (হরফ প্রকাশনী, পৌষ ১৪০৬। জানুয়ারি ২০০০) -এর ৩০ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ৭৬-৭৭।]
নিতাই ঘটক।
- শ্রেষ্ঠ নজরুল স্বরলিপি, (হরফ প্রকাশনী,
Deluxe Edition : July 2011)
-এর ৩১৮ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ৭৯৯-৮০০।]
- বিষয়াঙ্গ: ভক্তি [শাক্ত সঙ্গীত, বন্দনা]
- সুরাঙ্গ:
খেয়ালাঙ্গ