বিষয়: নজরুল সঙ্গীত
শিরোনাম: বেণুকা ও-কে বাজায় মহুয়া বনে।

বেণুকা ও-কে বাজায় মহুয়া বনে।
কেন ঝড় তোলে তার সুর আমার মনে॥                                  
বলে আয় সে দুরন্তে সখি
আমারে কাঁদাবে সারা জনম ও-কি,
সে কি ভুলিতে তারে দেবে না জীবনে॥
সখি, ভাল ছিল তার তীর-ধনুক নিঠুর,
বাজে আরো সকরুণ তা'র বেণুকার সুর।
সখি, কেন সে বন-বিলাসী
আমারই ঘরের পাশে বাজায় বাঁশি,
আছে আরো কত দেশ, কত নারী ভুবনে॥

শুনি সেই গান- যেন বনের মর্মর।
বনের কিশোর আসে বাঁশরী বিসরি।
হেরিয়া কিশোরে চন্দ্রা আনত নয়নে
অনামিকা অঙ্গুলিতে জড়ায় আঁচল।
যত লাজ বাধে, তত সাধে মনে মনে,
হে সুন্দর থাকো হেথা আরো কিছুক্ষণ।
মুঠি মুঠি বনফুল চন্দ্রা পানে হানি
মৃদু হাসি গেয়ে ওঠে বনের কিশোর।  

[তথ্যসূত্র: নজরুল যখন বেতারে। আসাদুল হক (বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী। মার্চ ১৯৯৯)। পৃষ্ঠা: ১১৯-১২০।]

গীতিনাট্যের এই গানটির রাগের পরিবর্তনের সাথে সাথে বাণীর ভাবগত পরিবর্তন ঘটে। এর ভিতর দিয়ে নাটক্যের দৃশ্যের পরিবর্তন ঘটে। পূর্বের গানটিতে ছিল সুরের চাঞ্চল্য, এই গানটির রয়েছে বিরহবেদনা। তাই এর রস করুণ। বাঁশীর সহজাত মধুর এবং করুণ ধ্বনির আবেশ এই গানের সুরে পাওয়া যায়। তবে এই বেদনার প্রকাশ ঘটে আদি, অকৃত্রিম এবং আরণ্যক। কবি তাই রাগ পরিচিতিতে উল্লেখ করেছিলেন -'বুনো বাঁশীর আভাস ফুটিয়ে ওঠে বলিয়া  ইহার নাম বেণুকা।' গানের বাণীতেও রয়েছে করুণ রসের মধুরিমা। এই মধুরিমা গাঢ়তর হয়ে উঠে, সঞ্চারী ও আভোগে। বেদনার সুর বলেই এই গানটির সুরে মীড়ের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। তাই এই গানের গায়কীতে ছন্দের ধাক্কার চেয়ে, অধিকতর ভাবের কোমল এবং স্নিগ্ধতার দাবি রাখে।

গানটির শুরু হয়েছে একটি সাধারণ কৌতুহল নিয়ে- 'বেণুকা ও-কে বাজায় মহুয়া বনে ' তারপর সেই কৌতুহলই অস্থিরতায় রূপ নেয় দ্বিতীয় পংক্তিতে। মূলত অদূরের মহুয়া বন থেকে ভেসে আসা বাঁশির সুর, মিলন পিয়াসী অভিমানী নারী চিত্তে যে ঝড় উঠে, তার বহির্প্রকাশ ঘটেছে এই গানে। যার বাঁশীর সুর এই নারীকে মোহিত করছে, সে অপরিচিত নয়। তাই সখিকে ডেকে সে বলে, সে যেনো ওই বংশীবাদককে গিয়ে বলে আসে, যদি সে নাই কাছে আসে তবে কেন বাঁশীর সুরে তার চিত্তকে এমনভাবে আকুল করে, কেন না পাওয়ার অতৃপ্ত বেদনায় তাঁকে বিদ্ধ করে। সে কি এমনিভাবে সারা জীবন তাকে কষ্ট দেবে? যে নিষ্ঠুর প্রেমিককে সে ভুলে থাকতে চায়, বাঁশীর সুরের ভিতর দিয়ে সে কেন ফিরে ফিরে আসে? গানের এই অংশে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-বিরহের ছায়া ফুটে উঠে।

বনচারী পুরুষ, যার নিষ্ঠুর তীর বনপ্রাণীকে বিদ্ধ করে যন্ত্রণা দেয়। এই নারীর কাছে তার তীরের চেয়েও নিষ্ঠুর মনে হয়, যখন সে বাঁশীর সুরে বিদ্ধ হয়। বংশীবাদকের এই আচরণ এই নারী কাছে বিলাসিতা মনে হয়। মনে হয়, ওই বংশীবাদকের নিষ্ঠুর খেলা। এই খেলা এই নারীর কাছে নির্মম এবং অর্থহীন মনে হয়। সারা পৃথিবীতে এত নারী আছে, তাদের ছেড়ে কেন এই বংশীবাদক তাঁকেই এমনি করে বাঁশরির সুরে বিদ্ধ করে।

এই গানের বাণী থেকে বনচারী সাঁওতাল রমনীর কথা মনে পড়ে যায়। গানের মহুয়া বন, বনবিলাসী, তীর-ধনুক ইত্যাদি শব্দের ভিতর দিয়ে অরণ্যঘেরা কোনো এক সাঁওতাল পল্লীর ব্যর্থ-প্রেমিকার কথা মনে হয়। মিলন কামনায় উভয়ই উভয়কে নিবিড়ভাবে চায়, কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞায় তারা মিলিত হতে পারে না। তাই বনবিলাসী প্রেমিক পুরুষ বংশীধ্বনির ভিতর দিয়ে তার প্রেমিকাকে জানিয়ে যায়, সে আছে, সে তাকে ভোলে নাই। আর সেই সুর শুনে, নিষেধাজ্ঞার শৃঙ্খলে বাধা নারী যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়। সে ভুলে থাকতে চায়, তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে। সে বাঁশীর সুরের ভিতর দিয়ে উদ্বেলিত হয়ে উঠে, কিন্তু নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল ভেঙে বের হতে পারে না। মূলত এই গানের ভিতর দিয়ে একটি নারী ভিতরে জেগে উঠা স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষার উদ্বেলিত বাসনা, মিলনে ব্যর্থতা, দয়িতার প্রতি তীব্র অভিমান সব একীভূত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে।