ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


বাল্মীকিপ্রতিভা

গ্রন্থপরিচয়
সূচনা | প্রথম দৃশ্য | দ্বিতীয় দৃশ্য | তৃতীয় দৃশ্য | চতুর্থ দৃশ্য | পঞ্চম দৃশ্য্য |


সূচনা

বাল্মীকিপ্রতিভায় একটি নাট্যকথাকে গানের সূত্র দিয়ে গাঁথা হয়েছিল, মায়ার খেলায় গানগুলিকে গাঁথা হয়েছিল নাট্যসূত্রে। একটা সময় এসেছিল যখন আমার গীতিকাব্যিক মনোবৃত্তির ফাঁকের মধ্যে মধ্যে নাট্যের উঁকিঝুঁকি চলছিল। তখন সংসারের দেউড়ি পার হয়ে সবে ভিতর-মহলে পা দিয়েছি; মানুষে মানুষে সম্বন্ধের জাল-বুনোনিটাই তখন বিশেষ করে ঔৎসুক্যের বিষয় হয়ে উঠেছিল। বাল্মীকিপ্রতিভাতে দস্যুর নির্মমতাকে ভেদ করে উচ্ছ্বসিত হল তার অন্তর্গূঢ় করুণা। এইটেই ছিল তার স্বাভাবিক মানবত্ব যেটা ঢাকা পড়েছিল অভ্যাসের কঠোরতায়। একদিন দ্বন্দ্ব ঘটল, ভিতরকার মানুষ হঠাৎ এল বাইরে। প্রকৃতির প্রতিশোধেও এই দ্বন্দ্ব। সন্ন্যাসীর মধ্যে চিরকালের যে মানুষ প্রচ্ছন্ন ছিল তার বাঁধন ছিঁড়ল। কবির মনের মধ্যে বাজছিল মানুষের জয়গান। মায়ার খেলায় গানের ভিতর দিয়ে অল্প যে একটুখানি নাট্য দেখা দিচ্ছে সে হচ্ছে এই যে, প্রমদা আপনার স্বভাবকেই জানতে পারে নি অহংকারে, অবশেষে ভিতর থেকে বাজল বেদনা, ভাঙল মিথ্যে অহংকার, প্রকাশ পেল সত্যকার নারী। মায়াকুমারীদের কাছ থেকে এই ভর্ৎসনা কানে এল:

                                        এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না—
                                        শুধু সুখ চলে যায়, এমনি মায়ার ছলনা।
 


           প্রথম দৃশ্য

 

                                    অরণ্য

                                    বনদেবীগণ

                        সহে না, সহে না, কাঁদে পরান।

                        সাধের অরণ্য হল শ্মশান।

                        দস্যুদলে আসি শান্তি করে নাশ,

                        ত্রাসে সকল দিশ কম্পমান।

                        আকুল কানন, কাঁদে সমীরণ,

                        চকিত মৃগ, পাখি গাহে না গান।

                        শ্যামল তৃণদল শোণিতে ভাসিল,

                        কাতর রোদনরবে ফাটে পাষাণ।

                        দেবী দুর্গে, চাহো, ত্রাহি এ বনে—

                        রাখো অধীনী জনে, করো শান্তিদান

                                              প্রস্থান

 

                                    প্রথম দস্যুর প্রবেশ

            আঃ বেঁচেছি এখন।              শর্মা ও দিকে আর নন।

            গোলেমালে ফাঁকতালে পালিয়েছি কেমন।

            লাঠালাঠি কাটাকাটি             ভাবতে লাগে দাঁতকপাটি,

            তাই, মানটা রেখে প্রাণটা নিয়ে সটকেছি কেমন—

                        আহা    সটকেছি কেমন।

            আসুক তারা আসুক আগে,  দুনোদুনি নেব ভাগে,

            স্যান্তামিতে আমার কাছে দেখব কে কেমন।

            শুধু   মুখের জোরে, গলার চোটে  লুট-করা ধন নেব লুটে,

            শুধু  দুলিয়ে ভুঁড়ি বাজিয়ে তুড়ি করব সরগরম—

                        আহা  করব সরগরম

                       

                        লুঠের দ্রব্য লইয়া দস্যুগণের প্রবেশ

 

                        এনেছি মোরা এনেছি মোরা রাশি রাশি লুটের ভার।

                        করেছি ছারখার— সব করেছি ছারখার—

                        কত গ্রাম পল্লী লুটে-পুটে করেছি একাকার।

প্রথম দস্যু।           আজকে তবে মিলে সবে করব লুটের ভাগ—

                        এ-সব আনতে কত লণ্ডভণ্ড করনু যজ্ঞ-যাগ।

দ্বিতীয় দস্যু।          কাজের বেলায় উনি কোথা যে ভাগেন,

                        ভাগের বেলায় আসেন আগে আরে দাদা!

এথম দস্যু।           এত বড়ো আস্পর্ধা তোদের,

                        মোরে নিয়ে এ কি হাসি-তামাশা!

                        এখনি মুণ্ড করিব খণ্ড, খবর্দার রে খবর্দার!

দ্বিতীয় দস্যু।          হাঃ হাঃ ভায়া খাপ্পা বড়ো, এ কী ব্যাপার!

                        আজি বুঝি বা বিশ্ব করবে নস্য, এমনি যে আকার।

তৃতীয় দস্যু।          এমনি যোদ্ধা উনি, পিঠেতেই দাগ—

তলোয়ারে মরিচা, মুখেতেই রাগ।

প্রথম দস্যু।           আর যে এ-সব সহে না প্রাণে—

                        নাহি কি তোদের প্রাণের মায়া!

                        দারুণ রাগে কাঁপিছে অঙ্গ—

                        কোথা রে লাঠি, কোথা রে ঢাল!

সকলে।               হাঃ হাঃ ভায়া খাপ্পা বড়ো, এ কী ব্যাপার!

                        আজি বুঝি বা বিশ্ব করবে নস্য, এমনি যে আকার

 

                                    বাল্মীকির প্রবেশ

সকলে।               এক ডোরে বাঁধা আছি মোরা সকলে।

                        না মানি বারণ, না মানি শাসন, না মানি কাহারে।

                        কে বা রাজা, কার রাজ্য, মোরা কী জানি!

                        প্রতি জনেই রাজা মোরা, বনই রাজধানী!

                        রাজা-প্রজা উঁচু-নিচু কিছু না গণি!

                        ত্রিভুবনমাঝে আমরা সকলে কাহারে না করি ভয়—

                        মাথার উপরে রয়েছেন কালী, সমুখে রয়েছে জয়

                       

                                    বাল্মীকির প্রতি

প্রথম দস্যু।           এখন করব কী বল্।

সকলে।               এখন করব কী বল্।

প্রথম দস্যু।           হো রাজা, হাজির রয়েছে দল!

সকলে।               বল্ রাজা, করব কী বল্ এখন করব কী বল্।

প্রথম দস্যু।           পেলে   মুখেরই কথা,

                        আনি যমেরই মাথা। করে দিই রসাতল!

সকলে।               করে দিই রসাতল!

সকলে।               হো রাজা, হাজির রয়েছে দল।

                        বল্ রাজা, করব কী বল্ এখন করব কী বল্

বাল্মীকি।              শোন্ তোরা তবে শোন্।

                        অমানিশা আজিকে, পূজা দেব কালীকে।

                        ত্বরা করি যা তবে, সবে মিলি যা তোরা—

                                                বলি নিয়ে আয়

                                    বাল্মীকির প্রস্থান

সকলে।               ত্রিভুবনমাঝে আমরা সকলে কাহারে না করি ভয়,

                        মাথার উপরে রয়েছেন কালী, সমুখে রয়েছে জয়

                                                -----

                        তবে আয় সবে আয়, তবে আয় সবে আয়—

                        তবে ঢাল্ সুরা, ঢাল্ সুরা, ঢাল্ ঢাল্ ঢাল্!

                        দয়া মায়া কোন্ ছার, ছারখার হোক।

                        কে বা কাঁদে কার তরে, হাঃ হাঃ হাঃ!

                        তবে আন্ তলোয়ার, আন্ আন্ তলোয়ার,

                        তবে আন্ বরশা, আন্ আন্ দেখি ঢাল।

প্রথম দস্যু।           আগে পেটে কিছু ঢাল্, পরে পিঠে নিবি ঢাল।

                        হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!

                        হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ

 

                                    উঠিয়া

সকলে।               কালী কালী বলো রে আজ—

                        বলো হো, হো হো, বলো হো, হো হো,বলো হো!

                                    নামের জোরে সাধিব কাজ—

                        বলো হো হো হো, বলো হো, বলো হো!

                        ওই        ঘোর মত্ত করে নৃত্য রঙ্গমাঝারে,

                        ওই        লক্ষ লক্ষ যক্ষ রক্ষ ঘেরি শ্যামারে,

                        ওই        লট্টপট্টকেশ অট্ট অট্ট হাসে রে—

                                    হাহাহা হাহাহা হাহাহা!

                        আরে      বল্ রে শ্যামা মায়ের জয়, জয় জয়!

                        জয় জয়, জয় জয়, জয় জয়, জয় জয়!

                        আরে      বল্ রে শ্যামা মায়ের জয়, জয় জয়!

                        আরে      বল্ রে শ্যামা মায়ের জয়

                                                গমনোদ্যম

                                    একটি বালিকার প্রবেশ

বালিকা।              ওই        মেঘ করে বুঝি গগনে।

                        আঁধার ছাইল, রজনী আইল,

                            ঘরে ফিরে যাব কেমনে।

                        চরণ অবশ হায়, শ্রান্ত ক্লান্ত কায়

                             সারা দিবস বনভ্রমণে

                             ঘরে ফিরে যাব কেমনে

                                    ----

                        এ কী এ ঘোর বন! এনু কোথায়!

                        পথ যে জানি না, মোরে দেখায়ে দে না।

                                    কী করি এ আঁধার রাতে।

                                    কী হবে মোর হায়।

                        ঘন ঘোর মেঘ ছেয়েছে গগনে,

                                    চকিত চপলা চমকে সঘনে,

                                                একেলা বালিকা—

                                    তরাসে কাঁপে কায়

                                   

                                    বালিকার প্রতি

প্রথম দস্যু।           পথ ভুলেছিস সত্যি বটে?   সিধে রাস্তা দেখতে চাস?

                        এমন জায়গায় পাঠিয়ে দেব  সুখে থাকবি বারো মাস।

সকলে।               হাঃ হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ।

 

                                    প্রথমের প্রতি

দ্বিতীয় দস্যু।          কেমন হে ভাই! কেমন সে ঠাঁই?

প্রথম দস্যু।           মন্দ নহে বড়ো—

                        এক দিন না এক দিন সবাই সেথায় হব জড়ো।

সকলে।               হাঃ হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ!

তৃতীয় দস্যু।          আয় সাথে আয়, রাস্তা তোরে দেখিয়ে দিই গে তবে—

                        আর তা হলে রাস্তা ভুলে ঘুরতে নাহি হবে।

সকলে।               হাঃ হাঃ হাঃ,হাঃ হাঃ হাঃ

 

                                    সকলের প্রস্থান

                        বনদেবীগণের প্রবেশ

                        মরি ও কাহার বাছা, ওকে কোথায় নিয়ে যায়।

                        আহা, ঐ করুণ চোখে ও কার পানে চায়।

                           বাঁধা কঠিন পাশে, অঙ্গ কাঁপে ত্রাসে,

                        আঁখি জলে ভাসে—এ কী দশা হায়।

                        এ বনে কে আছে, যাব কার কাছে—

                                                কে ওরে বাঁচায়