বিষয়: রবীন্দ্রসঙ্গীত।
গান সংখ্যা:
শিরোনাম:
খাঁচার
পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে
পাঠ ও পাঠভেদ:
খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে, বনের পাখি ছিল বনে।
একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে, কী ছিল বিধাতার মনে।
বনের পাখি বলে, ‘খাঁচার পাখি ভাই, বনেতে যাই দোঁহে মিলে।’
খাঁচার পাখি বলে, ‘বনের পাখি আয়, খাঁচায় থাকি নিরিবিলে।’
বনের পাখি বলে, ‘না, আমি শিকলে ধরা নাহি দিব।
খাঁচার পাখি বলে, ‘হায়, আমি কেমনে বনে বাহিরিব।’
বনের পাখি গাহে বাহিরে বসি বসি বনের গান ছিল যত,
খাঁচার পাখি গাহে শিখানো বুলি তার― দোঁহার ভাষা দুইমত।
বনের পাখি বলে, ‘খাঁচার পাখি ভাই, বনের গান গাও দেখি।’
খাঁচার পাখি বলে, ‘বনের পাখি ভাই, খাঁচার গান লহো শিখি।’
বনের পাখি বলে, ‘না, আমি শিখানো গান নাহি চাই।’
খাঁচার পাখি বলে, ‘হায় আমি কেমনে বনগান গাই।’
বনের পাখি বলে, ‘আকাশ ঘন নীল কোথাও বাধা নাহি তার।’
খাঁচার পাখি বলে, ‘খাঁচাটি পরিপাটি কেমন ঢাকা চারি ধার।’
বনের পাখি বলে, ‘আপনা ছাড়ি দাও মেঘের মাঝে একেবারে।’
খাঁচার পাখি বলে, 'নিরালা কোণে বসে বাঁধিয়া রাখো আপনারে।’
বনের পাখি বলে, ‘না, সেথা কোথায় উড়িবারে পাই!’
খাঁচার পাখি বলে, ‘হায়, মেঘে কোথায় বসিবার ঠাঁই।’
এমনি দুই পাখি দোঁহারে ভালোবাসে, তবুও কাছে নাহি পায়।
খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে পরশে মুখে মুখে, নীরবে চোখে চোখে চায়।
দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে, বুঝাতে নারে আপনায়।
দুজনে একা একা ঝাপটি মরে পাখা― কাতরে কহে, ‘কাছে আয়!’
বনের পাখি বলে, ‘না, কবে খাঁচায় রুধি দিবে দ্বার!’
খাঁচার পাখি বলে, ‘হায়, মোর শকতি নাহি উড়িবার।’
খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে
খাঁচার
পাখি গাহে শিখানো বুলি তার...
বনের
গান গাও দেখি...
খাঁচার পাখি বলে নিরালা কোণে বসে : কাব্যগীতি (১৩২৬)
খাঁচার
পাখি পড়ে শিখানো বুলি তার...
বনের
গান গাও দিখি...
খাঁচার পাখি বলে, নিরালা গৃহকোণে : গীতবিতান (আশ্বিন ১৩৩৮)
এ গানের রচনা সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি গ্রন্থে [রবীন্দ্র রচনাবলী সপ্তদশ খণ্ড (বিশ্বভারতী, আষাঢ় ১৩৯৩)। পৃষ্ঠা ২৭১।]; যা নিম্নরূপ-
"বাড়ির বাহিরে আমাদের যাওয়া বারণ ছিল, এমন-কি, বাড়ির ভিতরেও আমরা সর্বত্র যেমন-খুশি যাওয়া-আসা করিতে পারিতাম না। সেইজন্য বিশ্বপ্রকৃতিকে আড়াল-আবডাল হইতে দেখিতাম। বাহির বলিয়া একটি অনন্ত-প্রসারিত পদার্থ ছিল যাহা আমার অতীত, অথচ যাহার রূপ শব্দ গন্ধ দ্বার-জানলার নানা ফাঁক-ফুকর দিয়া এদিক-ওদিক হইতে আমাকে চকিতে ছুঁইয়া যাইত। সে যেন গরাদের ব্যবধান দিয়া নানা ইশারায় আমার সঙ্গে খেলা করিবার নানা চেষ্টা করিত। সে ছিল মুক্ত, আমি ছিলাম বদ্ধ― মিলনের উপায় ছিল না, সেইজন্য প্রণয়ের আকর্ষণ ছিল প্রবল। আজ সেই খড়ির গণ্ডি মুছিয়া গেছে, কিন্তু গণ্ডি তবু ঘোচে নাই। দূর এখনো দূরে বাহির এখনো বাহিরেই। বড়ো হইয়া যে কবিতাটি লিখিয়াছিলাম তাহাই মনে পড়ে–
খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে,
বনের পাখি ছিল বনে।
একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে,
কী ছিল বিধাতার মনে।
বনের পাখি বলে, "খাঁচার পাখি,আয়,
বনেতে যাই দোঁহে মিলে।"
খাঁচার পাখি বলে, "বনের পাখি, আয়,খাঁচায় থাকি নিরিবিলে।"
বনের পাখি বলে, "না,
আমি শিকলে ধরা নাহি দিব।"
খাঁচার পাখি বলে, "হায়,
আমি কেমনে বনে বাহিরিব।"
প্রথম খণ্ড, প্রথম সংস্করণ [বিশ্বভারতী, আশ্বিন ১৩৩৮, [সোনার তরী (১৩০১)। পৃষ্ঠা: ৯০-৯১] [নমুনা: প্রথমাংশ, শেষাংশ]
গীতবিতানের নাট্যগীতি পর্যায়ের ৫২ সংখ্যক গান।