দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৮৮২-১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ
প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ, কবি, সু-অভিনেতা, অনুবাদক ও বহুভাষাবিদ।

১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বরে (২ পৌষ ১২৮৯ বঙ্গাব্দ) কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ঠাকুরবাড়ির বংশলতিকা অনুসারে− রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সবচেয়ে বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরেরে পুত্র ছিলেন দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র ছিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই সূত্রে দিনেন্দ্রনাথ ছিলেন  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও নাতি। তাঁর নামের আদি বানান ছিল দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।  রবীন্দ্রনাথ এই নামের বানান পরিবর্তন করে রেখেছিলেন দিন+ইন্দ্র অর্থে দিনেন্দ্র। রবির আবির্ভাবে দিনের প্রকাশ অর্থে এই বানানই স্থায়ী রূপ লাভ করেছে।

 দিনেনন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর র স্ত্রীর কমলা দেবী

দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা সুশীলা দেবী ছিলেন বরিশালের লাখুটিয়া বংশের জমিদার রাখালচন্দ্র রায় চৌধুরীর কন্যা। দিনেন্দ্রনাথের বয়স যখন আট বৎসর তখন মায়ের মৃত্যু হয়। এই সময় তাঁর বোন নলিনীদেবীর বয়স ছিল ছয় বৎসর। এরপর দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন রাজা রামমোহন রায়ের জ্ঞাতি ললিতমোহন চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা হেমলতা দেবীকে। হেমলতা দেবী চারিত্রিকগুণে শান্তিনিকেতনে বড় মা নামেই পরিচিত হয়েছিলেন।

শৈশবে তিনি কাশিয়াবাগান স্কুলে ভর্তি হন। এখান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে, তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হন। দুরন্তপনার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে প্রায়ই অভিযোগ পাঠাতো। পরে তাঁকে এই স্কুল থেকে এনে সিটি স্কুলে ভর্তি করা হয়। এই স্কুল থেকে তিনি প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করেন। এরপর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে আইএসসিতে ভর্তি হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষা দেন নি।

১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা বীণাপাণিকে বিবাহ করেন। উল্লেখ্য বীণাপাণি দেবী ছিলেন হেমলতা দেবীর (দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৎ মা) ভাইঝি এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বোন সুনয়নী দেবীর কন্যা। অল্প বয়সেই বীণাপাণি ডিপথেরিয়া রোগে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন ক্ষেত্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের একমাত্র কন্যা কমলাদেবীকে। এই বৎসরে দিনেন্দ্রনাথ প্রথম শান্তিনকেতনে  আসেন।
 

১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে রামগড়ে তোলা ছবি। বাম থেকে- রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ সেন ও দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে ব্যারিষ্টারি পড়ানোর জন্য লণ্ডনে পাঠানো হয়। কিন্তু ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে (সম্ভবত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের-এর মৃত্যুর কারণে) দেশে ফিরে আসেন। এই সময় কলকাতা বঙ্গভঙ্গ-রদ আন্দোলনে উত্তাল ছিল। এই আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন। এই সময় সদলবলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর রচিত 'বাংলার মাটি বাংলার জল' গান পথে পথে গেয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে তোলায় সচেষ্ট হন। তাঁর উদ্যোগে চিৎপুরের মসজিদে মুসলমানদের রাখি বন্ধনসম্পন্ন হয়।

১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্যারিষ্টারি পড়ার জন্য পুনরায় লণ্ডনে যান। কিন্তু এবারেও তিনি পরীক্ষা না দিয়েই দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু লণ্ডনে থেকে তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতে তালিম নিয়ে এসেছিলেন। বিশেষ করে এই সূত্রে পাশ্চাত্য
স্টাফ নোটেশান এবং পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্র বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।  

১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে দিনেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি বাংলা এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য পড়াতেন। পরে ধীরে ধীরে অন্যতম সঙ্গীত শিক্ষকে পরিণত হন।
 

দাঁড়িয়ে: রমাদেবী (সুধীন্দ্রনাথের জৈষ্ঠ্যা কন্যা), দিনেন্দ্রনাথ, কমলা দেবী,
বসে:
মীরাদেবী, নীতিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, প্রতিমাদেবী
মাটিতে
এলাদেবী (সুধীন্দ্রনাথের মধ্যম কন্যা)

ঠাকুর বাড়ির সাঙ্গীতিক পরিবেশে বড় ওঠার সূত্রে তাঁর সঙ্গীতে অনুরাগ জন্মেছিল। অনেক সঙ্গীত গুণীজনের কাছে তালিমও পেয়েছিলেন ঠাকুরবাড়িতে। সেন্ট সেভিয়ার্সে স্কুলে পড়ার সময় পিয়ানো বাদনে দক্ষতা প্রকাশ করে পুরস্কৃত হয়েছেন বেশ কয়েক বার। বিলেত থেকে ফিরে তিনি রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী ও শ্যামসুন্দর মিশ্রের কাছে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষা লাভ করেছিলেন। এই সময়ে তিনি এস্‌রাজ শেখেন এবং বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। প্রথাগত অন্যান্য গানের সাথে সাথে তিনি ধীরে ধীরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি প্রণয়ন এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্যতম শিক্ষক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পর, ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১৮ আষাঢ় তিনি সঙ্গীতভবনের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে অধ্যক্ষ হন পর্যন্ত
ভীমরাও শাস্ত্রী। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে ভীমরাও শাস্ত্রী দেশে ফিরে গেলে দিনেন্দ্রনাথ পুনরায় অধ্যক্ষ হন। এরপর বিভিন্ন সময়ে হেমেন্দ্রলাল রায়, প্রতিমা দেবী, রবীন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ কর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় শেষ অধ্যক্ষ ছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার। ।

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে তাঁর গাওয়া ৬টি গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। গানগুলো হলো−

১. আমার পরাণ যাহা চায়
২. আমার মিলন লাগি তুমি
৩. আমার মাথা নত করে দাও
৪. মেঘের পরে মেঘ জমেছে
৫. আজি মর্মর ধ্বনি কেন
৬. আলোকের এই ঝর্নধারায়
শেষ পর্যন্ত 'মেঘের পরে মেঘ জমেছে' এবং 'আলোকের এই ঝর্নধারায়' গানটি গ্রামোফোন কোম্পানি প্রকাশ করেন নি। পরবর্তী সময়ে এই দুটি গানের স্বরলিপি নিয়ে নানা ধরনের তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সকল গান প্রকাশের অনুমতি দিলেও এই দুটি গান প্রকাশের অনুমতি দেয় নি।

রবীন্দ্রসঙ্গীতের সিংহভাগের স্বরলিপিকার তিনি করেছিলেন এবং সেকালের প্রায় সকল শিক্ষার্থীই ছিল তাঁর হাতে গড়া। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সূত্রে তিনি রবীন্দ্রনাথের সহযোগী হয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথ নতুন কোনো গান রচনা করার পরপরই তিনি স্বেচ্ছায় বা রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে শিখে নিতেন। এরপর তিনি সে গানের স্বরলিপি করে- সংরক্ষণ করতেন এবং তা অন্যান্য শিক্ষার্থীদেরকে শিখিয়ে দিতেন। পরবর্তীকালে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কোনো গানের সুর ভুলে গেলে- তিনি দিনেন্দ্রনাথের স্মরণাপন্ন হতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ফাল্গুনী নামক নাটকের উৎসর্গপত্রে লিখেছেন
'আমার সকল গানের কাণ্ডারী'।

 

যতদূর জানা যায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরে প্রথম স্বরলিপি প্রবাসী পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩১৬ সংখ্যায়। গানটি হলো .'বাঁচান বাঁচে মারেন মরি'। পরে ওই পত্রিকাতে তাঁর করা রবীন্দ্রসঙ্গীতের আরও অনেক স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থাকারে তাঁর করা স্বরলিপি গ্রন্থ 'গীতলেখা'র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৩২৪ বঙ্গাব্দে। পরে ১৩২৫ এবং ১৩২৭ বঙ্গাব্দে যথাক্রমে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। গীতলেখা -সহ তাঁর করা রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি গ্রন্থগুলো হলো

১. গীতলেখা, প্রথম খণ্ড (১৩২৪ বঙ্গাব্দ), দ্বিতীয় খণ্ড (১৩২৫ বঙ্গাব্দ), তৃতীয় খণ্ড (১৩২৭ বঙ্গাব্দ)

২. গীতপঞ্চাশিকা (১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ)

৩. বৈতালিক (১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ)

৪. গীতপত্র (১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ। এই গ্রন্থের ৮টি স্বরলিপি রবীন্দ্রনাথের সাথে করা। )

৫. কেতকী (১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ)

৬. শেফালি (১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ)

৭. গীতবীথিকা (১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ)

৮. কাব্যগীতি (১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ)

৯. নবগীতিকা, দুই খণ্ড (১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ)

১০. বসন্ত (১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ)

১১. গীতমালিকা, দুই খণ্ড (১৯২৬, ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ)

১২. বাল্মীকি প্রতিভা (১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দ)

১৩. তপতী (১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ)

তারপরেও তাঁর করা স্বরলিপি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সন্দিহান ছিলেন। ১৩২১ বঙ্গাব্দের ২০ জ্যৈষ্ঠ তারিখে রবীন্দ্রনাথ রামগড় থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লিখা একটি চিঠি থেকে তেমন আভাষই পাওয়া যায়। তিনি লিখেছিলেন
 

ফদফআ 'গান অনেক তৈরি হয়েচে। এখনো থামচেনা প্রায় রোজই একটা না একটা চলছে। আমার মুস্কিল এই যে সুর দিয়ে আমি সুর ভুলে যাই। দিনু কাছে থাকলে তাকে শিখিয়ে দিয়ে বেশ নিশ্চিন্ত মনে ভুলতে পারি। নিজে যদি স্বরলিপি করতে পারতুম কথাই ছিল না। দিনু মাঝে মাঝে করে কিন্তু আমার বিশ্বাস সেগুলো বিশুদ্ধ হয় না। সুরেন বাঁড়ুজ্জের সঙ্গে আমার দেখাই হয়না- কাজেই আমার খাতা এবং দিনুর পেটেই সমস্ত জমা হচ্ছে। এবার বিবি সেটা কতক লিখে নিয়েছে। কলকাতায় গিয়ে এসব গান গাইতে গিয়ে দেখি কেমন ম্লান হয়ে যায়।- তাই ভাবি, এগুলো হয়তো বিশেষ কারো কাজে লাগবেনা।'

[সূত্র : রবিজীবনী সপ্তম খণ্ড। প্রশান্তকুমার পাল (আষাঢ় ১৪১৪)]

 

মায়ারখেলার স্বরলিপি নিয়ে ইন্দিরাদেবী চৌধুরাণী'র সাথে দিনেন্দ্রনাথের বেশে খিটিমিটির সৃষ্টি হয়েছিল। ১৩২৬ বঙ্গাব্দের রবীন্দ্রনাথের  সাথে ইন্দিরাদেবীর পত্র বিনিময়ের মধ্যে তা স্পষ্ট ধরা পরে। ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১০ই অগ্রহায়ণ এবং ২১শে অগ্রহায়ণের দুটো চিঠি থেকে বুঝা যায়. দিনেন্দ্রনাথের প্রতি ইন্দিরাদেবী  কি পরিমাণ ক্ষুব্ধ ছিল, ।

১০ই অগ্রহায়ণ, ১৩২৬ বঙ্গাব্দে ইন্দিরাদেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি


   'মায়ার খেলা'র  স্বরলিপি বদল করে হাল নিয়মানুগত করে লেখার জন্য দিনুর হাতে দিয়েছি। কিন্তু ওর হাত খুব সচল নয়। ওর কাছ থেকে কাজ আদায় করার মজুরি পোষাবে কিনা জানিনে। ও নিজে যে স্বরলিপি লিখে তাতে হাত চালিয়ে কাজ করে কিন্তু এ ক্ষেত্রে ওর বিশেষ উৎসাহের লক্ষণ এখনো দেখ্‌চিনে।

   দিনু এখানকার ছেলেদের 'বিশ্ববীণারবে' যে ধাঁচায় গাইতে শিখিয়েচে সেই ধাঁচা অনুসারে স্বরলিপি লিখেচে। ঠিক মূলের অনুবর্তন করা দরকার মনে করেনি। মৈথিলি বিদ্যাপতি বাংলায় এসে যেমন স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করেচে এবং সেই স্বাতন্ত্র্যকে আমরা স্বীকার করেও নিয়েচি এই সমস্ত বিদেশী সুরেরও সেই রকম কিছু পরিবর্তন হবেই
হলে দোষই বা কি? এই সব যুক্ত মনে এনে ওকে আমি বেকসুর খালাস দিতে ইচ্ছে করি। আমি জানি এ সম্বন্ধে তোর আইন অত্যন্ত কড়া কিন্তু আমার মনে হয় পরদ্রব্য আত্মসাৎ করা সম্বন্ধে ঢিলেমি সাহিত্যে ললিতকলায় সকল অবস্থায় ফৌজদারী অথবা দেওয়ানী আদালতের বিচার এলাকায় আসে না।

রবীন্দ্রনাথের 'বেকসুর খালাস' ইন্দিরাদেবী পছন্দ করেন নি। তিন এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ ২১শে অগ্রহায়ণ ইন্দিরাদেবীকে আরও একটি চিঠি লেখেন।

'বিশ্ববীণারবে'র বিকৃতি সম্বন্ধে তোর আপত্তি সমর্থন করে তুই যে একটি অমোঘ যুক্তি সব শেষে নিক্ষেপ করেছিস সে একেবারে শক্তিশেলের মত এসে আমার মন্তব্যটাকে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করেচে।...দিনু যখন ভুল করে 'বিশ্ববীণারবে' শেখালে আমি বল্লুম বেশ হচ্চে, এই রকম হওয়াই উচিত। বুঝেছিস কেন? যদি বলি অন্যরকম হওয়া উচিত তাহলে হাঙ্গামা বাড়ে। তউ হয় ত রেগেমেগ শাপ দিয়ে বসবি, তোমার গান তাহলে সকলে যা ইচ্ছে তাই করে গাক।... মানুষকে ক্ষমা করতে গেলে মানুষকে বুঝতে হয় সেইজন্যে এতক্ষণ ধরে তোকে বোঝাবার চেষ্টা করা গেল কিন্তু ক্ষমা করবি কিনা আমার সন্দেহ রয়ে গেল।

১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে শৈলজারঞ্জন মজুমদার 'বিশ্বভারতী'র সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষ পদে ইস্তফা দেন এবং কলিকাতায় বসবাস আরম্ভ করেন। এরপর থেকে স্বরলিপি নিয়ে প্রকাশ্যে বিতর্ক শুরু হয়। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কিরণশশী দে এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করেছেন এবং এ বিতর্ক এখনো আছে।

দিনেন্দ্রনাথের স্বরলিপি যথার্থ না হলেও সম্ভবত তা খুব বেশি অন্যরকম ছিল না। কারণ তা হলে
রবীন্দ্রনাথ হয়তো অনুমোদন করতেন। রবীন্দ্রনাথের মনোভাব ছিল যেনো একটু অন্য রকম হয়েছে, হোক। এরকমও হতে পারে। দিনেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর বিশ্বভারতী দিনেন্দ্রনাথে স্বরলিপি নিয়ে যা করেছে, তা অপরাধযোগ্য। এরা দিনেন্দ্রনাথের স্বরলিপি পরিবর্তন করে, তা দিনেন্দ্রনাথের নামেই স্বরবিতানে যুক্ত করেছে।


যতদূর জানা যায়, দিনেন্দ্রনাথ অভিনয়েও দক্ষ ছিলেন। ঠাকুরবাড়ির নাটকে তাঁর জোরালো ভূমিকা ছিল নাটকে তাঁর স্বকণ্ঠে গীত গান। রবীন্দ্রনাথের রচিত বাল্মীকি প্রতিভা, শারদোৎসব, তপতী, বৈকুণ্ঠের খাতা, বিসর্জন, মায়ার খেলা, রাজা, ফাল্গুনী নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। বিশ্বভারতীর নাট্যদল হিসেবে ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে 'তাসের দল' মঞ্চস্থ করার জন্য বোম্বাই গিয়েছিলেন। তিনি শেক্সপিয়রের 'মার্চেন্ট অফ ভেনিস' নাটক পরিচালনা করেছিলেন।

 

কবিতা রচনাতে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর রচিত 'বীণ' নামক কাব্যগ্রন্থ ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে বোলপুর ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি তাঁর রচনা নিজের বাড়িতেই জমা করে রাখতেন। একবার অভিমান করে তিনি তাঁর সকল পাণ্ডুলিপি শান্তিনকেতন লাইব্রেরি থেকে এনে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। দিনেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর, তাঁর স্ত্রী কমলাদেবী 'বীণ' এবং অবশিষ্ট অন্যান্য রচনা সংগ্রহ করে দিনেন্দ্রনাথ রচনাবলী প্রকাশ করেছেন।
 

তাঁর সম্পাদনায় ১৩২৭ বঙ্গাব্দে দ্বিজেন্দ্রনাথের 'নানাচিন্তা', 'প্রবন্ধমালা' ও 'কাব্যমালা' নামে তিনটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তিনি এবং তাঁর বোন নলিনীর যৌথ সম্পাদনায় ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে 'মুক্তধারা' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। অবশ্য তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর, পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।


এছাড়া রয়েছে দিনেন্দ্রনাথ-এর সম্পাদিত ২০০ গানের স্বরলিপি গ্রন্থ 'গীতি-চর্চা' প্রকাশিত হয়েছিল। । ১৩৩২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ এবং দেবেন্দ্রনাথের গান স্থান পেয়েছিল।

 

জীবনের শেষ দিকে এসে ঘটনাসূত্রে তাঁর সাথে শান্তিনিকেতনের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। এর পিছনে একটি নাতিদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সেটা হলো মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ মৃত্যুর আগে তাঁর সম্পত্তির উইল করে যান। এই উইল অনুসারে শিলাইদহ, পতিসরের জমিদারি দিয়ে যান দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ এবং বলেন্দ্রনাথকে। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর জমিদারির অংশ নিরানবব্বই বৎসরের জন্য ৪৫ হাজার টাকায় রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যেন্দ্রনাথ-এর কাছে ইজারা দেন। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে  দ্বিজেন্দ্রনাথ যখন ডিড অফ সেটেলমেন্ট করেন, তখন তাঁর নাতি দিনেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে থাকতেন। তাই তাঁকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আংশিক স্বত্বাধিকারের পরিবর্তে বাড়তি পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এছাড়া তাঁর মাসোহারার একটা ব্যবস্থাও করে দেন। এই সময় এই টাকার বেনিফিসিয়ারি ট্রাস্টির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ এবং সুধীন্দ্রনাথ। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে সুরেন্দ্রনাথের নিজের একটি বাড়ি, রবীন্দ্রনাথের কাছে ২২ হাজার টাকায় বিক্রয় করেন। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাড়ি রবীন্দ্রনাথের কাছে দশ হাজার টাকায় কিনে নেন। অবশিষ্ট দিনেন্দ্রনাথের প্রাপ্য টাকা সুরেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ প্রতি বৎসর ৫০০ টাকা করে পরিশোধ করবেন এমন সিদ্ধান্ত হয়। এর কিছুকাল পরে, সুরেন্দ্রনাথ দেউলিয়া হয়ে গেলে, রবীন্দ্রনাথ প্রতি বৎসর দিনেন্দ্রনাথকে ৫০০ টাকা দিয়ে এসেছেন। দিনেন্দ্রনাথ ওই টাকা নিয়ে প্রতিবৎসর গ্রীষ্মকালে দার্জিলিং ভ্রমণে যেতেন। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধান্তে জমিদারির আদায় কম হচ্ছে বলে ট্রাস্টি থেকে দিনেন্দ্রনাথকে কোনো টাকা দেওয়া হলো না। দিনেন্দ্রনাথ এই কথা শুনে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলেন রথীদের কোনো খরচের কমতি হচ্ছে না, আমার বেলায় টাকা নেই? শেষ পর্যন্ত এই টাকা না পাওয়ায়, তিনি শান্তিনিকেতন ত্যাগ করার সংকল্প নেন। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শান্তনিকেতন থেকে 'তাসের দেশ'-এর নাট্য দল নিয়ে কলকাতা আসেন। আর বৎসরের শেষের দিকে কলকাতায় আবার আসেন অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্সে। এবারে তিনি এসেছেলেন 'মায়ার খেলা' এবং 'বাল্মীকি প্রতিভা'র দায়িত্ব নিয়ে। এরপর তিনি নিজের জিনিসপত্রের বিলিব্যবস্থা করে কলকাতায় ভাড়া বাসায় থাকা শুরু করেন। এখানে থাকার সময় রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিনেন্দ্রনাথকে বেতনভুক্ত কর্মী হিসেবে শান্তিনিকেতনে থাকার আমন্ত্রণ জানান। দিনেন্দ্রনাথ এতে অত্যন্ত অপমানিত হয়ে, সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।


১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জুলাই (৫ শ্রাবণ ১৩৪২ বঙ্গাব্দ) ইনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।


সূত্র: