গারো
ভারত প্রজাতন্ত্রের
মেঘালয়
রাজ্যের গারো পাহাড় ও
বাংলাদেশের
নেত্রকোণার
গারো পাহাড়
সংলগ্ন এলাকায়
বসবাসকারী আদিবাসী ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী।
এরা
মোঙ্গলীয় মহাজাতি সত্তার তিব্বতী-বর্মণ জাতিগোষ্ঠীর, বোড়ো শাখাভুক্ত। এদের মাথা ও
মুখমণ্ডল গোলাকার, চুল ও চোখ কালো, কপাল চোখের দিকে কিছুটা বাড়ানো, ভ্রূ ঘন, চোখ ছোট,
শ্মশ্রূহীন, গায়েও লোম কম, নাকমুখ চেপ্টা, চোয়াল উঁচু, নাসারন্ধ্র মোটা, প্রশস্ত
বুক, হস্ত-পদ-পেশি স্থূল, শরীর সবল, আকৃতি বেঁটে, চামড়া পীতাভ মসৃণ।
ভারতবর্ষে মোঙ্গলীয়রা প্রবেশ করেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া দিয়ে। এরা প্রথমে পূর্ব ও উত্তর ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। বিশেষ করে চীন-ভারতের সীমান্তবর্তী তিব্বত, ভুটান, নেপাল, সিকিম এবং তৎসলগ্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের মোঙ্গলীয়রা প্রবেশ করেছিল মায়ানমারের চীন প্রদেশের চীনা পাহাড়ের বন্ধুর পথ পেরিয়ে। ভারতে প্রবেশকারী মোঙ্গলীরা নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। ধারণা করা এদের একটি শাখা প্রথমে তিব্বতের তুরা প্রদেশে ও ভুটানের নকলবাড়ি নামক অঞ্চলে বসতি শুরু করে। এই শাখাকেই ভারতবর্ষে গারোদের আদি জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তিব্বত ও ভুটান থেকে স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারা বিতারিত হয়ে এরা কুচবিহার, আসাম ও রংপুরের রাঙ্গামাটি, গোয়ালপাড়াতে আশ্রয় নেয়। গোষ্ঠীগত কলহে এদের একটি দল গোয়ালপাড়া ত্যাগ করে জনশূন্য, জঙ্গলাকীর্ণ, বৃষ্টিবহুল দুর্গম গারো পাহাড়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। গারো পাহাড়বাসী বলে এদের তখন নাম হয় গারো। উল্লেখ্য ৩,০০০ বর্গমাইল আয়তনের এই পাহাড়টি বঙ্গদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্রিটিশরা এই পাহাড়কে আসামের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এরা এই অঞ্চলে পাহাড়ে জুমচাষ, পশুপালন, শিকার ইত্যাদি দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতো। কালক্রমে গারোরা বাসস্থানের বিচারে দু’ভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ভাগ দুটি হলো− সমতলবাসী ও পাহাড়ী। সমতলবাসীরা লামদানি এবং পাহাড়িরা আচ্ছিক গারো নামে পরিচিত। আচ্ছিকরা লামদানি গারোদের বলে ‘মান্দাই’। উল্লেখ্য, আচ্ছিক বা আচিক-এর অর্থ হলো পাহাড়। আর মান্দাই-এর অর্থ হলো মানুষ। এই মান্দই শব্দটি চীনা শব্দ।
দুর্গম পাহাড়ের কারণে বঙ্গদেশের অন্যান্য
অঞ্চল থেকে এরা বিচ্ছিন্ন ছিল। মোগলরা যখন পূর্বভারতে রাজ্যবিস্তার শুরু করে, তখন
এরা, গারোদেরকে ওরাংওটাং জাতীয় প্রাণী মনে করত। ব্রিটিশরা এদের মানুষ হিসেবে গণ্য
করলেও, অসভ্য ও বর্বর জাতি হিসেবে বিবেচনা করতো। কারণ সে সময়ে গারোরা গাছের বাকল
পরত। মেয়েদের ঊর্ধ্বাঙ্গও উন্মুক্ত থাকতো।
আধুনিক ভৌগোলিক বিভাজন অনুসারে এরা বৃহত্তর ময়মনসিংহ
ও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত। তবে
এই অঞ্চলের প্রথম বসবাসকারী জনগোষ্ঠী হিসেবে এদেরকে অধিবাসী বলা যায়।
সমতলী গারোরা এক সময় বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা,
শেরপুর ও টাঙ্গাইলের নলিতাবাড়ি, কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, শ্রীবর্দি, বারহাট্টা,
ধুবাউরা, হালুয়াঘাট, পূর্বধলা, ফুলপুর, ফুলবাড়িয়া, ভালুকা, মধুপুর ইত্যাদি
স্থানে ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে বাঙালিদের আধিক্যের কারণে টিলা-টেকর, সমতল ও জঙ্গলহীন হয়ে
পড়ে। এরপর এদের অধিকাংশই ভালুকা ত্যাগ করে। একসময় সিলেটের সুনামগঞ্জ, গাজীপুর জেলার শ্রীপুর, কাওরাইদ
এবং কুড়িগ্রামের রৌমারিতে গারোদের বাস ছিল। বর্তমানে এদের সংখ্যা কমে গেছে। ভারতে
সীমান্ত সংলগ্ন বাংলাদেশের
পাহাড়-টিলাগুলি ধসে সমতল হয়ে যাওয়াতে বহু গারো মেঘালয়ে চলে যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের
সময়ও অনেকে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
গারোরা ঐতিহাসিকভাবে ভূমিহীন, তাদের অনেকের
দখলে কিছু জমি থাকলেও তাদের দখলিস্বত্ব ছাড়া জমির কোনো দলিল নেই, তারা খাজনাও দেয়
না। গারোদের আদিম সাম্যবাদী শ্রেণীহীন সমাজে সামন্তবাদী ভূমিব্যবস্থা শুরু হয়েছিল
ব্রিটিশ শাসনামলের মধ্যভাগে। এদের মধ্যে পুঁজিবাদের প্রবর্তনও ব্রিটিশ আমলে ঘটে।
পূর্বে বেচা-কেনা হতো বিনিময় প্রথায়। খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলে অঢেল জমি দলিল করে
ব্যক্তি মালিকানায় দেওয়া হয়। এসব জমি পূর্বে ছিল গোত্রভিত্তিক মালিকানায় এবং
সেগুলি সমবায়ের মাধ্যমে চাষাবাদ করা হতো।
গারো সমাজে বিবাহ
সাধারণত অবিভাবকরা বিবাহের আয়োজন করে। এই জাতীয় বিবাহকে বলা হয় দোবিকদোকা। এই
প্রথায় সাধারণত মামাতো-পিসতুতো ভাইবোনদের মধ্যে হয়। বিবাহের দিন পাত্র আড়ালে থাকে।
বিবাহের লগ্নে উৎসাহী যুবকরা পাত্রকে ধরে এনে একটি ঘরে আটকে রাখে। প্রথানুসারে
পাত্ররা প্রথমে এই বিবাহে রাজী হয় না এবং পালিয়ে যায়। এরপর যুবকরা পাত্রকে পুনরায়
ধরে পাত্রীর সাথে একটি ঘরে আটকে রাখে। এবারও পাত্র পালিয়ে যায়। তৃতীয় দিন তাকে ধরে
আনে। পাত্র যদি একেবারেই পাত্রীকে পছন্দ না করে, তবে বিবাহ বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু
শেষ পর্যন্ত রাজি হলে, বিবাহ হয় এবং পাত্রীর সাথে রাত্রিযাপন করে।
গারোদের ভিতরে বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে। এক্ষেত্রে মৃত স্বামীর আত্মীয়দের ভিতরে
কাউকে বিবাহ করা হয়। সাধারণত মৃত স্বামীর ছোটো ভাইয়ের সাথে বিবাহ হয়ে থাকে।
বহুবিবাহ গারো সমাজে নেই। তবে কোনো কারণে কোনো পুরুষ দ্বিতীয় বিবাহ করতে চাইলে,
তাকে প্রথমা স্ত্রী অনুমতি নিতে হয়। এক্ষেত্রে সংসারে প্রথমা স্ত্রীর অধিকার সবচেয়ে
বেশি থাকে।
গারো সমাজ ব্যবস্থা ও পরিবার
এদের পারিবারিক ব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিক।
গারো সমাজে পুরুষের কর্তৃত্ব নেই। সন্তানদের পরিচয় হয় মায়ের বংশ ধরে। বিবাহিত জীবনে গারো ছেলেরা স্ত্রীর বাড়িতে এসে
বসবাস করে।
গারো সমাজে পুরুষদের সম্পত্তিতে কোনো অধিকার নেই। বিবাহের আগে পুরুষদের অর্জিত
সম্পত্তি পায় তার মা। মায়ের মৃত্যু হলে, ওই সম্পত্তি পায় মায়ের বোনেরা। বিয়ের পর
পুরুষের পূর্বে অর্জিত সম্পত্তি মা বা মায়ের বোনদের অধিকারে থাকে। সম্পত্তির মালিক মা, তারপর কনিষ্ঠ কন্যা বা মাতা মনোনীত অন্য কোনো কন্যা।
উত্তরাধিকারীণীকে বলা হয় নোকনা। বিবাহের পর স্বামীর অর্জিত সম্পত্তি স্ত্রীর অধিকারে থাকে।
এই সম্পত্তি স্বামী স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে ভোগ করতে পারে, কিন্তু হস্তান্তর করতে পারে
না। স্ত্রীর মৃত্যু হলে, ওই সম্পত্তির অধিকার পায় নোকনা হিসেবে নির্ধারিত
কন্যা।
নিঃসন্তান হিসেব কোনো স্ত্রী মৃত্যুবরণ
করলে, স্ত্রী আত্মীয়দের মধ্য থেকে পাত্রী নির্বাচন করা হয়। বিবাহের পর দ্বিতীয়া
আগের স্ত্রীর সকল সম্পত্তি পায়। কিন্তু কোনো কারণে যদি আগের স্ত্রীর কোনো
আত্মীয়াকে সে বিবাহ না করে, তাহলে ওই ব্যক্তিকে আগের স্ত্রীর সকল অর্জিত সম্পত্তি
ত্যাগ করে চলে যেতে হয়। স্ত্রীর মৃত্যুর পর যদি নাবালিকা কন্যা থাকে, তাহলে ওই
সম্পত্তির তত্ত্বাবধান করে, মৃতা স্ত্রীর আত্মীয়রা।
সন্তানদের লালন-পালনের
দায়িত্ব মায়ের ওপর অর্পিত। স্ত্রীর মৃত্যুর পর, ঐ বাড়িতে পিতার থাকার নৈতিক
অধিকার থাকে না। তবে সাধারণত এমন পুরুষকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া না। পরিবারে মেয়ের সমাদর ছেলের চেয়ে বেশি। কারণ,
ছেলেটি বিয়ের পর অন্যত্র চলে যাবে। বিয়ের পর, মাতৃগৃহ ছাড়ার সময় ছেলেটি খুব
কান্নাকাটি করে। স্ত্রীগৃহে সে মনমরা হয়ে থাকে। স্ত্রীর আন্তরিকতা ও আদর-আপ্যায়ন
তাকে আশ্বস্ত করে। তবু সুযোগ পেলে সে কখনও কখনও পালিয়ে যায়, কিন্তু আবার তাকে ধরে
আনা হয়। মায়েরা ছোট শিশুকে একখণ্ড কাপড় দিয়ে পিঠে বেঁধে কঠোর পরিশ্রম ও চলাফেরা
করে।
গারোদের মধ্যে সমগোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ। সমগোত্রের যুবকযুবতীর সম্পর্ক
ভাই-বোনের। উল্লেখ্য, গারো সমাজে রয়েছে দশটি গোত্র।
প্রথাভঙ্গ করে কেউ বিয়ে করলে সম্পত্তি থেকে সে বেওয়ারিশ ও গ্রাম থেকে বহিষ্কৃত
হয়। দুটি জবাই করা মোরগ পাশাপাশি ছেড়ে দিয়ে এগুলি যদি দাপাদাপি করে একত্র হয়ে
যায় তবে বিবাহ শুভ বলে গণ্য হয়। অনেক সময় যথার্থ গোত্রের মেয়ের পছন্দসই কোনো
যুবককে ধরে এনে বিবাহের ব্যবস্থা করা হয়। এতে ছেলের গোত্রের আপত্তি থাকে না।
স্বামীর মৃত্যু হলে, স্ত্রী স্বামীর গোত্রের কোনো স্ত্রীবিহীন পুরুষকে স্বামী
হিসেবে দাবি করতে পারে। এরূপ বিবাহ সম্পর্ক ও বয়সে প্রায়শ অসম হয়, তবু গোত্রের চাপে মেনে নিতে
হয়। স্বামীর মৃত্যুর পর জামাতা শাশুড়িরও স্বামীরূপে বিবেচিত। এতে মা-মেয়ের মধ্যে
সতীনের তিক্ত সম্পর্ক তৈরি হয় না। গোত্রীয় কারণে কারও নাবালিকার সঙ্গে বিয়ে হলে
সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত শাশুড়ির সঙ্গে জামাতার যৌনসম্পর্ক বিধেয়। গারো সমাজে
একসময় দলবিবাহ ও অবাধ যৌনাচার থাকলেও পরে বাধা-নিষেধ আরোপিত হয়। বিবাহপূর্ব কিংবা
অসম সম্পর্কের নারী-পুরুষদের যৌনাচার জরিমানা ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যথার্থ প্রমাণের
অভাবে কিছু কঠিন পরীক্ষা দ্বারা দোষী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে। বিবাহিত
ব্যক্তিদের মধ্যে সামাজিক অনাচারের শাস্তি হচ্ছে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ।
গারোদের পোশাক:
এক সময় গারোরা গাছের বাকল পরত।
বর্তমানে সাধারণ গারোরা জনা বা নেংটি এবং উপরের স্তরের লোকেরা নিজেদের বোনা
সংক্ষিপ্ত কাপড় পরে। মেয়েরা এক টুকরা সংকীর্ণ কাপড় সম্মুখ থেকে পিঠের দিকে বেঁধে
স্তন আবৃত করে রাখে। পুরুষরা গামছা বা ধুতি পরে। আধুনিক কালে গারোরা বাঙালিদের মতোই
পোশাক পড়ে। গারো মেয়েদের অনেকে শাড়ি,
সালোয়ার-কামিজ পরে।
খাদ্য:
এরা মোটামুটি সর্বভুক। তবে বিড়াল টোটেম বলে, বিড়াল হত্যা বা খাদ্য হিসেবে
নিষিদ্ধ ছিল। ফলমূল এদের প্রধান খাদ্য ছিল বলে অভাবহীন নির্বিঘ্ন জীবনে এদের দ্রুত
সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে। বয়স্ক গারোরা দিনে তিনবার, শিশুরা চার বার খায়। এরা বাঁশের
চোঙায় রানড়বা করে এবং প্রচুর মদ পান করে। মাংস ছাড়া এদের অতিথি আপ্যায়ন হয় না।
উৎসবাদিতে অতিথিরা মোরগ, শূকর ইত্যাদি নিয়ে আসে। এক সময় গারোরা কলাগাছের বাকল পুড়িয়ে এর ছাই সাবান ও লবণের
কাজে ব্যবহার করত। বিশেষ বিশেষ খাবার আজও ছাই দিয়ে রানড়বা হয়।
ধর্ম ও বিশ্বাস
বাংলাদেশের গারোদের নগণ্যসংখ্যক মুসলমান ছাড়া সবাই খ্রিষ্টান। খ্রিষ্টধর্মী
গারোরা খ্রিষ্টানধর্মের নিয়মাবলির পাশাপাশি তাদের ঐতিহ্যগত প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠান
করে থাকে।
গারোদের আদি ধর্ম বহু-দেবতা ভিত্তিক। এই ধরএম সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, বজ্র, বৃষ্টি প্রভৃতির পূজার বিধান রয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি গারোরা সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বরাবর বিশ্বাস করে এসেছে। তিনি যে এই পৃথিবীর সবকিছুর স্রষ্টা এ বিশ্বাস গারোদের মধ্যে ছিল। গারোরা একইসঙ্গে মানবদেহে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী এবং সেই আত্মা যে অবিনশ্বর এটাও তারা বিশ্বাস করে। তারা হিন্দুদের মতো জন্মান্তর বাদে বিশ্বাসী।
গারোদের প্রথাগত বিশ্বাস ও সংস্কারসর্বস্ব একটি অনানুষ্ঠানিক কৃষিভিত্তিক ধর্ম আছে যার নাম সাংসারেক। মূর্তিপূজা, পাপ-পুণ্য, ভগবান, স্বর্গ-নরক ইত্যাদির কোনো ধারণা তাদের নেই। জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, ফসল সংরক্ষণ, রোগশোক, মহামারী, ভূত-প্রেত-রাক্ষস ইত্যাদি অদৃশ্য অপশক্তির অমঙ্গল থেকে বাঁচার জন্য তারা বারো মাসে তেরো কিংবা ততোধিক ব্রত ও পর্ব-পার্বণ পালন করে।
গারোদের সৃষ্টিতত্ত্ব প্রায় অন্যান্য প্রধান প্রধান ধর্মবিশ্বাসের অনুরূপ। বিশেষ করে পবিত্র বাইবেলে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্বের সঙ্গে ব্যাপক সাদৃশ্য বিদ্যমান। তাদের বিশ্বাস আদিতে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জলময় ও ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। পরবর্তীকালে প্রধান দেবতা তাতারারাবুগা তাঁর সহচর নস্তু-নপান্তু ও অন্যান্য দেব-দেবীর সহায়তায় পৃথিবী, আকাশমণ্ডল, গ্রহ-নক্ষত্র, সাগররাজি, পর্বতমালা, নানা জীবজন্তু, গাছপালা প্রভৃতি সৃষ্টি করেন। তাতারা-রাবুগা ছাড়াও গারোদের উপাস্য আরও অনেক দেবেদবী রয়েছে। এইসব দেব-দেবীর কারো কারো দায়িত্ব মানুষকে বিষয়সম্পদে সৌভাগ্যশালী করা আবার কারো কারো দয়িত্ব মানুষকে নানাবিধ রোগ-ব্যাধি প্রদানের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করা।
গারোদের উল্লেখযোগয্ দেব-দেবী
- তাতারারাবুগা: প্রধান দেবতা। এর সহচরের নাম নস্তু-নপান্তু।
- গোয়েরা: বজ্র-বিদ্যুতের দেবতা। কখনো কখনো সুস্বাস্থ্য ও শক্তির দেবতা হিসেবে পূজা করা হয়।
- গোঙ্গা: ঐশ্বর্যের দেবতা। জুম চাষের প্রবর্তক এবং তুলা চাষের প্রবর্তক
- রোক্কিমা: ধানের দেবী। ধারণা করা হয় হিন্দু ধর্মের লক্ষ্মী দেবীই রোক্কিমা নামে গারোরা পূজা করে।
- সুসিমে: চন্দ্র দেবী। এই দেবী চঞ্চলমতি, ঈর্ষাপরায়ণা এবং বিভ্রান্তসৃষ্টিকারিণী। এ ছাড়া দেবীকে সৌভাগ্যের দেবী হিসেবও মান্য করা হয়।
- বালওয়া: বায়ু ও ঝড়ের দেবতা।
- সালগ্রা: আলোর দেবতা এবং সূর্যের প্রতিনিধি।
- সাল্জঙ্: উর্বরতার দেবতা।
- আবেত রেঙ্গে: ক্ষতির দেবতা। এই দেবতাকে অপমান করলে কঠিন অসুখ হয়। এবং এই অসুখ থেকে মৃত্যুও হতে পারে।
- নোয়েরি সিমেরি: ক্ষতিকারক দেবী। রোগের দেবী হিসেবে চিহ্নিত।
- নাগ্নি: সর্পদেবী। এর পরিচারকের নাম সুরেং রেং নামক একটি বিশাল সাপ। হিন্দু পৌরাণিক নাগিনী থেকে এই দেবী যুক্ত হয়েছে।
- কুবেরা: পাতালের দেবতা। পাতালের সঞ্চিত অর্থ পাহারা দেন। হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র কুবের-এর সাথে এর মিল রয়েছে।
- নাহ্মা নাহ্সা: মাছের দেবী।
- তেঙ্গাজা: জিন-পরির দেবী।
- ফোজোউ: সন্তান উৎপাদনের দেবী। হিন্দু পৌরাণিক দেবী ষষ্ঠীর অনুরূপ।
মন্ত্রতন্ত্র, জাদু-টোনা ইত্যাদি নিয়েই সাংসারেক ধর্ম। এরা সর্বপ্রাণবাদী ও বস্তুর দ্বৈতসত্তায় বিশ্বাসী এবং প্রকৃতি ও জড়বস্তুতে প্রাণ আরোপ করে। এরা সাপ ও বাঘকে মনে করে প্রেতাত্মার দেহীরূপ। কোনো কোনো মানুষ দিনে মানুষ থাকে এবং রাতে বাঘ হয়ে যায়। গারো ভাষায় এটাকে বলে মাৎসাদু মাৎসাদে। কোনো কোনো গাছ, পাথর, টিলা ভূতপ্রেতের আবাস, এ বিশ্বাসে তারা এগুলিকে এড়িয়ে চলে। গারোদের অনুষ্ঠানাদি উদযাপন, মহামারীর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় ব্রত পালন, তাবিজ-তুমার দিয়ে রোগ-বালাইয়ের নিরাময় ইত্যাদি যাঁরা করেন, তাঁরা সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি। এঁদেরকে অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন মনে করা হয়। এরা খামাল বা কামাল নামে পরিচিত।
অপশক্তির বদনজরের ভয়ে শিশুর সুশ্রাব্য নাম রাখা হয় না। মৃত ব্যক্তির প্রেতাত্মা যেন অমঙ্গল না করে সেজন্য অন্ত্যষ্টি ক্রিয়ার পূর্বে ও পরে পশুবলি, পিণ্ডদান, বিবিধ ব্রত পালন এবং তাদের নিকট প্রার্থনা করা হয়। পূর্বে সমভূমি থেকে ধরে নিয়ে মানুষ ধরে নিয়ে গিয়ে বলিও দিতো। গারোদের ধর্মীয় বিশ্বাস, মৃত্যুর পর আত্মা পর্বতের উচ্চতম চিক সাং শিখরে কিছুকাল অবস্থান করে অজানা পৃথিবীর অজ্ঞাত স্থানে ঘোরাঘুরি করতে করতে অবশেষে প্রেতাত্মারূপে ফিরে আসে কিংবা মানুষ বা পশুরূপে পুনর্জন্ম লাভ করে। আত্মঘাতক কিংবা হিংস্র জন্তুর আক্রমণে নিহত ব্যক্তি পশু হয়ে জন্মায়। মৃতের সৎকার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এর মধ্যে প্রধান পদ্ধতি হচ্ছে ‘মিমাংখাম’; লাশকে গোসল করিয়ে উত্তমরূপে তেল মাখিয়ে দেয় এক মহিলা, অন্য মহিলারা ঐতিহ্যগত বিলাপসঙ্গীত গায়। তারপর পুরুষরা নারী-পুরুষভেদে মৃতকে কাফন পরায়।
সাধ্যানুসারে মূল্যবান বস্তু দ্বারা উপাসনা করা হয়। চিতা থেকে এক টুকরো অর্ধপোড়া হাড় এনে মৃতের পূর্ব বাসঘরে পুঁতে রাখা হয়। এ জায়গাটিকে বলা হয় খাটিক। চিতাভস্মের কিয়দংশ ক্ষেত্রে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। মৃত ব্যক্তির পরিবারের লোকজন সাত দিন নিরামিশ ভোজন করে ও মৃত ব্যক্তিকে পিণ্ডদান করে। তারপর ভাত, মুরগি ও শূকরের মাংস দিয়ে শ্রাদ্ধ পালন করা হয়। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় শোকমিছিল। গারোরা মৃত ব্যক্তিকে শেষ পিণ্ডদানের দিন নাচ-গান করে ও বাজনা বাজায় এবং প্রচুর মদ্যপান করে।
তখন সংবৎসরের নিরাপত্তার নিমিত্তে আসিরোকা নামক নববর্ষ পালন করে। তারা বিশ্বাস করে, অপদেবতারা ক্ষেত ও গোলা থেকে উৎপন্ন ফসল চুরি করে নিয়ে যেতে পারে। এর বিরুদ্ধে প্রতিটি ফসল বপন ও সংগ্রহের সময় গারোরা বিভিন্ন নামে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান করে যার মধ্যে ওয়াংগালা অনুষ্ঠান সবচেয়ে বড়। সমগ্র গারো এলাকা তখন হয়ে ওঠে আনন্দমুখর। সবাই ঘরে মজুতকৃত মদ পান করে। বিভিন্ন গোত্রের যুবক-যুবতীরা বিশেষ পোশাক পরে, দেহ-মুখ চিত্রিত করে নাচগানে মাতাল হয়ে ওঠে। পরস্পরের পছন্দসই যুবক-যুবতীরা বারংবার পরস্পরের মুখে মদ ঢেলে দিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গী বেছে নেয়। অবিরত মহিষের শিঙ্গা, ঢাক-ঢোল ও এদের সর্বপ্রকার বাদ্যযন্ত্র একসঙ্গে বাজতে থাকে। শক্তিশালী যুবকরা ভূতপ্রেত-রাক্ষসীকে ভয় দেখাতে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে তাণ্ডব নর্তনকুর্দনে মেতে ওঠে। এসব অনুষ্ঠান সাংসারেক ধর্মের অঙ্গ। ভূতপ্রেত-রাক্ষসীকে ওরা দুইভাবে প্রশমিত রাখার চেষ্টা করে- রোগালা বা ভোগ দিয়ে ও ভয় দেখিয়ে।
জীবিকা:
গারোদের আদি জীবিকা ছিল শিকার-কৃত বন্য পশু এবং বনজ ফলমূল। পরবর্তী সময়ে এরা
কৃষিকাজ শেখে। পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করার জন্য, এরা জুম পদ্ধতির চাষে অভ্যস্থ হয়ে
উঠেছিল বহুকাল আগে থেকে। আধুনিক কালের শহুরে গারোরা নানা ধরনের চাকরি করে। এদের
সাথে গ্রামীণ গারোদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
চাষাবাদ: গারোদের কাছে চন্দ্র, সূর্য, বৃষ্টি, নদী, ফসল ইত্যাদি দেবতুল্য। এরা চৈত্র মাসে জঙ্গল কেটে ও পুড়িয়ে ধান বপন করে। এই বপন প্রক্রিয়া সমস্ত পাহাড়িদের কাছেই জুমচাষ নামে পরিচিত। জুম চাষকালে গারোরা খুব ভোরে মিফ্রিং (সকালের খাবার) খেয়ে সঙ্গে করে মিশাল (দুপুরের খাবার), লাউয়ের খোলে করে পানি, হাতের মং রেং, সেলু, মিলআম ইত্যাদি প্রয়োজনীয় অস্ত্র নিয়ে সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের সব মেয়ে-পুরুষ পাহাড়ি চড়াই-উৎরাই আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে বন্য হিংস্র পশুদের ভয়ে সারিবদ্ধ হয়ে গান ও সংকেতধ্বনি করে দূর দূর জুম ক্ষেতে কাজ করতে চলে যায় এবং অপরাহ্ণে শ্রমক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। দিনের বেলায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও ছেলেমেয়েরা বাড়ি-ঘর ও গরু-বাছুর দেখাশুনা করে। সন্ধ্যায় ক্ষেত থেকে ফিরে এসে ক্লান্তি দূর করার জন্যে সবাই মিলে মদ নিয়ে বসে, গল্পগুজব ও আমোদ-প্রমোদ করে পরে আহারাদি করে শুয়ে পড়ে। এদিকে প্রত্যেক বাড়ির দু’একজন পুরুষ বেলা থাকতে খেয়ে বরাংএ পাহারা দিতে চলে যায় এবং সারারাত হাতি, শূকর ইত্যাদির হাত থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য পাহারা দেয়। গারোদের সারা বছরে (বিলসিকারি বা সলেতক) জুম চাষের কার্যক্রমে মাস, সময়ের নাম, কাজের নাম ও কৃষি উৎসবের নাম ভিন্ন ভিন্ন।
গারো পঞ্জিকা ও ফসলের নাম
১. গালমাকজা (বৎসরের প্রথম মাস)। ফেব্রুয়ারি মাসের অর্ধেক এবং মার্চ মাসের অর্ধেক।
এ মাসে নববর্ষ উৎসব উদযাপন করা হয়। আসং কোশির (গ্রাম ও জীবন রক্ষক দেবতার) পূজা করা হয়। এ কৃষি সময়কে আসকারী বলা হয়। এ মাসের কৃষি উৎসব হলো ‘দেন বিলসিয়া’ (নতুন কৃষিজমি পরিষ্কারের উৎসব)। গিৎচিপং, মিচিল তাৎ আ ইত্যাদি বহু সংখ্যক উৎসব এ মাসে হয়ে থাকে।২. মেবাকজা (বৎসরের দ্বিতীয় মাস)। মার্চ মাসের অর্ধেক এবং এপ্রিল মাসের অর্ধেক।
এই মাসে কৃষি সময়ের নাম হলো গালমাক বা গেআ কারি। এ মাসে আসিরকা বা আ সি অকা কৃষ্টি উৎসব হয়। আসি অকা অর্থ মন্দ শক্তির প্রভাব দূর করা। এ মাসে পাহাড়ি ধান বোনা হয় এবং সামদিম দাংআ বা আগাছা নিড়ান হয়।৩. জাগ্রোজা (বৎসরের তৃতীয় মাস)। এপ্রিল মাসের অর্ধেক এবং মে মাসের অর্ধেক।
এ কৃষি সময়ের নাম হলো জাকরাকারি। এ মাসে নতুন কৃষিক্ষেত নিড়ান হয় এবং একে কেন্দ্র করে আ-জাকরা উৎসব পালিত হয়।৪. সগালজা (বৎসরের চতুর্থ মাস)। মে মাসের অর্ধেক এবং জুন মাসের অর্ধেক।
এ কৃষি সময়ের নাম হল দাংকারি। এ মাসে দ্বিতীয় বছরে ব্যবহৃত কৃষি ক্ষেত নিড়ান হয়। এর নাম আব্রংদাংআ। এ মাসে ভুট্টা (মিকপ) ফসল তোলা হয় এবং আব্রেংদাংগা উৎসব পালিত হয়।৫. জাগাপজা (বৎসরের পঞ্চম মাস)। জুন মাসের অর্ধেক এবং জুলাই মাসের অর্ধেক ।
এ কৃষি সময়ের নাম হলো মিসিকারি। এ মাসে বামিল (দ্বিতীয় ফসলের জন্য নতুন করে চাষ) এবং আব্রেংরাতা (ভুট্টা ফসল শেষ করে তোলা) হয়। মিসি নামক চিক্কণ শস্যও এ সময়ে কাটা হয়। এ মাসে ‘মি’ আমুয়া বা রক্ষিমের (শস্য দেবী) পূজা উৎসব হয়।৬. জামেদকজা (বৎসরের ষষ্ঠ মাস)। জুলাই মাসের অর্ধেক এবং আগস্ট মাসের অর্ধেক।
এ কৃষি সময়ের নাম হলো মিত্তেকারি। এ মাসে সামাংদাংআ বা আগাছা নিড়ান হয়। এ মাসে গ্রীষ্মকালীন ফসল তোলা শেষ হয় এবং রংচুগালা, গিন্দেগা”লা বা মিগিতালা উৎসব পালিত হয়।৭. মেপাংজা (বৎসরের সপ্তম মাস)। আগস্ট মাসের অর্ধেক এবং সেপ্টেম্বর মাসের অর্ধেক।
এ কৃষি সময়ের নাম হলো সামপাংকারি। এ মাসে গারোরা মুরাদ রাতা (আগাছা নিড়ান) করে এবং আহাইয়া, আ‘ আ উ আ বা জামেগাপা উৎসব পালন করে। এ উৎসবের আগে গারোরা লাল চাল খায় না।৮. আ’নিজা (বৎসরের অষ্টম মাস)। সেপ্টেম্বর মাসের অর্ধেক এবং অক্টোবর মাসের অর্ধেক। এ কৃষি সময়ের নাম ওয়াছি ছাকাতকারি। এ মাসে গারোদের প্রধান উৎসব ওয়ানগালা ও ঘুরে ওয়াতা উৎসব উদ্যাপিত হয়।
৯. বে’রকজ (বৎসরের নবম মাস)। অক্টোবর মাসের অর্ধেক এবং নভেম্বর মাসের অর্ধেক। এ কৃষি সময়ের নাম সিনকারি। এ মাসে কার্পাস ফসল তোলা হয় এবং আ’বিয়া উৎসব পালিত হয়।
১০. কিলকজা (বৎসরের দশম মাস)। নভেম্বর মাসের অর্ধেক এবং ডিসেম্বর মাসের অর্ধেক।
এ কৃষি সময়ের নাম শ্রুরুকারি। এ মাসে আখিং নকমা (রাজা) আ’দাল (নতুন জমি) চাষের জন্য বিতরণ করেন। এ মাসে উল্লেখযোগ্য কোনো উৎসব নেই।১১. আ’উইতজা (বৎসরের একাদশ মাস)। ডিসেম্বর মাসের অর্ধেক এবং জানুয়ারি মাসের অর্ধেক।
এ কৃষি সময়ের নাম আ আ অ অ’কারি। এ মাসে নতুন জমি পরিষ্কার করার কাজ আরম্ভ করা হয় এবং অ’পাতা উৎসব পালন করা হয়।১২. ওয়াচেংজা (বৎসরের দ্বাদশ মাস)। জানুয়ারি মাসের অর্ধেক এবং ফেব্রুয়ারি মাসের অর্ধেক। এ কৃষি সময়ের নাম ওয়াচেংকারি। এ মাসে বরাং তৈরি করা হয় এবং আ উইতা উৎসব পালন করা হয়।
গারো ভাষা:
গারো ভাষার অপর নাম মান্দি ভাষা। এটি
সিনো-তিব্বতীয়
ভাষা পরিবারের
অন্তর্গত
তিব্বত-বর্মীয়
উপরিবারের একটি ভাষা।
গারো উপকথা অনুসারে জানা যায় যে, গণ্ডারের
চামড়ায় গারো ভাষায় এদের লিখিত শাস্ত্র ছিল। সুদীর্ঘ কষ্টকর যাযাবর জীবনে তা
বিনষ্ট হয়ে যায়। ময়মনসিংহের এক জমিদার শিকারে গিয়ে এক গারো পর্বতগুহায় পুঁথির
দু-একটি ছেঁড়া পাতা পেয়ে এর ফটো সৌরভ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। তা এত ঝাপসা ছিল
যে, কোনো অক্ষরই বোধগম্য হয় নি। বাহ্যিকভাবে লেখাগুলি ছিল চীনা চিত্রলিপির মতো।
বর্তমানে বাংলাদেশের গারোরা গারো ও বাংলা ভাষায় কথা বলে। শিক্ষিত গারোরা ইংরেজি
শেখে। কিন্ত ভারতীয় গারোরা বাংলা, হিন্দি এবং গারো ভাষায় কথা বলতে পারে। গারো ভাষা
বাংলা বর্ণমালায় লেখা হয়।
গারো সংস্কৃতি
গারোদের অনেকে বাংলা নাচ-গানে পারদর্শী। গারোদের নিজস্ব খেলাধুলা আছে। গারোদের ঘর
মাচার উপর নির্মিত, অনেক জাদাপ বা বহু কোঠাবিশিষ্ট এ ঘরগুলি মহিষ ও হরিণের শিং
দ্বারা সুসজ্জিত। এক সময় তাদের ঘরে মানুষের করোটিও সাজিয়ে রাখা হতো। এসব করোটি
গারো কর্তৃক সমভূমির আক্রান্ত ও নিহত মানুষের। করোটিগুলি আত্মশক্তিবর্ধক, আভিজাত্য
ও বীরত্বের প্রতীকরূপে বিবেচ্য ছিল এবং এসব বিক্রয় হতো। গারোদের গোয়াল ও গোলাঘর
আলাদা। গ্রামের কেন্দ্রস্থলে নাকপান্থে নামের বাড়িতে যুবকদের বসবাস। এই বাড়িতে
আমোদ-প্রমোদের নিমিত্ত এরা একটি কারুকার্যময় ঘর তৈরি করে। এতে মেয়েদের প্রবেশ
নিষেধ।
সূত্র:
গারো সমাজ ও সংস্কৃতি। ডঃ বিমলেন্দু দান (রতনবিশ্বাস সম্পাদিত উত্তরবঙ্গের
জাতি ও উপজাতি)। পুনশ্চ, কলিকাতা, ২০০১।
বাংলাদেশের গারো আদিবাসী। সুভাষ জেংচাম। বাংলা একাডেমী। জুন ১৯৯৪
http://www.ebanglapedia.com/bn/article.php?id=13&title=গারো#.UxcZ762IqUk