বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি
বাংলা ভাষায় মুসলমান সাহিত্যিকদের জন্য
একটি সাহিত্য সংগঠন।
এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন-
ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ,
মোজাম্মেল হক, বিএ, কাজী
ইমদাদুল হক,
মাওলানা আকরাম খান, মৌলবি আবদুল করিম,
কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ-সহ আরো কিছু
সাহিত্যপ্রেমী।
১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা মে কলকাতার ৯নং অ্যান্টনী বাগানে, করিম বক্স ব্রাদার
দপ্তরীখানার মালিক মৌলভী আব্দুর রহমানের বাসভবনের অ্যান্টনী বাগান
মোজাম্মেল হকের বিএ
আহ্বানে একটি সাহিত্য সংগঠনের জন্য একটি সভার আহ্বান করা হয়। এই সভার সভাপতিত্ব
করেন তৎকালীন স্কুলসমূহের পরিদর্শক মৌলভী আব্দুল করিম বি.এ.। এই সময় উপস্থিত ছিলেন
মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, সাপ্তাহিক 'দি
মুসলমান'-এর সম্পাদক মৌলভী মুজিবুর রহমান, শেখ আব্দুর রহিম, মুনশী মোহাম্মদ
রেয়াজউদ্দীন আহমদ, শান্তিপুরের কবি
মোজাম্মেল হক, 'কোহিনূর' পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ রওশন আলী চৌধুরী প্রমুখ
তৎকালীন বিশিষ্ট সাহিত্যিক-সাংবাদিকবৃন্দ। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে 'বঙ্গীয় মুসলমান
সাহিত্য সমিতি' গঠিত হয় এবং মৌলভী আব্দুল করিম ও
ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে নবগঠিত সমিতির যথাক্রমে প্রথম সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচন করা হয়।
কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির প্রথম সম্পাদক
ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ সমিতি গঠনের পটভূমি সম্পর্কে তিনি বলেন: ইংরেজি ১৯১০ সালে আমি বি.এ.
পাস করি। ঐ সময় কলকাতায় কয়েকটি উৎসাহী যুবকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
তাঁদের মধ্যে ছিলেন
মোজাম্মেল হক, মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী, মৌলভী
আহমদ আলী, মঈনুদ্দীন হুসায়ন প্রভৃতি। সকলের মধ্যে জ্বলন্ত উৎসাহী ছিলেন মৌলভী
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক। আমরা কয়েকজন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভ্য ছিলাম। সেখানে
হিন্দু-মুসলমান কোন ভেদ না থাকলেও আমাদের সাহিত্যিক দারিদ্র্যের দরুন আমরা বড়
লোকের ঘরে গরীব আত্মীয়ের মতন মন-মরা হয়ে তার সভায় যোগদান করতাম। আমাদের মনে হলো
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে সম্বন্ধ বিচ্ছেদ না করেও আমাদের একটি নিজস্ব
সাহিত্য-সমিতি থাকা উচিৎ'।
সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য
১. বঙ্গীয় মুসলমান সমাজে বঙ্গ সাহিত্যের আলোচনা ও তাহার পরিপুষ্টি সাধন।
২. আরবী, ফারসী, উর্দু প্রভৃতি ভাষা হইতে ধর্মশাস্ত্র ও ইতিহাসাদির অনুবাদ প্রচার।
৩. প্রাচীন মুসলমান বঙ্গ সাহিত্যের সংগ্রহ ও সংরক্ষণ।
৪. বঙ্গদেশের বিভিন্ন স্থানের পীর, সাধুপুরুষ ও অন্যান্য মহাজনের জীবনী সংগ্রহ ও
প্রকাশ।
৫. বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের প্রাচীন বংশাবলীর ও প্রাচীন কীর্তিকলাপের ইতিবৃত্ত ও
জাতীয় ইতিহাসের অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ।
৬. বঙ্গীয় মুসলমান সমাজে সাময়িকপত্রের প্রচার।
৭. সদ্গ্রন্থের প্রচারকল্পে সাহিত্যসেবীদিগকে উৎসাহ প্রদান।
৮. সাহিত্যক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন।
৯. সমিতির সংশ্লিষ্ট একটি পুস্তকাগার স্থাপন ও পাঠাগার সংরক্ষণ।
এই সাহিত্য সমিতি তার প্রায় বত্রিশ বছরের ইতিহাসে মুসলিম জাতীয়তাবোধের বিকাশ
সাধনের চেষ্টা করে। সমিতির নিয়মিত মাসিক সভা ও বার্ষিক সম্মেলনের ব্যবস্থা করতো।
সমিতির উদ্যোগে মোট সাতটি সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর ভিতরে মধ্যে তৃতীয়
সম্মেলন চট্টগ্রামে, চতুর্থ সম্মেলন বসিরহাটে এবং বাকিগুলি কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়।
১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে
মোজাম্মেল হক, ২৯ নম্বর আপার সার্কুলার রোডের সাপ্তাহিক 'মোহাম্মদী' পত্রিকার
অফিসে তৎকালীন সাহিত্যানুরাগীদের এক সভা আহবান করেন। উক্ত সভার সভাপতিত্ব করেছিলেন
খান বাহাদুর আহাসানউল্লাহ। ওই সভার উপস্থিত সদস্যদের সম্মতিক্রমে 'বঙ্গীয় মুসলমান
সাহিত্য সমিতি'র সভাপতি হন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল ইন্সপেক্টর মৌলভী আব্দুল করিম এবং
সেক্রেটারি হিসেবে মনোনীত হন
মোজাম্মেল হক।
এছাড়া মনোনীত হয়েছিলেন চার জন সহাকারী সম্পাদক ও পনের জন কার্যনির্বাহী কমিটির
সদস্য। এরপর থেকে 'মোহাম্মদী' পত্রিকার অফিসে প্রতি সপ্তাহে এই সমিতির
সাহিত্য সভা অনুষ্ঠিত হওয়া শুরু হয়।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে
মোজাম্মেল হক
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারমাইকেল হোস্টেলের
সুপারন্টেন্ড হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করেন। এই হোস্টেলটি ছিল কলকাতার ৫১ নম্বর
বৈঠকখানা সড়কে। এই সময় সমিতির সেক্রেটারি মোজাম্মেল হক, ৪৭/১ নম্বর মীর্জাপুর
সড়কস্থ একটি বাড়ির নিচ তলায় মাসিক ২ টাকা ভাড়ায় সমিতির পাঠাগার স্থাপন করেন।
অল্পদিনের মধ্যেই এই পাঠাগারটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
১৯১৮
খ্রিষ্টাব্দের ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, তৎকালীন 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র
কার্যকরী সভায় একটি সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই
পত্রিকাটি প্রকাশের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়ছিল। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে 'বঙ্গীয়
মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা ' নামে ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয় ১৯১৮
খ্রিষ্টাব্দের ১৪ এপ্রিল (১লা বৈশাখ
১৩২৫) তারিখ থেকে। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন
ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও
মোজাম্মেল হক।
এই সময় 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি'র অফিস ছিল ৩২ নম্বর কলেজ
স্ট্রিটস্থ একটি বাড়ি। সমিতির ত্রিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৫-৬ এপ্রিল কলকাতায় রজত
জুবিলি পালন করে। এই অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করেছিলেন
এ,কে, ফজলুল হক, আর সভাপতিত্ব
করেছিলেন
কাজী নজরুল ইসলাম।
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ৮-৯ মে সমিতির সপ্তম ও শেষ বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়
কলকাতয়। লাহোর প্রস্তাবের প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে কলকাতায় ১৯৪২
খ্রিষ্টাব্দ পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি এবং ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান
সাহিত্য সংসদ।
১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দ বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন পদ লাভ করেন
মুসলমান সাহিত্যিক এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অধিকাংশ
সদস্য নবগঠিত দুটি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। ফলে এই সাহিত্য সমিতির কার্যক্রম
স্তিমিত হয়ে পড়ে। এরপর সমিতির কোনো বার্ষিক সম্মেলন হয় নি। ধারণা করা হয় পাক-ভারত
বিভাজনের আগেই এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।