মুকুলফৌজ
বাংলাদেশের শিশুদের কল্যাণ, নিরাপত্তা, গঠন, অধিকার ইত্যাদি বিষয়ক একটি সংগঠন।

আধুনকি সভ্যতায় বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে শিশুর কল্যাণ এবং অধিকার নিয়ে প্রথম ভাবনা-চিন্তার সূচনা হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে, স্কাউট আন্দোলনের মধ্য দিয়েই মূলতঃ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে শিশুকিশোরদের কল্যাণের বিষয়টির সূচনা ঘটে। ১৯০৭-০৮ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপের যুদ্ধ কবলিত পৃথিবীর শিশুকিশোরদের নিরাপত্তা, কল্যাণ ও জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল ‘বয় স্কাউট’ তৈরি করেছিলেন। উল্লেখ্য বোয়ারের যুদ্ধের বিভীষিকার কথা মাথায় রেখে তিনি এ সংগঠনটি গড়ে তুলেছিলেন। কালক্রমে এই সংগঠনটি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। বিশেষ করে ব্রিটিশ উপনিবেশিক দেশগুলোতে এ আন্দোলন স্কুল কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল 'গার্লস্ গাইড'।

এক্ষেত্রে ছোটদের জন্য গঠিত হয়েছিল ‘কাব’, আর বড়দের জন্য ‘রোভার স্কাউট’। উল্লেখ্য, সে সময়ে স্কাউট আন্দোলন কোন সমাজতান্ত্রিক দেশে প্রচিলত ছিল না। ধীরে ধীরে সমাতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে গণচীনে ‘লিটল রেড স্কাউট’ বা ‘লিটল রেড গার্ডস’, কোরিয়ার পিয়ং ইয়ং-এ গড়ে ওঠে ছোটদের সংগঠন। আর ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্র দেশসমূহে ‘পাইওনিয়ার’ আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের দেশগুলোতে সুসংগঠিত শিশুকিশোর আন্দোলন হিসেবে বিস্তার লাভ করে।

ভারত উপমহাদেশে মি. এস.কে. মল্লিকের নেতৃত্বে ১৯১৬ বঙ্গদেশে স্কাউট আন্দোলনের সূচনা হয়। শুরুর দিকে তৎকালীন বৃটিশ শাসক গোষ্ঠীর সমর্থনে প্রাথমিক পর্যায়েই শুধুমাত্র মিশনারী ও সরকারী স্কুলে স্কাউট আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল। পরে এই আন্দোলন ব্যাপকভাবে ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষাঙ্গনে ছড়িয়ে দেয়া হয়।

১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন এবং ব্রিটিশ বিরোধী অন্যান্য আন্দোলনের সমন্বয়ে অখণ্ড বঙ্গদেশে স্বদেশী আন্দোলন বিকশিত হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ত্রিশের দশকে অবিভক্ত বাংলায়
গুরুসদয় দত্ত, গড়ে তুলেছিলেন ‘ব্রতচারী’ আন্দোলন। এই ব্রতচারীদের দলীয় নাচকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল দেহচর্চার জন্য, অন্যদিকে গানের মাধ্যমে সামাজিক-সাংস্কৃত ভাবনাকে শেখানো হতো। এই সময় ব্রতচারীতে লাঠির পরিবর্তে ‘কাঠি নৃত্য’-এর প্রচলন হয়।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে মে তৈরি হয়েছিল 'বয়েজ স্কাউট' সমিতি গঠিত হয়। এই সময় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্কাউট আন্দোলন সুসংগঠিত করা হয়েছিল। সে সময় স্কাউটে যোগদান করার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদেরকে অভিভাবকরাই উৎসাহিত করতেন। কিন্তু দেশের অন্যান্য ছোট ছোটো শিশুকিশোর সংগঠনগুলো নানা বাধা-বিঘ্নের সম্মুখীন হয়। সে কারণে কিছু কিছু সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে আবাসিক এলাকায় তাদের কাজ শুরু করেছিল।

ত্রিশের দশকের শেষ দিকে দৈনিক আনন্দবাজারকে কেন্দ্র করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েদের নৈতিক, দৈহিক ও সাংস্কৃতিক মানোন্নয়নের জন্য তৎপরতা শুরু করে মনিমেলা। চল্লিশের দশকে নিখিল ভারত ‘মনিমেলা’ এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘জনযুদ্ধ’কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছিল কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘কিশোর বাহিনী’। এই কিশোর বাহিনীর সদর দপ্তর এবং প্রধান কর্মক্ষেত্র ছিল কোলকাতায়।

১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই আগষ্ট, মুসলিম সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েদেরকে স্বকীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে  দৈনিক আজাদের পাতায় ‘মুকুলের মাহফিল’ নামে বিশেষ বিভাগ খোলা হয়েছিল। উল্লেখ্য, এই নামটি দিয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এ সময় মুকুলের মাহফিলের পরিচালক ছিলেন মোহাম্মদ মোদাব্বের। মুকুলের মাহফিলের পটভূমিতে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামে গড়ে ওঠে শিশুকিশোর সংগঠন ‘মুকুল মেলা’। প্রাথমিক পর্যায়ে মুকুলের মেলাকে পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে একাকার করে দেয়া হয়েছিল। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে মুকুল মেলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘মুকুল ফৌজ’। এবারের মুকুল ফৌজের নতুন পরিচালক হয়েছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ১৪-১৫ আগষ্টে
পাকিস্তান এবং ভারত নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠিত হলে- মুকুল ফৌজ উভয় রাষ্ট্রে দুটি পৃথক সংগঠনে পরিণত হয়। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানএই সংগঠনের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় মুকুল ফৌজকে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দেওয়া  করা হয়। এই কারণে দৈনিক আজাদ পত্রিকার কর্তৃপক্ষের সাথে মুকুল ফৌজের নেতৃত্বের মতভেদ দেখা দেয়। এই মতভেদের সূত্রে ‘মুকুল’ নামে মুকুল ফৌজের নিজস্ব মুখপত্র প্রকাশ করা হয়। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ড. আব্দুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে সেগুনবাগিচায় মুকুল ফৌজের দ্বিতীয় সম্মেলনে, মুকুল ফৌজকে অসাম্প্রদায়িক শিশুকিশোর সংগঠন ঘোষণা করা হয়। তবে মুখ্য বিষয় ছিল-  শিশু-কিশোরদেরকে পাকিস্তানের উপযুক্ত নাগরিকরূপে গড়ে তোলা। তবে এর সাথে যুক্ত করা হয়েছিল সত্য, সুন্দর ও সাম্যের ভিত্তিতে বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের আদর্শ, মানবতার সেবা, অসম্প্রাদায়িকতা, শিক্ষা, সভ্যতা ও শান্তি। ৫০-৬০ এর দশকে মুকুল ফৌজ ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছিল। সে সময়ে এর প্রায় ৪০০ শাখায় সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ছিলো ষাট হাজার।

১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মুকুল ফৌজ থেকে বেরিয়া আসা একটি দল সৃষ্টি করেছিল সবুজসেনা নামক শিশু-সংগঠন।
১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে কবি ফররুখ আহমেদের প্রেরণায় ইসলামী আদর্শে শিশু-কিশোরদের উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে মুকুল ফৌজ থেকে বের হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল ‘
পাকিস্তান শাহীন ফৌজ’।

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ফেব্রুয়ারি ফয়জুল ওয়ারা বাবু ভাই এর নেতৃত্বে মুকুল ফৌজ থেকে বেরিয়ে এসে তৈরি করেছিলেন সূর্যসেনা। এই সংগঠনের শ্লোগান ছিল- ‘সূর্যই সকল শক্তির উৎস’। এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার প্রায় পর এক দশক সক্রিয় ছিল।

সংকলন উৎস:
বাংলাদেশের শিশুকিশোর আন্দোলন- এ কে এম বদরুদ্দোজা
বাংলাদেশের শিশুকিশোর আন্দোলন ও ফুলকুঁড়ি আসর- আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ
শিশু আন্দোলন: অতীত ও বর্তমান- মুহাম্মদ অছিয়ার রহমান মন্টু