১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের শুরর দিকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারে আমলে অনিয়ম, দুর্নীতির
প্রতিবাদ হিসেবে জাসদ আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৮
ফেব্রুয়ারি দলটি হরতাল ডাকে এবং ১৭ই মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভা করে। এই সভা শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেবার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। মিছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির সামনে পৌঁছলে পুলিশের সংগে জনতার খণ্ডযুদ্ধ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রক্ষীবাহিনীকে।
পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য রক্ষীবাহিনীকে তলব করা হয়। রক্ষীবাহিনীর সাথে
সংঘাতে বেশ কিছু জাসদ কর্মী হতাহত হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
জাসদ ক্রমান্বয়ে সহিংসতার পথ ধরে, সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নেয় এবং ছাত্র সমাজের
একটি অংশ বিল্পবী গণবাহিনীতে পরিণত হয়। এর বিভিন্ন স্থানে হত্যা এবং ধ্বাংসাত্মক
কর্মে লিপ্ত হলে- সরকার কঠোরভাবে তা দমনের উদ্যোগ নেয়। এই সময় বহু জাসদ কর্মী নিহত
এবং বন্দী হন। উল্লেখ্য, সে সময়ে (অব) কর্ণেল আবু তাহের ছিলেন জাসদের
গণবাহিনীর সর্বাধিনায়ক
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগষ্টে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি
বঙ্গবন্ধু
শেখ,
মুজিবর
রহমান নিহত হন।
এই সময় এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সংগঠক খন্দকার মোশতাক আহমেদ
রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২৫শে আগষ্ট
জিয়াউর
রহমান 'চীফ অফ আর্মি স্টাফ'
হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ৩রা নভেম্বর বীর বিক্রম শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ব্রিগেডের
সহায়তায় বীর উত্তম মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান
ঘটান। এর ফলে ৬ই নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমেদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং আবু সাদাত
সায়েম বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হন। এর পর
জিয়াউর
রহমানকে চীফ-অফ-আর্মি স্টাফ
হিসেবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। বীর উত্তম কর্নেল
(অবঃ) আবু তাহের সে সময় চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। কর্নেল তাহের ছিলেন জিয়াউর
রহমানের একজন বিশেষ শুভাকাঙ্ক্ষী। তিনি
জিয়াউর
রহমানকে নিজের আদর্শের মানুষ
হিসাবেই মনে করতেন। সাধারণ সিপাহীদের ভিতর কর্নেল তাহেরের জনপ্রিয়তা ছিল। এই
জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে তিনি
জিয়াউর
রহমানকে বন্দী দশা থেকে মুক্ত করেন। প্রথমে
কর্নেল তাহের চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসেন এবং তাঁর দল জাসদের কর্মীদের উজ্জীবিত করেন।
৭ই নভেম্বর তিনি যে অভ্যুত্থানটি পরিচালনা করেন, তাকে 'সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান'
নামে অভিহিত করা হয়। কথিত আছে জাসদের কর্নেল তাহের সিপাহী অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী
বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সাথে জড়িত ছিলেন। কর্নেল তাহেরের এই পাল্টা অভ্যুত্থান সফল হয় এবং জিয়াউর
রহমানকে তিনি মুক্ত করেন। এই সময়ে কর্নেল তাহেরের কাছে
জিয়াউর
রহমান অঙ্গীকার করেন যে, ক্ষমতা লাভের পর তিনি বিভিন্ন জেলে আটকৃত জাসদ
কর্মীদের মুক্তি দেবেন এবং জাসদকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করবেন। কিন্তু ক্ষমতা লাভ
করার পর, জেনারেল
জিয়াউর
রহমান ক্ষমতায় উঠে আসেন
এবং নিজের ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করার জন্য সেনাবাহিনীর ভিতর শুদ্ধি অভিযান চালান। এই সময়
তিনি বহু সৈনিককে হত্যা করেন। বিশেষ করে তাঁর বিরোধিতা করেছে বা করতে পারে এমন বহু
সৈন্যকে সামরিক আইনের অধীনে এনে হত্যা করেছেন। এই শুদ্ধি অভিযান চলাকালে,
তিনি তাঁর
ত্রাণকর্তা এবং প্রাণরক্ষাকারী কর্নেল (অবঃ) আবু তাহেরের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনেন এবং ১৯৭৬
খ্রিষ্টাব্দের ২১শে জুলাই কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেন। অনেকে মনে করেন, ৭ই নভেম্বরে
অভ্যুত্থানের সময় সাধারণ মানুষ এবং সৈন্যদের ভিতর কর্নেল তাহেরের জনপ্রিয়তা দেখে
জিয়াউর
রহমান শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। এবং তাঁর ক্ষমতা নিষ্কণ্টক রাখার জন্যই তাহেরের
বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার অভিযোগ এনে ফাঁসি দেওয়া হয়।
এরপর
জিয়াউর
রহমান কৌশলে জাসদকে
দুর্বল করে ফেলেন।
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দলটির প্রচুর সমর্থক থাকা সত্বেও জাসদ কোনো মতো টিকে ছিল
মাত্র। বিভিন্ন বিতর্ককে কেন্দ্র করে জাসদ বিভাজিত হয়ে যায়। এর প্রথম বিভাজন ঘটে
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে। এই বছরের ৭ই নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই দলটি আত্নপ্রকাশ করে।
নব গঠিত দলের নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। আর মূল ধারাটি জাসদ
নামেই থেকে যায়।
গতানুগতিকভাবে এদের
লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়- শোষণমূলক পুঁজিবাদী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করে শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা
করা। তবে এই দলের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল সাম্যবাদ করা। বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির
কমরেড খালেকুজ্জামান হলেন ব সাধারণ সম্পাদক। এছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন কমরেড বজলুর রশিদ ফিরোজ,কমরেড জাহেদুল হক মিলু এবং কমরেড রাজেকুজ্জামান রতন। উল্লেখ্য, এই দলের
কার্যালয় হলো- ২৩/২তোপখানা সড়ক (৩য় তলা), ঢাকা, বাংলাদেশ ১০০০
দলটির মাসিক মুখপত্রের নাম "ভ্যানগার্ড"।
১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে কাজী আরেফ আহমেদ ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদ (ইনু) হিসেবে পরিচিতি পায়।
১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে জাসদ (রব), জাসদ (ইনু) এবং বাসদ (মাহাবুব) এর একাংশ মঈন উদ্দিন খান বাদলের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়।
এই দলের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আ.স.ম রব এবং হাসানুল হক।
২০০২ খ্রিষ্টাব্দ আ.স.ম রবের নেতৃত্বে কতিপয় নেতা জেএসডি নামে জাসদের কার্যক্রম পরিচালনা
শুরু করছে।
২০০৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে হাসানুল হক ইনু’র নেতৃত্বে জাসদ ১৪ দল গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে
আসছে।
২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ১১ ও ১২ মার্চ জাসদের জাতীয় সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়। ১২ই মার্চের কাউন্সিল অধিবেশনের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সেশন শেষে নির্বাচনী অধিবেশনের দায়িত্ব গ্রহণ
করেন, নেতা নির্বাচনের জন্য গঠিত নির্বাচন কমিশন (এ সময় মূলত দলীয় সাংগঠনিক পদ
বিলুপ্ত হয়)। হাসানুল হক ইনু সর্বসম্মতভাবে একক প্রার্থী হিসেবে কণ্ঠভোটে সভাপতি পুনঃনির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক পদে শিরীন আখতার এমপি ও নাজমুল হক প্রধান এমপি-র নাম প্রস্তাব আসে। এ সময় শ্লোগান দেয়াকে কেন্দ্র করে উভয় প্রার্থীর পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার নেতৃত্বে কিছু কাউন্সিলর কাউন্সিল অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন। উত্তেজনাকর পরিস্থিতি শান্ত হলে কাউন্সিলররা কাজী বশির মিলানায়াতনে (মহানগর নাট্যমঞ্চ) সাংগঠনিক নিয়মে সরাসরি সাধারণ সম্পাদক পদে গোপন ব্যালটে ভোট প্রদান করেন। শিরীন আখতার এমপি পান ৬০৩ ভোট এবং নাজমুল হক প্রধান পান ১২৩ ভোট পান । প্রাপ্ত ভোটে শিরীন আখতার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অন্যদিকে কাজী বশির মিলানায়াতন (মহানগর নাট্যমঞ্চ) ত্যাগকারীরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে সমাবেশ করে, শরীফ নুরুল আম্বিয়াকে সভাপতি, নাজমুল হক প্রধানকে সাধারণ সম্পাদক এবং নিজেকে কার্যকরী সভাপতি ঘোষণা করেন মঈন উদ্দিন খান বাদল এমপি। এর মাধ্যমে কার্যত জাসদের আরেক দফা বিভক্তি চুড়ান্ত হয়।
নির্বাচন কমিশনে শরীফ নুরুল আম্বিয়া এবং নাজমুল হক প্রধান নিজেদের-কে বৈধ কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দাবি করে প্রতীক মশাল দাবি করেন। নির্বাচন কমিশন উভয় পক্ষের জন্য আলাদা আলাদা শুনানি এবং দাবির স্ব-পক্ষে দালিলিক প্রমাণ প্রদান করার জন্য পত্র প্রদান করে। ২০১৬
খ্রিষ্টাব্দর ৬ এপ্রিল দু-পক্ষ আলাদা আলাদা শুনানিতে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৬
খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে এপ্রিল হাসানুল হক ইনু, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে মশাল সুরক্ষার আবেদন জানিয়ে চিঠি উল্লেখ করেন।
এবং দলের প্রতীক হিসেবে ‘মশাল’ লাভ করেন।
২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল, নির্বাচন কমিশন হাসানুল হক ইনু’র নেতৃত্বাধীন অংশকে নিয়ম আনুযায়ী কাউন্সিল করার জন্য বৈধ কমিটি এবং তাদের অনুকুলে দলে নিবন্ধ বহাল রাখা হয়। নিবন্ধিত ১৩ নং দল জাসদ এর সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার দলের নির্বাচনী প্রতীক ‘মশাল’ এর আইনগত কর্তৃত্ব লাভ করেন। নির্বাচন কমিশনের এ সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক কারণেই
শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন অংশ মেনে নেয়নি। তারা নির্বাচন কমিশনে রিভিউ
আবেদন করেন, আবেদন নিস্পত্তিত্বে সময়ক্ষেপণের অভিযোগ নিয়ে হাইকোর্টে রীট করেন। রীটটি গ্রহণ না করে নির্বাচন কমিশনকে ৩০দিনের মধ্যে আবেদন নিষ্পত্তি করতে বলেন। নির্বাচন কমিশন পুর্বের সিদ্ধান্ত বহাল রাখলে এর প্রতিকার চেয়ে শরীফ নুরুর আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধান হাইকোর্টে রীট করেন।
এরপর মহামান্য হাইকোর্ট এ প্রশ্নে রুল জারি করেন। কিন্তু জাসদের ‘১৩’ নং নিবন্ধন অথবা ‘মশাল’ প্রতীকের বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্ট কোন বিধি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। উল্লেখ্য প্রতীক বরাদ্দের ক্ষেত্রে ‘লাঙ্গল’ নিয়ে হাইকোর্টের একটি রায় আছে।
জাসদের বর্তমান বিভাজিত দলসমূহ