দেবপর্বত
প্রাচীন পূর্ববঙ্গের প্রাচীন জনপদ সমতট-এর রাজধানী। এটি ছিল বর্তমান কুমিল্লার নিকটবর্তী শৈলশিরায়।

বলভট্টের ময়নামতী তাম্রশাসন হতে প্রমাণিত হয় যে, খড়গ নরপতি বলভট্ট খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শেষার্ধে প্রথম দেবপর্বতে সমতটের রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে রাত বংশসহ বাংলার প্রাথমিক দেব ও চন্দ্র শাসকদের দলিলপত্রে এর আরও বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।

প্রাথমিকভাবে এই নগরী গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে। বৌদ্ধদের কাছে এটি তীর্থস্থানের মতো ছিল। এলাকাটি ছিল পারবত্য বন ও পরিখার মতো নদী পরিবেষ্টিত সুউচ্চ স্থলভূমি। এই অঞ্চলের সৌন্দর্য এবং প্লাবনমুক্ত সুউচ্চ ভূমি হিসেবে সেকালের মানুষ একে দেবতার পর্বত নামে অভিহিত করেছিল। কালক্রমে লোকমুখে এর নাম দাঁড়িয়েছিল 'দেবপর্বত'। এই দেবপপর্বতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাদের ধর্মাচরণ এবং বসবাসের জন্য আশ্রম গড়ে তুলেছিল। পরে এই অাশ্রম বৌদ্ধ বিহারে পরিণত হয়েছিল। দেবপর্বত অঞ্চলে ফলমুলের সমাহার ছিল। সেই সাথে এর উর্বরভূমির কারণে কৃষিসমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল।

৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে খড়্‌গ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা খড়্গদ্যোম। এই বংশের সর্বশেষ রাজা বলভট্ট আনুমানিক ৬৯০-৭০৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই রাজবংশের শাসন অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই সময় দেবপর্বত উচ্চতর নদী ও বন পরিবেষ্টিত এই অঞ্চলে বহিরাগত আক্রমণ সহজ ছিল না। তাই খড়্‌গ রাজা রাজা বলভট্ট তাঁর রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেছিল। তিনি প্রতিরক্ষার অঙ্গ হিসেবে এই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকে দুর্গনগরী হিসেবে নতুনভাবে সাজিয়েছিলেন। এই নগরীতে একটি সুশোভিত রাজপথ ও উদ্যান তৈরি করেছিলেন। এই শহরের ভিতরে কটকশিলায় তৈরি করা হয়েছিল রাজলক্ষ্মী স্পৃহনিয়া প্রাসাদ। এই প্রাসাদ থেকেই বলভট্ট তাম্রশাসন জারি করেছিলেন। এই বংশের পতনের ঘটেছিল রাত বংশীয় রাজাদের হাতে।

৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে চন্দ্রবংশীয় রাজা ত্রৈলোক্যচন্দ্র সমতট দখল করলে, দেবপর্বত চন্দ্রবংশীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ত্রৈলোক্যচন্দ্রের পরে চন্দ্রবংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্র ক্ষমতা লাভ করেন ৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর দৃঢ়তায় পশ্চিমাঞ্চল থেকে পাল রাজ্যের আক্রমণ প্রতিহত হয়। এই সূত্রে তিনি হরিকেল সমতট-এর প্রধান মহারাজ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু রাজ্য পরিচালনার সুবিধার জন্য তিনি তাঁর রাজ্যের রাজধানী দেবপর্বত থেকে বিক্রমপুরে নিয়ে যান্।


সূত্র :
আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প (১৯২০ ত্রিবান্দ্রম সংস্করণ), পৃ. ২৩২-৩৩।
বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদিপর্ব) (১৪১২), পৃ. ১১২।

ভারতের ইতিহাস
। অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।
http://www.banglapedia.org/