শিলাইদহ
রবীন্দ্রনাথ এবং লালন শাহের সূত্রে সুপরিচিত একটি গ্রাম। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত কুঠিবাড়ির জন্য এই স্থানটি বিখ্যাত।

নাটোরের রাণীভবানীর জমিদারের একটি অংশ হিসাবে বৃহত্তর পাবনার একটি অংশ ছিল পুরো কুষ্টিয়া অঞ্চল। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে পাবনাকে পৃথক জেলাতে পরিণত করা হয়। গোড়ার দিকে একজন জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও একজন ডেপুটি কালেক্টর দ্বারা এই জেলার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পুরো কুষ্টিয়া অঞ্চল পাবনার অংশ ছিল। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে কুষ্টিয়াকে মহকুমা করে নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে পাংশা থানাকে ফরিদপুরের গোয়ালন্দ মহকুমার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একই সময়ে কুমারখালী থানাকে কুষ্টিয়া মহকুমার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই বিন্যাসের দ্বারা পাবনা জেলার দক্ষিণাংশের সীমানা পদ্মা দ্বারা নির্দিষ্ট হয়।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমা পূর্ব-পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং কুষ্টিয়াকে জেলায় রূপান্তর করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুমারখালিকে উপজেলা করা হয়। ফলে এর বর্তমান পরিচয় কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপাজেলার একটি গ্রাম।

পদ্মা ও গড়াই নদীর মধ্যবর্তী যে অর্ধচন্দ্রাকার ভূখণ্ড তৈরি হয়েছিল, সরকারি দলিলপত্রে তা খোরশেদপুর, কশবা ও হামিরহাট মৌজা নামে পরিচিত ছিল। প্রচলিত আছে খোরশেদ শাহ নামে এক ফকিরের বাস ছিল এখানে। তাঁর নামানুসারে একটি গ্রামের নাম ছিল খোরশেদপুর। এখানে খোরশেদ ফকিরের মাজার আছে। ফকির সম্বন্ধে স্থানীয় লোকদের মধ্যে একটি গল্প প্রচলিত আছে। গল্পটি হলো
খোরশেদ ফকির একদিন একটি খেয়া নৌকায় চড়ে নদী পাড়ি দিতেছিলেন। মাঝি তার কাছে খেয়ার কড়ি দাব করলে,  ফকির বলেন যে,  সে আল্লাতায়ালার হুকুমে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। তার কাছে কোনো টাকাকড়ি নাই। খেয়ার মাঝি রেগে উঠে, পুনরায় টাকা দাবি করলে, ফকির পদ্মার উত্তাল তরঙ্গের ভিতর নামার উদ্যোগ নিলে, একটি চর জেগে উঠে। ফকির সেই চরে নেমে পড়েন। তখন থেকে এই চরই হলো ফকিরের আস্তানা। ফকিরের অলৌকিক ক্ষমতার কথা চারদিক জানাজানি হয়ে গেলে, বহু ধর্মভীরু মানুষ এই চরে ফকিরের মুএইদ হয়ে বসবাস শুরু করে। সেই থেকে সেই চড়ের নামকরণ হয় খোরশেদপুর।  রবীন্দ্রনাথ ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে ফকিরের মাজার পাকা করে তার ভক্তিঅর্ঘ্য নিবেদন করেছিলেন।

কোম্পানির শাসনামলের অনেক আগে থেকেই, পদ্মা ও গড়াই নদীর জলপ্রবাহের কারণে, এই অঞ্চলে একটি গভীর জলাশয় সৃষ্টি হয়েছিল। স্থানীয় ভাষায় এই জলাশয়কে বলা হতো দহ। ইংরেজ শাসনামলে এই অঞ্চলে নীলচাষ শুরু হলে শেলি (Shelly) নামক জনৈক নীলকুঠিয়াল এই দহের পাড়ে একটি কুঠিবাড়ি তৈরি করেন। গোড়াতে এই কুঠিয়ালের নামে এই দহটি 'শেলির দহ' নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ওই নামই কালক্রমে হয়ে ওঠে শেলাইদহ>শিলাইদহ। এখনো পদ্মার দুই পাড়ের মানুষেরা এই স্থানটিকে শেলাইদ বা শিলাইদ বলে থাকেন।

আগের শিলাইদহ অঞ্চলটি ছিল বিরাহিমপুর পরগনার অন্তর্গত। খাজনা সূত্র : নদীয়া কালেক্টরের ৩৪৩০ নং তৌজ। ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দে দ্বারকানাথ ঠাকুর তাঁর পালকপিতা রামলোচনের নিকট থেকে উইলের মাধ্যমে, বিরাহিমপুর পরগণার জমিদার-সহ বিপুল সম্পত্তি লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে জমিদারি তদারকির জন্য কোলকাতা থেকে যাঁরা আসতেন তাঁরা এই নীলকুঠিতে অবস্থান করতেন। উত্তরাধিকার সূত্রে এই কুঠিবাড়ির মালিকানা পান  দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের  ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ আসেন তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরর সাথে। মাত্র কয়েকদিন পর তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। এরপর ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি  মাসের দিকে এসেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর ডাকে। রবীন্দ্রনাথ  সেখানে অজস্র লিখেছিলেন, কিন্তু তা পৃথক মর্যাদায় রক্ষিত হয় নাই। সে সময়ে রবীন্দ্রনাথ এবংও তার পরিবারের অন্যরা নীলকর সাহেবের কুঠি বাড়িতে বসবাস করতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলেবেলা গ্রন্থে এই পুরানো কুঠিবাড়ি সম্পর্কে লিখেছেন

   'পুরোনো নীলকুঠি তখনো খাড়া ছিল। পদ্মা ছিল দূরে  নীচের তলায় কাছারি, উপরের তলায় আমাদের থাকবার জায়গা। সামনে খুব মস্ত একটা ছাদ। ছাদের বাইরে বড়ো বড়ো ঝাউগাছ, এরা একদিন-নীলকর সাহেবের ব্যবসার সঙ্গে বেড়ে উঠেছিল। আজ কুঠিয়াল সাহেবের দাবরাব একেবারে থম থম করছে। কোথায় নীলকুঠির যমের দূত সেই দেওয়ান, কোথায় লাঠি-কাঁধে কোমর-বাঁধা পেয়াদার দল, কোথায় লম্বা-টেবিল-পাতা খানার ঘর, যেখানে ঘোড়ায় চড়ে সদর থেকে সাহেবরা এসে রাতকে দিন করে দিত— ভোজের সঙ্গে চলত জুড়ি-নৃত্যের ঘূর্ণিপাক, রক্তে ফুটতে থাকত শ্যাম্পেনের নেশা, হতভাগা রায়তদের দোহাই-পাড়া কান্না উপরওয়ালাদের কানে পৌঁছত না, সদর জেলখানা পর্যন্ত তাদের শাসনের পথ লম্বা হয়ে চলত। সেদিনকার আর যা-কিছু সব মিথ্যে হয়ে গেছে, কেবল সত্য হয়ে আছে দুই সাহেবের দুটি গোর। লম্বা লম্বা ঝাউগাছগুলি দোলাদুলি করে বাতাসে, আর সেদিনকার রায়তদের নাতি-নাতনিরা কখনো কখনো দুপুররাত্রে দেখতে পায় সাহেবের ভূত বেড়াচ্ছে কুঠিবাড়ির পোড়ো বাগানে।"

পুরানো কুঠিবাড়ি

আনুমানিক ১২৯০ বঙ্গব্দে পদ্মার ভাঙন শুরু হলে পুরানো কুঠিবাড়ির উপকরণ দিয়ে পদ্মার তীর থেকে বেশ দূরে নতুন কুঠিবাড়ি তৈরি করা হয়। কিন্তু পরে দেখা গেল পদ্মার ভাঙন পুরানো কুঠি বাড়ির দরজা পর্যন্ত এসে থেমে গিয়েছিল। বহুদিন পর্যন্ত এই পুরানো কুঠিবাড়ির ধ্বংসাবশেষ ছিল। এখন আর তার অবশেষও নেই।

১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ সদলবলে শিলাইদহে আসেন। এসময় তাঁর সাথে ছিল স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, কন্যা বেলা, পুত্র রথীন্দ্রনাথ, মৃণালিনী দেবীর সহচরী ও বলেন্দ্রনাথ। এই সময় এঁরা একটি বোটে (সদলবলা থাকার উপযোগী বড় নৌকা) থাকতেন। এই বোটে এসে নিয়মিতভাবে স্থানীয় কিছু গায়ক এঁদেরকে গান শুনিয়ে যেতেন। এই জন্য গায়করা দুই আনা করে সম্মানী পেতেন। এই সময় বলেন্দ্রনাথ সুনা-উল্লা নামক জনৈক গায়কের কাছ থেকে কিছু গান লিখে রাখেন। তাঁর সংগৃহীত গানের সংখ্যা ছিল ১২টি। এই সংগৃহীত গানের একটি ছিল গগন ডাকহরকরার লেখা 'আমি কোথায় পাবো তারে'। পরবর্তী সময়ে এই গানের সুর অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ 'আমার সোনার বাংলা' রচনা করেছিলেন।

পরিবর্তিত কুঠিবাড়ি, ১৯১১। ছবি জাহিদ হোসেন

পাকিস্তান আমলে কুঠিবাড়ি পরিত্যাক্ত এবং অবহেলার সম্পত্তি হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার বিশেষ যত্ন নিয়ে এই কুঠিবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করছে। তবে এর ফলে কিছু রূপান্তর ঘটেছে। এই বাড়িটির বাইরের দিক রেড অক্সাইড জাতীয় রঙের প্রলেপ ছিল। চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে শতবর্ষী রং রেড অক্সাইডকে মুছে দিয়ে সাদা চুনকাম করা হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদকে এভাবে পরিবর্তন করাকে অনেকে আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু তারপরেও এই কুঠিবাড়ি তার আগের লালচে রঙ ফিরে পায় নি।


সূত্র :
রবিজীবনী। প্রথম-তৃতীয় খণ্ড। প্রশান্তকুমার পাল।