পদ্মা সেতু
বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মাণাধীন একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। রাজধানী ঢাকার সাথে দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক ও রেল যোগাযোগের জন্য এই সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে।

ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক: ২৩.৪৪৪৩° উত্তর ৯০.২৬১০° পূর্ব
ভৌগোলিক অবস্থান: মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার মাওয়া থেকে শরীয়তপুর জাজিরা উপজেলার পদ্মাপারের অংশের সাথে সংযুক্ত হয়েছ।

 এর মূল অংশটিতে রয়েছে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যর ৪১টি স্প্যান (খণ্ডাংশ)। এর মোট দৈর্ঘ্য ৬.১৫০ কিলোমিটার এবং ১৮.১০ মিটার প্রস্থ।।

পদ্মা সেতু নির্মাণের ইতিহাস
১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ই পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। সরকার এই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা-খুলনা মহাসড়কে পদ্মা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবের মূল বিষয় ছিল-

এরপর ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে উক্ত সেতু প্রকল্পের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই পরীক্ষা শুরু হয়। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জুলাই মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি সরকার গঠন করে। এই সময় পদ্মা সেতুর কার্যক্রম বন্ধ থাকে। সরকার এই সেতুর স্থান নির্বাচনের জন্য পুনরায় যাচাই শুরু করে। সরকারের পরামর্শক কমিটি ৪টি স্থানে এই পরীক্ষা করে। এই স্থামগুলো ছিল-

১. পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পয়েন্ট
২. দোহার-চরভদ্রাসন পয়েন্ট
৩. মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট
৪. চাঁদপুর-ভেদরগঞ্জ পয়েন্ট।

২০০৪  খ্রিষ্টাব্দে জাইকা নিয়োজিত পরামর্শক নিপ্পন কোয়েই পদ্মা সেতু নির্মাণকল্পে বিস্তারিত সমীক্ষা পরিচালনার পর, আগের নির্ধারিত মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টেই সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয়।

রাজনৈতিক টানপোড়নের ভিতরে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি সারাদেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। আর এ সময় থেকে গত ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় দুই বছর দেশ পরিচালনা করেন ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আমলে পদ্মা সেতুর বিষয়টি পুনরায় বিবেচনায় আনা হয় এবং ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ২০ অগাস্ট তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার একনেকের বৈঠকে ১০,১৬১ কোটি টাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। উল্লেখ্য এই সেতুর প্রাথমিক পরিকল্পনায় রেলপথ ছিল না।

২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা লাভের পর এই সেতুর পরিকল্পনা সংশোধন ক'রে রেলপথ সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে নকশা প্রণয়নের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয় ও ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়। সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক অর্থ যোগান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সাথে বাংলাদেশ ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করে।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বাসেক) ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে এই প্রকল্পের জন্য প্রাক যোগ্যতা দরপত্র আহবান করে। প্রথম পরিকল্পনা অনুসারে, ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে সেতুর নির্মাণ কাজ আরম্ভ হওয়ার কথা ছিল এবং শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে।


২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জানুয়ারি, প্রথম দফায় সেতুর নকশা পরিবর্তন করা হয়। তখন এর মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। পরে এই ব্যয় সংশোধন করা হয় এবং শেষ পরযন্ত মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। সেতুর সাথে তিনটি জেলার সংযোগ সড়ক পথকে বিশেষভাবে তৈরি করার সিদ্ধান্ত হ্য়। এই জেলা তিনটি হল- মুন্সীগঞ্জ (মাওয়া পয়েন্ট/উত্তর পাড়),শরীয়তপুর এবং মাদারীপুর (জাজিরা/দক্ষিণ পাড়)। এর জন্য ৯১৮ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়।

২০১১ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে বিশ্বব্যাংকের সাথে বাংলাদেশের ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি হয়। একই বছরের ১৮ মে জাইকার সঙ্গে সরকারের ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ঋণচুক্তি হয়।

২০১১ খ্রিষ্টাব্দে ১০ অক্টোবরে দুর্নীতির অভিযোগ এনে পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমানের নামও দুর্নীতির অভিযোগের সাথে যুক্ত হয়। ২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে বদলি করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয় ও ৫ ডিসেম্বর তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এই সময় প্রধান মন্ত্রীর পুত্র জয় ওয়াজেদ এবং বোন শেখ রেহানাকে নানা ভাবে হেনস্তা করা হয়। সেতুর কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য নোবলে পুরস্কার বিজয়ী ড. ইউনুস নানাভাবে বিশ্বব্যাংকে প্রভাবিত করে।

২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন সেতুর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দরপত্রে অংশ নেওয়া এসএনসি-লাভালিনের সঙ্গে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তিটি বাতিল করে। পরে অন্য দাতা সংস্থাগুলোও তার প্রতিশ্রুত ঋণচুক্তি বাতিল করে।

২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জুলাই জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার কথা বলেন। ৮ জুলাই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ পরিকল্পনা সংসদে পেশ করেন তিনি। ৯ জুলাই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিসভা।

বিশ্বব্যাংকের শর্তের কারণে ২৩ জুলাই তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। ২৪ জুলাই সচিব মোশারেফ হোসেন ভূইয়াকে ওএসডি করা হয়। সরকারের অনুরোধে ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক প্রকল্পে পুনরায় সম্পৃক্ত হতে রাজি হলেও তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অর্থায়ন করতে অসম্মতি জানায়। ১৭ ডিসেম্বর সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করে সাত জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ২৬ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয় দুদক। গ্রেপ্তার করা হয় আরও দু’জনকে।

২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ জানুয়ারি মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করে সরকার। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি জামিনে মুক্ত হন তিনি।

২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থ আর নেওয়া হবে না সরকার এমন সিদ্ধান্তের কথা জানায়। ২০১৩ সালের ২৬ জুন আবার দরপত্র আহ্বান করা হয়।

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুন পদ্মা বহুমুখী সেতুটি নির্মাণে চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করে সেতু বিভাগ। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর দুদক জানায় পদ্মা সেতুতে কোন দুর্নীতি হয়নি। ২৬ অক্টোবর পদ্মা সেতু দুর্নীতির মামলার অবসান হয়। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ নভেম্বর মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ৭ ডিসেম্বর থেকে প্রকল্পটির প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শুরু হয়।

২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর মূল সেতুর নির্মাণ ও নদী শাসন কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের জুন-জুলাই মাসের ভিতরে নদী শাসন, প্রয়োজনীয় খুঁটি স্থাপনের কাজের সিংহভাগ শেষ করা হয়। এরপর শুরু হয় পর্যায়ক্রমে খুঁটির উপর স্প্যান বসানোর কাজ। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে সেতুটি দৃশ্যমান হয়ে ওঠতে থাকে।

২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জুন সেতুটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। মাওয়া প্রান্তে তিনি সেতুর মুরাল উন্মোচন করেন। উদ্বোধন উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট উন্মোচন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। মাওয়া প্রান্তের সভা শেষে শেখ হাসিনা
প্রথম টোল প্রদান করে গাড়িতে চেপে সেতুর উপর ওঠেন। গাড়ি থেকে নেমে সেতুর উপর তিনি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান ও জঙ্গী হেলিকপ্টার অ্যারোবেটিক ডিসপ্লে ও ফ্লাইপাস প্রদর্শন করে। এই সময় তিনি এই বাহিনীর গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন। এরপর তিনি সেতির অপর প্রান্তের জাজারিতে পৌঁছান এবং দ্বিতীয়বার সেতুর মুরাল উন্মোচন করেন। পরে শিবচরের জনসভায় ভাষণ দেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে  সেতুটির উদ্বোধন উপলক্ষে পাকিস্তান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভূটান, চীন, রাশিয়া, ডেনমার্কসহ পৃথিবীর অনেক দেশের সরকার ও রাষ্ট্রদূর অভিনন্দন বার্তা পাঠায়। তাছাড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশ্বব্যাঙ্কের আবাসিক প্রতিনিধিও বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানান।

২৫ জুন থেকে এটি সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। উন্মুক্ত করে দেবার প্রথম দিনই গতিসীমা অমান্য করে মোটরবাইক চালাতে গিয়ে সেতুতে দুর্ঘটনায় দুজনের মৃত্যু ঘটে। ছাড়া সেতুতে উঠে সেতু থেকে বল্টু খুলে নেওয়া এবং মুত্রত্যাগের মতো ঘটনা ঘটে। এরপর সেতুর নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া সেনাসদস্যদের। নিষিদ্ধ করা হয় সেতুতে যানবাহন থামানো, পার্কিং‌, পায়ে হেঁটে পার হওয়া ও মোটরসাইকেল চলাচল।