শামসুদ্দীন মন্ত্রিসভায় দলগত সদস্য হিসেবে
কাজ করতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন এবং
তমিজউদ্দীন মুসলিম লীগে যোগদান করেন। মন্ত্রী পরিষদের নলিনীরঞ্জন সরকার ১৯৩৯ সালের
২০ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন। এই বছরে তিনি
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে মুসলিম লীগ শহর ও গ্রামাঞ্চলের সর্বত্রই তাদের জনপ্রিয়তা
বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল।
লাহোর প্রস্তাবের কার্যনির্বাহী কমিটির সাথে ফজলুল হক |
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে মার্চ সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে,
মুহম্মদ আলী
জিন্নাহ ফজলুল হককে দিয়ে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করিয়েছিলেন।
১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে
জিন্নাহ'র
নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ফজলুল হক ভাইসরয়ের প্রতিরক্ষা পরিষদে যোগদান করেন। এই কারণে
জিন্নাহ'র
তাঁকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করেন এবং কোয়ালিশন দল থেকে লীগকে প্রত্যাহার করেন।
এর ফলে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে নতুনভাবে রাজনৈতিক মৈত্রী
গঠনের এক অভূতপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছিল।
১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ২রা ডিসেম্বর ফজলুল হক পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি প্রজা পার্টির
প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিবর্গ, কংগ্রেসের বসু গ্রুপ সহ অধিকাংশ হিন্দু
সদস্য এবং হিন্দু মহাসভার রক্ষণশীল সংস্কারবাদীদের নিয়ে বিস্তৃত ভিত্তির একটি
প্রগতিশীল কোয়ালিশন গঠন করতে সক্ষম হন। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই ডিসেম্বর শ্যামা-হক
মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। নতুন এই কোয়ালিশন সরকারের স্থায়িত্বকালে সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতি বজায় ছিল। কিন্তু প্রাদেশিক গভর্নর স্যার জন হার্বাটের (১৯৩৯-১৯৪৩)
চক্রান্তে প্রগতিশীল কোয়ালিশনের কর্মসূচি বানচাল হয়ে যায়।
মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলিত হয়ে হক মুসলমানদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বার্থের
বিরুদ্ধে কাজ করছেন, এমন প্রচারণা চালিয়ে মুসলিম লীগ- শ্যামা-হক মন্ত্রিসভাকে
বরখাস্ত করার জন্য গভর্ণরের কাছে আবেদন করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রে জাপানি আক্রমণের ভয়, সামরিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে বাস্তবায়িত 'প্রত্যাখ্যান নীতি' বদ্বীপ এলাকায় বেশ কষ্টকর
পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। ২৬শে অক্টোবর এক বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস
উপকূলবর্তী এলাকায় আঘাত হানে। এই সময় কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ত্রাণ তৎপরতা
ব্যাহত হয়। ৩ আগষ্ট ঢাকা কারাগারে বেশ কয়েকজন কয়েদি গুলিবিদ্ধ হয়। এ সবই
শ্যামা-হক মন্ত্রী সভার বিপক্ষে চলে যায়।
৯ আগষ্ট কংগ্রেস ভারত ছাড় আন্দোলন শুরু করলে প্রশাসন আরেকটি প্রচণ্ড চাপের
সম্মুখীন হয়। এই সূত্রে ব্যাপক ব্রিটিশ নিপীড়ন শুরু হলে- ভারতের সকল প্রদেশে
প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এই অবস্থায় শ্যামা মুখোপাধ্যায় পদত্যাগ করেন।
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী আইনসভায় প্রকাশ করেন যে, অবাধ ক্ষমতার
আবরণে গভর্নর বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রিসভা প্রদত্ত পরামর্শ অগ্রাহ্য করেছেন এবং তিনি
সে সবের তালিকাও পেশ করেন। গভর্নর এসব অভিযোগ সহজভাবে গ্রহণ করেন নি এবং প্রধানত
তাঁর উদ্যোগেই ২৪ ও ২৭ মার্চ আইনসভায় অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করা হয়। দুবারই
সামান্য ব্যবধানে হলেও প্রস্তাবগুলি নাকচ হয়ে যায়। তাঁর আদেশ কার্যকর করতে ২৮
মার্চ গভর্নর হককে একটি তৈরি পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষরের নির্দেশ দেন এবং শাসনতন্ত্রের
৯৩ ধারা বলে তিনি নিজেই প্রদেশের প্রশাসনিক দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এক মাস পর
খাজা নাজিমুদ্দিনকে মুখ্যমন্ত্রী করে লীগের প্রাধান্য বিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভা
নিয়োগ করা হয়।
১৯৪৩ এর পরবর্তী সময় তিনি প্রবলভাবে দ্বিজাতিতত্ত্ব-এর বিরোধিতা করতে থাকেন।
মুসলিম লীগের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ করার জন্য তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের
মুখ্যমন্ত্রী ডা: খান সাহেব এবং সিন্ধুর মুখ্যমন্ত্রী আলাহ বখ্শ ভারতীয়দের কাছে
অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে যুক্তভাবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে
একটি তারবার্তা পাঠান। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য ফজলুল হক প্রথম উদ্যোগ
গ্রহণ করেন। ত্রুটিপূর্ণ লাহোর প্রস্তাবের প্রতি বাঙালি মুসলমানদের মনোযোগ আকর্ষণ
করে তিনি জোরালোভাবে এর বিরুদ্ধে তাঁর মতামত প্রকাশ করেন। এর ফলে ফজলুল হক ও মুসলিম
লীগের মধ্যে তিক্ততা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে।
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল থেকে ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট পর্যন্ত ফজলুল হক
অবিশ্রান্তভাবে মুসলিম লীগের বিরোধিতা করেন। এর ফলে তিনি বাংলার রাজনীতির মূলধারা
থেকে উত্তরোত্তর ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ১১৭টি আসনের মধ্যে
মুসলিম লীগ ১১০টি আসন লাভ করে এবং কৃষক প্রজা পার্টি মাত্র
চারটি আসন পায়। এ চার আসনের মধ্যে তিনি নিজে দুটি আসন থেকে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দুটি আসনেই জয়লাভ করেন। হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী বাংলার
মুখ্যমন্ত্রী হন। তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা তখনও শীর্ষে থাকলেও রাজনৈতিকভাবে
তিনি একাকী
হয়ে পড়েন।
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই আগস্ট কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। সে সময় হক
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার করতে এবং কলকাতার পার্ক সার্কাসে তাঁর হিন্দু
প্রতিবেশীদের রক্ষা করতে চেষ্টা করেন। লীগ-নেতৃবৃন্দের অনুরোধে তিনি ১৯৪৬
খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে পুনরায় মুসলিম লীগে যোগদান করেন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের দেশ-বিভক্তির ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি লক্ষ্য করে তিনি অত্যন্ত
মর্মাহত হন। কলকাতা থেকে ফিরে তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করেন। ১৯৪৭
খ্রিষ্টাব্দে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
|
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আন্দোলন শুরু করে। বিক্ষোভ প্রদর্শনকারী ছাত্রদের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করলে ফজলুল হক আহত হন। এই সময় তিনি মুসলিম লীগবিরোধী আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট নেতারূপে আবির্ভুত হন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গণ অভ্যুত্থানের সূচনা হয়। এই অবস্থায় ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে জুলাই তিনি 'শ্রমিক-কৃষক দল' প্রতিষ্ঠা করেন। এই বছরই দলটির নাম পরিবর্তন করে কৃষক শ্রমিক পার্টি রাখা হয়।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও সোহ্রাওয়ার্দীকে নিয়ে তিনি যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট লাভ করে ২২৩ আসন। এর মধ্যে আওয়ামী মুসলীম লীগ পায় ১৪৩টি আসন।।