হাইরোগ্লিফ
Hieroglyph
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার লিখন পদ্ধতি বিশেষ। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ অব্দ থেকে ৪০০
খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই লিখন পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। প্রাচীন
মিশরীয়রা প্রথম
দিকে পাথরের লিখত। এই পদ্ধতিতে লোগোগ্রাফিক এবং বর্ণমালাভিত্তিক চিহ্নের সংমিশ্রণে
লিখত।
![]() |
|
নার্মার ফলকের উভয়
পাশে উৎকীর্ণ হাইরোগ্লিফ। |
হাইরোগ্লিফ শব্দটি গ্রিক ἱερός (hierós উৎসর্গকৃত) এবং γλύφω (glýphō 'Ι carve, engrave' অমি খনন করি বা খোদিত করি) দুটি গ্রিক শব্দের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে। মিশরীয়রা ধারণা করতো যে এই লিখনপদ্ধতি ছিল ঐশ্বরিক। এই লিপি তাদের দান করেছিলেন প্রজ্ঞার দেবতা থোথ্। এই কারণে তৎকালীন মিশরের পুরোহিতরাই শুধু এই লিপি ব্যবহার করতেন। আদি হাইরোগ্লিফ লেখা হতো পাথরে ফলকে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৫০-৩১০০ অব্দের দিকে মিশরের উচ্চ ও নিম্নাঞ্চলে রাজা নারমার-এর শাসনামলে কিছু মাটির ফলক পাওয়া যায়। এই নমুনাগুলোকে সাধারণভাবে নার্মার ফলক বলা হয়। হারাকোনপোলিস অঞ্চলে এগুলো পাওয়া গিয়েছিল। এই কারণে অনেক সময় এগুলোকে Great Hierakonpolis Palette বলা হয়। এই পাত্রগুলোর গায়ে হাইরোগ্লিফ-এর কিছু নমুনা পাওয়া যায়। এই নমুনাকে সর্বপ্রাচীন হাইরোগ্লিফের নমুনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই নুমনায় লোগোগ্রাম পাওয়া গেছে। এই লোগোগ্রাফ দ্বারা একটি শব্দকে প্রকাশ করা হতো। আবার ধ্বনিভিত্তিক কিছু একক গ্লিফ ছিল। যেগুলো বর্ণের প্রতীক ছিল। আর ছিল প্রতীকভিত্তিক ভাবলিপি। এর দ্বারা ভাব প্রকাশ করা হতো। কালক্রমে এর কিছু কিছু ব্যঞ্জন এবং স্বরধ্বনি ব্যঞ্জনধ্বনিতে পরিণত হয়েছিল।
![]() |
|
আদি হাইরোগ্লিফ-এর কিছু নমুনা |
খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের দিকে মিশরীয়রা
প্যাপিরাস পত্র তৈরি করে। এরপর এরা প্যাপিরাসে হাইরোগ্লিফ লেখা শুরু করে। ২৪টি বর্ণ
তৈরি করতে সক্ষম হয়। এর সাথে কোনো স্বরধ্বনি যুক্ত থাকতো না। প্রতিটি ব্যঞ্জনধ্বনি
যেকোনো স্বরধ্বনিসহযোগে উচ্চারিত হতো। যেকোনো বর্ণ উচ্চারিত হতো চিত্রের প্রকৃতির
সাথে সম্পর্ক রেখে। এছাড়া ছিল প্রায় ৮০টি দ্বিব্যঞ্জনধ্বনি। এগুলোর সাথে
স্বরধ্বনিগুলো সহজাত ধ্বনির সাথে উচ্চারিত হতো এবং তা নানা ধর্নের ধ্বনিকে নির্দেশ
করতো। এই লিখন পদ্ধতিতে কোন বিরামচিহ্ন ছিল না।
খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৮৬–১৬৫০ অব্দের ভিতরে হাইরোগ্লিফিকের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এই সময়ের ভিতরে
পিরামিড টেক্সট, সমাধির দেয়ালে এই লিপির নমুনা পাওয়া যায়।
এখন পর্যন্ত এই লিখন পদ্ধতির প্রায় ২০০০ মিশ্র প্রতীক পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয়, এসব মিশ্র প্রতীক সাধারণ মানুষ ততটা বুঝতো না। এগুলোর অনেকগুলোই আবার পুরোহিতরা তাদের গুপ্তবিদ্যা লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য ব্যবহার করতো।
হাইরোগ্লিফ-এর পাশাপাশি মিশরে কার্সিভ
হাইরোগ্লিফে লেখার নমুনা।
কার্সিভ হাইরোগ্লিফ
(cursive
hieroglyphs)
: এই লিখন পদ্ধতি ব্যবহৃত
হতো ধর্মীয় নথি পত্র লেখার জন্য। এই হাইরোগ্লিফ লেখা হতো প্যাপিরাস-এ। কিন্তু
এর বাইরে
আদি হাইরোগ্লিফ কালক্রমে পরিবর্তিত হয়েছে কয়েকবার। এর ভিতর তিনটি পদ্ধতিকে
বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়। এই পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছিল মূলত প্যাপিরাস-এ লেখার
সুবিধার সূত্রে। আদি হাইরোগ্লিফ-এর সাথে নতুন কিছু চিহ্ন যুক্ত হয়ে প্যাপিরাসে
প্রথম লিখিত হয়েছিল লিপি। তাকে সাধারণভাবে বলা হয় কার্সিভ হাইরোগ্লিফ।
Book of the Dead -এর কপি তৈরি করা হয়েছিল প্যাপিরাস-এ। মিশরের রামেশীয় যুগে
(খ্রিষ্টপূর্ব-১৫৫০-১০৬৯ অব্দ) লিখিত Papyrus of Ani
-এ কার্সিভ হাইরোগ্লিফ ব্যবহৃত হয়েছিল ।
কফিনের গায়ে ধর্মীয় বাণীও এই পদ্ধতিতে লেখা হতো। লেখার বিষয়ানুসারে এই পদ্ধতির
লেখার দিকনির্দেশনা হতো‒
বাম থেকে ডান বা ডান থেকে বাম।

গ্রন্থ :
Papyrus of Ani।
এরপর প্রচলিত হয় এই লিপির নব্য সংস্করণ। এই পদ্ধতিকে বলা হয়ে থাকে হাইরেটিক হাইরোগ্লিফ। নব্য এই পদ্ধতির পাশাপাশি পুরানো লেখন পদ্ধতিও বহুদিন সচল ছিল। সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় না, যে ওই সময় থেকে পুরানো পদ্ধতি বাতিল হয়ে গিয়েছিল। নব্য
![]() |
|
খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে লিখিত হাইরেটিক লিখের নমুনা। |
হাইরেটিক
হাইরোগ্লিফ (hieratic
hieroglyphs) :
মিশরের ফারাও রাজাদের সময় এই লিখন পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে। এই লিপির 'হাইরেটিক' নাম
দিয়েছিল গ্রিকরা। এই নামটির অর্থ হলো 'পুরোহিত সম্পর্কিত'। মূলত এটি ছিল
কার্সিভ হাইরোগ্লিফ-এর সরল সংস্করণ।
খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০০ অব্দের এই লিপির উদ্ভব ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। ৬৬০
খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই লিপির চর্চা ছিল। এরপর ডেমোটিক লিপি দ্বারা এই পদ্ধতি
প্রতিস্থাপিত হয়। হাইরেটিক লিপি অনেকটা জটিল ছিল বলে, সাধারণ মানুষের কাছে তা
দুর্বোধ্যই রয়ে গিয়েছিল। ফলে উচ্চশিক্ষিতরা ছাড়া আর কেউ তা পাঠ করতে পারতো না।
এই লিপির সরলীকরণের সূত্রে ডেমোটিক লিপির উদ্ভব ঘটেছিল এবং তা জনপ্রিয় হয়ে
উঠেছিল।
![]() |
|
খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টীয় ৫ম শতাব্দীর ভিতরে রচিত ডেমোটিক হাইরোগ্লিফ-এর নমুনা। |
ডেমোটিক হাইরোগ্লিফ (demotic
hieroglyphs) :
গ্রিক
δημοτικός
(জনপ্রিয়) শব্দ থেকে এই লিপির নামকরণ করা
হয়। এই নামটি গ্রিকদের দেওয়া। এই লিপি উদ্ভাবনের দুটি সূত্র উল্লেখ করা হয়।
একটি মতে বলা হয়- নীল বদ্বীপ অঞ্চলে প্রচলিত হাইরেটিক লিপির উত্তরাঞ্চলীয় রূপ
থেকে এই লিপির উদ্ভব ঘটেছিল। অন্যমতে মিশরীয় ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারায়
হাইরেটিক লিপির পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সাধারণ মানুষের সহজ পাঠযোগ্য
লিখন পদ্ধতি প্রণয়নের সূত্রে ডেমোটিক লিপির উদ্ভব ঘটেছিল। এবং এই কালক্রমে
সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। পরবর্তী সময়ে এই লিপির ব্যাপক প্রভাব
ফেলেছিল কোপ্টিক লিপির ক্ষেত্রে। ডেমোটিক লিপির বেশ কিছু চিহ্ন কোপ্টিক লিপিতে
গ্রহণ করা হয়েছিল।
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫০ অব্দের দিকে এই লিপি উদ্ভাবিত হয়েছিল। ৬০০
খ্রিষ্টাব্দের দিকে এই লিপি সাধারণ মানুষের লিপি হয়ে উঠেছিল।
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২-৩৯৪ অব্দের ভিতরে ধীরে ধীরে
বিলুপ্তির দিকে চলে যায়। শেষ হাইরোগ্লিফিক শিলালিপি ছিল- ফিলাই দ্বীপের মন্দিরে ৩৯৪
খ্রিষ্টাব্দে লেখা একটি গ্রাফিতি (এসমেত-এর পুত্র হারপক্রেটেসের নাম)।
সূত্র :
https://en.wikipedia.org/wiki/Narmer_Palette
https://en.wikipedia.org/wiki/Egyptian_hieroglyphs
http://www.aldokkan.com/art/hieroglyphics.htm