ঘরানা
হিন্দি ঘরানা>বাংলা ঘরানা
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ব্যবহৃত একটি
পারভাষিক শব্দ। হিন্দি ঘরানা শব্দটি ঘর-ওয়ানা থেকে উৎপন্ন
হয়েছে। এক সময় এর ব্যবহারিক অর্থ ছিল, সম্ভ্রান্তবংশীয়, কুলীন, অভিজাত ইত্যাদি। এর অন্য অর্থ দীর্ঘকাল
ধরে প্রতিষ্ঠিত বা বনেদি। ভারতীয় সঙ্গীত শাস্ত্রে সঙ্গীতের বনেদি শৈলী হিসেবেই এই
শব্দটি গৃহীত হয়েছে।
প্রথম দিকে ভারতীসঙ্গীত শাস্ত্রে 'দীর্ঘকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত বা
বনেদি' অর্থেই ঘরানা শব্দটির ব্যবহার ছিল। কালক্রমে এই শব্দটি 'প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত উপস্থাপন রীতি' অর্থে বুঝানো
হয়। ঘরনারা ঘর বলতে সঙ্গীত পরিবারকে বুঝানো হয়। প্রতিটি ঘরানার আদি গুরু হলেন
ঘরানার পিতা। তাঁর যোগ্য শিষ্যরা হলেন সেই পরিবারের প্রথম প্রজন্ম। তাই প্রতিটি
গুরুর আদি পরিবার তৈরি হয়েছে 'তিনি এবং তাঁর যোগ্য শিষ্যদের নিয়ে'। আদিগুরুর
মৃত্যুর পর, তাঁর শিষ্যদের মধ্য আদি গুরুর সঙ্গীতশৈলী সঞ্চালিত এবং প্রতিষ্ঠিত
হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আদি গুরুর পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের জন্ম হয়েছে। মূলত ভারতীয়
সঙ্গীতের গুরুমুখী ঐতিহ্যের সূত্রে এই ধারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে।
কালক্রমে বহু-শিষ্যদের দ্বারা আদিগুরুর সঙ্গীত শৈলীকে অন্যান্য ধারার সঙ্গীতগুরুরা
শ্রদ্ধার সাথে বিশেষ মর্যাদ দিয়েছেন। এরই ভিতর দিয়ে এক একটি ঘরানার সৃষ্টি হয়েছে।
সঙ্গীত মূলত গুরুমুখী বিদ্যা।
গুরুর কাছে শিক্ষাকালীন গুরু দ্বারা শিক্ষা যথাযথভাবে অনুকরণ করে গাওয়াকে নায়কী বলা
হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর ভিতরে নিজস্ব
বৈশিষ্ট্য প্রায় অনুপস্থিত থাকে।
শিক্ষার্থী ধীরে ধীরে পরিপক্ব হয়ে ওঠে, তখন তার ভিতরে পরিবেশনের
স্বকীয় বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে। এই বিশেষ নিজস্ব গায়ন-শৈলী হলো নিজস্ব গায়কী।
গুণী শিল্পীদের কেউ কেউ সঙ্গীত পরিবেশনে শুধু গায়কীর ভিতরে আবদ্ধ থাকেন না। তাঁর এর
সাথে নানা ধরনে অলঙ্কারে প্রয়োগ করে থাকেন। সেখানেও থাকে তাঁর নিজস্ব পরিবেশন শৈলী।
এই সূত্রে এই সব বিশেষ সঙ্গীতগুণীরা একটি বিশেষ ধারার সৃষ্টি করেন। যখন এই ধারাটি
বহুজনের মান্য হয়ে ওঠে তখন একটি গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়, যাঁরা প্রত্যেকেই বিশেষ ধারাকে
মান্য করেন। ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রের নবতর রূপের বিকাশ শুরু হয়েছিল
আমির খসরুর (১২৫৩-
১৩২৫) সূত্রে। ভারতীয় সঙ্গীতের ধারার সাথে আরব্য, পারশ্য
সঙ্গীতের সংমিশ্রণে খেয়াল গানর সূচনা করেছিলেন। বহু পথ অতিক্রম করে
সদারঙ্গ
(১৬৭০-১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দ)
হাতে তা হয়ে ওঠেছিল পরিশীলিত।
প্রাচীন ভারতের সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তনের ধারায় সৃষ্টি হয়েছিল
প্রবন্ধগান।
এই ধারাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছিল ধ্রুপদ। রাজা মানসিংহ তোমর-এর পরে
মিঞা তানসেন (১৫০৫-১৫৮৫)
ধ্রুপদ সঙ্গীতকে উৎকর্ষের সর্বোচ্চ
পর্যায়ে নিয়ে যান। বর্তমানে উত্তরভারতে যে ধ্রুপদ প্রচলিত তার অধিকাংশই মিঞা তানসেন
এবং তৎপরবর্তী গুণীমণ্ডলী কর্তৃক রচিত ও গীত হয়ে থাকে।
মূলত সম্রাট আকবরের আমলে ধ্রুপদ উত্তর ভারতে অত্যন্ত
জনপ্রিয় সঙ্গীতে পরিণত হয়। পরবর্তী সময়ে তানসেনের পুত্রবংশীয়, কন্যাবংশীয় এবং
শিষ্যদের দ্বারা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
ধ্রুপদ ও খেয়ালের দুটি ভিন্ন ধারাই বিকশিত হয়েছিল তৎকালীন রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায়।
এই গানের গুরুদের কাছে তালিম শেষ করে শিষ্যরা নিজের অঞ্চলে ফিরে যেতেন। এঁরা
নিজেদের মতো সঙ্গীতচর্চা এবং শিক্ষা প্রদান করতেন। ফলে গুরু ও অঞ্চল ভেদে বিশিষ্ট
সঙ্গীতের ধারার উদ্ভব হয়েছিল। এরই মধ্য দিয়ে সূচনা হয়েছিল নতুন নতুন সঙ্গীত ঘরানা।
প্রতিটি ঘরানার নামকরণের পিছনে আদি গুরুর বিশেষ সম্পর্ক
রয়েছে। ভারতীয় সঙ্গীতের গুরুমুখী ঐতিহ্যের সূত্রে কোনো বিশেষ ব্যক্তি সঙ্গীতচর্চা
শুরু করেছিলেন দূরদেশে। এখানে এই ব্যক্তির স্থানীয় সঙ্গীতগুরু তাঁকে বিশেষভাবে
প্রভাবিত করতে পারেন নি এটা ভাবতেই হবে, কারণ নিজদেশের শিক্ষা মনোমত না হলেই কষ্ট
করে অন্যদেশে যায়। সুতরাং এই ব্যক্তি অন্যদেশের গুরুর কাছে গিয়ে, যদি সেখানেই আজীবন
কাটিয়ে দিতেন, তাহলে তাঁর সঙ্গীতশৈলী গুরুর দ্বারা আচ্ছন্ন থাকতো এবং এই গুরু তাঁর
শিষ্যকে ভিন্নভাবে সঙ্গীত পরিবেশনের হয়তো অনুমতিই দিতেন না। যখন কোনো ব্যক্তি
বিশেষভাবে সঙ্গীতে দক্ষতা অর্জন করে, নিজদেশে বা কোনো অনুকুল নতুন কোনো জায়গায় এসে
সঙ্গীত চর্চা করেছেন, তখন তিনি তাঁর নিজস্ব নান্দনিক বোধ থেকে সঙ্গীত শৈলীতে
পরিবর্তন করেছেন। কালক্রমে তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্যদের দ্বারা একটি স্থানিক ঘরানার
সৃষ্টি হয়েছে। এবং ওই ঘরানার নামকরণও হয়েছে ওই স্থানের নামানুসারে। যেমন- আগ্রা
ঘরানা, বেনারস ঘরানা, বিষ্ণুপুর ঘরানা ইত্যাদি।
ঘরানার শ্রেণিকরণ
সুর ও তালের বিচারে সঙ্গীতের ঘরানাকে প্রাথমিকভাবে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। এই ভাগ দুটি হলো—
তথ্যসূত্র:
ভারতীয় সঙ্গীতকোষ। শ্রীবিমলাকান্ত রায়চৌধুরী। কথাশিল্প প্রকাশ। বৈশাখ ১৩৭২।