লেটো
ভারতের রাঢ় অঞ্চলের পালাধর্মী লোকগান। গীত, বাদ্য, নৃত্য এবং অভিনয়ের সমন্বয়ে এই পালা অভিনীত হয়ে থাকে। এই গানের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করা হতো রাঢ় বাংলার লোকগাঁথা, হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি, ইসলামি কাহিনি, ঐতিহাসিক কাহিনি, সামাজিক রঙ্গরস ও আটপৌরে গ্রামীণ জীবন ইত্যাদিকে থেকে। সাধারণত শীতের ফসল ওঠার পর, অগ্রহায়ণ থেকে কার্তিক মাসের ভিতরে লেটোর আসর বসতো। 

লেটোগানের উদ্ভব
চর্যাগীতির পরে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে একটি বড় ধরনে ধাক্কা লাগে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি’র বঙ্গদেশের অভিযানের মাধ্যমে। ১২০৪-০৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকের এই বখতিয়ার খিলজির গৌড় দখলের পর, শুরু হয় বাংলার আর্থ-সামজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা। ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দ ইলিয়াস শাহ বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে রাজত্ব শুরু করেন। এর মধ্য দিয়ে বঙ্গদেশের আর্থ-সামজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রশমিত হতে থাকে। ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি বাংলাদেশের সিলেট থেকে উত্তরে বারাণসী এবং উত্তর-পূর্ব বঙ্গ সকল অঞ্চল জুড়ে তিনি তাঁর অধিকারে আনেন। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে এই সময় বাঙালি কবি চণ্ডিদাস জীবিত ছিলেন। এই সময় বাংলা সাহিত্যের চর্চা পুনরায় শুরু হয়। এই বিচারে ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে মোটা দাগে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের সূচনাকাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৩৫০ থেকে ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বিদ্যাপতির পদাবলি এবং বড়ুচণ্ডুদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সূত্রে নাগরিক গান হিসেবে কীর্তনের বিকাশ শুরু হয়েছিল। এছাড়া আদি বাংলা ঝুমুর,বাউল গানের সূচনাও এই সময়ের মধ্যে হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পরে বাংলা সাহিত্যের, বিশেষ করে কাব্যসৃষ্টিতে বাংলার কবিরা সক্রিয় উঠেছিলেন। এই ধারায় অনুবাদ কাব্য এবং মঙ্গলকাব্য বাংলা কাব্যজগতকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।  শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পরে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগের শেষে, কৃত্তিবাস ওঝা (১৩৯৯-১৪৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলা সাহিত্যের নবতর ধারার সূচনা করেছিলেন, বাংলায়  রামায়ণ অনুবাদের মধ্য দিয়ে। ১৪১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৪৪২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা অস্থির হয়ে উঠছিল , রাজা গণেশ, মুসলমান দরবেশদের বিদ্রোহ, জালালউদ্দীন, মহেন্দ্রদেব, সামসুদ্দিন আহমেদে সিংহাসনের দ্বন্দ্বে। অনেকেই মনে করেন ১৪১৮-১৪৩১ খ্রিষ্টাব্দের ভিতর কবি কৃত্তিবাস অনুবাদ করেছিলেন রামায়ণ। বর্তমানে এই গ্রন্থটি 'কৃত্তিবাসী রামায়ণ' নামে পরিচিত। তবে রচনাকাল নিয়ে কিছুটা মতভেদ আছে।

১৪৫০ থেকে ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে রাঢ় বাংলায় ঝুমুর, পূর্ববঙ্গে ভাটিয়ালি, উত্তরবঙ্গে ভাওইয়া গানের বিকাশ ঘটেছিল। এই সমায়ে আদি বাউল গান বাউলগুরুদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল ব্যাপকভাবে। পূর্ববঙ্গের ভাটিয়ালি এবং পশ্চিমের কীর্তনের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল নব্যধারার বাউল সুর। এছাড়া ছিল নানাধরনের মঙ্গলাকাব্য এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের সৃষ্ট জারি গান।

সপ্তদশ শতাব্দীতে বঙ্গদেশে নতুন ধারার বিপত্তি নেমে এসেছিল 'বর্গীর হাঙ্গামা'র সূত্রে। যদিও নবাব আলীবর্দী খান (১৬৭১-১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দ), মারাঠী বর্গীদের অনেকাংশে দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে আদি কলকাতা এবং তৎসংলগ্ন  অঞ্চল কলকাতা নিরাপদ হয়ে উঠেছিল। কিম্তু এর ভিতরেই বাংলার বহুজন সর্বশান্ত হয়ে পড়েছিল। এই অস্থিরতার মধ্যে বাংলার সাহিত্য-সঙ্গীত অঙ্গনেও বিপর্যয় নেমে এসেছিল। বর্গীর হাঙ্গামার পর বাংলার জনজীবনে দ্বিতীয় আঘাত এসেছিল ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিরাজদৌল্লাহ-র পতন। পলাশী যুদ্ধের পর ইংরেজরা বঙ্গদেশের উপর ধীরে ধীরে তাদের রাজত্ব সুদৃঢ় করা শুরু করেছিল। মূলত ইংরেজদের নতুন প্রশাসন কার্যক্রম সুদৃঢ় হয়ে ওঠেছিল ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে।

১৭০০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বাংলা গানে যুক্ত হয়েছিল নানা ধরনের নাগারিক ও আধা-নাগরিক গান। এই শতাব্দীর শুরুর দিকে কবিগানের সূচনা হয়। এই গানকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন গোঁজলা গুই (১৭০৪-? খ্রিষ্টাব্দ)। তাঁকে বলা হয় কবিগানের আদি কবিয়াল। গোঁজলা গুই-এর শিষ্য রঘুনাথ দাস (১৭২৫- ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দ) এই কবিগানের ধারাকে সচল রেখেছিলেন মাত্র। তবে রঘুনাথ দাস কবিগানকে শাস্ত্রীয় গানের আদর্শে সাজানোর চেষ্টা করেছিলেন। কবি গানের এই বিশেষ বিন্যাসকে বলা হয়ে থাকে দাঁড়া কবি গান। এই বিন্যাসের অধ্যায়গুলোর নাম ছিল চিতেন, পরচিতেন, ফুকা, মেল্‌তা, মহড়া, শওয়ারী, খাদ ও অন্তরা। এই ধারার গানকে জনপ্রিয় করে তোলেন রঘুনাথ দাস-এর দুই শিষ্য রাসু রায় ও নৃসিংহ রায় (১৭৩০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ) কবিয়াল হিসেবে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। এই ধারায় আরও একজন বিখ্যাত কবিয়াল ছিলেন লালু নন্দলাল। তবে কবিগানকে মর্যাদার আসনে তুলে ধরেছিলেন রঘুনাথ দাস-এর অপর শিষ্য হরুঠাকুর (১৭৪৯-১৮২৪খ্রিষ্টাব্দ)। এই ধারার পরবর্তী উল্লেখযোগ্য কবিয়াল ছিলেন নিত্যানন্দ বৈরাগী (১৭৫১-১৮২১ খ্রিষ্টাব্দ) ও তাঁর অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভবানী বণিক ।

১৭৫০ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে যখন আখড়াই গান অশ্লীল হিসেবে সুধীজনদের কাছে অপাংক্তেয় হয়ে উঠেছিল, সে সময় নিধুবাবু আখড়াই গানের অশালীন তকমা সরিয়ে ফেলে, নতুন ধরনের আখড়াই গানের সূচনা করলেন। ১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দে দিকে তিনি এই নবতর আখড়াই গানের ধারা কলকাতায় প্রচলন করেন। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে বড়বাজারের রামসেবক মল্লিকের বাড়িতে সর্বসাধারণের সামনে প্রথম হাফ-আখড়াই গানের আসর বসেছিল। নিধুবাবু প্রথম দিকে হাফ আখড়াই গানের প্রতি বিরক্ত হয়েছিলেন, তবু শিষ্যের এই প্রচেষ্টাকে আশীর্বাদ জানিয়েছিলেন। এই গানে তিনি কবিগানের মতো উত্তর-প্রত্যুত্তর ও সখীসংবাদ যুক্ত করেছিলেন। টপ্পা অঙ্গের আখড়াই গানে ছিল রাগের নানারূপ আলঙ্করিক প্রয়োগ। হাফ আখড়াই গানের শিল্পীরা সেখান থেকে সরে এসে সরল সুরের গান বাঁধতেন। এই গানে অন্তরা থাকত না।  হাফ-আখড়াই গানের পদ রচিত হতো চিতেন, পরচিতেন, ফুকা, ডবল ফুকা, মেলতা, মহড়া, খাদ, দ্বিতীয় ফুকা, দ্বিতীয় ডবল ফুকা, দ্বিতীয় মেলতা ইত্যাদি এই ধারাক্রমে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে হাফ আখড়াই গান জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে এবং এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যায়।

নিধুবাবু (১৭৪১-১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দ) এবং তাঁর শিষ্যদের দ্বারা টপ্পা যখন কলকাতার নগরকেন্দ্রিক সঙ্গীতজগত নিমগ্ন, সে সময়ে বাংলাগানের ভিন্ন রসের সঞ্চার করলেন শ্রীধর কথকের কথক গান। সুরে সুরে গল্প বলার রীতি প্রচলিত হয়েছিল মধ্যযুগের পাঁচালির সূত্রে। কথক তারই একটি প্রকরণ মাত্র। এই ধারাটি শ্রীধর কথকের (১৮১৬-? খ্রিষ্টাব্দ) আগে থেকেই অল্পবিস্তর ছিল। শ্রীধরের পিতামহ লালচাঁদ বিদ্যাভূষণও কথক ছিলেন। কিন্তু শ্রীধর কথক এই গানকে উচ্চতর সঙ্গীতশৈলীতে পরিণত করেছিলেন। উল্লেখ্য, কথক গানের মতই তিনি টপ্পাতেও সমান কৃতিত্ব দেখান।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে আখড়াই, হাফ আখড়াই, কবিগান সংমিশ্রণে জন্ম নিয়েছিল নব্যধারার পাঁচালি। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্থে দাশরথি রায় (১৮০৬-১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ) পাঁচালির এই মিশ্ররূপ দান করেন। নাগরিক সাহিত্যের পাশাপাশি বঙ্গদেশে লোকসাহিত্য ও সঙ্গীতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। বঙ্গদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতই রাঢ় অঞ্চলেও এর প্রভাব পড়েছিল।

প্রাক্-ইসলামী যুগে রাঢ় অঞ্চলের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভিতরে প্রচলিত ছিল- কীর্তন, বাউল গান, বোলান গান, কেষ্টযাত্রা, হাপু গান, পাঁচালী, ঝাপান গান, মঙ্গলগীতি (চণ্ডী মঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসা মঙ্গল ইত্যাদি), নানা ধরনের রসগীত, বিয়ের গান, নবান্নের গান, ঝুমুর গান, পটুয়া গান ইত্যদি। সেকালের রাঢ় অঞ্চলের শ্রমজীবী প্রান্তিক গোষ্ঠীর কাছে এই সব গান এবং লোকনৃত্য ছিল চিত্তবিনোদনের অন্যতম উপকরণ। রাঢ় বাংলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ ইসলাম ধর্ম করলে, ধর্মভিত্তিক দুটি গোষ্ঠীতে বিভাজিত হয়ে যায়। নব্য মুসলমানরা ধর্মাচারণের সাথে সাংঘর্ষিক বিবেচনায়  সনাতন ধর্মভিত্তিক গানগুলো বর্জন করেছিল। কিন্তু এই অবস্থা বেশিদিন টিকে ছিল না। অচিরেই, নব্য মুসলমানরা চিত্তবিনোদনের জন্য নতুনভাবে রচিত ইসলামী গান সৃষ্টি করলো। এ ক্ষেত্রে মুসলমান শিল্পীরা (যারা সনাতন ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছিল), সনাতন ধর্মীদের গানের আদলে নতুন গানের ধারার উদ্ভব ঘটিয়েছিল। এই সূত্রে মনসা মঙ্গলের আদলে তৈরি করেছিল 'সত্যপীরে গান' এবং পাঁচালীর অনুকরণে তৈরি করেছিল সত্যপীরের পাঁচালী, হোসেনের পাঁচালী। কৃষ্ণযাত্রা বা কেষ্টযাত্রা থেকে তৈরি হয়েছিল- ইমামযাত্রা । সনাতন ধর্মীদের পটুয়া গানের চিত্রাংশে থাকতো- পৌরাণিক কাহিনী। মুসলমান পটুয়ারা তাঁদের গানে ব্যবহার করতো সতীপীরের, গাজীপীরের চিত্রকর্ম।

কোনো কোনো গবেষকের মতে-লেটোগানের উদ্ভব হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে। এই গানের উদ্ভাবক ছিলেন- মুর্শিদাবাদ জেলার একঘরিয়া গ্রামের মুন্সি আহমদ হোসেন।  কিন্তু তাঁর গানের কোন নমুনা পাওয়া যায় নি লেটোগানের উদ্ভবের সময়টা মেনে নিলেও- উল্লেখযোগ্য প্রমাণাদি ছাড়া উদ্ভাবকের নাম নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। বাংলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে অন্যান্য সকল উপকরণের মতই বাংলা লোকসঙ্গীতও গড়ে উঠেছে কালানুক্রমিক ক্রমবিকাশের ধারায়। তাই লেটোগানের উদ্ভবের ক্ষেত্রে আমাদেরকে অষ্টাদশ শতাব্দের পূর্বের বাংলা গানের ধারাকে অনুসরণ করতে হবে। বিশেষ করে চর্যাপদ-উত্তর বাংলা গানের অন্ধকার যুগ এবং বাংলা গানে মুসলমানদের অবদান নিয়ে ভাবতেই হবে।

কাজী নজরুল ইসলামের লেটো গান-বিষয়ক গবেষণার সূত্রে যে কয়েকজন লেটোগান রচয়িতা বা গোদাকবির নাম পাওয়া যায়, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আকাই মিঞা, অখু শেখ, আব্দুল খাঁ, আমীর খাঁ, আরশেদ আলি, ইজ্জত আলি, ঋষি বাউরী, এলাহী বকশ, কাজী আবু তাহের, কাজী আব্দুর রহমান, কাজী বজলে করীম, কাজী ফজলে আহমদ, খলিল আহমদ মণ্ডল, গোলাম রহমান, গোলাম রহমান মাজী, জমিরুদ্দিন শেখ, জুম্মন খাঁ, ধরু হাজরা, নবাব মণ্ডল, নাসের সাহেব, পেসকার আলী. ফকির আহমদ মণ্ডল, ফকির শেখ, বাবুল্লাহ, বারু বাউরী, মজিদ খাঁ. মলিন্দ বাউরী, মহাম্মদ আমিন, মোসলেম খাঁ, রুস্তম শেখ,  রহিমুদ্দিন সাখা, শেখ খোদানে ওয়াজ, শুকু শেখ, সাম শেখ, হবিব মণ্ডল. প্রমুখ।

এঁদের ভিতরে লেটোগানে সমকালীন গোদাকবিদের ভিতরে নিজ প্রতিভার গুণে দীর্ঘদিন খ্যাতির শীর্ষস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বজলে করীম ছিলেন এই অঞ্চলের স্বনামধন্য এবং  অপরাজেয় গোদাকবি। এখন পর্যন্ত তাঁর যে কয়েকটি লেটো লেটোপালা বা চাপান সং-এর সন্ধান পাওয়া গেছে, তার সূত্র তাঁর অসামান্য কবি-প্রতিভা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। তাঁর রচনায় পাওয়া যায়-সমকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপট ও আর্থ-সামাজিক দ্বন্দ্বের কথা,কাব্য রচনার অসাধারণ ক্ষমতা, অতুলনীয় রসবোধ এবং প্রতিপক্ষ গোদাকবিকে ঘায়েল করার জন্য তীব্র বিদ্রূপ এবং বাক্যাঘাত। তিনি তাঁর দল নিয়ে নানা স্থানে চাপান-উতোর সং পালায় যোগদান করেছেন। তিনি  বিশেষভাবে জানত ইসলাম ধর্মের শরিয়তি, মারফতি ও সুফি দর্শন, বাউল দর্শন, হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি, বৈষ্ণব ও শাক্ত দর্শন। এছাড়া ছিল বিষয়ভিত্তিক অতুলনীয় বিশ্লেষণী ক্ষমতা।

লেটোপালা কবিদের লড়াই-য়ের ক্ষেত্রকে উজ্জীবিত করেছিল। এই সময় আসরে দু্জন কবিয়াল আসরে নামতেন নিজ নিজ দলবল নিয়ে। এঁরা একটি  কাহিনি সংক্ষেপে গানে গানে উপস্থাপন করতেন। এরপর তিনি প্রতিপক্ষের কবিয়ালের প্রতি একটি প্রশ্ন রেখে আসর থেকে অবসর নিতেন। এরপর আসরে অবতীর্ণ হতেন প্রতিপক্ষ কবিয়াল। তিনি প্রথম কবিয়ালের রেখে যাওয়া প্রশ্নের উত্তর দিতেন এবং আসর ত্যাগ করার সময় প্রতিপক্ষের প্রতি একটি প্রশ্ন রেখে যেতেন।

লেটোর লড়াইয়ে পালার এই অংশকে বলা হতো- চাপান সং। প্রতিপক্ষ দলের প্রশ্নের উত্তর প্রদানকারী অংশের নাম ছিল উতোর। চাপান ও উতোর পরিবেশনার মধ্য দিয়ে লেটোর লড়াই চলতো। লেটোগানের লড়াইয়ে জয়লাভ করে কোনো কোনো গোদাকবি বিপুলভাবে সমাদৃত হতেন। লড়াইয়ে জেতা কবিয়ালের খ্যাতির সূত্রের অন্যান্য গ্রামগুলো থেকে আমন্ত্রণ পেতেন। এই সূত্রে অনেক সময় গোদাকবি ধনবান এবং অভিজাত শ্রেণির আমন্ত্রণ পেতেন। এসব আমন্ত্রণের সূত্রে পাওয়া সম্মানীই ছিল, দলের আয়ের ঊৎস। এছাড়া বিজয়ী দলের গোদাকবিকে সম্মানিত করা হতো- পদক ও নগদ অর্থ দিয়ে।

সাধারণত, স্বনামধন্য কোনো লেটো দলের সাথে যুক্ত থেকে কোনো প্রতিভাবান কবি, গান পরিবেশন এবং গান রচনা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যখন সুনাম অর্জন করতেন, তখন নিজের মতো করে পালা পরিবেশনের আকাঙ্ক্ষায়  নিজের নামে দল তৈরি করতেন। অনেক সময় দলের গোদাকবি বার্ধ্যক্যজনিত কারণে বা মৃত্যুতে দলের গোদাকবির স্থান দখল করতেন নিতেন দলের দ্বিতীয় কবি। অন্য দলের খ্যাতি বা নিজ দলের প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে অনেকে দলে যোগদান করতেন 'আসামী‌' হয়ে।

লেটো দলের বিন্যাস

পালাধর্মী গান হিসেবে লেটো দল তৈরি হতো একাধিক কণ্ঠশিল্পী ও বাজনদার নিয়ে। এই দলটি পরিচালনা করতেন একজন প্রধান কবিয়াল। যিনি গোদা কবি নামে পরিচিত ছিলেন। দলে অংশগ্রহণকারীরা বিষয় অনুসারে নানা নামে অভিহিত হয়ে থাকে। যেমন- সাধারণত লেটোর আসর বসতো স্থানীয় কোনো ফাঁকা জায়গায়। লড়াইয়ে জেতা কবিয়াল খ্যাতির সূত্রের দূরের দূরের গ্রামগুলোতে আমন্ত্রণ পেতেন। আর এসবই আমন্ত্রণের সূত্রে এঁদের জীবিকা নির্বাহ হতো। সাধারণত লেটোর আসর বসতো স্থানীয় কোনো ফাঁকা জায়গায়। লড়াইয়ে জেতা কবিয়াল খ্যাতির সূত্রের দূরের দূরের গ্রামগুলোতে আমন্ত্রণ পেতেন। আর এসবই আমন্ত্রণের সূত্রে এঁদের জীবিকা নির্বাহ হতো।

কাজী নজরুল ইসলাম ও লেটো গান
কাজী বজলে করীমের হাত ধরে, নজরুল যখন লেটো গানের জগতে আসেন তাঁর বয়স বার-তের বৎসর, এই সময় তাঁর গুরু বজলে করীম ছিলেন এই অঞ্চলের স্বনামধন্য এবং অপরাজেয় গোদাকবি। এখন পর্যন্ত তাঁর যে কয়েকটি লেটো লেটোপালা বা চাপান সং-এর সন্ধান পাওয়া গেছে, তার সূত্র তাঁর অসামান্য কবি-প্রতিভা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। তাঁর রচনায় পাওয়া যায়-সমকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপট ও আর্থ-সামাজিক দ্বন্দ্বের কথা,কাব্য রচনার অসাধারণ ক্ষমতা, অতুলনীয় রসবোধ এবং প্রতিপক্ষ গোদাকবিকে ঘায়েল করার জন্য তীব্র বিদ্রূপ এবং বাক্যাঘাত।

[বিস্তারিত কাজী নজরুল ইসলামের লেটো গান ]


তথ্য সূত্র:

১. কাজী নজরুল ইসলাম ও বাংলা সাহিত্য। আজিবুল হক। লেখা প্রকাশনী, কলকাতা। ২য় সংস্করণ। ১৯৯৯
২. দুখুমিয়ার লেটো গান। সংকলক ও সম্পাদনা মুহম্মদ আয়ুব হোসেন। বিশ্বকোষ পরিষদ। নজরুল ফাউণ্ডেশন, কলকাতা। প্রথম প্রকাশ: ১৯ অগ্রহায়ণ, ১৪১০/৬ ডিসেম্বর, ২০০৩।
৩. কাজী নজরুল। প্রাণতোষ ভট্টাচার্য। ন্যাশনাল বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড। কলকাতা-১২। ১৩৭৩ বঙ্গাব্দ
৪. কাজী নজরুল ইসলাম। বসুধা চক্রবর্তী। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট ইন্ডিয়া। নয় দিল্লী। জানুয়ারি ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ।
৫. নজরুল-চরিত মানস। সুশীলকুমার গুপ্ত। ভারতী লাইব্রেরী, কলিকাতা। ভাদ্র ১৩৬৭
৬. নজরুল জীবনী। অরুণকুমার বসু। পশ্চিমবঙ্গ  বাংলা আকাদেমি। জানুয়ারি ২০০০।
৭. নজরুল-জীবনী। রফিকুল ইসলাম। নজরুল ইন্সটিটউট, ঢাকা। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ।
৮. নজরুল রচনা সম্ভার। আব্দুল কাদির সম্পাদিত। ইউনিভার্সল বুক ডিপো। কলিকাতা। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দ।
৯. নজরুল-সংগীত সংগ্রহ। সম্পাদনা রশিদুন্ নবী। কবি নজরুল ইনস্টিটিউট। ঢাকা। তৃতীয় সংস্করণ। পৌষ ১৪২৪/জানুয়ারি ২০১৮।
১০. বাংলা সাহিত্যে নজরুল। আজাহারউদ্দীন খান। ডিএম লাইব্রেরি। কলিকাতা। তৃতীয় সংস্করণ পৌষ ১৩৬৫
১১. বিদ্রোহী-রণক্লান্ত, নজরুল জীবনী। গোলাম মুরশিদ। প্রথমা, ঢাকা। ফেব্রুয়ারি ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ।
১২. লেটো ও লোক-ঐতিহ্য। ওয়াকিল আহমদ। নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ: বৈশাখ ১৪০৮/এপ্রিল ২০০১।
১৩. শত কথায় নজরুল। সম্পাদনায়: কল্যাণী কাজী। সাহিত্যম, কলকাতা। প্রথম প্রকাশ: ১৪০৫।