ঠাকুরবাড়ির গান

ঠাকুরবাড়ির গান বলতে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়- জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির বাড়ির গান।

১১৮৯ বঙ্গাব্দের পূর্বে কলকাতার ঠাকুরবাড়ি ছিল পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি। ১১৮৯ বঙ্গাব্দের সুপ্রীম কোর্টের রায়ে এরপর দর্পনারায়ণ ও নীলমণি পৃথক পৃথক সম্পত্তির অধিকার লাভ করেন। এই সূত্রে কলকাতার জোড়াসাঁকোতে নীলমণি ঠাকুর নতুন আবাসস্থল গড়ে তোলেন। এরমধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস।
        [ দেখুন: জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বংশের ইতিহাস]

কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নীলমণি ঠাকুরের মৃত্যুর পর, ঠাকুর বাড়ির অভিভাবক হন রামলোচন। সে সময়ের গ্রাম-বাংলায় লোকগানের চর্চা ছিল ঐতিহ্য অনুসারে। আর ছিল কীর্তন ও শ্যামসঙ্গীতের মতো ভক্তিগীতি। কলকাতায় টপ্পার চর্চা করতেন নিধুবাবুর শিষ্যদের কেউ কেউ। তবে হাফ আখড়াই গানের জনপ্রিয়তা ছিল সর্বাধিক। এর সাথে ছিল কলকাতায় বসবাসরত স্থানীয় রাজা এবং নব্য ধনী পরিবারগুলোর জলসা ঘরে বসতি বাঈজী এবং রাগ সঙ্গীতের আসর। সেকালের খেয়াল, ধ্রুপদ বা যেকোনো ধরনের রাগাশ্রয়ী গানকে বলা হতো কালোয়াতী গান। অন্যদিকে নদীয়া কৃষ্ণচন্দ্রের দরবারে কবিগান, কীর্তন, রামপ্রসাদী এবং হাফ-আখড়াই গানের আসরও বসতো। সেকালের কলকাতার অন্যান্য সৌখিন ধনীদের মতই রামলোচন ঠাকুর ঠাকুরবাড়িতে বিভিন্ন গুণী সঙ্গীত শিল্পীদের নিয়ে আসর বসাতেন। এই আসরে অবশ্য ঠাকুর পরিবারের আত্মীয়-স্বজনর বা এই পরিবারের ঘনিষ্ট বন্ধুবান্ধবরা আমন্ত্রিত হতেন। রামলোচনের দত্তকপুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর যখন পরিবারের অভিভাবক হলেন, তখন তিনিও এই এরকম আসরের আয়োজন করতেন। এই বিষয়টি দেবেন্দ্রবাথের 'বাল্যস্মৃতি' থেকে কিছুটা আভাষ পাওয়া যায়। তিনি  লিখেছেন 'সমস্ত রাত্রি কথা হইত এবং কীর্তন হইত, তাহার শব্দে আমরা রাত্রে ঘুনাইতে পারিতাম না।' উল্লেখ্য দ্বারকানাথ ঠাকুর উত্তরাধিকার সূত্রে বৈষ্ণব ছিল। ফলে ধর্মকথা এবং কীর্তন এই আসরের মূখ্য বিষয় ছিল। তবে দ্বারকানাথ নিজে সঙ্গীতচর্চা করতেন, এমন কথা জানা যায় না। দ্বারকানাথই ঠাকুর পরিবারের প্রথম ব্যক্তি যিনি পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যের গান সমানভাবে গ্রহণ করেছিলেন।  প্রাচ্যের গানকে তিনি ভালোবাসতেন পারিবারিক ঐতিহ্যের সূত্রে আর পাশ্চাত্য গানকে ভালবাসতে শিখেছিলেন ইংরেজদের সাথে ওঠবসার সূত্রে। ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে দ্বারকানাথের সার্বক্ষণিক সহচরদের ভিতরে একজন ছিলেন জার্মান বংশোদ্ভুত সঙ্গীতের পণ্ডিত। এছাড়া তাঁর বেলাগাছিয়া ভিলাতে প্রায়ই পাশ্চাত্য শিল্পীদের নিয়ে নৃত্যগীতের আসর বসাতেন। এই সূত্রে দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথের প্রথম জীবনে উভয় ধরনের সঙ্গীতের প্রভাব পড়েছিল। আর দেবেন্দ্রনাথের সূত্রেই প্রথম ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের মধ্য গানের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সূত্রপাত হয়।

 

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর,
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে উঠেছিলেন, ঠাকুরবাড়ির প্রাণপুরুষ। ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে ২০ আগষ্ট তারিখে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ব্রাহ্মসমাজ গঠন করেন। ব্রাহ্মসমাজের অভিভাবক দেবেন্দ্রনাথ দক্ষ হাতে এই নতুন মতকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, প্রচারণা ছাড়াও ব্রহ্মসঙ্গীত রচনায় হাত দেন। অবশ্য রামমোহন রায়ের অনুসরণ করে, সেকালের ব্রাহ্মসমাজের অনেকেই ব্রহ্মসঙ্গীত রচনায় হাত দিয়েছিলেন। এর উদাহরণ পাওয়া যায়,  ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার বছরেই (১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দ) ব্রহ্মসঙ্গীত নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে। এই গ্রন্থে রাজা রামমোহন রায় এবং অন্যান্য অনেকর গান স্থান পেয়েছিল। এই গ্রন্থে গীতকার হিসেবে নাম পাওয়া যায়, কৃষ্ণমোহন মজুমদার, নীলমণি ঘোষ, নীলরতন হালদার, গৌরমোহন সরকার, কালীনাথ রায়, নিমাইচরণ মিত্র, ভৈরবচন্দ্র দত্ত ও রামচন্দ্র দত্ত-এর। সুরের বিচারে এই গানগুলিতে বাংলার লোকগীতির কোনো ছাপ পাওয়া যায় না। অধিকাংশই ছিল রাগভিত্তিক এবং ধ্রুপদাঙ্গের। এই গ্রন্থে সকল গানের রচয়িতার নাম পাওয়া যায় না। এই গ্রন্থে কিছু গানের সাথে সংক্ষেপে কিছু রচয়িতার নাম রয়েছে। যেমন ভৈ.দ (ভৈরবচন্দ্র দত্ত), ক.ম. (কৃষ্ণমোহন মজুমদার), নি.মি. (নিমাইচন্দ্র মিত্র) ইত্যাদি। এই সংকলনের যে সকল গানের সাথে এই জাতীয় সঙ্কেত নেই, সেগুলোও যে রামমোহনের রচিত তা বলা যায় না। তাঁর মৃত্যুর পর যে সকল গ্রন্থে তাঁর গান সংকলিত হয়েছিল, সেগুলো নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। পরবর্তী সময়ে ব্রহ্মসঙ্গীত লিখে খ্যাতিলাভ করেছিলেন বেহালা ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা বেচারাম চট্টোপাধ্যায়। 
 

রাজা রামমোহন রায় ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বরে মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হন ইংল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করেন। এই সময় ব্রাহ্মধর্ম টিকে থাকবে কিনা এ নিয়ে অনেকে সংশয় ছিল। কারণ তাঁর অবর্তমানে এই ধর্মমতকে প্রচার করার মতো উল্লেখযোগ্য কেউ ছিলেন না। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মের সদস্য ছিলেন বটে কিন্তু এই ধর্মের প্রতি, তখন পর্যন্ত ততটা নিষ্ঠাবান হয়ে উঠতে পারেন নি। ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্কুল ছেড়ে, তাঁর পিতা প্রিন্স দ্বারকনাথ ঠাকুর-এর প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের কোষাধ্যক্ষ রমানাথ ঠাকুরের অধীনে শিক্ষানবীশ হিসাবে যোগদান করেন। এই সময় তিনি নানা প্রকার মোদ-প্রমোদের মত্ত ছিলেন। এই অবস্থা থেকে ফেরানোর জন্য, তাঁর অভিভাবকরা তাঁর বিবাহের ব্যবস্থা করেন। ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে যশোহরের রামনারায়ণ চৌধুরীর কন্যা সারদাসুন্দরী দেবীর সাথে তাঁর বিবাহ হয়। কিন্তু ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পিতামহী অলকা দেবীর মৃত্যুর পর, তাঁর জীবনধারা পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই সময় তিনি ভারতীয় ও ইউরোপীয় ধর্ম ও দর্শনপাঠে ত্মনিয়োগ করেন। এরপর তিনি সকল ধর্মীয় গ্রন্থের মধ্য থেকে উপনিষদকে যথার্থ গ্রন্থ হিসাবে নির্বাচিত করেন। মূলতঃ উপনিষদের চর্চা ও এর বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই অক্টোবর (২১ই শ্বিন ১২৪৬ বঙ্গাব্দ) তারিখে জোড়সাঁকোর-বাড়ির একটি ছোটো ঘরে দশজন ত্মীয় ও বন্ধু নিয়ে 'তত্ত্বরঞ্জিনী সভা' স্থাপন করেন। এই সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ সভার চার্য পদ গ্রহণ করলে– চার্য এই নাম পরিবর্তন করে রাখেন– 'তত্ত্ববোধিনী'। ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে ইনি 'তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা' স্থাপন করেন। এই স্কুলটি সেখানে জনসমাদর লাভ না করায় স্কুলটি বাঁশবেড়িয়া নামক গ্রামে স্থানান্তরিত করেন এবং শেষ পর্যন্ত দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ডিসেম্বর তত্ত্ববোধিনী' নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি ২১ জন ত্মীয়-সহ নুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর অবশিষ্ট ত্মীয়রা এই সময় তাঁকে পরিত্যাগ করেন। ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্রহ্মসঙ্গীতের একটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এর নাম ছিল নির্গুণস্তোত্র। এই সময় থেকে ব্রহ্মসঙ্গীতের একটি প্রবল ধারা শুরু হয়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে এর আগে ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেছিলেন বটে, কিন্তু ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের পরে তিনি নবোদ্যমে ব্রহ্মসঙ্গীত রচনায় হাত দেন।

 

দেবেন্দ্রনাথ সঙ্গীতের চর্চা করতেন। তিনি ভারতীয় সঙ্গীতগুণীদের কাছে কণ্ঠসাধনা করেছিলেন এবং সেই সাধে রাগসঙ্গীতে তাঁর বিশেষ ধারণা জন্মেছিল এটা অনুমান করা যায়। এছাড়া ইউরোপীয় পিয়ানো বাদকের কাছে কিছুদিন, পিয়ানোর তালিম নিয়েছিলেন। তবে গায়ক হিসেবে তার কোনো নাম ছিল না। সম্ভবত তিনি গায়ক হওয়ার চেষ্টাও করেন নি। গানের প্রতি বিশেষ আগ্রহ, ব্রাহ্মধর্মের প্রতি অনুরক্ততা এবং রামমোহন রায়ের ব্রহ্মসঙ্গীতের নমুনা তাঁকে বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ সঙ্গীত রচনায় অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁর ঠাকুমা দিগম্বরী দেবীর মৃত্যুতে তিনি যে আঘাত পেয়েছিলেন, সে সূত্রে আবেগতাড়িত হয়ে তিনি গান রচনা করা শুরু করেন। যতদূর জানা যায়, দেবেন্দ্রনাথই ঠাকুরবাড়ির প্রথম গীতিকার।

সতীশচন্দ্র সম্পাদিত 'মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী' গ্রন্থে তাঁর ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা সম্পর্কে জানা যায় এই ভাবে
"আমি সুবিধা পাইলেই দিবা দুই প্রহরে একাকী বোটানিক্যাল উদ্যানে যাইতাম। এই স্থানটি খুব নির্জন। ঐ বাগানের মধ্যস্থলে যে একটা সমাধিস্তম্ভ আছে, আমি গিয়া তাহাতে বসিয়া থাকিতাম। মনে বড় বিষাদ। চারিদিক অন্ধকার দেখিতেছি। বিষয়ের প্রলোভন আর নাই, কিন্তু ঈশ্বরের ভাবও কিছুই পাইতেছি না; পার্থিব ও স্বর্গীয় সকল সুখেরইও অভাব। জীবন নীরস, পৃথিবী শ্মশানতুল্য। কিছুতেই সুখ নাই, কিছুতেই শান্তি নাই। দুই প্রহরের সূর্যের কিরণ-রেখা সকল যেন কৃষ্ণবর্ণ বোধ হইত। সেই সময় আমার মুখ দিয়া সহসা এই গানটি বাহির হইল, 'হবে কি তবে দিব্য আলোকে, জ্ঞান বিনা সব অন্ধকার।' এই আমার প্রথম গান। আমি সমাধিস্তম্ভে বসিয়া একাকী এই গানটি মুক্ত কণ্ঠে গাইতাম।"

 

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন মূলত গীতিকার। ধারণা করা হয়, তাঁর অধিকাংশ গানের সুরকার ছিলেন বিষ্ণু চক্রবর্তী। ধারণা করা  দুটি গানের সুর ছিল তাঁরই দেওয়া। এই গান দুটি হলো- 'হবে কি হবে দিবা আলোকে' ও 'যোগী জাগে, ভোগী রোগী'।

'হবে কি তবে দিব্য আলোকে, জ্ঞান বিনা সব অন্ধকার' গানটিকে বাদ দিলে,
প্রথম দিকে দেবেন্দ্রনাথ গান লিখতেন সংস্কৃত ভাষায়। প্রথম দিকে এই গান পরিবেশন করতেন শ্রীকণ্ঠ সিংহ, তাঁর বন্ধুরা এবং পরিবারে শুদ্ধ উচ্চারণে সংস্কৃত পাঠ করতে পারতেন যাঁরা, তাঁরা। পরে দেবেন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাতেই ব্রহ্মসঙ্গীত রচনায় মন দেন। দেবেন্দ্রনাথের উৎসাহে ধীরে ধীরে ব্রহ্মসঙ্গীত রচনায় যুক্ত হলেন
তাঁর সঙ্গীসাথি এবং পরিবারের লোকেরা। এর ফলে পারিবারিক পরিবেশে ব্রাহ্মধর্ম এবং ব্রহ্মসঙ্গীত একাকার হয়ে গিয়েছিল।

 

দেবেন্দ্রনাথের মোট ১১টি গানের সন্ধান পাওয়া যায়। এর ভিতর ৫টি গানের সুর পাওয়া যায় না। বাকি ১১টি গানের সুর রক্ষিত হলেও বর্তমানে তা সুপ্রচলিত নয়। রামমোহন রায়ের নিকট উত্তরসূরী হলেও, তাঁর গানে টপ্পার ধরনটা কমে এসেছিল। সম্ভবত 'কারণ সে যে'-গানটিতে টপ্পার ধরনটা বজায় ছিল।  তাঁর অধিকাংশ গানে খেয়ালের চলনটা ছিল। এই গানগুলো একতালে নিবদ্ধ। তবে শুদ্ধ ধ্রুপদের ঢংটা ঠাকুরবাড়িতে দেবেন্দ্রনাথের হাত ধরে গভীরভাবে প্রবেশ করেছিল। দেশ রাগে নিবদ্ধ 'পূর্ণ পূজেন' গানটি তেওরা তালে নিবদ্ধ হওয়ায়, ধ্রুপদের গাম্ভীর্য পাওয়া যায়।

 

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমলে, ঠাকুর বাড়ির বেতনভুক সঙ্গীত শিক্ষক ছিলে বিষ্ণু চক্রবর্তী। এছাড়া সে সময়ে ঠাকুর বাড়িতে নিত্য আসা যাওয়া ছিল রমাপতি বন্দ্যোপাধ্যায়, যদুনাথ ভট্টাচার্যের মতো সঙ্গীতগুণীদের। তাঁরই উৎসাহে ঠাকুরবাড়িতে সঙ্গীতের যে আবহ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা পরবর্তী সময়ে সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলেছিল ঠাকুর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উপর। তিনি কখনো কখনো উত্তরসূরীদের অনেকই প্রত্যক্ষভাবে গান রচনার আদেশ দিতেন বা ভালো গান রচনার জন্য পুরস্কৃত করতেন। দেবেন্দ্রনাথের এমনি একটি উৎসাহে, তাঁর দ্বিতীয় সন্তান সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি গান রচনা করেছিলন। দেবেন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়-

'আমি এক গান ভাঙ্গছিলেম- তাহার প্রথম লাইন লিখিয়াছিলাম 'সবে মিলে গাও তাঁহার মহিমা।' সত্যেন্দ্র কাছে ছিলেন। আমি তাঁহাকে বলিলাম ;আচ্ছা, এর দ্বিতীয় লাইনটা তুমি তৈরী কর দেখি।' তিনি লিখিলেন, 'আজি কর রে ফলালভ।' আমি বলিলাম, তবে তুমি সমস্ত গানটাই তৈরী কর।' তিনি তাহাই করিলেন।  

[দেখুন: দেবেন্দ্রনাথের গানের তালিকা]

তাঁর মতই তাঁর ভাই গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কিছু গান রচনা করেছিলেন। কিন্তু তার প্রকৃতি ছিল ভিন্নতর। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ছিল ধর্মীয় আদর্শের গুরগম্ভীর রূপ। আর গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরে গান ছিল যাত্রাভিনয়ের জন্য হাল্কা মেজাজের গান। তবে গিরীন্দ্রনাথের পুত্র গণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ছিল দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতই। গণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান নিয়ে কালানুক্রমে যথাস্থানে আলোচনা করা হয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথের পরে, ঠাকুর বাড়ির সঙ্গীত রচয়িতাদের তালিকায় তৃতীয় গীতাকার হিসেবে পাওয়া যায়, দেবেন্দ্রনাথের প্রথম পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

 

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান
দেবেন্দ্রনাথের পুত্রেদের মধ্যে, প্রথম অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬)। এখন পর্যন্ত তাঁর ৩১টি গানের তালিকা পাওয়া যায়। এর ভিতরে ২৮টি ব্রহ্মসঙ্গীত, ২টি প্রেমগীতি ও একটি জাতীয় সঙ্গীত।

তাঁর গানে ব্যবহৃত রাগগুলো
হলো আশাবরী, ইমনকল্যাণ, কানাড়া, কুকুভ, কেদার, জয়জয়ন্তী, ঝিঁঝিট, দেওশাক, নটনারায়ণ, নারায়ণী, পরজ, বসন্ত, বিভাস, ভৈরব, ভৈরবী, মেঘ-মল্লার, সাহানা, সোহিনী বাহার ও হাম্বীর।

তাঁর গানে ব্যবহৃত রাগগুলো
হলো আড়াঠেকা, কাওয়ালি, চৌতাল, ঝাঁপতাল, ঠুংরি, ধামার, যৎ, সুরফাঁকতাল। তালের এই নামগুলো দেখেই ধারণা করা যায়, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর টপ্পার চাল থেকে বেরিয়ে এসে ধ্রুপদী চালের আশ্রয় নিয়েছিলেন। একথা আরও বেশি করে মানতে ইচ্ছা করে, যখন দেখি তাঁর ৩১টি গানের ভিতরে যৎ, ঠুংরি এবং আড়াঠেকায় গান মাত্র একটি করে। এর বাইরে কাওয়ালি তালে রয়েছে ২টি খেয়ালাঙ্গের গান। বাকি ২৬টি গান ধ্রুপদাঙ্গের।

মূলত ঠাকুরবাড়িতে ব্রহ্মসঙ্গীতে ধ্রুপদের প্রবেশ তাঁর হাত ধরে। তিনিই প্রথম ধ্রুপদের রাজসিক তাল হিসেবে প্রচলিত চৌতাল এবং সুরফাঁকতাল ব্যবহার করেছিলেন। এছাড়া ধ্রুপদী ঢং বজায় রেখে ব্যবহার করেছেন ধামার ও ঝাঁপতাল।
এই গানে প্রথাগত ধ্রুপদের দীর্ঘ আলাপ, লয়করীর কসরৎ এবং নানা রকম ধ্রুপদী অলঙ্কার বর্জন করে, শুধু ধ্রুপদের ভাবগম্ভীর চলনটি তিনি রেখেছিলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রথম গান হিসেবে স্বীকৃত 'জ্ঞানময় জ্যোতি কে জানে'। গানটি আনন্দঘনের রচিত একটি ধ্রুপদের বন্দীশ ভাঙা। ভৈরবী রাগে নিবদ্ধ এই গানটি তিনি প্রায় আক্ষরিক অর্থে অনুবাদ করেছিলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথের সমবয়সী ছিলেন যদুভট্ট। তিনি ঠাকুর বাড়ির সঙ্গীত শিক্ষকও ছিলেন। ঠাকুর বাড়িতে আসা-যাওয়ার সূত্রে, তাঁর সাথে যদুভট্টের প্রাগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। সম্ভবত যদুভট্ট-এর কাছে তিনি মূল গানটি শুনে, বাংলা ব্রহ্মসঙ্গীত রচনায় উৎসাহিত হয়েছিলেন। যদুভট্ট ছিলেন মূলত ধ্রুপদ শিল্পী। সেকালের ঠাকুর বাড়িতে তাঁর গান অতিপরিচিত ছিল। এর ভিতরে 'শুদ্ধ বসন্ত' রাগাশ্রয়ী সুরে সৃষ্ট 'বসন্ত আগত ভায়ো'  গানটির ধ্রুপদের সুর তাঁকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল। এই গানটিতে যদুভট্ট তাঁর ত্রিপুরার রাজার দেওয়া উপাধি 'তানরাজ' ভণিতায় ব্যবহার করেছেন। এই গানের সুর ও ভাবের অনুসরণে তিনি রচনা করেন 'আনন্দ আকুল সবে' গানটি। প্রচলিত ধ্রুপদভাঙা গানের পাশাপাশি তিনি, নিজের মতো করেও কিছু গান রচনা করেছিলেন। 'অনুপম-মহিম পূর্ণব্রহ্ম কর ধ্যান' এমনি একটি গান।
 

দ্বিজেন্দ্রনাথ খেয়ালাঙ্গের ব্রহ্মসঙ্গীত 'আজি কি হরষ সমীর' সেকালে জনপ্রিয় হয়েছিল। পরজ-বাহার রাগে ত্রিতালে নিবদ্ধ একটি খেয়াল গানের সুরালম্বে তিনি এই বাংলা গানটি রচনা করেছিলেন। এই সুরে রবীন্দ্রনাথ ৪৩ বৎসর বয়সে রচনা করেছিলেন 'আজি এই গন্ধ বিধূর সমীরণে। আর ৫৩ বৎসর রচনা ফাল্গুনী নাটকের জন্য এই সুরে রচনা করেছিলেন 'ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে।  

উত্তর ভারতীয় ধ্রুপদ, খেয়ালের পাশাপাশি কর্ণাটকী সুরেও তিনি গান রচনা করেছিলেন। তবে তিনি দক্ষিণী রাগের জটিল বিন্যাস বাদ দিয়ে শুধু চলনটা রেখে একটি স্নিগ্ধ ভাবগম্ভীর রূপ দিয়েছিলেন, তাঁর '
ভজো রে ভজো' গানে।


পূর্বেই উল্লেখ করেছি, দ্বিজেন্দ্রনাথের ব্রহ্মসঙ্গীতের সংখ্যাই বেশি। তবে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর, তিনি গভীর বিচ্ছেদ বেদনায় লিখেছিলেন কয়েকটি বেদনার গান। এমনি একটি গান হলো 'বসন্তের কাল গেছে'। গানটি প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্গলক্ষ্মী পত্রিকায়। অনেক পরে, এই সুরে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন ৭০ বৎসর বয়সে 'কী ধ্বনি বাজে' গানটি।

 

১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দ যখন আশুতোষ দেবের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি হিন্দু মেলা প্রথম অধিবেশন হয়, তখন প্রধান পরামর্শক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই হিন্দু মেলা উপলক্ষে তিনি রচনা করেছিলেন-'মলিন মুখ চন্দ্রমা'।
    [দেখুন: দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান]                                    


গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই সময় ঠাকুরবাড়ির গানের ধারায় যোগ দেন দেবেন্দ্রনাথে ভাই মেজো ভাই গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরে পুত্র গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪১-১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দ)। বয়সে তিনি ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটো এবং সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়। তবে উভয়ই ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষায় দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
 

গণেন্দ্রনাথ সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন নি। বরং দেবদেবীতে তাঁর ভক্তি ছিল। কিন্তু তাঁর রচিত সঙ্গীতে ব্রহ্মার তীব্র অনুভব পাওয়া যায়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গান খুব পছন্দ করতেন। তিনি জয়জয়ন্তী রাগে নিবদ্ধ বৈজুবাওরা রচিত  ধ্রুপদ 'প্রথম নাম ওঙ্কার' অনুসরণে রচনা করেছিলেন 'প্রথম নাম ওঙ্কার'। এই গানটি দেবেন্দ্রনাথ নিজেই মাঝে মাঝে গাইতেন। সেকালে তাঁর গান জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। মাঘোৎসবেও তাঁর গান পরিবেশিত হয়েছিল।
 

১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের দ্বিতীয় মেলা উপলক্ষে তিনি রচনা করেছিলেন 'লজ্জায় ভারত যশ গাহিব কি করে' গানটি। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জানুয়ারি, মাঘোৎসবের প্রভাতী অধিবেশনে  পরিবেশিত হয়েছিল একটি ব্রহ্মসঙ্গীত। গানটি হলো- দীন নাথ প্রেম সুধা দাও।

তাঁর আরও একটি গান সেকালে ঠাকুরবাড়ির লোকের মুখে মুখে ফিরতো। এই গানটি ছিল- '
দেখিলে তোমার সেই অতুল প্রেম-আননে'। রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতির পাণ্ডুলিপি থেকে এই গানটি সম্পর্কে জানা যায় এই ভাবে,-

'আমাদের পরিবারে গানচর্চার মধ্যেই শিশুকাল হইতে আমরা বাড়িয়া উঠিয়াছি। কবে যে গান গাহিতে পারিতাম না তাহা মনে পড়ে না। মনে আছে, বাল্যকালে গাঁদা ফুল দিয়া ঘর সাজাইয়া মাঘোৎসবের অনুকরণে আমরা খেলা করিতাম। সে খেলায় অনুকরণের আর-আর সমস্ত অঙ্গ একেবারেই অর্থহীন ছিল কিন্তু গানটা ফাঁকি ছিল না। এই খেলায় ফুল দিয়া সাজানো একটা টেবিলের উপরে বসিয়া আমি উচ্চকণ্ঠে 'দেখিলে তোমার সেই অতুল প্রেম-আননে' [গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর-রচিত ব্রহ্মসংগীত।] গান গাহিতেছি, বেশ মনে পড়ে।' [রবীন্দ্ররচনাবলী সপ্তদশ খণ্ড, বিশ্বভারতী (ভাদ্র ১৩৯৩)। পৃষ্ঠা: ৪৭০]

এই গানটির আদলে রবীন্দ্রনাথ তিনটি গান রচনা করেছিলেন। গান তিনটি হলো-
                   
চেনা ফুলের গন্ধস্রোতে [প্রকৃতি-২৬৯] [
       
            পিতার দুয়ারে দাঁড়াইয়া সবে  ভুলে যাও [পূজা ও প্রার্থনা-৩২]
                    বসন্তে কি শুধু কেবল ফোটা ফুলের মেলা রে [প্রকৃতি-২০৩]
 

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
ঠাকুরবাড়ির ব্রহ্মসঙ্গীতের রচয়িতাদের মধ্যে কালানুক্রমিকতার বিচারে, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪২-১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন চতুর্থ। তিনি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র।
১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের দ্বিতীয় মেলা উপলক্ষে তিনি রচনা করেছিলেন 'লজ্জায় ভারত যশ গাহিব কি করে' গানটি। বিলেত থেকে আইসিএস পাশ করা সরকারি কর্মচারী হলেও, ঠাকুরবাড়ির গানের গণ্ডীতে তিনি বাঁধা পড়েছিলেন।

 

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাধ্যমে ঠাকুর বাড়িতে ধ্রুপদাঙ্গের গান রচনার সূত্রপাত হয়েছিল। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সে ধারাকে সচল রেখেছিলেন। তাঁর গানে ব্রহ্মসঙ্গীতের গাম্ভীর্য ছিল, অন্যদিকে সুরের চলনে ধ্রুপদের ঢং থাকলেও, তা ধ্রুপদী অলঙ্কারের দ্বারা সালঙ্করা হয়ে উঠে নি। তাঁর গানে চৌতাল, ধামার, সুরফাঁকতাল, ঝাঁপতাল, তেওরা ব্যবহৃত হয়েছে, ধ্রুপদের গাম্ভীর্যের সাথে সুসমন্বয়ের জন্য।

 

ধ্রুপদের পাশাপাশি সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর খেয়াল ভেঙে গান তৈরি করেছিলন। এরূপ সদারঙ্গের রচিত কেদার রাগে নিবদ্ধ 'মোহে কাসি নিকি লাগি' একটি খেয়ালের আদলে রচনা করেছিলেন 'তারো হে ভবতারণ'। উভয় গানের সূত্রে রবীন্দ্রনাথ একটি গান রচনা করেছিলেন- 'ডাকে বার বার ডাক'। তাঁর রচিত খেয়ালাঙ্গের গানে কাওয়ালি এবং একতালের ব্যবহার বেশি। এর বাইরে আড়াঠেকায় দুই একটি টপ্পাঙ্গের গান পাওয়া যায়।
     

তাঁর আগে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ধ্রুপদ ও খেয়াল ভেঙে গান রচনা করলেও, সঙ্গীত গবেষকরা মনে করেন, ভাঙা গানের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি নিজেও গান করতে পারতেন। এই ধারায়  একটি বেহাগ রাগাশ্রয়ী ধামার গানের আদলে একটি গান রচনা করেছিলেন। মূল গানটি হলো- 'পিয়ারি তেরি'। আর সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত গানটি হলো- ' অমৃতধনে জানে রে' । আরও পরে এই গানের সুর অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন 'আজি রাজ আসনে'।

 

সেকালের অপর একটি জনপ্রিয় সাদরা ছিল শ্যামাশাম রচিত 'যমুনা তেরা বুখা'। এই গানটি অবলম্বনে তিনি রচনা করেছিলেন- 'কে রচে এমন সুন্দর'। উল্লেখ্য এই পরজের চলনটি ছিল বিষ্ণুপুর ঘরানার। সত্যেন্দ্রনাথের এই গানে বিষ্ণুপুরী ঘরানার পরজের ছায়া পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে সত্যেন্দ্রনাথের এই গানের সুরে দেবেন্দ্রনাথের চতুর্থ কন্যা (১৮৫৬-১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দ) স্বর্ণকুমারী দেবী রচনা করেছিলেন- 'দীন দয়াময় দীনজনে দেখা দাও।' এই সুরের আদলে, ১৩০৯ বঙ্গাব্দের মাঘোৎসব উপলক্ষে, রবীন্দ্রনাথ ( ৪১ বৎসর বয়সে) রচনা করেছিলেন- 'গভীর রজনী রজনী নামিল হৃদয়ে।

সে আমলে সত্যেন্দ্রনাথের গান ঠাকুর বাড়ি ও ঠাকুর বাড়ির বাইরে জনপ্রিয় ছিল।  মহারাষ্ট্রে তাঁর গান মারাঠি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল এবং সেখানকার অনেক প্রার্থনা সভায় সে গান গাওয়াও হতো। এরূপ একটি গান হলো
'প্রেমমুখ দেখো'।

 

১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি আদি ব্রাহ্ম সমাজের সাম্বৎসরিক মাঘোৎসবের প্রাতঃকালীন অধিবেশনে, বিষ্ণুরাম চট্টোপাধ্যায়ের রচিত একটি গান পরিবেশিত হয়েছিল। গানটি হলো'জগৎ পিতা তুমি বিশ্ববিধাতা'। পরবর্তী সময়ে এই গানের সুরে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছিলেন- 'দয়াঘন তোমা হেন কে হিতকারী'। উল্লেখ্য এই বোম্বাইয়ের প্রার্থনাসভায় হিন্দিতে এই গানটি পরিবেশিত হতো। হিন্দি গানটির প্রথম চরণ ছিল দয়াঘন তুঝ বীন কো হিতকারী'। এই সুরের আদলে রবীন্দ্রনাথ দুটি গান রচনা করেছিলেন। গান দুটি হলো- 'বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি' ও 'মিটিল সব ক্ষুধা'।

 

তাঁর গানে সেকালের সুপ্রচলিত প্রায় সব রাগই ব্যবহৃত হয়েছে। গানের মেজাজ অনুসারে তাঁর গানে যে সকল রাগ পাওয়া যায়, সেগুলো হলো আশা, কাফি, কেদার, খট, গৌড় মল্লার, ছায়ানট, জয়জয়ন্তী, ঝিঁঝিট, টোড়ি, দেশ, পরজ, পূরবী,  বিলাবল, বেহাগ, ভৈরব, ভৈরবী, মেঘ মল্লার, শুক্ল বিলাবল, সিন্ধুড়া, হাম্বীর।

 

    [দেখুন: সত্যন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের তালিকা]

হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র
হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক। বিশেষ করে তাঁর আগ্রহ ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞান ও রসায়ন বিজ্ঞানে। কিন্তু ঠাকুর বাড়ির সাঙ্গীতিক পরিবেশে, তিনিও শৈশব থেকে সঙ্গীত অনুরক্ত হয়ে উঠছিলেন। তাই বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধাদি রচনার পাশাপাশি গান রচনাতে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। বিশেষ করে সত্যেন্দ্রনাথের ধ্রুপদের সুর অবলম্বনে তিনিও কিছু ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেছিলেন।  এর ভিতরে 'আনন্দ-ধারা প্রবাহে' গানটি সেকালে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এরূপ তাঁর রচিত আরও একটি জনপ্রিয় গান ছিল- 'জয় জয় ব্রহ্মা'। অনেক পড়ে রবীন্দ্রনাথ এই গানের সুরে একটি গান চিত্রাঙ্গদায় জুড়ে দিয়েছিলেন। এই গানটি হলো- 'ক্ষমা করো আমায়'
    [দেখুন:
হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের তালিকা]
 

সৌদামিনী দেবী
দেবেন্দ্রনাথের সন্তানদের মধ্যে প্রথম সন্তানটি কন্যা। ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে এই কন্যার জন্মের পরেই মৃত্যুবরণ করেন। এরপর জন্মগ্রহণ করেন চারটি পুত্র সন্তান। চতুর্থ সন্তান বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। উন্মাদ রোগে আক্রান্ত এই সন্তান ঠাকুরবাড়ির গানে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন নি। এরপর ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন, দ্বিতীয় কন্যা সৌদামিনী দেবী। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম কন্যার অকাল মৃত্যুর কারণে, সৌদামিনী দেবীই দেবেনদ্রনাথের জ্যেষ্ঠা কন্য হিসেবে অভিহিতা হয়েছেন। তাঁর স্বামী সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর, তাঁর একমাত্র পুত্র সত্যপ্রসাদ এবং  দুই কন্যা ইরাবতী ও ইন্দুবতীকে নিয়ে সৌদামিনী ঠাকুরবাড়িতে থাকতেন। ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে দেবেন্দ্রনাথের পত্নী সারদাদেবীর মৃত্যুর পর, বৃহৎ ঠাকুর পরিবারের তিনিই গৃহকর্তীর দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সাথে। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে তাঁর একমাত্র রচনা 'পিতৃস্মৃতি'। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির সাঙ্গীতিক পরিবেশে তিনিও সঙ্গীতানুরাগিণী হয়ে উঠছিলেন। তাঁর তাঁর রচিত গানের নমুনা খুব বেশি পাওয়া যায় না। ঠাকুরবাড়িতে তাঁর রচিত একটি ব্রহ্মসঙ্গীত বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই গানটি হলো

            প্রভু পূজিব তোমারে [তথ্য ও শ্রবণ নমুনা]

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চম পুত্র
। রবীন্দ্রনাথের ভাই-বোনদের ভিতরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের (১৮৪৯-১৯২৫) প্রতিভার সাথে রবীন্দ্রনাথকে তুলনা করা যায়। রবীন্দ্রনাথের মতোই তাঁরও বিচরণ ছিল বাংলা সাহিত্যের সকল অঙ্গনে। সাহিত্যাঙ্গনের বাইরে তিনি ছিলেন সেকালের অন্যতম সুরকার। নিজের গান ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের বেশি কিছু গানের সুর করেছিলেন। বাংলা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে আকারমাত্রিক স্বরলিপির উদ্ভাবনও তিনিই করেছিলেন।

 

পিতা দেবেন্দ্রনাথ থেকে অগ্রজা সৌদামিনী দেবী পর্যন্ত বাংলা গানের ধারা প্রবাহিত হয়েছিল। তাকে সম্প্রসারিত করে, বাংলা গানকে একটি উন্মুক্ত অঙ্গনে দাঁড় করিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠাকুর বাড়ির গান শুরু হয়েছিল টপ্পাঙ্গের চলনে। অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ সে ধারায় যুক্ত করেছিলেন ধ্রুপদী চলন। সত্যেন্দ্রনাথ এই দুটি ধারার সাথে সার্থকভাবে খেয়ালাঙ্গের গানকে যুক্ত করেছিলেন। এই ধারাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন গণেন্দ্রনাথ ও হেমেন্দ্রনাথ। সকলেই ধ্রুপদ, খেয়াল বা টপ্পার অলঙ্কার বর্জন করে চালটা নিয়েছিলেন। মূলত গানের ভাবকে অধিকতর মূল্য দিতে গিয়ে তাঁর একটি সরল এবং ভাবপ্রতীকী সুরের আশ্রয় নিয়েছিলেন। পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি অবলম্বন করেই নতুন দিক খুলে দিলেন। তাঁর আগে ঠাকুর পরিবারে নাটকের গান হিসেবে নতুন কোনো গানের সংযোজন হয় নি। তাঁর গানের সুরের ধারায় যুক্ত হয়েছিল পাশ্চাত্য সঙ্গীত। বিলাতফেরত সত্যেন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য সুরকে এড়িয়ে গেলেও, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের গানে পাশ্চাত্য গানের পরীক্ষা নিরীক্ষা লক্ষ্য করা যায়।

 

তিনি ভারতবর্ষের নানা ভাষায় রচিত রাগসঙ্গীত সংগ্রহ করেছিলেন। সে সকল গানের সুর নিয়েও তাঁর পরীক্ষা নিরীক্ষার অন্ত ছিল না। যার ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের উপর। তাঁর সংগৃহীত ৩২টি রাগ-সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথ গান রচনা করেছিলেন। যে গানগুলোকে বর্তমানে রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গান বলা হয়। বাণীর বিচারে রবীন্দ্রনাথের প্রথম গান 'জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ'। ধারণা করা হয়, এই গানটির সুর করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর সংকলিত ও ব্যাখ্যাত 'স্বরলিপি-গীতিমালা (১৩০৪) অনুসারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সুরারোপিত গান পাওয়া যায় ২০টি।
      [দেখুন: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের তালিকা]

 

সুকুমারী দেবী
পুণ্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
শরৎকুমারী দেবী
 

স্বর্ণকুমারী দেবী
দেবেন্দ্রনাথের চতুর্থ কন্যা (১৮৫৬-১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দ)। দেবেন্দ্রনাথের কন্যাদের মধ্যে সর্বার্থে সাহিত্যিক বলতে তিনিই ছিলেন। ঠাকুরবাড়ির সাঙ্গীতিক পরিবেশে অন্যান্য ভাইবোনবদের তিনই বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁর প্রথম যে গানটির সন্ধান পাওয়া যায়, সেটি রচিত হয়েছিল, তাঁর
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'কে রচে এমন সুন্দর' গানের রচনা করেছিলেন-
                দীন দয়াময় দীনজনে দেখা দাও। [শ্রবণ নমুনা: অভিরূপ গুহ ঠাকুর] [
শ্রবণ নমুনা: পত্রলেখ দত্ত]
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ এই গানের সুরে রচনা করেছিলেন, 'গভীর রজনী নামিল'।

 

 

দেবেন্দ্রনাথের তৃতীয় প্রজন্মের গীতিকার
রবীন্দ্রনাথের ভাইবোনদের বাদ দিলে, এঁদের সন্তানদের ভিতরে কেউ কেউ সঙ্গীতচর্চা এবং সঙ্গীত রচনায় কেউ কেউ খ্যাতিলাভ করেছিলেন। এঁদের ভিতর
ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইন্দিরাদেবী এবং সরলাদেবীর নাম বিশেষভাবে পাওয়া যায়। এঁদের গানে পূর্বসূরীদের প্রভাব থাকলেও, স্বকীয় বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুরে সঙ্গীত নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেকালের গানে নুতন মাত্রা এনে দিয়েছিল।


ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর

হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নীপময়ী দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বিশিষ্ট গীতিকার, সুরকার এবং সঙ্গীতশিল্পী। সে সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর রচিত গান প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তিনি সেকালের প্রথাগত ধ্রুপদাঙ্গের ব্রহ্মসঙ্গীতের ধারা থেকে বেরিয়ে এসে অন্য সুরাঙ্গের আশ্রয়ে ব্রহ্মসঙ্গীত তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। এরূপ একটি গান হলো
           
মরি সেই রূপ কিবা [শ্রবণ নমুনা: রাজেশ্বরী বন্দ্যোপাধ্যায়]
           
ঝড় উঠিয়াছে কেন রে [শ্রবণ নমুনা: তপনকান্তি ঘোষ]

 

রলা দেবী

পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর অগ্রজদের সূত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেন। ঠাকুরবাড়ির বাইরে কেশবচন্দ্র সেনের সমাজভুক্ত ত্রৈলোক্যনাথ প্রায় দুই হাজার ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়।



 


সূত্র :
রবীন্দ্রসঙ্গীত মহাকোষ। প্রবীরগুহ ঠাকুরতা। দে'জ পাবলিশিং। জানুয়ারি ২০০৮, মাঘ ১৪১৪।
রবিজীবনী ১-৯ খণ্ড। প্রশান্তকুমার পাল।
রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসংগীত। দিলীপকুমার বিশ্বাস। দেশ সাহিত্য সংখ্যা ১৩৯৩।