ঢাক
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা {ঘাত-বাদ্যযন্ত্র |আনদ্ধ  | বাদ্যযন্ত্র | যন্ত্র | ডিভাইস | যন্ত্রীকরণ | মনুষ্য-সৃষ্টি | এককঅংশ | দৈহিক-লক্ষ্যবস্তু | দৈহিক সত্তা | সত্তা | }

সাধারণ ভাবে বর্তমানে ঢাক একটি স্বতন্ত্র বাদ্যযন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। কিন্তু প্রাচীন ভারতে চামড়া দ্বারা আচ্ছাদিত সকল তালযন্ত্রই ঢাক হিসেবে পরিচিত ছিল। এই বিচারে ভারতীয় সঙ্গীতজগতে ঢাক হচ্ছে চামড়ার দ্বারা আচ্ছদিত আদি তালযন্ত্র। প্রাচীন সঙ্গীতবিষয়ক গ্রন্থাদি অনুসরণ করলে এমন ধারণাই পাওয়া যায়।

ভরতে নাট্যশাস্ত্রের ত্রয়স্ত্রিংশ অধ্যায়ের 'ঢাকের উৎপত্তি' শিরোনাম অংশ থেকে জানা যায়, স্বাতি মুনির উদ্যোগে এই বাদ্যযন্ত্রটি তৈরি হয়েছিল। নাট্যশাস্ত্রের এই অংশ থেকে জানা যায়, কোনো এক বর্ষাকালে স্বাতি একটি সরোবরে জল আনতে গিয়েছিলেন। এই সময় দেবরাজ ইন্দ্র প্রবল ঝড়-বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে পৃথিবীকে একটি বিশাল সাগরে পরিণত করা শুরু করেন। এর ফলে বাতাসের প্রবল ধাক্কা বৃষ্টির ফোটাগুলো সজোরে পদ্ম পাতার উপর পড়ে অদ্ভুদ শ্রুতিমধুর শব্দের সৃষ্টি করতে থাকলো। মুনি এই ধ্বনিগুলো শুনে মুগ্ধ হলেন এবং এই ধ্বনি-উৎপাদক বাদ্যযন্ত্র তৈরির কথা ভাবলেন। তিনি এই যন্ত্র তৈরির জন্য বিশ্বকর্মার শরণাপন্ন হন। মুনির অনুরোধে বিশ্বকর্মা  চারটি বাদ্যযন্ত্র তৈরি করলেন। এই বাদ্যযন্ত্রগুলো হলো- মৃদঙ্গ, পুষ্কর, পণব ও দর্দুর। এই অধ্যায়ের ১৭তম শ্লোক থেকে জানা যায়- এই চারটি যন্ত্রই ঢাক।

এরপর দেবতাদের দুন্দুভির অনুকরণে তৈরি করলেন বিশ্বকর্মা আলিঙ্গ্য, ঊর্ধ্ক ও আংকিক নামক ঢাক তৈরি করেছিলেন। বিশ্বকর্মা মূলত তৈরি করেছিলেন ঢাকের কাঠামো। এই কাঠামোগুলোর আকার অনুসারে বিভিন্ন নাম দিয়েছিলেন। ঋষি ঊহাপোহে মৃদঙ্গ, দর্দুর ও পণবের কাঠামোর খোলা মুখ চামড়া দ্বারা আচ্ছাদিত করেন এবং এই চামড়া যাতে কাঠামোর সাথে দৃঢ়ভাবে যুক্ত থাকে, সে জন্য তিনি ডুরি দিয়ে চামড়াকে বাঁধলেন। এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়েছিল ঝল্লরী, পটহ এবং অন্যান্য ঢাক।

নাট্যশাস্ত্রের ঢাকের উৎপত্তি-কথনে বিশ্বকর্মা, ইন্দ্র ইত্যাদি পৌরণিক চরিত্র বাদ দিলে, একটি সাধারণ বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্তে আসা যায়, তা হলো- প্রাচীন কালে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট সুখকর ধ্বনি থেকে মানুষ ঢাকের মতো বাদ্যযন্ত্রাদি তৈরি করেছিল। নানা ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্রের বিকাশ ঘটেছিল এবং সেগুলো স্বতন্ত্র নামে পরিচিতি লাভ করেছিল।

প্রাচীন ভারতে ঢাকের শ্রেণিকরণ করা হয়েছিল- এর আকার, শব্দগুণ এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রের বিচারে। যেমন- বাংলাদেশে ঢাক একটি ঐতিহ্যবাহী তালযন্ত্র। সনাতন ধর্মের দুর্গ পুজা, চড়ক পূজা ইত্যদিতে ঢাকের বাদ্য অপরিহার্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া বাংলা ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা, নৌকাবাইচ ইত্যাদিতে উৎসবের আমেজ আনার জন্য ঢাক ব্যবহার করা হয়।