ও (গ্রিক পৌরাণিক সত্তা)
গ্রিক
Ἰώ
ইংরেজি :
Io। অন্য নাম আইডা (Ida)।
গ্রিক পৌরাণিক কাহিনীতে এই নামে দুটি চরিত্র পাওয়া যায়।


১.
িক পৌরাণিক কাহিনি মতে ক্রিট দ্বীপের পরী বিশেষ। ইনি ছিলেন
মেলিসাস-এর কন্যা। এর অপর একটি বোন ছিল। এর নাম ছিল এ্যাড্রাসটেইয়া। জিউস-এর জন্মের পর ধরিত্রী দেবী, জিউসকে ক্রিট দ্বীপে নিয়ে আসেন। পরে এ্যাড্রাসটেইয়া ও আইও-এর হাতে জিউসকে অর্পণ করেন। এঁদের আদর যত্নে জিউস এই দ্বীপে বড় হয়ে উঠেছিলেন। এই দুই বোন এ্যামালথিয়া' নামক একটি পৌরাণিক ছাগলের দুধ ও বন থেকে সংগৃহীত মধু জিউসকে খাওয়াতেন। এই সময়  জিউসের সাথে এ্যামালথিয়া'র অন্য একটি শাবক দুধ পান করতো। এই শাবকটির নাম ছিল প্যান। জিউস প্যানকে দুধভাই হিসাবে বিশেষ স্নেহ করতেন। জিউস পরবর্তী সময়ে এদের প্রত্যেকের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করেছেন।

 

২. আইও একই সাথে একটি গ্রিক পৌরাণিক চরিত্র ও একটি কিম্বদন্তী। এই চরিত্রটির মধ্য দিয়ে গ্রিকবাসীরা তাঁদের ধর্মবিশ্বাসে চন্দ্রের সাথে গাভীকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। প্রাচীন গ্রিসের লোকেরা চাঁদকে পানির উৎসসমূহের দেবী হিসাবে পূজা করতো। গাভী দুধ দেয় বলে গাভীকে চাঁদের মূর্ত প্রতীক হিসাবে গণ্য করত। এই ধারণা থকে পরবর্তী সময়ে আইও-এর কাহিনীটি গড়ে ওঠে। গ্রিকবাসীরা চাঁদের তিনটি রঙ কল্পনা করতো। রঙ তিনটি হলো সাদা, লাল ও কালো। আইও-কে চন্দ্রদেবী হিসাবে কল্পনা করার সময়, তারা রঙের এই তিনটি প্রতীককে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

পৌরাণিক চরিত্র হিসাবে আইও-কে পাওয়া যায় একটি দীর্ঘ বেদনাদায়ক কাহিনী থেকে। উল্লিখিত  প্রতীকের সাথে আইওকে উপস্থাপন করা হয় অনেক সময়। এক্ষেত্রে তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই বিষয় তিনটি হলো

১. চাঁদের রঙ শুভ্র পবিত্রতার প্রতীক। আইও-প্রথমে হেরার মন্দিরের পূজারিণী ছিলেন। এর জীবনের পবিত্রতা চাঁদের শুভ্র রঙের মতো ছিল।

২. চাঁদের লাল রঙ যৌবনের প্রতীক। প্রকৃতপক্ষে চাঁদের লাল আভা দেখা দেয় পূর্ণিমার চাঁদের উদয়কালে। যৌবনের উষালগ্নে আইও লাঞ্ছিত হয়েছিলেন দেবরাজ জিউস কর্তৃক। লাল রঙ একই সাথে সেই বেদনারও প্রতীক।

৩. চাঁদের কালো রঙ যা একই সাথে বার্ধক্য ও চাঁদের কলঙ্ককে প্রকাশ করে। আইও-এর সমগ্র কলঙ্ক এই কালো রঙ এবং নিঃসঙ্গ মৃত্যু, চাঁদের কলঙ্ক ও অমাবস্যাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

 

আইও নদীদেবতা ইনাকসের (Inachus) ঔরসে মেলিয়া নামক এক পরীর (বা ওসিয়ানিড) গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। ইনি গ্রিক দেবী হেরার মন্দিরের পূজারিণী ছিলেন। ইনক্স নামক এক নারী মায়া দ্বারা দেবরাজ জিউসকে আইও-এর প্রতি প্রেমে আসক্ত করে তুলেছিলেন।

 

একবার এক সকালে আইও একাকী নদীতে স্নান করছিলেন। জিউস তাঁর সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে, তাঁর কাছে আসেন এবং মিলিত হন। কোনো কোনো মতে, জিউস সম্ভোগ প্রার্থনা করলে আইও বলেন যে, তাঁর পিতা জানলে তাঁকে গৃহ থেকে বহিষ্কার করে দেবেন। এরপর জিউস আইওর পিতার এবং তাঁর স্ত্রী হেরার দৃষ্টিকে আড়াল করার জন্য ঘনমেঘ সৃষ্টি করে নিজেদের আবৃত করেন এবং আইও-র সাথে মিলিত হন।

 

এই মেঘ দিয়ে আইও-র পিতার দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারলেও, হেরাকে ফাঁকি দিতে পারেন নি। হেরা অসময়ে ঘন মেঘের আবরণ দেখতে পেয়ে তদন্ত করার জন্য মর্তে নেমে আসেন। জিউস তত্ক্ষণাৎ আইও-কে একটি সাদা রঙের বকনা বাছুরে পরিণত করেন এবং নিজেকে একখণ্ড সাদা মেঘে পরিণত করেন। হিরা বিষয়টি বুঝতে পেরে জিউসের কাছে বাছুরটি প্রার্থনা করেন। জিউস মান বাঁচাতে গিয়ে হেরকে গাভীটি  দান করলেন। জিউস যাতে আইও-র কাছে না যেতে পারে, এই উদ্দেশ্যে  হেরা বাছুরটিকে শতচক্ষুবিশিষ্ট আর্গস (Argus) নামক এক দৈত্যের কাছে রেখে এলেন।

 

এদিকে হারিয়ে যাওয়া কন্যাকে খুঁজতে খুঁজতে, ইনাকাস আর্গসের কাছে আসেন। ইনাকাস তাঁর কন্যার কথা আর্গসকে জিজ্ঞাসা করলে আর্গস জানান যে, তিনি কোনো মানব কন্যার সন্ধান জানেন না। ইনাকাস ফিরে যতে উদ্যোগী হলে, আর্গসের কাছের রক্ষিত গাভীরূপী আইও খুরের সাহায্যে নিজের দুঃখের কথা জানালেন। কিন্তু ইনাকাস বুঝতে পেরেও কোনো প্রতিকার করতে পারেন নি।

 

এর বেশ কিছুদিন পর, জিউস আইও-কে উদ্ধারের জন্য হের্মেজকে পাঠান। হের্মেজ এসে দেখলেন যে, আর্গস সারাদিন শতচক্ষুতে গাভীটিকে লক্ষ্য করেন, এমনকি রাতে ঘুমানোর সময়ও এর দুটি চোখ খোলা থাকে। হের্মেজ তখন নলখাগড়া থেকে একটি বাঁশী প্রস্তুত করে একটি ঘুম পাড়ানী সুর বাজাতে থাকেন। সুরের প্রভাবে আর্গস ঘুমিয়ে পড়লে, হের্মেজ আর্গসের মাথা কেটে ফেললেন। হেরা বিষয়টি জানতে পেরে, প্রথমে আর্গসের শতচক্ষুকে ময়ূরের পেখমে স্থাপন করলেন, এরপর একটি ডাঁশ জাতীয় মাছি পাঠালেন গাভীটির কাছে। এই ডাঁশটি সর্বক্ষণ হুলের দ্বারা গাভীটিকে তাড়িত করতে থাকলো। এই ডাঁশটির তাড়নায় গাভীরূপী আইও প্রায় সারা পৃথিবী ভ্রমণ করেন।

 

প্রথমে আইও প্রান্তরে প্রান্তরে ছুটে বেড়াতে লাগলেন। এরপর আশ্রয় পাওয়ার জন্য এক সাগরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তাঁর নামানুসারে এই সাগরের নাম পরবর্তী সময়ে আইওনিয়ান রাখা হয়। সাঁতরে তিনি প্রথমে উঠলেন থ্রেস উপদ্বীপে। সেখান থকে উত্তর দিকে রওনা হয়ে পৌঁছালেন- হেমাস (Heamus) পর্বতে । পর্বত ছেড়ে অচিরেই ইনি চলে এলেন ডানিয়ূব নদীর ব-দ্বীপে। এরপর কৃষ্ণসাগরের চারদিক ঘুরে বসফোরাস প্রণালী পার হলেন। এরপর হাইব্রিস্তে (Hybristes) নদীর ধার দিয়ে নদীর উৎসমুখ ককেশাস পর্বতে হাজির হলেন। এই পর্বতে গিয়ে ইনি শৃঙ্খলিত প্রোমেথেয়ুসকে দেখতে পান। প্রোমেথেয়ুসকে গিয়ে আইও তাঁর দুঃখের কথা জানালেন। উত্তরে প্রোমেথেয়ুস ভবিষ্যৎ বাণীতে জানালেন যে, নীলনদের অববাহিকায় তাঁর মুক্তি মিলবে। এবং তাঁর গর্ভজাত সন্তানের সূত্রে যে বংশধারা সৃষ্টি হবে, সে বংশে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বীর সন্তান জন্মগ্রহণ করবে। উল্লেখ্য, প্রোমেথেয়ুসের এই ভবিষ্যৎবাণী সত্য হয়েছিল। কারণ, আইও-এর উত্তরসূরীই ছিলেন- প্রখ্যাত বীর হেরাক্লেজ

 

য়ও এবং জিউস। চিত্রকর্ম । Antonio da Correggio

প্রোমেথেয়ুসের-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, তিনি কোলচিসের (Colchis) মধ্য দিয়ে প্রথমে ইউরোপে, পরে এশিয়া মাইনরে প্রবেশ করলেন। এই পথে ইনি প্রথমে আসেন তার্সাস (Tersus)। এরপর ইনি এই অঞ্চল অতিক্রম করে, যথাক্রমে জোপ্পা (Joppa), মিডিয়া (Media), ব্যাক্ট্রিয়া (Bactria) পরিভ্রমণ করেন। এরপর তিনি ভারতের ভিতর দিয়ে ক্রমে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে আরবে প্রবেশ করেন। এরপর বাব-এল-মানদেব প্রণালী পার হয়ে আফ্রিকার ইথিওপিয়া পৌঁছেন। এরপর নীল নদের উৎসমুখে এসে পিগমিদের সাথে তাঁর দেখা হয়। এই পথ ধরেই ইনি মিশরে প্রবেশ করেন। এইখানে জিউস তাঁকে আবার মানুষের রূপটি ফিরিয়ে দেন। এইখানে তাঁর প্রথম সন্তান এপাফাসের জন্ম হয়।

 

অন্য মতে আইও গাভী থাকা অবস্থায় আইওনিয়া পর্বতের এক গুহায় একটি এঁড়ো বাছুরের জন্ম হয়েছিল। এটি ছিল জিউস ও আইওর প্রথম সন্তান। আর এই বাছুরটি ডাঁশের কামড়ে মারা গিয়েছিল। জিউস যখন মিশরে আইও-কে মানুষের রূপ ফিরিয়ে দেন, তখন তাঁর সাথে আবার মিলিত হন। আর এই মিলনের ফলেই মানুষরূপী এপাফাসের জন্ম হয়েছিল। এরপর আইও-এর বিবাহ হয়েছিল মিশরের রাজা টলিগোনাসের সাথে।

 

আইও-এর সম্পর্কে আরো একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। আইও মিশরের এসে গাভীরূপ পরিত্যাগ করলে- পশ্চিমাঞ্চলের রাজা জিউস পিকাস (Zeus Picus), আইওকে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে এবং তাঁর কয়েকজন ভৃত্যকে পাঠিয়ে আইও-কে তাঁর প্রাসাদে ধরে এনে ধর্ষণ করেন। এর ফলে লিবিয়া নামে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। এরপর ইনি মিশরে পালিয়ে যান। সেখানে এসে দেখেন যে জিউস পুত্র হার্মিজ অবস্থান করছেন।

 

এরপর তিনি সিরিয়ার অন্তর্গত সিলসিয়াম পর্বতে চলে যান এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। এদিকে আইও-এর ভাইরা তাঁকে খুঁজতে এসে বুঝতে পারে যে আইও মারা গেছেন। এরপর তারা –'এখানে কি আইও-এর আত্মা আছে ?' বলে চিৎকার করতে থাকেন। সেই ডাকের উত্তরে -একটি গাভীর স্বরে উত্তর আসে, ‘হ্যাঁ আমরা এখানেই আছি।’ এরপর আইও-র ভাইরা দেশে না ফিরে সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। কালক্রমে সেখানে একটি নগর গড়ে ওঠে। পরে ওই নগরীর নামকরণ করা হয়- আইওপোলিস।


সূত্র :
greek myth/Robert Graves, cassel & comoany, fourth edition 1995

http://en.wikipedia.org/wiki/Io_(mythology)