প্রাকৃত ভাষা
আর্য-অনার্য জাতির ভাষার সংমিশ্রণে সৃষ্ট প্রাচীন ভারতীয় ভাষার সাধারণ নাম।
নৃবিজ্ঞানী এবং ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে—
প্রায় ২ লক্ষ বৎসর আগে, নর-বানর থেকে আধুনিক মানুষ তথা
Homo sapiens
(হোমো স্যাপিয়েন্স)
নামক প্রজাতিটির আবির্ভাব ঘটেছিল
আফ্রিকার
ইথিওপিয়া অঞ্চলে। আফ্রিকা থেকে ভারতবর্ষে আগত আদি নৃগোষ্ঠীকে
বলা হয়
নেগ্রিটো।
এদের ভাষার কোনো নমুনা পাওয়া যায় না। এরপর ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড নৃগোষ্ঠী।
নেগ্রিটোদের সাথে
প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের রক্তের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল যে মিশ্র জাতি,
ভাষাতাত্ত্বিকরা তাদের ভাষাকে
অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা
পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ভাষার বিচারে তাই এদেরকে কখনো কখনো অস্ট্রিক জাতি
বলা হয়। প্রাচীন ভারতের বিশাল অংশ জুড়ে এই ভাষার মানুষ ছড়িয়ে পড়েছিল।
এরপর ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল দ্রাবিড়রা। এদের প্রবেশ ঘটেছিল ভারতবর্ষের পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে। এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ভারতবর্ষের সিন্ধু নদীর তীরে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০-৩৫০০ বৎসরের ভিতরে বসতি স্থাপন করেছিল। তারপর এরা ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের সাথে অস্ট্রিক ভাষাভাষীদের সম্মিলনে ভারতবর্ষের ভাষায় আবার সংমিশ্রণের ধারা সচল হয়ে উঠেছিল। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে দ্রাবিড়দের বিস্তার যতটা প্রবলভাবে ঘটেছিল, বঙ্গদেশে ততটা ঘটে নি। ফলে এই অঞ্চলের ভাষায় অস্ট্রিক ভাষার আধিপত্য রয়েই গিয়েছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের দিকে আর্যরা ভারতবর্ষে আসা শুরু করেছিল। উত্তর-পশ্চিম ভারত দিয়ে এই আগত এই জনগোষ্ঠী খ্রিষ্টপূর্ব ১১০০ অব্দের দিকে বঙ্গদেশ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। খ্রিষ্ট-পূর্ব ১০০০ বৎসরের ভিতরে ভারতীয় ইন্দো-ইরানিয়ান ভাষার পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ের ভিতরে এই পরিবর্তিত ভাষার নমুনা পাওয়া যায় ঋগ্বেদ। ধারণা করা হয়- ঋগ্বেদের শ্লোকগুলো রচিত হয়েছিল খ্রিষ্ট-পূর্ব ১২০০-১০০০ বৎসরের ভিতরে। বিভিন্ন ঋষিদের রচিত বিভিন্ন শ্লোকগুলো একত্রিত করে যে সংকলিত গ্রন্থ প্রস্তুত করা হয়, তাই ঋগ্বেদ নামে পরিচিতি লাভ করে। এরপর লেখা হয় অন্য তিনটি বেদ এবং এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য গ্রন্থ। গোড়ার দিকে সকল বেদ সংকলিত হয়ে একটি বেদ-আকারে ছিল। বেদের এই ভাষাকে বলা হয় বৈদিক ভাষা।
বৈদিকভাষার যুগে আর্য ঋষিদের সাথে সাধারণ আর্যদের যতটা যোগাযোগ ছিল, কালক্রমে তা অনেকটা শিথিল হয়ে পড়েছিল। বৈদিক ভাষা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা না হয়ে সাহিত্যের ভাষা হয়ে উঠেছিল। এর ফলে বৈদিক ভাষার নানা ধরনের কথ্যরূপ তৈরি হয়েছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৫০০ অব্দের ভিতরে বৈদিক ভাষা থেকে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল। ব্যাকরণ দিয়ে এই ভাষার রীতি নীতি অনেকে বাঁধার চেষ্টাও করেছিলেন অনেকে। এক্ষেত্রে পাণিনি সফল হয়েছিলেন। তাঁর সাফল্য সাময়িকভাবে বৈদিক ভাষাকে জীবন্ত করেছিল বটে, দীর্ঘজীবী করতে ব্যর্থ হয়েছে।
পাণিনি 'অষ্টাধ্যায়ী' নামক একটি ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০-৪০০ অব্দের দিকে। এই ব্যাকরণের সূত্রে বৈদিক সংস্কৃতি বিবর্তনের ভিতর দিয়ে একটি পরিমার্জিত ও পরিশীলিতরূপ লাভ করেছিল। পাণিনির পূর্বে বা সমসাময়িককালে সংস্কৃত ভাষার তিনটি কথ্য রূপ গড়ে উঠিছল।
সুনীতি চট্টোপাধ্যায় ভারতের মহারাষ্ট্র অঞ্চলে সংস্কৃত ভাষার অপর একটি রূপ ছিল বলে অনুমান করেছেন। তিনি এর নাম দিয়েছেন দাক্ষিণ্যাত্য।
স্থানীয় অনার্যদের ভাষা এবং বিবর্তিত
সংস্কৃতভাষার সংমিশ্রণে সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষা নতুন রূপ লাভ করেছিল। ভারতীয়
ভাষার ক্রমবিকাশের ধারায়- এই বিবর্তিত এবং সংমিশ্রিত ভাষার সাধারণ নাম হলো
প্রাকৃত ভাষা।
ভারতবর্ষের বিশাল অঞ্চলে ভাষার বিবর্তনের প্রকৃতি এক রকম ছিল না। কোথায়ও এর প্রচলন
ঘটেছিল লোকের মুখে মুখে। কোথাও বা সাহিত্যের ভাষারূপে বিকশিত হয়েছিল। আঞ্চলিকতার
বিচারে যে সকল প্রাকৃত ভাষার যে সকল শাখা আত্মপ্রকাশ করেছিল, তা হলো−
প্রাকৃত ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারায় সাহিত্যধর্মী প্রাকৃত ভাষা (মাগধী, অর্ধ-মাগধী ইত্যাদি) থেকে কথ্যরূপ সৃষ্টি হয়েছিল। একে বলা হয় অপভ্রংশ। আরও পরে এই সকল অপভ্রংশ থেকে তৈরি হয়েছিল অবহট্ঠ ভাষার। এরপর ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে এই ভাষাগুলো থেকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে নব্যভারতীয় ভাষাগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। নিচে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারা দেখানো হলো।
সূত্র :
ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। রূপা। বৈশাখ ১৩৯৬।
ভাষার ইতিবৃ্ত্ত। সুকুমার সেন। আনন্দ পাবলিশারস্ প্রাইভেট লিমিটেড। নভেম্বর
১৯৯৪।
বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত। ডঃ মুহম্মদ শহীদউল্লাহ। মাওলা ব্রাদার্স। জুলাই ১৯৯৮
বাংলা সাহিত্যের কথা। ডঃ মুহম্মদ শহীদউল্লাহ। মাওলা ব্রাদার্স।
সাধারণ ভাষা বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা। ডঃ রামেশ্বর শ।
http://en.wikipedia.org/wiki/Indo-Aryan_languages
http://en.wikipedia.org/wiki/Magadhi_Prakrit