মানব-সভ্যতা
মানব সভ্যতা হলো মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রযুক্তিগত ও বৌদ্ধিক উন্নয়নের স্তরগত দশা । আজ থেকে প্রায় পাঁচ লক্ষ বছর আগে, যখন পৃথিবী ছিল বরফযুগের তুষারবৃত দশায় ছিল। তখন আফ্রিকার বিভিন্ন প্রান্তে হোমো গণের ক্রমবিবর্তনের একই সঙ্গে জেগে উঠছিল এক নতুন প্রজাতি হোমো স্যাপিয়েন্স ের আদ্য রূপ । এই প্রজাতির আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকার উত্তরের মরুভূমি, দক্ষিণের সাভানা, পূর্বের রিফট ভ্যালি এবং পশ্চিমের বনাঞ্চল জুড়ে তখন থেকেই শুরু হয়েছে- মানব সভ্যতার অভিযাত্রা।

প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের সূত্রে আদিম মানুষের আবির্ভাবকাল ধরা হয়ে থাকে ৩৫০,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এই অনুমানের সূত্র হলো- উত্তর আফ্রিকার মরক্কোর জেবেল ইরহুদ  অঞ্চলের পাহাড়ি গুহায় প্রাপ্ত মানুষের জীবাশ্ম। ৩,১৫,০০০ অব্দের দিকে একদল বসতি স্থাপন করেছিল। তাদের মুখ আধুনিক মানুষের মতো, কিন্তু মস্তকের গড়ন ছিল প্রাচীন। এই জীবাশ্মই আজ পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন হোমো স্যাপিয়েন্স প্রমাণ।

২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে আবিষ্কৃত এই জীবাশ্মগুলোর বয়স নির্ধারিত হয়েছে আনুমানিক ৩১৫,০০০ ± ৩৪,০০০ বছর। অর্থাৎ, উচ্চ সীমা বিবেচনায় বলা যেতে পারে- মানুষের অস্তিত্ব বিকশিত হতে শুরু হয়েছিলে প্রায় ৩৫০,০০০ বছর আগে। এই প্রাচীনতম জীবাশ্মের ভিত্তিতে বলা যায় আফ্রিকার উত্তরাংশে (মরক্কো) মানুষের উপস্থিতি সবচেয়ে আগে প্রমাণিত। এদের মুখমণ্ডল ছিল আধুনিক মানুষের মতো সমতলীয়। মাথা ছিল পিছনের দিকে বিস্তারিত ছিল। এদের মস্তিষ্কের মাপ ছিল ১৪৫০ সিসি (মানুষের মস্তিষ্কের কাছাকাছি)।

এরা আদিম লেভালয়িস  পদ্ধতির হাতিয়ার ব্যবহার করতো। পাথুরে এসব হাতিয়ার দিয়ে এরা শিকার করা, মাংস থেঁৎলানো বা কাটা, গাছ কাটা ইত্যাদি কাজ করতো। এদের নিকটতম জ্ঞাতি হোমো হাইডেলবার্গেনসিস-দের কাছ্ থেকে এরা আগুন জ্বালানো এবং  লেভালয়িস পদ্ধতির হাতিয়ার তৈরি করা শিখেছিল। এদের শিকারের তালিকায়  গাজেল, হাতি, পাখি।

এদের ধর্ম সম্পর্কে কি ছিল তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। সামগ্রিক প্রত্নতাত্ত্বিক এবং নৃবিজ্ঞানীয় গবেষণা থেকে অনুমান করা যায় যে, এই আদিম মানুষের মধ্যে ধর্ম বোধের সূচনা যেভাবে হয়েছিল,  তা হলো-

আফ্রিকার অঞ্চল বিশেষ থেকে মানুষ আফ্রিকার ভিতরে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। যদি ধরে নেওয়া যায়- জেবেল ইরহুদ ছাড়াও একই সময়ে আফ্রিকার নানা অঞ্চলে উদ্ভব হয়েছিল এবং এদের জিন সঙ্কেতের মৌলিক কিছু অংশ একই রকম হলেও কিছু কিছু ব্যতীক্রমও ছিল। কালক্রমে প্রজননের সূত্রে এদের ভিতরে জিনের কিছু অংশ বিনিময় হয়েছিল।

জিন বিষয়ক আলোচনার প্রাথমিক পর্যালোচনায় দেখা যায়- জেবেল ইরহুদের জীবাশ্মগুলো থেকে সরাসরি ডিএনএ পাওয়া যায় না। কিন্তু আধুনিক উত্তর আফ্রিকানদের (যেমন বেরবের এবং তুয়ারেগ) জিনোমের সাথে তুলনা করে বোঝা যায়- তাদের জিনে প্রাচীন আফ্রিকান উৎসের মিশ্রণ আছে। উদাহরণস্বরূপ,
E1b1b হ্যাপ্লোগ্রুপ (Y-DNA) উত্তর আফ্রিকায় সাধারণ, যা জেবেল ইর্হৌদের মানুষের সাথে যুক্ত। এছাড়া, mtDNA U6 লাইনেজ দেখায় যে, এরা দক্ষিণ এবং পূর্ব আফ্রিকার জনগোষ্ঠীর সাথে জিন বিনিময় করেছিল। এই পরোক্ষ জেনেটিক বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে, জেবেল ইর্হৌদের মানুষ ছিলেন প্যান-আফ্রিকান নেটওয়ার্কের অংশ। তাদের জিন বয়ে গিয়েছিল সাহারার সবুজ উপত্যকা হয়ে দক্ষিণে, রিফট ভ্যালিতে পূর্বে। আজকের মিশরীয়, লিবিয়ান এবং আলজেরিয়ানদের ডিএনএ-তে এই প্রাচীন উত্তর আফ্রিকান সঙ্কেতে লুকিয়ে আছে।

আফ্রিকার অভ্যন্তরে মানুষের এই মিশ্রণকে যদি আদিম মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হয়, তাহলে পরবর্তী পর্যায়ের বিচারে আসবে- আফ্রিকা থেকে বেড়িয়ে আসা মানুষর জিন-প্রকৃতি। আদিম মানুষের ভিত্তিকে উত্তর আফ্রিকা ধরলে- এই তালিকায় পাওয়া যাবে- উত্তর আফ্রিকা দেশসমূহে বসবাসরত মনুষ্য গোষ্ঠীগুলোর দিকে। এই দেশগুলো হল- এ্যাঙ্গোলা, বোৎসোয়ানা, এসওয়াতিনি (প্রাক্তন নাম সোয়াজিল্যান্ড), লেসোথো, মালাওয়াই, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও জাম্বিয়া এবং জিম্বাবুয়ে।

উত্তর আফ্রিকাকে বাদ দিলে তিনি প্রধা অভিযাত্রী দলের নাম পাওয়া যায় এগুলো হলো-

প্রায় ২ .৬ থেকে ৩.৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে দিকে এদের একটি দল ইথিওপিয়া অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল। পরে এরা ইউরেশিয়া হয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইউরোপের গ্রিসের আপিডিমা গুহায় প্রাপ্ত  মানুষের জীবাশ্মের বয়স নিরূপণ করা হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব ২ লক্ষ ১০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। আর এশিয়ার ইস্রায়িলের প্রাপ্ত প্রাচীনতম মানুষের জীবাশ্মের বয়স নিরূপণ করা হয়েছে ১ লক্ষ ৯০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এ থেকে ধারণা করা যায়- আফ্রিকা থেকে আগত মানবগোষ্ঠী ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২ লক্ষ বছরের দিকে।

আবহাওয়ার অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছিল বরফযুগের কারণে। ১.৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে তাপমাত্রা অভাবনীয়ভাবে কমে গিয়েছিল। এর ফলে হিমবাহের সৃষ্টি হয়েছিল ইউরোপ জুড়ে। এই হিমবাহ যুগের ১ লক্ষ ৩৫ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে পৃথিবীর তাপমাত্রা ব্যাপকভাবে কমে গি্য়েছিল। এই সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল ইমিয়ান আন্তঃ হিমবাহ অধিযুগ (Eemian interglacial)। এর ফলে বিষুব অঞ্চলে বরফের প্রভাব কমে গিয়েছিল। এর ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলের বরফ গলে গিয়ে সাগরের জলরাশি বৃদ্ধি করেছিল। এছাড়া বিশাল বিশাল বরফের স্তূপগুলোর তলদেশ দুর্বল হয় পড়ার কারণে বড় বড় হিমবাহ সচল হয়ে উঠেছিল। ১,৩০,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই তাপমাত্রা কমে গেলেও,  বর্তমান পৃথিবীর তাপমাত্রার চেয়ে কিছুটা বেশি ছিল। বিশেষ করে বর্তমান কালের উত্তর মেরু অঞ্চলের তাপামাত্রার চেয়ে প্রায় ২-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। ফলে উত্তর মেরুতে বনভূমিতে কাষ্ঠাল বৃক্ষের উদ্ভব হয়েছিল। নরওয়ের তুন্দ্রা অঞ্চল এবং ফিনল্যান্ড অঞ্চলে হ্যাজেল ও ওক গাছের বিস্তার ঘটেছিল।

জীববিজ্ঞানীদের মতে ১.৩ লক্ষ থেকে ৮০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে মানুষের দেহকোষে
mitochondrial haplogroup (L2)-এর আবির্ভাব হয়েছিল। আফ্রিকার উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের আদিম জনগোষ্ঠীর দেহে আদি এল২-এর বিকাশ ঘটেছিল। বহির্গোত্রীয় নারী-পুরুষের যৌনসংসর্গে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ভিতরে সঞ্চলিত হয়েছিল।

১,২৫,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে পৃথিবীর তাপমাত্রা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছিল। পৃথিবীর হিমবাহগুলো নিঃশেষ হয়ে না গেলেও, ব্যাপক হ্রাস পেয়েছিল। এই সময় জলহস্তীদের একটি অংশ জার্মানির রাইন এবং ইংল্যান্ডের টেমস নদীতে আশ্রয় নিয়েছিল। আর ক্যানাডার বাফিন দ্বীপ এবং  মেরুসংলগ্ন দ্বীপগুলোতে বৃক্ষের সম্প্রসারণ ঘটেছিল। গ্রীষ্মকালে বর্তমান আলাস্কার উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জমাট বরফের অস্তিত্ব ছিল না।

এরপর পৃথিবীর তাপমাত্রা আবার কমা শুরু করেছিল। ১,১৫,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে তাপমাত্রা ব্যাপকভাবে কমে গিয়ে আবার বরফের স্তূপ জমে উঠা শুরু হয়েছিল। এবং এই সূত্রে শুরু হয়েছিল শেষ হিমবাহ অধিযুগ। ১,১০,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে তাপমাত্রা এই অধিযুগের শুরু হয়েছিল। এরই ভিতরে ৯৫,০০০ থেকে ২০,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে উত্তর আমেরিকা এবং কানাডার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বরফে ঢাকা পড়েছিল। বিজ্ঞানীরা এই অঞ্চলের বরফ-আবরণের নাম দিয়েছেন- লাউরেন্টিড বরফ আবরণ (Laurentide Ice Sheet)। জমাটবদ্ধ বরফের বিশাল আবরণের ফলে ভূপ্রকৃতিতে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটেছিল।  সেই সাথে গ্রীষ্মকালে সৃষ্টি হয়েছিল বিশালাকার হিমবাহ। তবে আলাস্কার উপকূলীয় ভাগে বরফ মুক্ত ছিল। তবে আমেরিকার রকি পর্বব্তমালা বরফে ঢেকে গিয়েছিল। সাইবেরিয়ার নেভাদা তুষারটুপির উদ্ভব হয়েছিল এই সময়। এছাড়া স্ক্যান্ডেনেভিয়ান তুষার ক্ষেত্রে ব্রিটেন, ইউরোপের মূল ভূখণ্ড, উত্তর-পশ্চিম এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছিল। এই সময় এ সকল দেশসংলগ্ন অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে হিমশৈলের আধিক্য ঘটেছিল। অন্যদিকে দক্ষিণ মেরু এবং এর সংলগ্ন সাগর জল বিশাল বরফক্ষেত্র তৈরি করেছিল। এর প্রভাবের অস্ট্রেলিয়ার কিছু অংশ বরফের আবরণে ঢাকা পড়েছিল। এই বরফ বলয়ে আটকা পড়েছিল নিউজিল্যান্ড এবং তৎসংলগ্ন দ্বীপপুঞ্জগুলো। দক্ষিণ আমেরিকার চিলি,  পশ্চিম নিউ গায়না, ইন্দোনেশিয়াতে এর প্রভাব পড়েছিল ব্যাপকভাবে।

পৃথিবীর শেষ বরফযুগের টানোপোড়নের বিরাট প্রভাব পড়েছিল উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতে। বিশেষ করে পৃথিবীর বহু স্থান বরফের কারণে উদ্ভিদশূন্য হয়ে পড়েছিল। ফলে প্রাণিকূলে খাদ্য সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল। এক দিকে ছিল প্রচণ্ড শীত, অন্যদিকে ছিল খাদ্যাভাব। উভয় সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য, মানুষ আফ্রিকার অভ্যন্তরে এবং আফ্রিকার বাইরে ইউরেশিয়ার দিকে পা বাড়িয়েছিল।


সূত্র: