মানব সভ্যতার কালানুক্রমিক ইতিহাস
দ্বিতীয় পর্ব
(৩.৫ লক্ষ থেকে ৫০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)

আয়োনিয়ান আমল (৭.৮১- ১.২৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) মাঝামাঝি সময়ে, সাড়ে তিন লক্ষ বৎসর আগে প্রাইমেট বর্গের অন্তর্গত হোমিনিডি গোত্রের হোমো গণের অন্তর্গত Homo sapiens এর আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকার মরোক্কোর জেবেল ইর্হৌদ (Jebel Irhoud) -তে। এখান থেকে শুরু আধুনিক মানুষের প্রাগৈতিহাসিক যুগ। এই সময়ের ভিতরে পাশাপাশি পাথুরে যুগকে সচল রেখেছিল- হোমো হাইডেলবার্গেনসিস হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দলগুলো। নিম্ন প্রস্তর যুগের আদিম পর্যায়ে সৃষ্টি হয়েছিল আদিম পাথরে অস্ত্র। এই সময় আগুনের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। এবং নিম্ন পর্যায়ের ভাষার ব্যবহার শিখেছিল। তবে প্রথম পর্বে কোনো শিল্পকর্মের নমুনা পাওয়া যায় নি। সম্ভবত ভাষার পাশাপাশি এদের ভিতরে সঙ্গীতের আদিম রূপ বিকশিত হয়েছিল। কিন্তু এই সময়ের কোনো বাদ্যযন্ত্রের নমুনা পাওয়া যায় নি।

মানব সভ্যতার দ্বিতীয় পর্যায় দেখা যায়, ব্যাপক শিল্পকর্মের নমুনা। এর ভিতরে ছিল পাথরের ভাস্কর্য, পর্বত গুহায় খোদিত, অঙ্কিত চিত্রকর্ম ও নানা ধরনের প্রতীকী চিহ্ন। একই সাথে লক্ষ্য করা যায় পাথুরের অস্ত্রের উন্নয়নের ধারা।

আয়োনিয়ান আমল ৩.৫ থেকে ১.২৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত

হোমো স্যাপয়েন্সদের বিকাশ
প্রায় ৩.৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আবির্ভূত হোমো স্যাপিয়েন্সদের আভির্ভাব হয়েছিল আফ্রিকার মরোক্কোতে। সম্ভবত পরবর্তী ৩০-৩৫ হাজার বছর ধরে এদের বিচরণক্ষেত্র ছিল মরোক্কোর বনভূমিতে। এই সময়ের ভিতরে নিজেদের প্রচেষ্টায় কিম্বা হোমো হাইডেলবার্গেনসিসহোমো নিয়ানডার্থালেনসিসদের অনুসরণে এরা আগুন জ্বালানো এবং নিয়ন্ত্রণ করা শিখেছিল।

এই অঞ্চলের জীবাশ্মের সাথে প্রাপ্ত অন্যান্য উপকরণের ভিতরে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো ছিল দাহ্য কয়লা এবং অর্ধদগ্ধ গ্যাজেলের হাড়। সম্ভবত এরা আগুন জ্বালানোর জন্য কয়লার ব্যবহার করতো। সম্ভবত গ্যাজেলের হাড়- আগুন উস্‌কে দেওয়া বা মাংস ঝলসানোর দণ্ড হিসেবে ব্যবহার করতো। 

 মরোক্কোর জেবেল ইর্হৌদে প্রাপ্ত ৩.১৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের আদিম অস্ত্রের নমুনা

লেভালয়িস যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন
সম্ভবত একইভাবে এই দুটি জনগোষ্ঠীর অনুসরণে আশুলিয়ান যন্ত্রপাতি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা শিখেছিল। উন্নত মস্তিষ্কের সুবাদে এরা দ্রুত অগ্রসর জাতিতে পরিণত হয়েছিল। পুরানো অস্ত্র  তৈরির প্রক্রিয়া ত্যাগ করে নতুন পদ্ধতিতে এবং অধিকতর ব্যবহার-উপযোগী লেভালয়িস যন্ত্রপাতি নির্মাণ কৌশল উদ্ভাবন করেছিল। বিশেষ কৌশলে নির্মিত এই অস্ত্রের আদিমতম রূপটির বিকাশ ঘটেছিল প্রায় ৩.১৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মরক্কোর জেবেল অঞ্চলে। এই পদ্ধতির অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে এরা বেছে নিয়েছিল সাধারণ পাথরের পরিবর্তে বিভিন্ন স্ফটিক পাথরের ফলক। এরা বড় কোনো স্ফটিক পাথরের গা থেকে সতর্কতার সাথে পাতলা পাত বের করে নিত। পরে এই পাতের প্রান্তদেশ ঘষে ঘষে তীক্ষ্ণ করে নিতো। এই এই বিশেষ ধরনের অস্ত্রের কারণে এরা শিকারের দেহে আঘাত করে অধিকতর গভীর ক্ষত তৈরি করতো। এছাড়া এই জাতীয় অস্ত্র ব্যবহার করে এরা শিকারকৃত পশুর মাংস হাড় থেকে করতে পারতো। সম্ভবত কচি ডালাপালা কাটা বা থেঁৎলানোর জন্য এই অস্ত্রগুলো ব্যবহার করতো। সম্ভবত সাধারণ পাথরের পরিবর্তে এরা রঙবেরঙে বাহারি স্ফটিক পাথরে ব্যবহার করতো, এদের কাঠিন্য ধারালো করার সহজতর বলেই।। এই সূত্রে এরা আদিম পর্যায়ের হোমো নিয়ানডার্থালেনসিসদের সাথে আঞ্চলিকতার দ্বন্দ্বে জয়লাভ করতে পেরেছিল।

জীবাশ্ম প্রাপ্তির সূত্রে জানা যায় ২.৭৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাদের ভিতরে পূর্ব আফ্রিকার গাদেমোত্তা অঞ্চলে মানুষ বসতি স্থাপন করেছিল। অন্যদিকে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ইস্রায়েল থেকে মানুষের যে প্রাচীন জীবাশ্ম (চোয়ালের হাড়) পাওয়া গেছে, তার বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১.৭৭ লক্ষ খ্রিষ্টাব্দ। এই বিচারে ধারণা করা হয় ২.৭৭ থেকে ১.৭৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে মানুষ আফ্রিকা থেকে এশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিল। এর কাছাকাছু সময়ে ১.৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এর ভিতরে হোমো স্যাপিয়েন্সের একটি উপ-প্রজাতি ১ লক্ষ ৬০ হাজার বৎসর আগে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হয়েছিল। এই প্রজাতিটি হলো Homo sapiens idaltu। আধুনিক মানুষের মূল প্রজাতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়-  Homo sapiens sapiens উপ-প্রজাতিকে।

২.৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রাপ্ত লেভালয়িস যন্ত্রপাতির নমুনা

প্রায় ২.৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে আফ্রিকার সাব-সাহারান অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। আফ্রিকার ভিতরে বিশেষ করে এদের অভিযাত্রা পথ ছিল ইথিওপিয়া, কেনিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা অভিমুখে। ইথিওপিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ওমো প্রত্নক্ষেত্রে এদের জীবাশ্ম প্রাপ্তির সূত্রে ধারণা করা হয় ৩.৫ থেকে  থেকে ২.৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে  হোমো স্যাপিয়েন্সরা বর্তমান ইথিওপিয়ার দিকে চলে এসেছিল। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে এখান থেকে প্রাপ্ত জীবাশ্ম থেকে অনুমান করা হয়, এরা ২.৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এই অঞ্চলে এসে পৌঁছেছিল। অবশ্য কেউ কেউ এখান থেকে পাওয়া করোটিটি হোমো হাইডেলবার্গেনসিস। এই করোটির মাপ ছিল ১৪০০ কিউবিক সেন্টিমিটার।

পরে এদের একটি দল ইউরেশিয়া হয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইউরোপের গ্রিসের আপিডিমা গুহায় প্রাপ্ত  মানুষের জীবাশ্মের বয়স নিরূপণ করা হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব ২ লক্ষ ১০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। আর এশিয়ার ইস্রায়িলের প্রাপ্ত প্রাচীনতম মানুষের জীবাশ্মের বয়স নিরূপণ করা হয়েছে ১ লক্ষ ৯০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এ থেকে ধারণা করা যায়- আফ্রিকা থেকে আগত মানবগোষ্ঠী ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২.৫ লক্ষ বছরের দিকে।

দক্ষিণ আফ্রিকার আদি হোমো স্যাপিয়েন্স
হোমো স্যাপিয়েন্সদের ভ্রাম্যমান দলগুলো আফ্রিকা অভ্যন্তরে দুটি ধারায় বিভাজিত হয়েছিল। এই দল দুটি হলো আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চল। আফ্রিকা আধুনিক রাষ্ট্রীয় বিভাজন অনুসারে এই দুই অঞ্চলে যে সকল দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তা হলো-

জীববিজ্ঞানীদের মতে ১.৩ লক্ষ থেকে ৮০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে মানুষের দেহকোষে mitochondrial haplogroup (L2)-এর আবির্ভাব হয়েছিল। আফ্রিকার উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের আদিম জনগোষ্ঠীর দেহে আদি এল২-এর বিকাশ ঘটেছিল। পরে এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বৈবাহিকসূত্রে ছড়িয়ে পড়েছিল।

এই দলের একটি বড় অংশ ১ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন ও
নর্থ কেপ শহরের নিকটবর্তী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। এখানে এদের হাতে তৈরি হয়েছিল প্রাচীনতম শিল্পকর্ম। এরা পাহড়ের গুহা বাস করতো। আর সেই গুহাকে অলঙ্কৃত করেছিল চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে। এই গুহাচিত্রগুলো হলো-

ইউরোপে আধুনিক মানুষের প্রবেশ
প্রায় ৮০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে ইউরোপে আধুনিক মানুষ প্রবেশ করেছিল। এদের সাথে অন্যান্য হোমোগণের সদস্যদের সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাত করে ধীরে ধীরে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করে নিয়েছিল। বিশেষ করে ইউরোপের উল্লেখযোগ্য সকল গুহাই দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। ৪৩ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এরা ইউরোপে অন্য জাতিতে পরিণত হয়েছিল। এর ভিতর দিয়ে ক্রো-ম্যাগনান সভ্যতার পত্তন ঘটিয়েছিল।

এরপর এরা ইউরোপের আইবেরিয়ান উপদ্বীপ (জিব্রাল্টার) থেকে রাশিয়ার উরাল অঞ্চল পর্যন্ত নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পাওয়া গেছে প্রায়
৩৫০টি চিত্রকর্ম-গুহা। এর ভিতরে প্রায় অর্ধেক নমুনা পাওয়া গেছে উত্তর স্পেন এবং দক্ষিণ ফ্রান্সে। প্রায় ৪০ থেকে ১০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এ সকল গুহাচিত্র অঙ্কিত হয়েছিল। সব মিলিয়ে এই আঞ্চলিক শিল্পকর্মকে আঞ্চলিকতার বিচারে একে ফ্রাঙ্কো-ক্যান্টাবেরিয়ান শিল্পকর্ম (Franco-Cantabrian Cave Art) নাম অভিহিত করা হয়।

নিয়ানডার্থালদের সভ্যতার বিকাশ ও অভিযাত্রা
এর পাশাপাশি
৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস জনগোষ্ঠী আফ্রিকার মরক্কো অঞ্চলে বসতি গড়ে তুলেছিল এবং  প্রায় ৩ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এরা এই অঞ্চলের একটি শক্তিশালী জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবহাওয়ার অভাবনীয় পরিবর্তনের ফলে এরা খাদ্যাভাবে পড়ে যায়। ফলে এরা ৩ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে দলে দলে প্রথমে ইউরেশিয়াতে প্রবেশ করেছিল। পরবর্তী ২ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এরা মধ্য এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর এদের কিছু অংশ ১.৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে ।

আবহাওয়ার অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছিল বরফযুগের কারণে। ১.৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে তাপমাত্রা অভাবনীয়  ভাবে কমে গিয়েছিল। এর ফলে হিমাবাহের সৃষ্টি হয়েছিল ইউরোপ জুড়ে। এই হিমবাহ যুগের ১ লক্ষ ৩৫ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে পৃথিবীর তাপমাত্রা ব্যাপকভাবে কমে গি্য়েছিল। এই সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল ইমিয়ান আন্তঃ হিমবাহ অধিযুগ (Eemian interglacial)এর ফলে বিষুব অঞ্চলে বরফের প্রভাব কমে গিয়েছিল। এর ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলের বরফ গলে গিয়ে সাগরের জলরাশি বৃদ্ধি করেছিল। এছাড়া বিশাল বিশাল বরফের স্তূপুলোর তলদেশ দুর্বল হয় পড়ার কারণে বড় বড় হিমবাহ সচল হয়ে উঠেছিল। ১,৩০,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই তাপমাত্রা কমে গেলেও,  বর্তমান পৃথিবীর তাপমাত্রার চেয়ে কিছুটা বেশি ছিল। বিশেষ করে বর্তমান কালের উত্তর েরু অঞ্চলের তাপামাত্রার চেয়ে প্রায় ২-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। ফলে উত্তর মেরুতে বনভূমিতে কাষ্ঠাল বৃক্ষের উদ্ভব হয়েছিল। নরওয়ের তুন্দ্রা অঞ্চল এবং ফিনল্যান্ড অঞ্চলে হ্যাজেল ও ওক গাছের বিস্তার ঘটেছিল।

১,২৫,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে পৃথিবীর তাপমাত্রা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছিল। পৃথিবীর হিমবাহগুলো নিঃশেষ হয়ে না গেলে, ব্যাপক হ্রাস পেয়েছিল। এই সময় জলহস্তীদের একটি অংশ জার্মানির রাইন এবং ইংল্যান্ডের টেমস নদীতে আশ্রয় নিয়েছিল। আর ক্যানাডার বাফিন দ্বীপ এবং  মেরুসংলগ্ন দ্বীপগুলোতে বৃক্ষের সম্প্রসারণ ঘটেছিল। গ্রীষ্মকালে বর্তমান আলাস্কার উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জমাট বরফের অস্তিত্ব ছিল না।

এরপর পৃথিবীর তাপমাত্রা আবার কমা শুরু করেছিল।
১,১৫,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে তাপমাত্রা ব্যাপকভাবে কমে গিয়ে আবার বরফের স্তূপ জমে উঠা শুরু হয়েছিল। এবং এই সূত্রে শুরু হয়েছিল শেষ হিমবাহ অধিযুগ। ১,১০,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে তাপমাত্রা এই অধিযুগের শুরু হয়েছিল। এরই ভিতরে ৯৫,০০০ থেকে ২০,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে উত্তর আমেরিকা এবং কানাডার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বরফে ঢাকা পড়েছিল। বিজ্ঞানীরা এই অঞ্চলের বরফ-আবরণের নাম দিয়েছেন- লাউরেন্টিড বরফ আবরণ (Laurentide Ice Sheet)। জমাটবদ্ধ বরফের বিশাল আবরণের ফলে ভূপ্রকৃতিতে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটেছিল।  সেই সাথে গ্রীষ্মকালে সৃষ্টি হয়েছিল বিশালাকার হিমবাহ। তবে আলাস্কার উপকূলীয় ভাগে বরফ মুক্ত ছিল। তবে আমেরিকার রকি পর্বব্তমালা বরফে ঢেকে গিয়েছিল। সাইবেরিয়ার নেভাদা তুষারটুপির উদ্ভব হয়েছিল এই সময়। এছাড়া স্ক্যান্ডেনেভিয়ান তুষার ক্ষেত্রে ব্রিটেন, ইউরোপের মূল ভূখণ্ড, উত্তর-পশ্চিম এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছিল। এই সময় এ সকল দেশসংলগ্ন অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে হিমশৈলের আধিক্য ঘটেছিল। অন্যদিকে দক্ষিণ মেরু এবং এর সংলগ্ন সাগর জল বিশাল বরফক্ষেত্র তৈরি করেছিল। এর প্রভাবের অস্ট্রেলিয়ার কিছু অংশ বরফের আবরণে ঢাকা পড়েছিল। এই বরফ বলয়ে আটকা পড়েছিল নিউজিল্যান্ড এবং তৎসংলগ্ন দ্বীপপুঞ্জগুলো। দক্ষিণ আমেরিকার চিলি,  পশ্চিম নিউ গায়না, ইন্দোনেশিয়াতে এর প্রভাব পড়েছিল ব্যাপকভাবে।

পৃথিবীর শেষ বরফযুগের টানোপোড়নের বিরাট প্রভাব পড়েছিল উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতে। বিশেষ করে পৃথিবীর বহু স্থান বরফের কারণে উদ্ভিদশূন্য হয়ে পড়েছিল। ফলে প্রাণিকূলে খাদ্য সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল। এক দিকে ছিল প্রচণ্ড শীত, অন্যদিকে ছিল খাদ্যাভাব। উভয় সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য, মানুষ আফ্রিকার অভ্যন্তরে এবং আফ্রিকার বাইরে ইউরেশিয়ার দিকে পা বাড়িয়েছিল।

নিয়ানডার্থাল-মানবগোষ্ঠীর শিল্পকর্ম
আগেই উল্লেখ করেছি যে,
সম্ভবত প্রায় ৪ থেকে সাড়ে লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সেই সাথে খাদ্যাভাবের কারণে,  নিয়ানডার্থালদের একটি অংশ ইউরেশিয়ায় প্রবেশ করেছিল। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার তাগিদে এরা নানা ধরনের পাথুরে অস্ত্রশস্ত্র এবং যন্ত্রপাতি তৈরি করার কৌশল আয়ত্ত করেছিল। এর বাইরে সৌন্দর্য-সুখের তাড়নায় এরা নানা ধরনের শৈল্পিক সৃষ্টির দিকে হাত বাড়িয়েছিল।

এদের হাতে গড়ে উঠেছিল আদিম প্রস্তরযুগের সভ্যতা। এই অঞ্চলে পাওয়া গেছে আদিম ভাস্কর্য টান-টানের ভেনাস। ৫ থেকে সাড়ে লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে নিয়ানডার্থালদের একটি দল আফ্রিকার মরোক্কোর বর্তমান টান-টান নগরীর অদূরে বসতি স্থাপন করেছিল। সম্ভবত এই সময় আদি মাতৃদেবীর ধারণা বিকশিত হয়েছিল। সেই সূত্রে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট মানবীর আকৃতির প্রস্তর খণ্ডকে এরা মাতৃদেবীর প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছিল। পরে এই মূর্তিটি সংস্কার করে নতুন রূপ দিয়েছিল। স্ফটিক পাথরের নির্মিত এই মূর্তিটির উচ্চতা প্রায় ৬ ইঞ্চি, প্রস্থ প্রায় ২.৬ ইঞ্চি। ওজন প্রায় ১০ গ্রাম। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে এই মূর্তিটি আবিষ্কার করেছিলেন জার্মানির প্রত্নতত্ত্ববিদ লুৎজ ফিয়েডলার (Lutz Fiedler) । মরক্কোর টান-টান নগর থেকে কিছু দূরে ড্রা নদীর তীরে এই মূর্তিটি তিনি পেয়েছিলেন। পরে টান-টান নগরের নামানুসারে এর নামকরণ করেছিলেন টান-টান-এর ভেনাস (Venus of Tan-Tan)

খ্রিষ্টপূর্ব ৭০ থেকে ৪০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে উত্তর-পশ্চিম ফ্রান্সের পারব্ত্য অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। এখানে এদের দ্বারা এখানে পত্তন হয়েছিল মৌস্টারিন সভ্যতার।  এই সময় এরা আগুন জ্বালাতে শিখেছিল। সম্ভবত এরা শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পশুর চামড়া গায়ে জড়িয়ে রাখতো। হিংস্র পশু এবং প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পর্বত গুহায় বসবাস করতো। নিজেদের ভিতরে তথ্য আদান প্রদানের মতো নিম্নস্তরের ভাষার বিকাশ ঘটেছিল। এদের খাদ্য তালিকায় ছিল পশুর মাংস এবং নানা ধরনের ফলমূল। এদের ভিতরে মৃতদেহ কবরস্থ করার রীতি গড়ে উঠেছিল।

সম্ভবত এদের ভিতরে আদিম গান এবং নৃত্যের চর্চা ছিল। এছাড়া চিত্র অঙ্কনের অভ্যাস  গড়ে উঠেছিল। এরা গুহারে পাথুরে দেওয়ালে পেয়ালার অবয়ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। এগুলো এরা তৈরি করেছিল গুহাগুলোকে শৈল্পিকভাবে সাজানোর তাগিদে। এর অন্যতম নমুনা স্থান হিসেবে উল্লেখ করা যায়- ফ্রান্দের লা ফেরাসসিয়ের গুহাকে। ধারণা করা হয়, এই দেওয়াল সজ্জার নমুনা'র বয়স ধরা হয়েছে ৬০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এই দেওয়াল সজ্জার নাম দেওয়া হয়েছে '
La Ferrassie Cave Cupules' টান-টানের ভেনাস-এর মতো এখানে কোনো নারী মূর্তি পাওয়া যায় নি বটে, তবে দেওয়াল খোদিত করে নারী যোনী'র চিত্র অঙ্কন করেছিল। সম্ভবত এটিও ছিল আদি দেবীর প্রতীক। এর ভিতর দিয়ে তৈরি হয়েছিল যোনি চিহ্ন ও প্রতীকপ্রাক-সুমেরিয়ান প্রতীক হিসেবে খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দের দিকে লিখন পদ্ধতিতে যোনি চিহ্ন যুক্ত হয়েছিল নারী অর্থে। এর সাথে কাপড়ের চিহ্ন যুক্ত হয়ে তৈরি হয়েছিল 'প্রাপ্তবয়স্কা'র প্রতীক।


নারী

কাপড়

প্রাপ্তবয়স্কা

নিয়ানডার্থাল-মানবগোষ্ঠীর সঙ্গীতবোধ
সঙ্গীতের প্রতি হোমো গণের আদিম প্রজাতির ভিতরে কখন আগ্রহ জন্মেছিল, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। সুমিষ্ট ধ্বনি যে বিশেষভাবে মোহিত করে, তারই চর্চার ভিতর দিয়ে সুরের উদ্ভব হয়েছিল। একই সাথে ছন্দ ও নৃত্যের বিকাশ ঘটেছিল ধীরে ধীরে। সুরের প্রতি প্রবল আগ্রহ এবং চর্চার ভিতর দিয়ে এদের মাধ্যমে পাতার তৈরি রিড জাতীয় বাদ্যকৌশল। একই সাথে উদ্ভব হয়েছিল নলাকার নলখাগড়া জাতীয় উদ্ভিদ থেকে তৈরি হয়েছিল নলাকার বাশি। এদের কেউ কেউ উদ্ভিজ নলাকার বস্তুর পরিবর্তে অস্থি থেকে বাঁশি তৈরি করেছিল। এই সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল ডিভ্‌জে বাবে বাঁশি উল্লেখ্য, ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে স্লোভেনিয়ার ডিভ্‌জে বাবে প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্রের একটি অনুভূমিক গুহা থেকে এদের তৈরি একটি বাঁশির সন্ধান পাওয়া গেছে। এই বাঁশি ডিভ্‌জে বাবে বাঁশি নামেই প্রচলিত। উল্লেখ্য, প্রায় ৪১,৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বাঁশিটি তৈরি হয়েছিল।  প্রাপ্ত বাঁশিটি তৈরি হয়েছিল গুহাভল্লুকের উরুর অস্থি থেকে।

ইরেক্টাসদের অভিযাত্রা এবং ক্রমবিকাশ
প্রায় ২,৩০,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আফ্রিকা থেকে আগত হোমো ইরেক্টাসরা, বর্তমান ইস্রায়ে অধিকৃত গোলন মালভূমির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত রাম হ্রদে কাছে বসতি স্থাপন করেছিল। এই অঞ্চলে পাওয়া গেছে বিখ্যাত ভাস্কর্য নারীর মূর্তি হিসেবে এর নামকরণ করা হয়েছে 'বেরেখাত রানের ভেনাস' (Venus of Berekhat Ram)। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের গ্রীষ্মকালে গোলান মালভূমি থেকে, হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয় অফ জেরুজালেম-এর প্রত্নতত্ত্ববিদ নামা গোরেন-ইনবার এই ভাস্কর্যটি আবিষ্কার করেছিলেন। এটি ছিল একটি নারী মূর্তি।

ইরেক্টাসরা নিয়ানডার্থাল ও আধুনিক মানুষের চেয়ে অস্ত্র তৈরি এবং যুদ্ধ কৌশলে অনেকটা পিছিয়েছিল। ফলে এই জনগোষ্ঠীর কাছে পরাজিত হতে হতে, নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছিল। ফলে ৫০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এদের এর সকল উপপ্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।