মানুষ (হোমো স্যাপিয়েন্স)
ইংরেজি : homo, man, human being, human
সমার্থক বাংলা নাম: জন, মনুষ্য, মানব, মানুষ, লোক। আধুনিক মানুষের প্রজাতিগত পরিচয় হলো- Homo sapiens (হোমো স্যাপিয়েন্স)।

জীববিজ্ঞানের শ্রেণিবিন্যাসের বিচারে মানুষ হলো- হোমিনিডিগোত্রের হোমো গণের একটি প্রজাতি। দৈহিক বৈশিষ্টের বিচারে এরা ভূমির উপর দুই পায়ে সরলভাবে দাঁড়াতে এবং চলাচল করতে পারে। মনোজগতের বিচারে এরা বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে এরা অন্যান্য প্রজাতির চেয়ে শ্রেষ্ঠতর এবং সৃজন-ক্ষমতার অধিকারী। সৃজনশীল ক্ষমতার দ্বারা এরা নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিজেদের প্রয়োজনীয় জীবনধারণের উপকরণ প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করতে পারে এবং উপাদনসমূহ থেকে নানাবিধ উপকরণ তৈরি করতে পারে। উন্নত মানসিক ভাবনার দ্বারা চিত্তবিনোদনের জন্য নানাবিধ বিমূর্তভাবনা উপস্থাপন করতে পারে। এছাড়া বাক্‌প্রত্যঙ্গ দ্বারা সৃষ্ট ভাষার সাহায্যে সুচারুরূপে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে।

হোমো গণের প্রজাতিগুলোর বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করলে দেখা যায়, মানুষ-সহ অন্যান্য প্রজাতির ভিতর আদিম মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলো বিকশিত হয়েছিল। এই বিচারে হোমো গণের সকল প্রজাতিই এক অর্থে মানুষ।

এরা এককভাবে দুর্বল, কিন্তু সমষ্টিগতভাবে প্রবল। আদিম মানবগোষ্ঠী নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার স্বার্থে দলগত ঐক্য বজায় রাখার জন্য সচেষ্ট ছিল। এই কারণে এরা দলের সকলের প্রতি যত্নশীল হয়ে উঠেছিল। সৃজনী ক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তা এবং দলগত ঐক্যের ভিতর দিয়ে হোমো গণের প্রজাতিরা সমকালীন অন্যান্য প্রজাতির উপর প্রভুত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়ে উঠেছিল। এর ভিতরে সর্বশেষে প্রজাতি হলো- হোমো স্যাপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষ।

প্রজাতিগত বিবর্তনের ধারায় আধুনিক মানুষুষ
হোমো গণের অজ্ঞাত কোনো এক প্রজাতি থেকে ২৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আফ্রিকাতে হোমো হ্যাবিলিস নামক প্রজাতির বিকাশ ঘটেছিল। ১৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এদের দ্বারা আদি মানবগোষ্ঠীর নিম্ন-প্রস্তর যুগের তান্জানিয়ার ওল্ডুভাই জর্জ (Olduvai Gorge) অঞ্চলে। এই অঞ্চলে বিকশিত সভ্যাতাকে সাধারণভাবে বলা হয় ওল্ডুভিয়ান সভ্যতা

এরপর হোমো গণ থেকে ২০ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে হোমো ইরেক্টাসদের আবির্ভাব ঘটেছিল। আধুনিক মানুষের সাথে এদের অনেক মিল থাকলেও সৃজনশীল ক্ষমতার বিচারে মানুষের সমকক্ষ ছিল না। আর বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল ৪ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে। এরাই আফ্রিকার বাইরে এসে চীন ও ইন্দোনেশিয়া নিজেদের সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। বর্তমানে এদেরকে জাভা মানব এবং পিকিং মানব নামে অভিহিত করা হয়।
 

ধারণা করা হয় প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ বৎসর আগে প্রাইমেট বর্গের অন্তর্গত হোমিনিডি গোত্রের হোমো গণের অন্তর্গত Homo sapiens এর আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকার মরোক্কোর জেবেল ইর্হৌদ (Jebel Irhoud) -তে। উল্লেখ্য আগে মনে করা হতো, দুই লক্ষ বৎসর আগে আদি মানুষের উদ্ভব ঘটেছিল ইথিওপিয়া অঞ্চলে। উল্লেখ্য, হোমো স্যাপিয়েন্সের একটি উপ-প্রজাতি ১ লক্ষ ৬০ হাজার বৎসর আগে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হয়েছিল। এই প্রজাতিটি হলো Homo sapiens idaltu। আধুনিক মানুষের মূল প্রজাতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়-  Homo sapiens sapiens উপ-প্রজাতিকে।

আধুনিক মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম হলো- Homo sapiens । ল্যাটিন sapiens -এর অর্থ হলো জ্ঞানী মানুষ। হোমো গণের আগের প্রজাতিগুলোর থেকে এই প্রজাতির মূল পার্থক্য হলো- এর বুদ্ধিমত্তা। এমন কি নিয়ানডার্থালদের (হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস) সাথে মস্তিষ্কের পরিমাপগত মিল (১৭০০ সিসি) থাকলেও বুদ্ধিমত্তার বিচারে Homo sapiens আরও অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছে।

মানুষের জাতিসত্তা
প্রজাতিগতভাবে মানুষ একটি প্রাণিসত্তার সমষ্টিগত নাম। আফ্রিকা থেকে উৎপন্ন হোমো স্যাফিয়েন্সরা কালক্রমে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে, নতুন নতুন প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং এর সাথে জীবন সংগ্রাম, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির কারণে এদের দেহগত নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটে। কালক্রমে দেহগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে পৃথক পৃথক রূপ লাভ করে। দৈহিক বৈশিষ্ট্যের বিচারে এদেরকে নানাভাগে ভাগ করা হয়। 

 

খাদ্য
মানুষ সর্বভুক প্রাণী। আদিম মানুষ সবকিছুই কাঁচা খেতো। আগুন আবিষ্কারের পর থেকে মানুষ ফল জাতীয় খাবার ছাড়া সবকিছুই রান্না করে খায়। মানুষ প্রাকৃতি থেকে অবিকৃত খাদ্য-উপাদান সরাসরি খায় আবার প্রাকৃতিক উপকরণগুলোকে নানা প্রক্রিয়া খাদ্যে পরিণত করে গ্রহণ করে। মানুষ প্রধান খাদ্য তালিকার অন্যতম উপকরণ শর্করা জাতীয় খাদ্য। এই খাদ্য মানুষ সংগ্রহ করে ধান বা গম জাতীয় শস্য থেকে। মানুষ আমিষের চাহিদা মেটায় নানা ধরনের প্রাণী থেকে। কিছু আমিষের চাহিদা মেটায় আমিষ-সমৃদ্ধ খাবার থেকে। চর্বিজাতীয় খাবার, বনজ ফল ও তেলসমৃদ্ধ বীজ থেকে তেল সংগ্রহ করে স্নেহজাতীয় খাবারের অভাব পূরণ করে। লবণের চাহিদা মেটায় মূলত সামুদ্রিক লবণ বা খনিজ লবণ থেকে। পানির চাহিদা মেটায় মূলত সরাসরি পানি পান করে। এছাড়া পানি-সমৃদ্ধ ফল বা শস্য থেকেও পানির চাহিদা মেটায়।

 

প্রজনন ও বংশগতি
যৌন-প্রক্রিয়া দ্বারা নারী গর্ভবতী হয়। প্রায় ৯ মাস গর্ভধারণ করার পর, নারী একটি বা দুটি সন্তান প্রসব করে। কখনো কখনো এর চেয়ে বশি সন্তান প্রসবের ঘটনাও দেখা যায়। মানব শিশু মূলত মায়ের যত্নে বড় হয়ে উঠে। প্রায় ১৫ বৎসরে মেয়ে শিশু এবং ১৮ বৎসর বয়সে পুরুষ শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠে। মানুষের সর্বোচ্চ প্রায় ১২০ বৎসর বাঁচে।

 

বংশগতির বিচারে মানুষ সু-প্রাণকেন্দ্রীয় কোষ-যুক্ত দ্বিবিভাজিতধর্মী বহুকোষী প্রাণী। ২৩টি করে ক্রোমোজম সেট নিয়ে এর কোষ গঠিত। এর একটি সেট পিতামাতার ক্রোমোজোম দ্বারা সংমিশ্রিত হয়। এর ভিতরে ১টি সেট মানব শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করে। অবশিষ্ট ২২টি ক্রোমোজোম মানবশিশুর অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বা গুণ ধারণ করে। অন্যান্য সু-প্রাইমেট-দের মতো- এদের স্ত্রী লিঙ্গ নির্ধারিত হয় XX লিঙ্গ ক্রোমোজোম এবং পুংলিঙ্গ নির্ধারিত হয় XY লিঙ্গ ক্রোমোজোম দ্বারা। মানুষের বংশগতি নির্ধারণের জন্য রয়েছে প্রায় ২২০০০ জিন।


সূত্র: