মানুষ (হোমো স্যাপিয়েন্স)
ইংরেজি :
homo, man, human being, human
সমার্থক বাংলা নাম: জন, মনুষ্য, মানব, মানুষ, লোক।
আধুনিক মানুষের প্রজাতিগত পরিচয় হলো-
Homo sapiens
(হোমো স্যাপিয়েন্স)।
জীববিজ্ঞানের শ্রেণিবিন্যাসের বিচারে মানুষ হলো-
হোমিনিডিগোত্রের
হোমো
গণের একটি প্রজাতি। দৈহিক বৈশিষ্টের বিচারে এরা ভূমির উপর দুই পায়ে সরলভাবে দাঁড়াতে এবং চলাচল করতে পারে।
মনোজগতের বিচারে এরা বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে এরা অন্যান্য প্রজাতির চেয়ে শ্রেষ্ঠতর এবং সৃজন-ক্ষমতার অধিকারী।
সৃজনশীল ক্ষমতার দ্বারা এরা নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিজেদের প্রয়োজনীয় জীবনধারণের উপকরণ প্রকৃতি থেকে
সংগ্রহ করতে পারে এবং উপাদনসমূহ থেকে নানাবিধ উপকরণ তৈরি করতে পারে। উন্নত মানসিক ভাবনার দ্বারা চিত্তবিনোদনের জন্য
নানাবিধ বিমূর্তভাবনা উপস্থাপন করতে পারে। এছাড়া বাক্প্রত্যঙ্গ দ্বারা সৃষ্ট ভাষার সাহায্যে সুচারুরূপে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে।
হোমো গণের
প্রজাতিগুলোর বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করলে দেখা যায়, মানুষ-সহ
অন্যান্য প্রজাতির ভিতর আদিম মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলো বিকশিত হয়েছিল।
এই বিচারে হোমো গণের সকল প্রজাতিই এক অর্থে মানুষ।
এরা এককভাবে দুর্বল, কিন্তু সমষ্টিগতভাবে প্রবল। আদিম মানবগোষ্ঠী নিজেদের
অস্তিত্ব বজায় রাখার স্বার্থে দলগত ঐক্য বজায় রাখার জন্য সচেষ্ট ছিল। এই কারণে এরা দলের সকলের প্রতি যত্নশীল হয়ে উঠেছিল।
সৃজনী ক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তা এবং দলগত ঐক্যের ভিতর দিয়ে হোমো গণের প্রজাতিরা সমকালীন অন্যান্য প্রজাতির উপর
প্রভুত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়ে উঠেছিল। এর ভিতরে সর্বশেষে প্রজাতি হলো- হোমো স্যাপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষ।
জীবজগতের ক্রমবিবর্তনের ধারায়- হোমো গণের উন্নততম প্রজাতি হিসেবে স্যাপিয়েন্সের তথা মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় ৩.৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আফ্রিকার মরোক্কোর জেবেল ইর্হৌদ
(Jebel Irhoud )
অঞ্চলে। মানুষের আবির্ভাবের পুরো সময়টকুকেই 'প্রাক্-মানব অধ্যায়' হিসেব গ্রহণ করা উচিৎ হলেও- কিন্তু সঙ্গীতের ইতিহাসের বিচারে সুপ্রাচীন 'প্রাক্-মানব অধ্যায়' গ্রহণ করাটা সঙ্গত হবে না। মূলত সৃজনশীল ক্ষমতার মধ্য দিয়ে মানুষ অন্য সকল প্রজাতির মধ্য শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল।
ধারণা করা হয় প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ বৎসর আগে
প্রাইমেট বর্গের অন্তর্গত
হোমিনিডি
গোত্রের
হোমো
গণের অন্তর্গত
Homo sapiens
এর আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকার মরোক্কোর জেবেল ইর্হৌদ
(Jebel
Irhoud
>)
-তে। উল্লেখ্য আগে মনে করা হতো, দুই লক্ষ বৎসর আগে আদি মানুষের উদ্ভব ঘটেছিল ইথিওপিয়া অঞ্চলে।
উল্লেখ্য,
হোমো স্যাপিয়েন্সের একটি উপ-প্রজাতি
১ লক্ষ ৬০ হাজার বৎসর আগে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হয়েছিল। এই প্রজাতিটি হলো
Homo sapiens idaltu
।
আধুনিক মানুষের মূল প্রজাতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়-
Homo sapiens।
উপ-প্রজাতিকে।
মানুষের জাতিসত্তা
প্রজাতিগতভাবে মানুষ একটি প্রাণিসত্তার সমষ্টিগত নাম। আফ্রিকা থেকে উৎপন্ন হোমো
স্যাফিয়েন্সরা কালক্রমে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে, নতুন নতুন
প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং এর সাথে জীবন সংগ্রাম, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির কারণে এদের দেহগত
নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটে। কালক্রমে দেহগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে পৃথক পৃথক রূপ লাভ করে।
দৈহিক বৈশিষ্ট্যের বিচারে এদেরকে নানাভাগে ভাগ করা হয়।
খাদ্য
মানুষ সর্বভুক
প্রাণী। আদিম মানুষ সবকিছুই কাঁচা খেতো। আগুন আবিষ্কারের পর থেকে মানুষ ফল জাতীয়
খাবার ছাড়া সবকিছুই রান্না করে খায়। মানুষ প্রাকৃতি থেকে অবিকৃত খাদ্য-উপাদান
সরাসরি খায় আবার প্রাকৃতিক উপকরণগুলোকে নানা প্রক্রিয়া খাদ্যে পরিণত করে গ্রহণ করে।
মানুষ প্রধান খাদ্য তালিকার অন্যতম উপকরণ শর্করা জাতীয় খাদ্য। এই খাদ্য মানুষ
সংগ্রহ করে ধান বা গম জাতীয় শস্য থেকে। মানুষ আমিষের চাহিদা মেটায় নানা ধরনের
প্রাণী থেকে। কিছু আমিষের চাহিদা মেটায় আমিষ-সমৃদ্ধ খাবার থেকে। চর্বিজাতীয় খাবার,
বনজ ফল ও তেলসমৃদ্ধ বীজ থেকে তেল সংগ্রহ করে স্নেহজাতীয় খাবারের অভাব পূরণ করে।
লবণের চাহিদা মেটায় মূলত সামুদ্রিক লবণ বা খনিজ লবণ থেকে। পানির চাহিদা মেটায় মূলত
সরাসরি পানি পান করে। এছাড়া পানি-সমৃদ্ধ ফল বা শস্য থেকেও পানির চাহিদা মেটায়।
প্রজনন ও বংশগতি
যৌন-প্রক্রিয়া দ্বারা নারী গর্ভবতী হয়। প্রায় ৯
মাস গর্ভধারণ করার পর, নারী একটি বা দুটি সন্তান প্রসব করে। কখনো কখনো এর চেয়ে বশি
সন্তান প্রসবের ঘটনাও দেখা যায়। মানব শিশু মূলত মায়ের যত্নে বড় হয়ে উঠে। প্রায় ১৫
বৎসরে মেয়ে শিশু এবং ১৮ বৎসর বয়সে পুরুষ শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠে। মানুষের সর্বোচ্চ প্রায় ১২০ বৎসর বাঁচে।
বংশগতির বিচারে মানুষ
সু-প্রাণকেন্দ্রীয় কোষ-যুক্ত দ্বিবিভাজিতধর্মী বহুকোষী প্রাণী। ২৩টি করে ক্রোমোজম সেট নিয়ে এর কোষ গঠিত। এর একটি সেট পিতামাতার ক্রোমোজোম দ্বারা সংমিশ্রিত হয়। এর ভিতরে ১টি সেট মানব শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করে। অবশিষ্ট ২২টি ক্রোমোজোম মানবশিশুর অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বা গুণ ধারণ করে। অন্যান্য
সু- প্রাইমেট
-দের
মতো- এদের স্ত্রী লিঙ্গ নির্ধারিত হয়
XX
লিঙ্গ ক্রোমোজোম এবং পুংলিঙ্গ নির্ধারিত হয়
XYলিঙ্গ ক্রোমোজোম দ্বারা। মানুষের বংশগতি নির্ধারণের জন্য
রয়েছে প্রায় ২২০০০ জিন।
প্রজাতিগত বিবর্তনের ধারায় আধুনিক মানুষ
জীবজগতের এই ক্রমবিবর্তনের ধারায় সৃজনশীল প্রজাতির আবির্ভাবের সূচনার মধ্য দিয়ে জীবজগতে মনুষ্যের আবির্ভাবের ক্ষেত্রটি উন্মোচিত হয়েছিল। এই ক্ষমতার সূত্রে মানুষ অর্জন করেছিল নামক
সকল সৃজশীল বিদ্যা। মূলত মানুষের এই বিশেষ ক্ষমতাটি অর্জিত হয়েছিল- মানুষের পূর্ববর্তী মানবেতর প্রজাতির মধ্য দিয়ে। মানুষের ক্রমবির্তনের ধারায় সৃজনশীল প্রজাতি হিসেবে প্রথম কোনো বিশেষ প্রজাতিকে চিহ্নিত করাটা যথাযথ তথ্য প্রমাণাদির অভাবে নিরূপণ করা সম্ভব নয়। বিগত কয়েক শতাব্দী জুড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রে যে সকল প্রমাণাদি পাওয়া যায়, তারই বিচারে দেখা যায়
কেনিয়ান্থ্রোপাস গণের কিছু প্রজাতির ভিতরে সৃজনশীল ক্ষমতার
সৃষ্টি হয়েছিল। ধারণা করা হয় প্রায় ৩৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে দিকে এরা আবির্ভুত হয়েছিল।
সম্ভবত ৩২ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে দিকে এরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সৃজনশীল
ক্ষমতার প্রাক্-মান অধ্যায় হিসেবে এই প্রজাতির আবর্ভাবের সময়কে প্রাক্-মানব
অধ্যায়ের আদিকাল হিসেবে ধরা যেতে পারে।
প্রাক্-মানব অধ্যায় (৩৫-৩.৫ লক্ষ
খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রে ৩৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে দিকে
কেনিয়ান্থ্রোপাসরা বসবাস
করতো- কেনিয়াতে। ক্রমবিবর্তনের ধারায় মানুষের সৃজনশীল ক্ষমতার বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ
ঘটে চলেছিল এদের ভিতরে।
প্রায় ৩৩ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে, প্রাগৈতিহাসিক যুগ তথা
প্রস্তর যুগের সূচিত হয়েছিল
কেনিয়ান্থ্রোপাস বা
অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেনসিস নামক হোমো গণের প্রজাতিদের মাধ্যমে। বুদ্ধিমত্তা দিক থেক
কেনিয়ান্থ্রোপাসরা
(Kenyanthropus platyops)
অস্ট্রালোপিথেকাসদের চেয়ে অগ্রসর ছিল। এদের দ্বারা
নিম্ন প্রস্তরযুগ
(Lower Palelithic stage)
।
এই প্রস্তর যুগের ব্যাপ্তী ছিল ৩৩ থেকে ৩ লক্ষ
খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।
প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রে ধারণা করা হয়
অস্ট্রালোপিথেকাস গণের ভিতরে
অস্ট্রালোপিথেকাস সেডিবার
(আবির্ভাবকাল ২০ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। বিলুপ্তকাল ১৮ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ভিতরে
সৃজনশীল ক্ষমতার বিকাশ ঘটেছিল।এরা একটি কুঁজো হয়ে
দুই পায়ে চলতে পারতো। তবে এরা চলার সময় হাতও ব্যবহার করতো।
এদের খাদ্য তালিকায় উদ্ভিদ ও মাংস উভয়ই ছিল। সম্ভবত এরা পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করে পশু হত্যা করা শিখেছিল।
অস্ট্রালোপিথেকাসদের পরে
হোমো
গণের আবির্ভাব হয়েছিল ২৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে ।
এই সময়ের ভিতরে
অস্ট্রালোপিথেকাস সেডিবারা
আবির্ভুত হয়েছিল। তবে ১৮ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে বিলুপ্ত
হয়ে গিয়েছিল।
হোমো
গণের আদিম প্রজাতিগুলো গোড়াতেই সুগঠিত ভাষার ব্যবহার শিখে উঠতে পারে নি বটে,
কিন্তু এরা অঙ্গসঞ্চালন এবং কিছু ধ্বনি ব্যবহার করে, যোগাযোগ এবং ভাব বিনিময় করতে
শিখেছিল। এই ধারায় হোমো গণের আদিম কোন প্রজাতির আবির্ভাব হয়েছিল, তা সুনির্দিষ্ট
করে বলা যায় না। তবে হোমো গণের প্রজাতিসমূহের সর্বপ্রাচীন জীবাশ্ম হিসেবে
হোমো
হ্যাবিলিসদের বিবেচনা করা হয়। ২৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আফ্রিকাতে এই
প্রজাতির উদ্ভব হয়েছিল। আর ১৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এরা বিলুপ্ত হয়ে
গিয়েছিল। এদের দ্বারা আদি মানবগোষ্ঠীর
নিম্ন প্রস্তরযুগ যুগের
তান্জানিয়ার ওল্ডুভাই জর্জ
(Olduvai Gorge)
অঞ্চলে। এই অঞ্চলে বিকশিত সভ্যতাকে সাধারণভাবে বলা হয়
ওল্ডুভিয়ান সভ্যতা। এরপর ক্রমবিবর্তনের ধারায় প্রায় ২৪ লক্ষ
খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আবির্ভূত
হোমো রুডোলফেনসিস-রা সৃজনশীলতার বিচারে আরো একটু উন্নত
হয়েছিল।
চতুষ্পদী
হোমো হ্যাবিলিস এবং
হোমো রুডোলফেনসিস চেয়ে সৃজনশীলতার বিচারে উন্নততর প্রজাতি
হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল দ্বিপদী
হোমো ইরেক্টাস। এরা ভূমির উপর
সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতো। ২০ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের
দিকে এদের আবির্ভাব হয়েছিল হিমশীতল বৈরি পরিবেশে। কারণ
পৃথিবীর ক্রমবিবর্তনের ধারায় তখন চলছিল
প্লেইস্টোসিন
অন্তঃযুগ। এই অন্তঃযুগের ২৫.৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে শুরু হয়েছিল
কোয়াটার্নারি বরফযুগ'। প্রাথমিক পর্যায়ে এই বরফযুগের প্রভাবে উত্তর গোলার্ধের
মেরু সংলগ্ন এলাকার জলস্থল বরফ ঢেকে গিয়েছিল। ২০.৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পরে
বেশকিছু
হিমযুগ
ও আন্তঃ হিমযুগ সংঘটিত হয়েছিল। এর ফলে এই সময়ে উত্তর মহাসাগর বিশাল বরফ-প্রান্তরে
পরিণত হয়েছিল। এই বরফশীতল পরিবেশের ভিতরে ২০ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে
আফ্রিকার পরিবেশ ও শীতল দশায় পৌঁছেছিল। এই পরিবেশে ২০ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের
ভিতরে স্বতন্ত্র প্রজাতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল
হোমো ইরেক্টাস । আধুনিক মানুষের সাথে এদের
অনেক মিল থাকলেও সৃজনশীল ক্ষমতার বিচারে মানুষের সমকক্ষ ছিল না। হোমো হ্যাবিলিস মতোও নিম্নপ্রস্তর-যুগ বিকাশে এরা ভূমিকা
রেখেছিল। প্রায় ১৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই প্রজাতিটিই
আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের একটি শাখা ইউরেশিয়ায় প্রবেশ করে।
পরে এই শাখাটি বিভাজিত হয়ে একটি শাখা ইউরোপের ককেশাশ অঞ্চলে থেকে যায়। অবশিষ্ট
অংশের একটি দল প্রথমে চীনে প্রবেশ করে। পরে এর একটি দল ইন্দোনেশিয়ার জাভা
দ্বীপাঞ্চলে চলে যায়। বিশাল অঞ্চল জুড়ে এই প্রজাতিটি ছড়িয়ে পড়ার কারণে, বিভিন্ন
স্থানে এই প্রজাতিটির বিবর্তিত হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন ধারায়। এসকল প্রজাতির
জীবাশ্মগুলোকে বিভিন্ন সময়ে নানা ভাবে এবং নানা নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন-
জাভা মানব,
সোলো মানব,
পিকিং মানব ইত্যাদি।
পরবর্তী প্রজাতিগুলো ১৯ লক্ষ ৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের
ভিতরে আবির্ভুত প্রজাতিগুলো ছিল
হোমো এর্গাস্টার,
হোমো গটেনজেনসিস,
হোমো জর্জিকাস,
হোমো এন্টেসেসর,
হোমো আটল্যান্থ্রোপাস,
হোমো সেপ্রানেনসিস। এরা অল্পবিস্তর আগুনের ব্যবহার
শিখেছিল এবং বহুবিধ অর্থবোধক ধ্বনির ব্যবহার করে যোগাযোগ রক্ষা করতে শিখেছিল।
এরপরে আধুনিক মানুষের কাছাকাছি প্রজাতি হিসেবে ৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আবির্ভূত হয়েছিল-
হোমো হাইডেলবার্গেনসিস।
পৃথিবীর ক্রবির্তনের
ধারায় তখন ছিল
আয়োনিয়ান
আমলে (৭.৮১- ১.২৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং সমগ্র
সাইবেরিয়া অঞ্চলে ব্যাপক শৈত প্রবাহ বিদ্যমান ছিল। ইউরোপের হিমশীতল পরিবেশে এদের
টিকে থাকার জন্য আগুনের ব্যবহারটা অত্যন্ত জরুরি ছিল। সম্ভবত এই সময় এরা শীত থেকে
রক্ষা পাওয়ার জন্য মোটা পশুর চামড়া ব্যবহার করা শিখেছিল। এরূপ হিমশীতল পরিবেশে
নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে মাংস, হাড়, চামড়া সংগ্রহের জন্য বড় বড় পশু শিকার
করতো দলবদ্ধভাবে। তখন এদের শিকারের তালিকায় ছিল- গণ্ডার, জলহস্তি, ভল্লুক, ঘোড়া,
নানা ধরনের হরিণ।
ধারণা করা হয় ৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এরা আফ্রিকাতেই ছিল। খাদ্য সংকট এবং
প্রাকৃতি পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে ৪-৩ লক্ষ বছর পূর্বে আফ্রিকা ইউরেশিয়ার দিকে
চলে আসে। এরা জার্মান, ইতালি, স্পেন, গ্রিস প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের একটি
শাখা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল বলে ধারণা করা যায়। উত্তর ভারতের নর্মদা নদীর তীরে
এদের একটি অংশ বসতি স্থাপন করেছিল। পরে এই প্রজাতিটি
বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
আধুনিক মানুষের নিকটতম প্রজাতি হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিল
হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস। প্রায় ৫ লক্ষ ৩০ হাজার
থেকে ৪০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে আফ্রিকায়। ধারণা করা হয়
,
এদের প্রধান বিচরণক্ষেত্র ছিল মরক্কো'র টান-টান নগরীর আশপাশ জুড়ে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৪,৫০,০০০ অব্দের ভিতরে
হোমো ইরেক্টাস-দের পাশাপাশি এরা মিশ্র সভ্যতার
পত্তন ঘটিয়েছিল। এই
অঞ্চলে পাওয়া গেছে আদিম ভাস্কর্য
টান-টানের ভেনাস। স্ফটিক পাথরের
নির্মিত এই মূর্তিটির উচ্চতা প্রায় ৬ ইঞ্চি, প্রস্থ প্রায় ২.৬ ইঞ্চি। ওজন প্রায় ১০
গ্রাম।
১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে এই মূর্তিটি আবিষ্কার করেছিলেন জার্মানির
প্রত্নতত্ত্ববিদ লুৎজ ফিয়েডলার (Lutz
Fiedler) । মরক্কোর টান-টান নগর থেকে কিছু দূরে ড্রা নদীর তীরে এই মূর্তিটি
তিনি পেয়েছিলেন। পরে টান-টান নগরের নামানুসারে এর নামকরণ করেছিলেন টান-টান-এর ভেনাস
(Venus of Tan-Tan)।
সম্ভবত প্রায় ৪ থেকে সাড়ে ৩ লক্ষ
খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এরা জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সেই
সাথে খাদ্যাভাবের কারণে এরা এশিয়া এবং ইউরোপে প্রবেশ করেছিল।
প্রায় ১ লক্ষ ৩০ বৎসর
আগে এরা
পুরোপুরি নিয়ানডার্থালের
প্রজাতিগত গুণাবলী অর্জন
করেছিল।
ধারণা করা
হয়
খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫,০০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫,০০০ অব্দের ভিতরে এরা মেসোপটেমিয়ায়
অনেকটা স্থায়ী আবাস গড়ে
তুলেছিল।
নিয়ানডার্থাল-মানবগোষ্ঠীর জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে প্রাক্-প্রস্তরযুগের সূচনা হয়েছিল।
এরা পাথুরে অস্ত্র ব্যবহার করতো। এই সূত্রে এরা শিকারে দক্ষ হয়ে উঠেছিল। এক্ষেত্রে
তারা কুঠার, বর্শা ব্যবহার করতো। বর্শাফলকের সাথে তারা কাঠের দণ্ড ব্যবহার করার
কৌশল আয়ত্ব করেছিল। এদের অস্ত্রের গঠন দেখে ধারণা করা হয়েছে যে, এরা ম্যামথ
(বিলুপ্ত হাতীজাতীয় প্রাণী) বড় বড় প্রাণী হত্যা করতে পারতো। ৩৫ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের
দিকে হোমো
স্যাপিয়েন্সদের সাথে সংঘাত
এবং প্রতিকূল পরিবেশের কারণে
এরা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
খ্রিষ্টপূর্ব ৭০ থেকে ৪০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে উত্তর-পশ্চিম ফ্রান্সের
পারব্ত্য অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। এখানে এদের দ্বারা এখানে পত্তন হয়েছিল
মস্টারিন সভ্যতার। এই সময় এরা আগুন জ্বালাতে শিখেছিল। সম্ভবত এরা শীতের হাত থেকে
রক্ষা পাওয়ার জন্য পশুর চামড়া গায়ে জড়িয়ে রাখতো। হিংস্র পশু এবং প্রতিকূল আবহাওয়া
থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পর্বত গুহায় বসবাস করতো। নিজেদের ভিতরে তথ্য আদান প্রদানের
মতো নিম্নস্তরের ভাষার বিকাশ ঘটেছিল। এদের খাদ্য তালিকায় ছিল পশুর মাংস এবং নানা
ধরনের ফলমূল। এদের ভিতরে মৃতদেহ কবরস্থ করার রীতি গড়ে উঠেছিল।
এরা চিত্র অঙ্কনে
পারদর্শী হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে এর এরা গুহারে পাথুরে দেওয়ালে পেয়ালার অবয়ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। এগুলো
এরা তৈরি করেছিল গুহাগুলোকে শৈল্পিকভাবে সাজানোর তাগিদে। এর অন্যতম নমুনা স্থান
হিসেবে উল্লেখ করা যায়- ফ্রান্দের লা ফেরাসসিয়ের গুহাকে। ধারণা করা হয়, এই দেওয়াল
সজ্জার নমুনা'র বয়স ধরা হয়েছে ৬০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এই দেওয়াল সজ্জার নাম
দেওয়া হয়েছে
' La
Ferrassie Cave Cupules'।
টান-টানের ভেনাস-এর মতো এখানে কোনো নারী মূর্তি পাওয়া
যায় নি বটে, তবে দেওয়াল খোদিত করে নারী যোনী'র চিত্র অঙ্কন করেছিল। সম্ভবত এটিও ছিল
আদি দেবীর প্রতীক।
সম্ভবত
এদের ভিতরে আদিম গান এবং নৃত্যের চর্চা ছিল। এদের মাধ্যমে পাতার তৈরি রিড জাতীয়
বাদ্যকৌশলের স্থান করেছিল নলাকার বাশি। আর
বায়ুতাড়িত বাঁশির উদ্ভাবকও ছিল এরা। এই ধারণা
সুদৃঢ় হয়ে ওঠে এদের তৈরি
ডিভ্জে বাবে বাঁশির
নমুনা দেখে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৫
খ্রিষ্টাব্দে স্লোভেনিয়ার ডিভ্জে বাবে প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্রের একটি অনুভূমিক
গুহা থেকে এদের তৈরি একটি বাঁশির সন্ধান পাওয়া গেছে। এই বাঁশি
ডিভ্জে বাবে বাঁশি
নামেই প্রচলিত। উল্লেখ্য, প্রায়
৪৩,১০০
খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বাঁশিটি তৈরি হয়েছিল।
প্রাপ্ত বাঁশিটি
তৈরি হয়েছিল
গুহাভল্লুকের উরুর অস্থি থেকে। এই বাঁশিকে যদি সেকালের
একটি আদর্শ নমুনা হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে একথা মানতেই হবে যে, নিয়ানডার্থলদের
মধ্যে সুর ও সুরেলা বাঁশির
চর্চা শুরু হয়েছিল লক্ষ বা হাজার বছর আগে। ধারণা করা যায় নিয়ানডার্থলদের আবির্ভাবের
সূচনালগ্নই সঙ্গীত বিকশিত হতে থাকে। মোটা দাগে বলা যায় আনুমানিক ৩ লক্ষ থেকে ৫০
হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে সঙ্গীতের প্রাথমিক বিকাশ শুরু হয়েছিল।
৪৩,১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বাঁশিটি ছিল এদের একটি আদর্শিক নমুনা
মাত্র।
এরা আদিম শব্দভিত্তিক ভাষাকে বাক্যভিত্তিক ভাষায় উন্নীত
করেছিল। এদের সাংস্কৃতিক উপাদান তথা ভাষা, সঙ্গীত ও অন্যান্য মানবিক
আচার-আচরণ মনুষের মতোই ছিল।
তারপরেও জিনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে এর মানুস তথা হোমো স্যাপিয়েন্স
ছিল না।