|
প্রাইমেট
Primate
স্তন্যপায়ী প্রাণীকুলের
একটি বর্গ হলো প্রাইমেট। ১৭৫৮
খ্রিষ্টাব্দে এই
বর্গের নামকরণ করেছিল
Linnaeus।
মূলত
স্তন্যপায়ীদের বিকাশ ঘটেছিল বিভিন্ন ধারায়। এদের ভিতর তিমির মতো বিশাল
প্রজাতিগুলো সাগরের জলে আশ্রয় নিয়েছিল। এদের বিবর্তিতরূপ বাদুর জাতীয় প্রজাতিগুলো
আকাশচারীও হয়েছিল। কিন্ত
স্তন্যপায়ীদের অধিকাংশই রয়ে গিয়েছিল ডাঙাতে।
ডাঙার
স্তন্যপায়ীরাও বিভাজিত গিয়েছিল বিভিন্ন ভাবে। খাদ্যাভ্যাস,
আকার,
অঙ্গসংস্থান ইত্যাদির প্রভেদে স্তন্যপায়ীদের বিবর্তন চলছিল বিভিন্ন পরিমণ্ডলে। এরই
ভিতর কতিপয় স্তন্যপায়ী ভূমি ছেড়ে গাছে গাছে ঘুড়ে বেড়ানো রপ্ত করেছিল। এই কাজটি
তারা যে সখের বশে করেছিল,
তা কিন্তু নয়। উদ্ভিদভোজী কিছু প্রাণী লতাপাতার সাথে গাছের ফলের প্রতিও আকৃষ্ট
হয়েছিল। এছাড়া ডাঙার বাঘ-সিংহের মতো বলবান এবং হিংস্র প্রাণীদের হাত থেকে রক্ষা
পাবার জন্য গাছ তাদের অবলম্বন হয়ে উঠেছিল। ফলে কালক্রমে এদের হাত-পায়ের গঠনের
পরিবর্তন ঘটেছিল। লাফ-ঝাঁপ দেওয়ার সূত্রে এদের সম্মুখের দুটি পা প্রসারিত করতে
পারতো যথেষ্ঠ পরিমাণ এবং তাতে মুক্তভাবে সঞ্চালনের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। সামনের
দুই পায়ের এই ক্ষমতা বৃদ্ধির সূত্রে,
যে পরিবর্তন ঘটেছিল,
তারই সূত্রে আমরা এর নামকরণ করেছি হাত। গাছে গাছে ঘুরে বেড়ানো,
ডালপালা আঁকড়ে ধরা এবং হাতের ভরে শরীরের ভারসাম্য ঠিক রেখে ডালে ডালে ঝুলে ঝুলে
ঘুরে বেড়ানোর জন্য হাত পায়ের আঙুলের আকার,
আকৃতি ও সংখ্যার পরিবর্তন ঘটেছিল। এছাড়া মুখের সম্মুখভাগে চোখের অবস্থান
সুনির্দিষ্ট হওয়ায়,
দৃষ্টিক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এইসব শারীরীক পরিবর্তনের সাথে সাথে অন্যান্য
স্তন্যপায়ীদের চেয়ে,
এদের মস্তিষ্কেরও বিকাশ ঘটেছিল অনেক বেশি। গাছে গাছে ফল-পাতা অন্বেষণ,
গাছে গাছে লাফিয়ে বা লতায়-পাতায় জড়িয়ে ছুটে চলার মধ্য দিয়ে এদের মস্তিষ্কের
চর্চাও বেড়ে গিয়েছিল। আত্মরক্ষার জন্য এরা সমাজ গঠন করেছিল। ফলে দলের সদস্যদের
মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা বা সংকেত আদান প্রদানের ক্ষেত্রেও এরা পারঙ্গম হয়ে
উঠেছিল। বিজ্ঞানীরা এই সকল বৃক্ষাচারী স্তন্যপায়ীদের চিহ্নিত করেছেন প্রাইমেট
হিসাবে।
বিবর্তনের ফলে আদিকালের প্রাইমেট থেকে ধীরে ধীরে উদ্ভব ঘটেছিল অন্যান্য প্রজাতির।
বর্তমানে প্রাইমেটদের ভিতরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়-
ওরাংওটাং,
গরিলা,
শিম্পাঞ্জি,
মানুষ
ইত্যাদি।
আদিকালের
প্রাইমেটের সে সকল প্রজাতি এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারপরেও এখন অব্দি যতগুলো
প্রাইমেটের সন্ধান পাওয়া গেছে তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম নয়। বর্তমানে প্রায় ২৩৫টি
প্রজাতির প্রাইমেটের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, আগামী ২০ বৎসরের ভিতর এই সকল প্রজাতির ১০% হারিয়ে যাবে। অন্যান্য প্রাইমটেদের একটি
বিশাল অংশও বিলুপ্তি হতে পারে এমন আশংকা করা হচ্ছে। প্রাইমেটদের বিলুপ্ত হওয়ার
কারণ হিসাবে দেখানো হচ্ছে পরিবেশগত প্রতিকূলতা। মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে,
প্রাইমেটদের আবাসস্থল ও খাদ্যের সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। এছাড়া পশ্চিম আফ্রিকায় কিছু
প্রাইমেটকে হত্যা করা হয়ে থাকে খাদ্যের জন্য।
প্রাইমেটদের ক্রমবিবর্তন :
প্রাইমেটদের সাধারণ দৈহিক বৈশিষ্ট্য
ের
দিকে।
১৬.৫ কোটি
খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ক্ল্যাডোথেরিয়া থাক
বিভাজিত হয়ে
জাথেরিয়া থাকের প্রাণীকুল থেকে উদ্ভব হয়েছিল।
পরে
জাথেরিয়া
থাক থেকে উদ্ভব হয়েছিল
ট্রাইবোসফেনিডা
থাকের প্রাণীকুল।
ইউয়ার্কোন্টোগ্লিরিস: আবিরভাব কাল ৬.৫ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
ইউয়ার্কোন্টা: আবির্ভাব কাল ৬.৫ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।
প্রাইমেটোফোর্মা: আবির্ভাব কাল ৬.৫ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।
স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্রমবিবর্তনের ধারায়- ৬.৫ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে গর্ভফুলযুক্ত প্রাণীকুলের একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে প্রাইমেটদের আদি রূপ বিকশিত হয়েছিল। ৫ কোটি ৯০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে প্রাইমেট বর্গের প্রাণীকুল দুটি উপবর্গে বিভাজিত হয়ে যায়। এই উপ-বর্গ দুটি হলো‒
প্রাইমেটদের আকার, ওজন ও দৈহিক শক্তি : প্রাইমেটরা ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের হয়। উচ্চতার দিকে থেকে গরিলা ও মানুষ বড় হয়ে থাকে। তবে ক্ষুদ্রাকার প্রাইমেটও বিরল নয়। নিচে চার প্রজাতির প্রাইমেটের গড় ওজনের তুলনামূলক তালিকা দেওয়া হলো-
প্রজাতি |
নারী |
পুরুষ |
গরিলা |
১০৫ কেজি |
২০৫ কেজি |
মানুষ |
৬২ কেজি |
৭৮ কেজি |
পটাশ বানর |
৫ কেজি |
১০ কেজি |
পিগমি মারমোসেট |
১২০ গ্রাম |
১৪০ গ্রাম |
অন্যান্য বন্য প্রাণীদের তুলনায়, প্রাইমেটরা শারীরীক কর্মক্ষমতার দিক থেকে ততটা শক্তিশালী নয়। যেমন, ঘোড়ার মতো দ্রুত দৌড়াতে পারে না, পাখির মতো আকাশে উড়তে পারে না, সাপের মতো বিষ নেই মুখে, হাতি বা গণ্ডারের মতো সুদৃঢ় শরীর নেই, বাঘ সিংহের মতো ভালো শিকারীও নয়। প্রাইমেট শ্রেণীর বলেই, এই সকল দোষ মানুষেরও আছে। কিন্তু বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে মানুষকে বাইরে রাখলেও, সকল প্রাইমেটই অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে উঁচু স্তরে রয়েছে।
প্রাইমেটদের হাতের গঠন : প্রাইমেটদের হাতের গঠন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এই বর্গের প্রতিটি প্রজাতির প্রতিটি হাতে বা পায়ে রয়েছে পাঁচটি আঙুল। আঙুলগুলো এরা তালুর দিকে গুটাতে পারে বা মুষ্টিবদ্ধ করতে পারে। হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল অন্যান্য আঙুল থেকে একটু পৃথকভাবে বিন্যস্ত। এই বিন্যাসের কারণে, প্রাইমেটরা বৃদ্ধাঙ্গুলকে অপর চার আঙুলের বিপরীত দিকে টেনে আনতে পারে। আঙুলে নখ থাকে, কিন্তু অন্যান্য মাংশাসীদের মতো অত শক্ত বা দীর্ঘ হয় না।
গিবনের হাত |
মানুষের হাত |
গরিলার হাত |
|
|
|
প্রত্যেক্যের হাত পা মিলিয়ে ২০টি আঙুল রয়েছে। হাতের তালু থাকে চ্যাপ্টা। আঙুলগুলো বাঁকিয়ে আঁকড়া মতো করে শক্ত করে ধরতে পারে। এরা দুই পায়ে ভর করে বসতে পারে, তবে সবাই মানুষের মতো সোজা হয়ে হাঁটতে না পারলেও প্রয়োজনে দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে। এদের ভিতর মানুষ এবং এপ জাতীয় প্রজাতিগুলোর লেজ নেই। লেমুর জাতীয় প্রাইমটেদের নাক শিয়ালের মতো একটু চোখা হলেও, অন্যান্য সকল প্রাইমেটদের নাক মানুষের মতো কমবেশী খাটো আকারের হয়ে থাকে।
এদের চোখ সামনের দিকে পাশাপাশি থাকে। এই কারণে এরা স্বচ্ছন্দে ত্রিমাত্রিক দৃশ্য দেখতে পারে। এক্ষেত্রে একটি চোখে একটি সরলরেখা অনুসরণে দেখতে পারে। এক্ষেত্রে ১২০ ডিগ্রী পরিমিত অঞ্চল দৃশ্যমান হয়। কিন্তু দুই চোখে দেখার কারণে ১৬০-১৮০ ডিগ্রী অঞ্চল উপরিপাতন (overlapping) ঘটে। ফলে স্পষ্ট ত্রিমাত্রিক ছবি দেখা সম্ভব হয়। মানুষ, এপ, বানর এই ভাবে ত্রিমাত্রিক দৃশ্য দেখলেও লেমুররা তা পারে না। পাশের চিত্রে ত্রিমাত্রিক দৃশ্য দেখার ক্ষেত্রে উপরিপাতনের বিষয়টি দেখানো হলো।
মানুষ ও গরিলা ছাড়া আর সকল প্রাইমেটই গাছে ঘুমায় বা বিশ্রাম নেয়। তবে মানুষ ও গরিলা প্রয়োজনে গাছে উঠে থাকে। প্রাইমেটরা মোটামুটি সামাজিক জীবন-যাপন করে এবং পরস্পরের সাহায্য সহযোগিতার ভিতর দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে। এদের কোন কোন প্রজাতি প্রায় শতাধিক সদস্য নিয়ে সামাজিক পরিবেশে কাটায়। এদের অধিকাংশই উদ্ভিভোজী। তবে মানুষ ও কিছু প্রাইমেট রয়েছে সর্বভুক। প্রাইমেটদের ভিতর মানুষের পাকযন্ত্র অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং রোগও অনেক বেশি।