হোমো হাইডেলবার্গেনসিস

হোমো গণের একটি প্রজাতি বিশেষ। ধারণা করা হয়, এই প্রজাতিটি হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস -এর প্রত্যক্ষ পূর্ব-পুরুষ। এদের আবির্ভাব ঘটেছিল আয়োনিয়ান আমল অন্তঃযুগে ৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে।

১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসের ২১ তারিখে, জার্মানির হাইডেলবার্গের নিকটবর্তী মাউয়ের
(Mauer) নামক গ্রামের উত্তরে এর দাঁতসহ চোয়ালের এটি জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়। এই জীবাশ্মটি আবিষ্কার করেছিলেন Rösch নামক জনৈক শ্রমিক। মাউয়ের প্রথমে গবেষক O. Schoentensack -কে এই জীবাশ্মটি প্রথম দেখান। পরে এই গবেষক এই নমুনার নামকরণ করেন এবং এই প্রজাতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেন।  অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে এর নামকরণ করেন Schoetensack । এই জীবাশ্মের চোয়াল ছিল বেশ ছোটো। এদের দাঁতের গড়ন ছিল মানুষের মতো, কিন্তু চোয়ালের গড়ন মানুষের  মতো ছিল না। চোয়ালটির অস্থি ছিল বেশ মজবুত এবং বড়। এই আবিষ্কারের পর থেকেই এটি হাইডেলবার্গের মানব নাম পরিচিতি লাভ করে। এরপর এই জাতীয়  আরও অনেক জীবাশ্ম পাওয়ার পর, এর প্রজাতিগত নাম দেওয়া হয়- Homo heidelbergensis

১৯২১ সালের ১৭ জুন তারিখে, জাম্বিয়ার কাব্‌উয়ে
(Kabwe) থেকে Tom Zwiglaar নামক একজন শ্রমিক একটি খুলি আবিষ্কার করেন। পরে এই খুলিটি পরীক্ষার জন্য আর্থার স্মিথ উডওয়ার্ড (Arthur Smith Woodward) -এর কাছে পাঠানো হয়। উডওয়ার্ড নেচার পত্রিকার ১০৮ সংখ্যায় এই খুলিটি সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। তিনি একে একটি পৃথক প্রজাতি বিবেচনা করে নামকরণ করেন Homo rhodesiensis (হোমো রোডেসিয়েনসিস)।

রোডেশিয়ান-মানবের খুলি


এই খুলিটি সাধারণ মানুষের কাছে রোডেশিয়ান-মানব (Rhodesian Man) নামে পরিচিত হয়। পরে হাইডেলবার্গ-মানবের সাথে এর মিল থাকায়- এর নাম রাখা হয় Homo heidelbergensis । কিন্তু মাথার খুলির মাপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- রোডেশিয়া হোমো রোডেসিয়েনসিস ) মানবের খুলির মাপ ছিল হাইডেলবার্গেনসিস-এর চেয়ে বড়। অনেকে এই প্রজাতিকে হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস এবং ক্রো-ম্যাগনান এর পূর্ব-পুরুষ হিসাবে বিবেচনা করে থাকেন। কাব্‌উয়ে থেকে প্রাপ্ত খুলির মাপ ছিল ১২০০ সিসি। ধারণা করা হয়, এই খুলির অধিকারী প্রাণীটি ৩ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিক জীবিত ছিল।
 

রোডেশিয়ান-মানবের খুলি

১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানির স্টুটগার্ডের ২০ কিলোমিটার উত্তরে একটি মাথার  খুলি আবিষ্কৃত হয়। এই খুলিটির নাম রাখা হয়েছে
Steinheim skull । ধারণা করা হয় এই ২ লক্ষ ৫০ হাজার বৎসরের পুরানো। এর মাপ ছিল ১১১০-১২০০ সিসি।
 

আরাগো খুলি

১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সের টাউটাভেলের আরাগো গুহায় এই প্রজাতির জীবাশ্ম পাওয়া যায়। উল্লেখ্য একই প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্র থেকে পাওয়া গিয়েছিল প্রায় সহাস্রাধিক পাথরের যন্ত্রপাতি এবং  নানা জীবজন্তুর জীবাশ্ম। এখানে প্রাপ্ত হাইডেলবার্গ মানবের খুলিটি ছিল বেশ বড়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সম্ভবত এটি ছিল কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের কঙ্কাল। এই জীবাশ্মগুলোর সময় ধরা হয়েছে ৪ থেকে ২.৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।

এদের জীবনযাপনের সাথে সম্পর্কিত যন্ত্রপাতি এবং দেহগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে ধরনে বিতর্ক আছে। এদেরকে সরাসরি হোমো ইরেক্টাসদের সদস্য হিসেবে অনেকে দাবি করেছেন। আবার অনেকে হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। নানা ধরনের গবেষণার পর, একে একটি স্বতন্ত্র প্রজাতি হিসেবে সকলে স্বীকার করে নিয়েছে।

সম্ভবত হোমো গণের ভিতর এই প্রজাতিই প্রথম তাদের মরদেহ কবর দিত। এদের ভিতরে ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা জন্মেছিল। অবশ্য এদের আগেই হোমো এর্গাস্টারদের ভিতর কথা বলার উপযোগী স্বরতন্ত্র এবং বাগ্-প্রত্যঙ্গের বিকাশ হয়েছিল। এরা শিকারের জন্য নিক্ষেপণযোগ্য বর্শা ব্যবহার করতো। বিভিন্ন জীবাশ্ম পর্যালোচনার পর, বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন এদের উচ্চতা ছিল প্রায় ১৪০ সেন্টিমিটার। তুলনামূলকভাবে এদের পা দেহের উপরের অংশের চেয়ে বড় ছিল। এদের উজ্জ্বল ও মোটা অস্থি দেখে ধারণা করা যায় যে, দৈহিকভাবে এরা বেশ সবল ছিল।

এদের মস্তিষ্কের গড় মাপ ছিল ১২৫০ সিসি। মস্তিষ্কের সম্মুখভাগে ছিল ছোটো চক্ষু-গহ্বর। এই গহ্বরের উপরে ছিল বাঁকানো ভ্রূ-রেখা। মুখের চোয়াল ততটা প্রশস্ত ছিল না। এর ফলে এরা আগের প্রজাতিগুলোর মতো বড় হা করতে পারতো না। নিচের চোয়াল বেশ মজবুত ছিল। আগের প্রজাতিদের চেয়ে এদের দাঁত ছোটো ছিল। তবে
আকারে আধুনিক মানুষদের চেয়ে বড় ছিল।

ক্ল্যাক্টোনিয়ান যন্ত্রপাতি

এরা ছিল মূলত শিকারী। শিকারের জন্য এরা পাথরের তৈরি নানা আকারের অস্ত্র ব্যবহার করতো। এছাড়া মাটি খনন, মাংস কাটা বা থ্যাঁৎলানোর জন্য পাথরের কুঠার ব্যবহার করতো। এদের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি ছিল হোমো এর্গাস্টারদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতরির মতো। এর বাইরে এরা এন্টলার হরিণের অস্থি এবং কাঠ দিয়ে অস্ত্র তৈরি করা শিখেছিল। এসকল উপকরণ দিয়ে এরা হাতুরি, বর্শা ইত্যাদি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। ৪ লক্ষ ২৪ হাজার থেকে ৪ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এদের হাতে সৃষ্টি হয়েছিল ক্ল্যাক্টোনিয়ান যন্ত্রপাতি

এরা আগুন জ্বালানো এবং আগুন নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবহার করা শিখেছিল।
রাতে হিংস্র পশুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এরা গুহার সম্মুখভাবে আগুন জ্বালিয়ে রাখতো। এছাড়া মাংস পুড়িয়ে খাওয়াত জন্য এরা আগুন ব্যবহার করতে শিখেছিল।

আয়োনিয়ান আমলে (৭.৮১- ১.২৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং সমগ্র সাইবেরিয়া অঞ্চলে ব্যাপক শৈত প্রবাহ বিদ্যমান ছিল। ইউরোপের হিমশীতল পরিবেশে এদের টিকে থাকার জন্য আগুনের ব্যবহারটা অত্যন্ত জরুরি ছিল। সম্ভবত এই সময় এরা শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মোটা পশুর চামড়া ব্যবহার করা শিখেছিল। এরূপ হিমশীতল পরিবেশে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে মাংস, হাড়, চামড়া সংগ্রহের জন্য বড় বড় পশু শিকার করতো দলবদ্ধভাবে। তখন এদের শিকারের তালিকায় ছিল- গণ্ডার, জলহস্তি, ভল্লুক, ঘোড়া, নানা ধরনের হরিণ।


ধারণা করা হয় ৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এরা আফ্রিকাতেই ছিল। খাদ্য সংকট এবং প্রাকৃতি পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে ৪-৩ লক্ষ বছর পূর্বে আফ্রিকা ইউরেশিয়ার দিকে চলে আসে। এরা জর্মান, ইতালি, স্পেন, গ্রিস প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের একটি শাখা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল বলে ধারণা করা যায়। উত্তর ভারতের নর্মদা নদীর তীরে এদের একটি অংশ বসতি স্থাপন করেছিল।