নিম্ন প্রস্তরযুগ
(Lower Palelithic stage)
ব্যাপ্তী ৩৩ থেকে ৩ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।
প্লিয়োসিন
অন্তঃযুগের যুগের দ্বিতীয় এবং শেষ আমল হিসেবে অভিহিত
পিয়াসেনজিয়ান
-এর সময়সীমা ছিল ৩৬-২৫.৮ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এই আমলে পৃথিবীর আবহাওয়া বেশ গরম ও আর্দ্র ছিল। সাগরের পানি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মহাসাগরীয়
উপকূলীয় অঞ্চল প্লাবিত হয়েছিল। এই সময় আবাহওয়ার পরিবর্তনের ফলে
আফ্রিকার
ইথিওপিয়া অঞ্চলের গভীর অরণ্য হাল্কা হয়ে গিয়েছিল। ফলে অনেক স্থানে ফাঁকা জায়গা
তৈরি হয়েছিল। আর এ সব ফাঁকা জায়গা পূরণ করেছিল ঘাস। এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে সৃষ্টি
হয়েছিল 'সাভানা' অঞ্চল।
এই সময়
অস্ট্রালোপিথেকাস
গণের ৫টি প্রজাতির উদ্ভব হয়েছিল এবং
জীবের ক্রমবিবর্তনের ধারায় হয়েছিল
অস্ট্রালোপিথেকাসদের
নিকট জ্ঞাতী বা কোনো এক অজ্ঞাত প্রজাতি থেকে
হোমো হ্যাবিলিসদের উদ্ভব
হয়েছিল।
নিম্ন-প্রস্তর যুগের ব্যাপ্তীকালকে মোটামুটিভাবে খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩ থেকে ৩ লক্ষ
অব্দের ভিতরে ধরা হয়। এই সময়ের ভিতরে মোটা দাগে যে সকল সভ্যতাকে বিশেষভাবে
কয়েকটি স্তরে ভাগ করা হয়। এই ভাগগুলো হলো-
লোমেক্উই (৩৩ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ):
পিয়াসেনজিয়ান
আমলে হোমিনিনি
গণ থেকে ৩৫-৩২ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে উদ্ভব হয়েছিল
কেনিয়ান্থ্রোপাস
নামক নূতন একটি গণ। এই গণের
Kenyanthropus platyops
প্রজাতি কেনিয়ার তুর্কানা হ্রদের কাছে বসবাস করতো। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সোনিয়া হার্মার্ড এবং
জেসন লুইস কেনিয়ার তুর্কানা হ্রদের কাছে কিছু পাথরের তৈরি যন্ত্রপাতির সন্ধান পান। গবেষকরা এই ক্ষেত্রের নামকরণ করেন
লোমেক্উই
।
এই নতুন ক্ষেত্রটিতে পাওয়া যায় এমন কিছু যন্ত্র, যেগুলো পাথর ঘষে তৈরি করা হয়েছিল।
এই গণের জীবন-যাপনে প্রথম সৃজনশীল কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়। এর আগের প্রজাতিগুলো,
জন্মগ্তসূত্রে প্রাপ্ত সহজাত ক্ষমতায় যা করতে পারতো, তার বাইরে কিছু ভাবাটা প্রয়োজন
মনে করে নি।
কেনিয়ান্থ্রোপাস
গণের এই প্রজাতিটি, এর বাইরে বেরিয়ে এসে পাথরকে ঘষে ঘষে যন্ত্র তৈরি করেছিল। মটি খনন,
হিংস্র জন্তু থেকে আক্রমণ প্রতিহতকরণ, মাংস কর্তন বা থেঁতলানোর জন্য এরা এই পাথুরে যন্ত্র ব্যবহার করতো।
গাছ থেকে কাঠ সংগ্রহ করতো।
সেকালের পরিবেশে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য এই টুকু ক্ষমতাই হয়তো পর্যাপ্ত ছিল না। তাই ৩২ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে
এরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
প্রায় ৩৩ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে
অস্ট্রালোপিথেকাস এ্যানামেনসিসরা
তৈরি পাথুরে অস্ত্র ব্যবহার করতো, এমন নমুনা পাওয়া যায়।
তবে কেনিয়ান্থ্রোপাস
ও
অস্ট্রালোপিথেকাস এ্যানামেনসিসদের
অস্ত্র ছিল আকারে অনেক বড়। ফলে
এর যথার্থ ব্যবহার নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
ওল্ডুভিয়ান সভ্যতা (২৬
থেকে ১৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
পিয়াসেনজিয়ান
আমলের শেষের দিকে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমে যেতে থাকে এবং বরফ যুগের পরিবেশ
সৃষ্টি হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে এই বরফযুগের
প্রভাবে উত্তর গোলার্ধের মেরু সংলগ্ন এলাকার জলস্থল বরফ ঢেকে গিয়েছিল।
এই সময়ের এই পরিবেশে সেই অজ্ঞাত প্রজাতি বিবর্তনের মধ্য ভিতরে
২৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে
হোমো হ্যাবিলিসদের উদ্ভব হয়েছিল।
নিম্ন প্রস্তর যুগের
(Lower Palelithic stage)
দ্বিতীয় অধ্যায়ের অবতারণ করেছিল
হোমো হ্যাবিলিসরা।
এরা আত্মরক্ষা এবং
শিকারের জন্য অস্ত্র তৈরি করতে শিখেছিল। এদের প্রধান শত্রু ছিল- সেকালের শিকারী
হায়না
(Chasmaporthetes nitidula)
, লেপার্ড, সাবার-টুথ, কুমির। এদের দ্বারা সৃষ্ট সভ্যতার প্রথম নমুনা
পাওয়া যায় পূর্ব-আফ্রিকার তাঞ্জানিয়ার ওল্ডুভাই জর্জ
(Olduvai Gorge)
অঞ্চলে।
পরবর্তী
গেলাসিয়ান আমল
(২৫.৮-১৮.৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
শেষভাগে অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ১৮ লক্ষ ৬ হাজার অব্দের ভিতরে বরফের আগ্রাসন
বিষুব অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এর ফলে এই সময়ে উত্তর মহাসাগর বিশাল
বরফ-প্রান্তরে পরিণত হয়।
এই সময় শিকারের জন্য এরা বহনযোগ্য পাথরকে ঘষে মেজে আঘাত করার যোগ্য করে তুলেছিল।
বিজ্ঞানীরা আদিম কালের সে সকল পাথরের টুকরোকে কুঠার নামে অভিহিত করে থাকেন।
এই কুঠারে
কোনো হাতল ছিল না। এই কুঠার মুঠোবন্দি করে, সজোরে আঘাত হানা হতো। এই কুঠারের
সাহায্যে এরা গাছের ছালবাকল বা কন্দ থেঁৎলানো, শিকারকে আঘাত করা এবং বন্য প্রাণীর
আক্রমণ প্রতিহত করার কাজ করতো। এ ছাড়া কাঠ চেরা, নরম জিনিস কাটার জন্যও
ব্যবহার করতো এই কুঠার। এই কুঠারের আঘাতকারক অংশ ছিল সুঁচালো। হোমো হ্যাবিলিসদের এই
কুঠার উন্নতর হয়েছিল পরবর্তী পরবর্তী ১৪ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত ক্রমবিবর্তনের ধারায়। এই ধারায়
হোমো হ্যাবিলিসরা কুঠারকে দীর্ঘ করেছিল এবং প্রান্তভাগ অধিকরতর সুঁচালো করতে সক্ষম
হয়েছিল।
হোমো হ্যাবিলিসদের বড় সমস্যা ছিল, এরা সটান মাটির উপর
দাঁড়াতে পারতো না। তাছাড়া মস্তিষ্কের পরিমাপের বিচারে ধরা হয়, সৃজনশীল দক্ষতায়
খুব বেশি পটু হওয়া সম্ভব ছিল না। এই দুটি প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে আবির্ভূত
হয়েছিল
হোমো ইরেক্টাসরা।
হোমো ইরেক্টাসদের
ক্রমবিকাশ
ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সূত্রে জানা যায়,
গেলাসিয়ান আমল
(২৫.৮-১৮.৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
শেষভাগে অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ১৮ লক্ষ ৬ হাজার অব্দের ভিতরে বরফের আগ্রাসন
বিষুব অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
পৃথিবীর
ক্রমবিবর্তনের ধারায় তখন চলছিল
প্লেইস্টোসিন অন্তঃযুগ। এই অন্তঃযুগের ২৫.৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে শুরু
হয়েছিল
কোয়াটার্নারি বরফযুগ'। প্রাথমিক পর্যায়ে এই বরফযুগের প্রভাবে উত্তর
গোলার্ধের মেরু সংলগ্ন এলাকার জলস্থল বরফ ঢেকে গিয়েছিল। ২০.৬ লক্ষ
খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পরে বেশকিছু
হিমযুগ ও
আন্তঃ হিমযুগ সংঘটিত হয়েছিল। এর ফলে এই সময়ে উত্তর মহাসাগর বিশাল বরফ-প্রান্তরে
পরিণত হয়েছিল। এই বরফশীতল পরিবেশের ভিতরে ২০ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে
আফ্রিকার পরিবেশ ও শীতল দশায় পৌঁছেছিল
এবং এই পরিবেশে
হোমো ইরেক্টাস স্বতন্ত্র প্রজাতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল।
এদের গড় উচ্চতা ছিল ১.৮
মিটার। এদের গড় ওজন ছিল ৬০ কেজি। খুলির গড়ন ছিল আধুনিক মানুষের মতো। খুলির
পরিমাপ ছিল ৯০০-১১০০ সিসি। এরা আধুনিক মানুষের মতো দুই পায়ে সোজা হয়ে হাঁটতো
এবং হাত ও পায়ের আনুপাতিক দৈর্ঘ্য ছিল আধুনিক মানুষের মতো।
সটান মাটির উপর দাঁড়ানোর জন্য
এরা তাদের স্বাভাবিক দৃষ্টিকে বহুদূরে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেল। পায়ে ভর দিয়ে
চলাফেরার জন্য এদের হাত মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। ফলে হাতকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের
ক্ষেত্রে হোমো হ্যাবিলিসদের চেয়ে এরা এগিয়ে ছিল। তাই আফ্রিকার আদি বাসভূমিতে
যখন খাদ্য সঙ্কট দেখা দিল, তখন এরা দ্রুত অন্যত্র চলে যেতে সক্ষম হয়েছিল। এই
সূত্রে এদের একটি অংশ যাযাবরের মতো চলমান জাতিতে পরিণত হয়েছিল। কোনো বিশেষ
পরিবেশে থেকে, সেখানকার প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে বসতি স্থাপন করবে এমন
ভাবনা তাদের ছিল না। কারণ এরা নিজদের খাবার নিজেরা তৈরি করতে পারতো না। ফলে
প্রকৃতির
উপর নির্ভরশীল এই প্রজাতি দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদের অভিযাত্রার প্রথম
দিকে অর্থাৎ ১৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই প্রজাতিটিই
আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে এদের একটি শাখা ইউরেশিয়ায়
প্রবেশ করে। ইউরেশিয়া শাখার হোমো ইরেকটাসরা দুটি বিভাজিত হয়ে গিয়েছিল। এর একটি
শাখা ইউরোপের ককেশাশ অঞ্চলে থেকে যায়। অবশিষ্ট অংশের একটি দল প্রথমে চীনে
প্রবেশ করে। পরে এদের একটি দল ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপাঞ্চলে চলে যায়। বিশাল
অঞ্চল জুড়ে এই প্রজাতিটি ছড়িয়ে পড়ার কারণে, বিভিন্ন স্থানে এই প্রজাতিটির
বিবর্তিত হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন ধারায়। এসকল প্রজাতির জীবাশ্মগুলোকে বিভিন্ন সময়ে
নানা ভাবে এবং নানা নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন-
জাভা মানব,
সোলো মানব,
পিকিং মানব ইত্যাদি।
আফ্রিকার হোমো ইরেক্টাস
আফ্রিকার ওল্ডুভাই জর্জ অঞ্চলে এর জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয় ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে। এর বয়স
নিরূপণ করা হয়েছে ১২ লক্ষ ৫০ হাজার বৎসর।
|
পাথরের কুঠারের নমুনা
|
এরা পাথর বা পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করতে শিখেছিল। এবং গাছের গুড়ি খণ্ড-বিখণ্ড করার
জন্য পাথরের কুঠার ব্যবহার করতো। এছাড়া মটির ভিতর থেকে মূল-জাতীয় খাদ্য সংগ্রহের
জন্য। এছাড়া পশু হত্যার জন্য এই কুঠারের ব্যবহার ছিল। আর শিকারের জন্য বর্শা হিসাবে
ব্যবহার করতো সুচালো গাছের ডাল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাথুরে সুচালো অংশ ডালের
সাথে বেঁধে ব্যবহার করতো। এছাড়া বড় বড় প্রাণীর হাড়,শিঙ-কেও অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার
করতো। খাদ্যের জন্য দলবদ্ধভাবে বড় বড় পশু শিকার করতো এবং মাংস আগুনের পুড়িয়ে
খাওয়া শিখেছিল। এছাড়া ফলমুল খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করতো।
১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ইথিওপিয়ার মধ্য আওয়াশ
অঞ্চলে ডাব্লিউ হেনরি গিলবার্ট কিছু জীবাশ্ম নমুনা পাওয়া গেছে। এর নাম-Daka
BOU-VP-2/66। এর বয়স ধরা হয়েছে ১০
লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।
আশুলিয়ান সভ্যতা (১৭ লক্ষ থেকে ১৩ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
নিম্ন প্রস্তরযুগের শেষ অধ্যায় রচিত
হয়েছিল
হোমো এর্গাস্টারদের
দ্বারা। ধারণা করা হয়, হোমো ইরেক্টাসদের আবির্ভাবের প্রায় ১ লক্ষ বছর পর,
১৯ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আবিরর্ভূত
হয়েছিল
হোমো এর্গাস্টার নামক অপর একটি প্রজাতি। আর ১৪ লক্ষ খ্রিষ্টপর্বাব্দের
ভিতরে এই প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
এরা মাটির উপর দুই পায়ে সটান দাঁড়াতে পারতো। তাই প্রথম দিকে কোনো কোনো
বিজ্ঞানী একে
হোমো ইরেক্টাস-এর উপ-প্রজাতি হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। বর্তমানে একে একটি
পৃথক প্রজাতি হিসাবেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। হোমো গণের আগের প্রজাতিগুলো
অপেক্ষা এদের বুদ্ধি ছিল বেশি। এদের মাথার খুলির মাপ ছিল ৭০০-৮৫০ সিসি। ধারণা
করা হয় এদের গড় উচ্চতা ছিল ১.৯ মিটার। এদের নিতম্বের হাড়ের গড়ন দেখে মনে হয়- এরা
দীর্ঘপথ হাঁটতে বা দৌড়াতে পারতো। এদের হাতের ও পায়ের গড়ন ছিল আধুনিক মানুষের
মতো।
|
ফ্রান্সে প্রাপ্ত আশুলিয়ান কুঠারের নমুনা |
১৯ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আবিরর্ভূত হয়েছিল হোমো গণের আরও দুটি প্রজাতি।
সম্ভবত এরা আগুনের ব্যবহার শিখেছিল। এই কারণে,অনেকে এদেরকে সরাসরি মানুষের
পূর্ব-পুরুষ হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। মূলত এদের সাথে
হোমো ইরেক্টাসের অনেক মিল থাকলেও- ধারণা করা এরা পূর্ববর্তী কোনো
অজ্ঞাত প্রজাতি থেকে বিবর্তিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
হোমো গণের কয়েকটি প্রজাতির ভিতরে নিম্ন প্রস্তরযুগের
তৃতীয় ধাপ সম্পন্ন হয়েছিল। পাথুরে অস্ত্রের নিদর্শনের বিচারে এদেরকে সাধারণভাবে
আশুলিয়ান সভ্যতা হিসেবে বিবেচনা
করা হয়। ভৌগোলিক অবস্থান এবং সময়ের বিচারে এই সভ্যতাকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করা
যায়। যেমন-
(Madrasian Civilization):
১৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
সম্ভবত
হোমো ইরেক্টাসদেরএকটি দল ইউরেশিয়া ঘুরে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল ১৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের
দিকে। এবং এরা দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজ (আধুনিক নাম চেন্নাই) অঞ্চলে বসতি স্থাপন
করেছিল। এদের দ্বারাই ভারতে নিম্ন প্রস্তরযুগের সূচনা হয়েছিল। এদের যন্ত্রপাতি ছিল
আশুলিয়ান যন্ত্রপাতির
মতোই। চেন্নাই শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে আট্টিরামপক্কম নাম প্রত্নক্ষেত্রে
আশুলিয়ান যন্ত্রপাতির
সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে। ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ রবার্ট ব্রুচ
ফুট এই যন্ত্রপাতি উদ্ধার করেন। গবেষকদের মতে এই যন্ত্রপাতিগুলো প্রায় ১৫ লক্ষ
খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে
হোমো ইরেক্টাস বা একট নিকট জ্ঞাতি
হোমো এর্গাস্টাদের
অভিবাসী দল। ধারণা করা হয় এই আমলের ১৪ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এরা
বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
হোমো হাইডেলবার্গেনসিস সভ্যতা
(৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
হোমো ইরেক্টাসদের ক্রমোন্নতির মধ্যে আবির্ভাব হয়েছিল
হোমো হাইডেলবার্গেনসিস নামক প্রজাতির।
প্রায় ৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আফ্রিকায় এদের আবিরর্ভাব
হয়েছিল। সম্ভবত হোমো গণের ভিতর এই প্রজাতিই প্রথম তাদের মরদেহ কবর দিত। এদের ভিতরে ভাষা
ব্যবহারের ক্ষমতা জন্মেছিল।
অবশ্য এদের আগেই
হোমো এর্গাস্টারদের
ভিতর কথা বলার উপযোগী স্বরতন্ত্র এবং বাগ্-প্রত্যঙ্গের বিকাশ
হয়েছিল। এরা শিকারের জন্য নিক্ষেপণযোগ্য বর্শা ব্যবহার করতো।
বিভিন্ন জীবাশ্ম পর্যালোচনার পর, বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন এদের উচ্চতা ছিল প্রায় ১৪০ সেন্টিমিটার।
তুলনামূলকভাবে এদের পা দেহের উপরের অংশের চেয়ে বড় ছিল।
এদের উজ্জ্বল ও মোটা অস্থি দেখে ধারণা করা যায় যে, দৈহিকভাবে এরা বেশ সবল ছিল।
এদের মস্তিষ্কের গড় মাপ ছিল ১২৫০ সিসি। মস্তিষ্কের সম্মুখভাগে ছিল ছোটো চক্ষু-গহ্বর। এই গহ্বরের উপরে ছিল বাঁকানো
ভ্রূ-রেখা। মুখের চোয়াল ততটা প্রশস্ত ছিল না। এর ফলে এরা আগের প্রজাতিগুলোর মতো বড় হা করতে পারতো না। নিচের চোয়াল
বেশ মজবুত ছিল। আগের প্রজাতিদের চেয়ে এদের দাঁত ছোটো ছিল। তবে
আকারে আধুনিক মানুষদের চেয়ে বড় ছিল।
এরা ছিল মূলত শিকারী। শিকারের জন্য এরা পাথরের তৈরি নানা আকারের অস্ত্র ব্যবহার করতো। এছাড়া মাটি খনন,
মাংস কাটা বা থ্যাঁৎলানোর জন্য পাথরের কুঠার ব্যবহার করতো। এদের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি ছিল
হোমো এর্গাস্টারদের
ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মতো। এর বাইরে এরা এন্টলার হরিণের অস্থি এবং কাঠ দিয়ে অস্ত্র তৈরি করা শিখেছিল। এসকল উপকরণ দিয়ে এরা
হাতুরি, বর্শা ইত্যাদি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। এরা আগুন জ্বালানো এবং আগুন নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবহার করা শিখেছিল।
আয়োনিয়ান আমলে
(৭.৮১- ১.২৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং সমগ্র সাইবেরিয়া অঞ্চলে ব্যাপক শৈত প্রবাহ বিদ্যমান ছিল।
ইউরোপের হিমশীতল পরিবেশে এদের টিকে থাকার জন্য আগুনের ব্যবহারটা অত্যন্ত জরুরি ছিল। সম্ভবত এই সময় এরা শীত থেকে
রক্ষা পাওয়ার জন্য মোটা পশুর চামড়া ব্যবহার করা শিখেছিল। এরূপ হিমশীতল পরিবেশে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে মাংস, হাড়, চামড়া সংগ্রহের জন্য বড় বড় পশু শিকার করতো দলবদ্ধভাবে। তখন
এদের শিকারের তালিকায় ছিল- গণ্ডার, জলহস্তি, ভল্লুক, ঘোড়া, নানা ধরনের হরিণ।
ধারণা করা হয় ৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এরা আফ্রিকাতেই
ছিল। খাদ্য সংকট এবং প্রাকৃতি পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে
৪-৩ লক্ষ বছর পূর্বে আফ্রিকা ইউরেশিয়ার দিকে চলে আসে।
এরা জর্মান, ইতালি, স্পেন, গ্রিস প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের একটি শাখা
ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল বলে ধারণা করা যায়। উত্তর ভারতের নর্মদা নদীর তীরে এদের
একটি অংশ বসতি স্থাপন করেছিল।
এই দলটি পরে দুটি স্বতন্ত্র দলে পরিণত হয়। এই দল দুটি হলো-
হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস
ও
ডেনিসোভান মানব।
তবে
ডেনিসোভান মানবের
আবির্ভাব হয়েছিল আরও পরে।
সোয়ানিয়ান সভ্যতা
(Soanian Civilization)
৫ থেকে ১.২৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
ভারত উপমহাদেশের শিবালিক পাহাড়ের আশপাশে
হোমো ইরেক্টাসরা বসতি স্থাপন করেছিল। পরে সোয়ান উপত্যাকার নামানুসারে এই সভ্যতাকে সো্য়ান সভ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বর্তমানে এই অঞ্চলটি ছড়িয়ে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল জুড়ে। এদের অস্ত্রের
ধরন ছিল
আশুলিয়ান যন্ত্রপাতির মতোই।
হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস
সভ্যতা
প্রায় ৫
লক্ষ ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে আফ্রিকা
এবং ইউরেশিয়ায় বসবাসকারী
হোমো
গণের
এই
প্রজাতিটি আবির্ভূত হয়েছিল। এরা
নিম্ন্ প্রস্তরযুগের
অংশভাগী ছিল।
এরা পাথুরে অস্ত্র ব্যবহার
করতো। এই সূত্রে এরা শিকারে দক্ষ হয়ে উঠেছিল। এক্ষেত্রে তারা কুঠার, বর্শা ব্যবহার
করতো। বর্শাফলকের সাথে তারা কাঠের দণ্ড ব্যবহার করতো। এদের অস্ত্রের গঠন দেখে ধারণা
করা হয়েছে যে, এরা ম্যামথ (বিলুপ্ত হাতীজাতীয় প্রাণী) বড় বড় প্রাণী হত্যা করতে
পারতো।
প্রায় ৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এরা আফ্রিকার
মরক্কো অঞ্চলে বসতি গড়ে তুলেছিল এবং প্রায় ৩ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে
এরা এই অঞ্চলের একটি শক্তিশালী জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল।
এদের একটি শাখা ৩ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে ইউরেশিয়ায় প্রবেশ করেছিল এবং
ইউরেশিয়ার বিভিন্ন অংশে এদের সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল।
এই প্রজাতিকে আধুনিক মানুষের ঠিক পূর্ববর্তী প্রজাতি হিসাবে গণ্য করা হয়। আবার
কেউ কেউ মনে করেন এরা ছিল আধুনিক মানুষের (হোমো স্যাপিয়েন্স) সমান্তরাল প্রজাতি।
গোড়ার দিকে এরা মরক্কো'র টান-টান নগরীর আশপাশ জুড়ে
বসবাস করতো। খ্রিষ্টাপূর্ব ৪,৫০,০০০ অব্দের ভিতরে
হোমো ইরেক্টাস-দের পাশাপাশি এরা মিশ্র সভ্যতার
পত্তন ঘটিয়েছিল। সম্ভবত
প্রায়
৪ থেকে সাড়ে ৩ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের
ভিতরে এরা জনসংখ্যা বৃদ্ধি
এবং সেই সাথে খাদ্যাভাবের কারণে এরা এশিয়া এবং ইউরোপে প্রবেশ করেছিল।
জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার তাগিদে এরা নানা ধরনের পাথুরে অস্ত্রশস্ত্র এবং যন্ত্রপাতি
তৈরি করার কৌশল আয়ত্ত করেছিল। এর বাইরে সৌন্দর্য-সুখের তাড়নায় এরা নানা ধরনের
শৈল্পিক সৃষ্টির দিকে হাত বাড়িয়েছিল।
৫ থেকে সাড়ে ৩ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের
ভিতরে নিয়ানডার্থালদের একটি দল আফ্রিকার মরোক্কোর বর্তমান টান-টান নগরীর অদূরে বসতি
স্থাপন করেছিল। এই অঞ্চলে পাওয়া গেছে আদিম ভাস্কর্য
টান-টানের ভেনাস। সম্ভবত এই সময়ে এদের ভিতরে ধর্মীয়
বোধের বিকাশ ঘটতে শুরু করেছিল। সম্ভবত এই সময় আদি মাতৃদেবীর ধারণা বিকশিত হয়েছিল। সেই সূত্রে
প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট মানবীর আকৃতির প্রস্তর খণ্ডকে এরা মাতৃদেবীর প্রতীক হিসেবে
গ্রহণ করেছিল। পরে এই মূর্তিটি সংস্কার করে নতুন রূপ দিয়েছিল। স্ফটিক পাথরের নির্মিত এই মূর্তিটির উচ্চতা প্রায় ৬ ইঞ্চি, প্রস্থ প্রায়
২.৬ ইঞ্চি। ওজন প্রায় ১০ গ্রাম।
১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে এই মূর্তিটি আবিষ্কার করেছিলেন জার্মানির প্রত্নতত্ত্ববিদ লুৎজ ফিয়েডলার
(Lutz Fiedler)
।
মরক্কোর টান-টান নগর থেকে কিছু দূরে ড্রা নদীর তীরে এই মূর্তিটি তিনি পেয়েছিলেন। পরে টান-টান নগরের নামানুসারে
এর নামকরণ করেছিলেন টান-টান-এর ভেনাস (Venus
of Tan-Tan)।
হোমো হাইডেলবার্গেনসিস
শিকারের জন্য এরা পাথরের তৈরি নানা আকারের অস্ত্র ব্যবহার করার
মধ্য দিয়ে উন্নতর পাথরে যন্ত্রপাতি তৈরি করেছিল।
এ মাটি খনন,
মাংস কাটা বা থ্যাঁৎলানোর জন্য পাথরের কুঠার ব্যবহার করতো।
কিন্তু বড় বড় প্রাণী হত্যা করা বা এদের মাংস কাটার জন্য প্রয়োজন ছিল ভারি ও
ধারালো। এই তাড়না থেকে এরা প্রায়
৪ লক্ষ ২৪ হাজার থেকে ৪ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এদের হাতে সৃষ্টি হয়েছিল
ক্ল্যাক্টোনিয়ান যন্ত্রপাতি।
এই অস্ত্রগুলো এরা ব্যবহার করতো হাতি এবং জলহস্তী শিকার এবং এদের মাংস
কাটার জন্য।
নিম্ন প্রস্তর যুগের ক্রমবিবর্তনের ধারায় এর পরে আমরা পাই 'মুঘারান
যন্ত্রপাতি'। এই যন্ত্রপাতির বিকাশ ঘটেছিল ৪ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ ২০ হাজর ভিতরে
মূলত
অস্ট্রালোপিথেকাস এ্যানামেনসিস,
হোমো হ্যাবিলিস,
হোমো ইরেক্টাস,
হোমো হাইডেলবার্গেনসিস এবং
হোমো নিয়ানডার্থালেনসিসদের দ্বারা
নিম্নপ্রস্তর যুগ সংঘটিত হয়েছিল।
এই সময়ে আবির্বভুত হয়েছিল হোমো গণের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রজাতি
হোমো স্যাপিয়েন্স
প্রায় ৩ লক্ষ ৫০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এদের আবির্ভাব ঘটেছিল
আফ্রিকার
মরোক্কো অঞ্চলে। আর পরবর্তী ৫০ হাজার বছর আফ্রিকার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়া শুরু
করেছিল। তবে নিম্নপ্রস্তর যুগের এদের সৃষ্ট যন্ত্রপাতির বিশেষ কোনো নিদর্শন পাওয়া
যায় না। ৩ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের নিম্ন প্রস্তর যুগ শেষ হয়ে যায়। পরে এই
যুগকে
হোমো ইরেক্টাস,
হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস
এবং
হোমো স্যাপিয়েন্স
এই ধারাকে টেনে গিয়েছিল মধ্য প্রস্তরযুগ অবধি।
সূত্র
https://www.ancient.eu/Stone_Age/