মানব সভ্যতার কালানুক্রমিক ইতিহাস
প্রথম পর্ব: [৩৬-৩.৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ]
হোমো স্যাপিয়েন্স
তথা আধুনিক মানুষের ইতিহাসের কথা যদি বলা যায়, তাহলে মোটা দাগে
বলতে হয়-
প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ বৎসর আগে
প্রাইমেট
বর্গের অন্তর্গত
হোমিনিডি
গোত্রের
হোমো
গণের অন্তর্গত
Homo sapiens
এর আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকার মরোক্কোর জেবেল ইর্হৌদ (Jebel
Irhoud)
-তে। উল্লেখ্য আগে মনে করা হতো, দুই লক্ষ বৎসর আগে আদি মানুষের উদ্ভব ঘটেছিল ইথিওপিয়া অঞ্চলে।
উল্লেখ্য,
হোমো স্যাপিয়েন্সের একটি উপ-প্রজাতি
১ লক্ষ ৬০ হাজার বৎসর আগে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হয়েছিল। এই প্রজাতিটি হলো
Homo sapiens idaltu।
আধুনিক মানুষের মূল প্রজাতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়- Homo sapiens
sapiens
উপ-প্রজাতিকে।
কিন্তু মানুষ সভ্যতার ইতিহাসের কথা বললে, প্রথমেই প্রশ্ন জাগে, আধুনিক মানুষের আদিম সভ্যতা কি শুধুই এদের দ্বারাই শুরু হয়েছিল। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যায়, হোমো স্যাপিয়েন্স-এর আগে থেকে আদিম মানব সভ্যতার প্রস্তর যুগের সূচনা হয়েছিল, মানবেতর কিছু প্রজাতির মাধ্যমে। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রে আদিম সভ্যতার যে সব নমুনা এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেছে, সে সব নমুনার নিরিখে দেখা যায়- আদিম সভ্যতার সূচনা ঘটেছিল সৃজনশীল পিয়াসেনজিয়ান (৩৬-২৫.৮ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) আমলের প্রায় ৩৩ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে। এই সময়ের নমুনা পাওয়া গিয়েছে কেনিয়ার লোমেক্উই প্রত্নক্ষেত্র থেকে। তাই মানুষের সভ্যতার বিকাশে হোমো স্যাপিয়েন্স-এর পূর্বসূরীদের অবদানের কথা অনিবার্যভাবে চলে আসে।
লোমেক্উই সভ্যতা (পিয়াসেনজিয়ান: ৩৬-২৫.৮ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
হোমিনিনি গণ থেকে ৩৫-৩২ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে উদ্ভব হয়েছিল কেনিয়ান্থ্রোপাস নামক নূতন একটি গণ। এই গণের Kenyanthropus platyops প্রজাতি কেনিয়ার তুর্কানা হ্রদের কাছে বসবাস করতো। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সোনিয়া হার্মার্ড এবং জেসন লুইস কেনিয়ার তুর্কানা হ্রদের কাছে কিছু পাথরের তৈরি যন্ত্রপাতির সন্ধান পান। গবেষকরা এই ক্ষেত্রের নামকরণ করেন লোমেক্উই । এই নতুন ক্ষেত্রটিতে পাওয়া যায় এমন কিছু যন্ত্র, যেগুলো পাথর ঘষে তৈরি করা হয়েছিল।
এই গণের জীবন-যাপনে প্রথম সৃজনশীল কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়। এর আগের প্রজাতিগুলো, জন্মগ্তসূত্রে প্রাপ্ত সহজাত ক্ষমতায় যা করতে পারতো, তার বাইরে কিছু ভাবাটা প্রয়োজন মনে করে নি। কেনিয়ান্থ্রোপাস গণের এই প্রজাতিটি, এর বাইরে বেরিয়ে এসে পাথরকে ঘষে ঘষে যন্ত্র তৈরি করেছিল। মটি খনন, হিংস্র জন্তু থেকে আক্রমণ প্রতিহতকরণ, মাংস কর্তন বা থেঁতলানোর জন্য এরা এই পাথুরে যন্ত্র ব্যবহার করতো। গাছ থেকে কাঠ সংগ্রহ করতো। সেকালের পরিবেশে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য এই টুকু ক্ষমতাই হয়তো পর্যাপ্ত ছিল না। তাই ৩২ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
পিয়াসেনজিয়ান আমলের শেষের দিকে, অর্থাৎ ২৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আফ্রিকাতে হোমো হ্যাবিলিসদের আবিরভাব হয়েছিল। আর ১৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ এরা পৃথিবীতে আধিপত্য বিস্তার করতে করতে পিয়াসেনজিয়ান আমল শেষ হয়ে গিয়েছিল। এরপর শুরু হয়েছিল- গেলাসিয়ান আমল।
ওল্ডোয়ান সভ্যতা: গেলাসিয়ান আমল (২৫.৮-১৮.৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)।
এই আমলের ২৫.৮ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে, 'কোয়াটার্নারি বরফযুগ' শুরু হয়েছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে এই বরফযুগের প্রভাবে উত্তর গোলার্ধের মেরু সংলগ্ন এলাকার জলস্থল বরফ ঢেকে গিয়েছিল। এই আমলের ২০.৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পরে বেশকিছু হিমযুগ ও আন্তঃ হিমযুগ সংঘটিত হয়েছিল। এই আমলের শেষভাগে অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ১৮ লক্ষ ৬ হাজার অব্দের ভিতরে বরফের আগ্রাসন বিষুব অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এর ফলে এই সময়ে উত্তর মহাসাগর বিশাল বরফ-প্রান্তরে পরিণত হয়। এর ফলে এই সময়ে উত্তর মহাসাগর বিশাল বরফ-প্রান্তরে পরিণত হয়। পরবর্তী ক্যালাব্রিয়ান আমলের শেষে অর্থাৎ ৭ লক্ষ ৮১ হাজার অব্দের ভিতরে শৈত-প্রবাহের সূত্রে এ্যান্টার্ক্টিকা মহাদেশে এবং গ্রিনল্যান্ডে পুরু বরফস্তরের সৃষ্টি হয়েছিল। উল্লেখ্য এখনো এই বরফস্তর বিদ্যমান আছে। আয়োনিয়ান আমলে (৭.৮১- ১.২৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং সমগ্র সাইবেরিয়া অঞ্চলে ব্যাপক শৈত প্রবাহ বিদ্যমান ছিল। এই অবস্থাকে কোয়াটার্নারি বরফযুগের প্রথম ধাপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
২৪ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এদের দ্বারাই তাঞ্জানিয়ায় ওল্ডুপাই জর্জের ওল্ডোয়ান সভ্যতা পত্তন ঘটেছিল। ওল্ডুপাই জর্জকে সাধারণভাবে মানবসভ্যতার সুতিকাগার হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এই অঞ্চলটি বর্তমানে এটি একটি জনমানব শূন্য বন্ধুর এলাকা মাত্র। ধারণা করা হয় এই এলাকায় ২৫-২৪ লক্ষ বৎসর পূর্বে হোমো হ্যাবিলিস বসবাস শুরু করেছিল।
প্রায় ১৮ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আফ্রিকা থেকে আগত হোমো স্যাপিয়েন্সদের কয়েকটি দল ব্র্তমান প্যালেস্টাইন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। প্রাচীন প্যালেস্টাইনের জর্ডন উপত্যাকায় অবস্থিত উবেইদিয়া নামক এরূপ একটি প্রাচীন জনপদে এর নমুনা পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রে এখানে পাওয়া গেছে ১৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মানুষ এবং অন্যান্য কিছু প্রাণীর জীবাশ্ম। এ সকল জীবাশ্মের পাশাপাশি পাওয়া গেছে পাথুরে দিয়ে হস্ত-কুঠার ও অন্যান্য উপকরণ।
গেলাসিয়ান আমলের শেষ অবধি হোমো হ্যাবিলিসরা বেশ দাপটের সাথেই নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। হোমো হ্যাবিলিসদের বিচরণ ক্ষেত্রে ছিল আফ্রিকা থেকে পশ্চিম-এশিয়া পর্যন্ত।তবে এই আমলে আবির্ভূত হয়েছিল- হোমো গণের উল্লেখযোগ্য প্রজাতি হোমো ইরেক্টাস। ২০ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আফ্রিকাতে এই প্রজাতির উদ্ভব হয়েছিল। ৫০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এদের এর সকল উপপ্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। হোমো গণের এই প্রজাতি প্রথম দুই পায়ে ভর করে মাটির উপর সটান দাঁড়াতে সক্ষম হয়ে উঠেছিল। এছাড়া এরা সৃজনশীল ক্ষমতার দ্বারা নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিজেদের প্রয়োজনীয় জীবনধারণের উপকরণ প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করতে পারতো এবং উপাদনসমূহ থেকে নানাবিধ উপকরণ তৈরি করতে পারতো। তবে সৃজনশীল ক্ষমতার বিচারে এরা আধুনিক মানুষের সমকক্ষ ছিল না। এরা দুই পায়ে ভর করে মাটিতে চলাফেরা করতে পারতো। এছাড়া গাছে গাছে দোল খেয়ে চলার মতও ক্ষমতা ছিল। মানুষের মতই এদের উচ্চতার হেরফের ছিল। এদের মস্তিষ্ক অস্ট্রালোপিথেকাসদের চেয়ে বড় ছিল। সটান মাটির উপর দাঁড়াতে বা চলাফেরা করার বিশেষ গুণের কারণে এরা চলাফেরায় স্বচ্ছন্দ গতি পেয়েছিল। এই বিশেষ গুণের কারণেই এরা হাতে, মাথায় ভারি বস্তু বহন করতে সক্ষম হয়েছিল। এছাড়া মস্তিষ্কের ও দেহের কাঠামোগত পরিবর্তনের দিক দিয়ে এরা অনেকটাই আধুনিক মানুষের মতো হয়ে উঠেছিল।
এদের গড় উচ্চতা ছিল ১.৮ মিটার। এদের গড় ওজন ছিল ৬০ কেজি। খুলির গড়ন ছিল আধুনিক মানুষের মতো। খুলির পরিমাপ ছিল ৯০০-১১০০ সিসি। এরা আধুনিক মানুষের মতো দুই পায়ে সোজা হয়ে হাঁটতো এবং হাত ও পায়ের আনুপাতিক দৈর্ঘ্য ছিল আধুনিক মানুষের মতো।
হোমো হ্যাবিলিস মতোও নিম্নপ্রস্তর-যুগ বিকাশে এরা ভূমিকা রেখেছিল। প্রায় ১৮.৬- ১৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই হোমো ইরেক্টাসরা আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের একটি শাখা ইউরেশিয়ায় প্রবেশ করে। পরে এই শাখাটি বিভাজিত হয়ে একটি শাখা ইউরোপের ককেশাশ অঞ্চলে থেকে যায়। অবশিষ্ট অংশের একটি দল প্রথমে চীনে প্রবেশ করে। পরে এর একটি দল ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপাঞ্চলে চলে যায়। বিশাল অঞ্চল জুড়ে এই প্রজাতিটি ছড়িয়ে পড়ার কারণে, বিভিন্ন স্থানে এই প্রজাতিটির বিবর্তিত হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন ধারায়। এসকল প্রজাতির জীবাশ্মগুলোকে বিভিন্ন সময়ে নানা ভাবে এবং নানা নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন- জাভা মানব, সোলো মানব, পিকিং মানব ইত্যাদি। এরপর শুরু হয় ক্যালাব্রিয়ান আমল (১৮.৬-৭.৮১ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)।
আশুলিয়ান যন্ত্রপাতি'র সভ্যতার প্রথম পর্ব। ক্যালাব্রিয়ান আমল (১৮.৬-৭.৮১লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
এই আমলে নিম্ন প্রস্তরযুগের ক্রমবিকাশে তিনটি প্রজাতি বিশেষ অবদান রেখেছিল। এই প্রজাতি তিনটি হলো-আশুলিয়ান যন্ত্রপাতি'র সভ্যতার দ্বিতীয় পর্ব। আয়োনিয়ান আমল (৭.৮১- ১.২৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
- হোমো হ্যাবিলিস: এরা এই আমালের ১৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এরা আফ্রিকা এবং পশ্চিম-এশিয়ায় নিম্ন প্রস্তরযুগের অংশভাগী হয়েছিল।
- হোমো ইরেক্টাস: ২০ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আফ্রিকাতে আবির্ভুত হয়েছিল মূল ধারার হোমো ইরেক্টাস। খ্রিষ্টপূর্ব ১৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে এদের কয়েকটি দল মধ্য এশিয়া হয়ে চীনে প্রবেশ করেছিল। এদেরকে সাধারণভাবে পিকিং মানব নামে অভিহিত করা হয়। ১৯২৩-২৭ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে চীনের রাজধানী বেইজিং (পূর্বনাম পিকিং)-এর নিকটবর্তী ঝোউকোউশিয়েন (Zhoukoudian) অঞ্চলে এই উপপ্রজাতির কিছু জীবাশ্মা পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, ১৯২১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ঝোউকোউশিয়েন অঞ্চলে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ শুরু হয়। এই সূত্রে ১৯২৩-২৭ খ্রিষ্টাব্দের ভিতর অঞ্চলের চুনাপাথরের স্তরে এই প্রজাতির কিছু সদস্যের জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়। এর ভিতরের ছিল চোয়াল, দাঁত, কিছু অস্থি, আর পাথুরে অস্ত্রপাতি।
ঘুরে ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে পৌঁছায়। ধারণা করা হয় ১৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এই প্রজাতির উদ্ভব হয়েছিল। এদেরকে জাভা মানব নামে অভিহিত করা হয়।
- হোমো এর্গাস্টার: প্রায় ১৯ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে হোমো এর্গাস্টারদের উদ্ভব হয়েছিল দক্ষিণ এবং পূর্ব আফ্রিকাতে এবং এই প্রজাতি প্রায় ১৪ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এই বিচারে বলা যায় হোমো এর্গাস্টারদের পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল ক্যালাব্রিয়ান আমলে এবং শেষও হয়েছিল এই আমলে।
ফ্রান্সে প্রাপ্ত আশুলিয়ান কুঠারের নমুনা
প্রায় ১৭.৫ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে হোমো এর্গাস্টারা পাথুরে অস্ত্রের উন্নয়ন করেছিল। ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সের সোমে নদীর তীরবর্তী সেন্ট আশুয়েল (St. Acheul) অঞ্চলে এই যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়েছিল। এই সূত্রে এই যন্ত্রপাতিকে আশুলিয়ান যন্ত্রপাতি বলা হয়। আশুলিয়ান যন্ত্রপাতির ভিতরে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো উপকরণ হলো- পাথরের তৈরি হাত-কুঠার।
অঞ্চলভেদে এই এই কুঠারে মধ্যভাগ স্ফীত। বিজ্ঞানীরা নাশপাতি, অশ্রুকণা, গোলাকার ইত্যাদির সাথে এর আকারে তুলনা করেছেন। এগুলোর দৈর্ঘ্য ছিল ১২-২০ সেন্টিমিটার। এর উভয় পার্শ্ব ছিল ধারলো। গাছ কাটা, মাটি খনন, পশু শিকার এবং এর মাংস কাটা ইত্যাদি কাজে এই কুঠার ব্যবহার করা হতো।
সেন্ট আশুয়েলের বাইরে এই বৈশিষ্ট্যের প্রাচীন যন্ত্র পাওয়া গেছে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে উত্তর ইউরোপ অবধি। আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চলের আশুলিয়ান যন্ত্রপাতিগুলোর সর্বাপ্রাচীন নমুনা তৈরি হয়েছিল ১৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে।
- হোমো গটেনজেনসিস: হোমো এর্গাস্টারদের পাশাপাশি ১৯ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের এই প্রজাতির আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকার কেনিয়া অঞ্চলে। উদ্ভিদজাত খাদ্য খাওয়ার উপযোগী এদের বেশ বড় বড় দাঁত ছিল। আধুনিক মানুষের চেয়ে এদের খুলি ছিল বেশ ছোট। ধারণা করা হয়- এরা হাতিয়ার হিসাবে পাথর ব্যবহার করতে পারতো এবং আগুন ব্যবহার করতে শিখেছিল। এদের দৈর্ঘ্য ছিল ৩ ফুট এবং ওজন ছিল ১১০ পাউন্ড (৫০ কিলোগ্রাম)। এরা মাটিতে দুই পায়ে হাঁটতো, তবে অধিকাংশ সময় এরা গাছে বসবাস করতো। ৬ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
ধারণা করা হয়, এরাও হোমো এর্গাস্টারদের মতো পাথুরে অস্ত্র ব্যবহারে অভ্যস্থ ছিল। তবে অস্ত্রের কোনো নমুনা পাওয়া যায় নি।
- হোমো জর্জিকাস:
সম্ভবত এদেরও আবির্ভাবকাল ১৮ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। অবশ্য এর যে খুলিটি পাওয়া গেছে, তা ১৭.৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পুরানো। এদের মাথার খুলির মাপ ৬০০ ঘন-সেন্টিমিটার। এদের তৈরি কোনো অস্ত্রের কোনো নমুনা পাওয়া যায় নি।
- হোমো এন্টেসেসর: প্রায় ১২ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আফ্রিকা স্পেন ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে আবির্ভূত হয়েছিল। ৮ লক্ষ বৎসর আগে এরা ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইউরোপে যে কয়েকটি মনুষ্য- প্রজাতি বসবাস করতো- হোমো এন্টেসেসর ছিল তার মধ্যে একটি। ধারণা করা হয় এরা ছিল হোমো এর্গাস্টার এবং হোমো হাইডেলবার্গেনসিস -এর মধ্যবর্তী একটি প্রজাতি। কিন্তু Richard Klein-সহ আরও অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন হোমো এর্গাস্টার থেকে বিবর্তিত হয়ে এই প্রজাতিটির উদ্ভব হয়েছিল। বৈশিষ্ট্যে বিচারে এরা হোমো হাইডেলবার্গেনসিস-এর কাছাকাছি ছিল। আবার অনেকে মনে করেন হোমো এন্টেসেসর আর হোমো হাইডেলবার্গেনসিস একই প্রজাতি।
ধারণা করা হয়, এরা নিম্ন পর্যায়ের ভাষার ব্যবহার শিখেছিল। সম্ভবত ভাষার আদি স্তরে কিছু প্রতীকী ধ্বনির সাহায্যে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারতো।- হোমো আটল্যান্থ্রোপাস
ধারণা করা হয়, ১২ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই প্রজাতির বিকাশ ঘটেছিল আফ্রিকার মৌরতানিয়া অঞ্চলে । এদের উচ্চতা ছিল ১.৭-১.৮ মিটার এবং ওজন ছিল ৬০ কেজি। এদের মস্তিস্কের পরিমাণ ছিল ১০০০-১১০০ ঘন-সেন্টিমিটার।- হোমো সেপ্রানেনসিস
প্রথম দিকে ধারণা করা হয়েছিল এই প্রজাতিটি ৯-৭ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে জীবিত ছিল। এই সময় এর সাথে হোমো ইরেক্টাস-এর খুলির অনেক মিল লক্ষ্য করে, অনেকে ভেবেছিলেন হয়তো এই খুলিও হোমো ইরেক্টাস-এর। পরে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে অনুমান করেছেন, হয়তো এরা ৫ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ ৫০ হাজার বৎসর আগে পৃথক প্রজাতি হিসেবে বিকশিত হয়েছিল।