জ্ঞানদানন্দিনী ঠাকুর
(১৮৫০-১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ)
ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারীর সামাজিক অধিকারের সংস্কারক এবং জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের বধূ।

১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ শে জুলাই (শুক্রবার ১২ শ্রাবণ ১২৫৭ বঙ্গাব্দ) যশোহর জেলার নরেন্দ্রপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। বাবা নাম অভয়চরণ মুখোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম নিস্তারিনী দেবী।

১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে (১২৬৬ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে বিয়ে হয়। উল্লেখ্য, পিতা অভয়চরণ কুলীন ব্রাহ্মণ বংশের হওয়া সত্ত্বেও পিরালি পরিবারের একজনকে বিয়ে করার কারণে তাঁকে সমাজচ্যূত করা হয়েছিল।

১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে সত্যেন্দ্রনাথ যখন তার প্রবেশনারি ট্রেনিং-এর জন্য ইংল্যান্ডে যান, তখন জ্ঞানদানন্দিনীকেও সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। বয়সের কথা বিবেচনা করে দেবেন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে যেতে বাধা দেন। এই সময় জ্ঞানদানন্দিনীর দেবর হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এই সময় তিনি অযোধ্যনাথ পাকরাশির কাছেও শিক্ষা গ্রহণ করেন।

১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে সত্যেন্দ্রনাথ যখন প্রথম ভারতীয় সিভিল সার্ভিস সদস্য হিসেবে ইংল্যান্ড থেকে ফিরলেন, তখন জ্ঞানদানন্দিনী তাঁর স্বামীর সাথে বোম্বেতে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। এখানে বসবাসের সময়, তিনি ইউরোপীয় আচার-আচরণের সাথে পরিচিত হন এবং ধীরে ধীরে এসব আচরণে অভ্যস্থ হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে ইউরোপীয় রীতিতে স্বামীর সাথে ক্লাবে যাওয়া, ইউরোপীয় মতো শুভেচ্ছা করমর্দন ইত্যাদিতে আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠেন।

তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, আটপৌড়ে জীবনে বাঙালি নারীদের পোশাক যথেষ্ঠ শালীন নয়। তা ছাড়া বাঙালি নারীদের শাড়ি পড়ার ধরণটিও তাঁর কাছে ভালো লাগতো না। স্বামীর সাথে গুজরাটে এক সফরে গিয়ে তিনি পারসি নারীদের শাড়ি পড়ার ধরণ দেখেন এবং তাঁদের মতো শাড়ি পড়ার রীতি আয়ত্ব করেন। তবে তিনিই প্রথম বাম দিকে আঁচল শাড়ি পড়ার ধরনটি চালু করেন। সেটা ছিল পারসি স্টাইলের বিপরীত। ডান হাত দিয়ে যেন নির্বিঘ্নে কাজ করা যায় সেই চিন্তা থেকেই বাম কাঁধে আঁচল ফেলার বিষয়টি তিনি শুরু করেন। এছাড়া তিনি সৌন্দর্যের বিচারে সম্মুখভাগে কুঁচির ব্যবহার করেন। এই ধরনের শাড়ির সাথে পরিধানের জন্য বক্ষবন্ধনী, পেটিকোট, জুতা ও মোজার ব্যবহার যুক্ত করেছিলেন। কলকাতায় তার অনুগত প্রথম দিককার ছাত্রীদের মধ্যে একজন ছিলেন বিহারী লাল গুপ্তা আইসিএস-এর স্ত্রী সৌদামিনী গুপ্তা। এই শাড়ি পড়ার রীতি কলকাতার ব্রাহ্ম নারীদের মধ্যে তা দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এই বিশেষ রীতির শাড়ি পড়ার ধরনের নাম দিয়েছিলেন 'ব্রাহ্মিকা শাড়ি'।

১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে সেকালের রীতি ভেঙে ভাইসরয় লর্ড লরেন্সের দেয়া ভোজসভায় স্বামীর সাথে যোগ দিয়েছিলেন। এই আসরে পাথুরিঘাটার ঠাকুর পরিবারের প্রসন্নকুমার ঠাকুর ছিলেন। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর দৃঢ়তায় তিনি গভীরভাবে ক্ষুব্ধ হন এবং ভাইসরয়র আবাস ত্যাগ করে চলে যান। তার শ্বশুর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও তার স্বাধীনচেতা মনোভাবকে উদারভাবে মেনে নিতে পারেন নি। এর ফলে ঠাকুর পরিবারে একধরনের তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল। ঠাকুর বাড়িতে তিনি নিজের মতো করে চলতে পারছিলেন না, তাই ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে জোড়াসাঁকো ছেড়ে পার্ক স্ট্রিটে স্বামীর সাথে নতুন সংসার পেতেছিলেন।

১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে জ্ঞানদানন্দিনী তাঁর স্বামীর সাথে বোম্বেতে ফিরে যান। এই বছরে তাঁর প্রথম সন্তানের জন্ম হয় এবং জন্মের কিছুদিনের মধ্যে এই সন্তানের মৃত্যু হয়।

১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে পুনায় থাকাকালে পুত্র সুরেন্দ্রনাথের জন্ম হয়।

১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বিজাপুরে থাকাকালে কন্যা ইন্দিরাদেবীর জন্ম হয়। এসময় জ্ঞানদানন্দিনী সন্তানদের জন্য একজন মুসলিম সেবিকা নিয়োগ করেন। সে সময় শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ের নার্স কিংবা গভের্নেসদের তত্ত্বাবধানে বাচ্চা রাখার বিষযটি ভারতীয় অভিজাত পরিবারগুলোতে ছিল একটি সাধারণ রীতি ছিল। তবে মুসলমান সেবিকা রাখাটা রক্ষণশীল বাঙালিরা মেনে নিতে পারেন নি।

১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে সিন্ধু প্রদেশের হায়দারাবাদে তার তৃতীয় পুত্র কবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়।

১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে গর্ভবতী অবস্থায় জ্ঞানদান্দিনী ইংল্যান্ডে যান তার তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে। ভারতীয় কোনো নারী কোনো পুরুষসঙ্গী ছাড়া ইংল্যান্ডে গেছেন, এ নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। তার স্বামীর কাকা জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর তাঁকে লন্ডনে স্বাগত জানান। তিনি কিংসটন গার্ডেনসে কাকা শ্বশুড়ের বাড়িতে কিছুদিন থাকার পর, সাসেস্কের ব্রাইটনে মদীনা ভিলায় একটি বাড়িতে চলে যান। এই সময় তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র কবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। লন্ডনের কেনসাল গ্রিন সিমেট্রিতে দ্বারকানাথ ঠাকুরের সমাধির পাশে কবীন্দ্রনাথকে সমাহিত করা হয়।

১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছুটিতে ছোটভাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে সেখানে আসেন। মৃত সন্তানের জন্মদান এবং কনিষ্ঠ পুত্র মৃত্যুর কারণে ইংল্যান্ডে তার প্রথম বছরটি ছিল বিষাদে পূর্ণ। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছুটি শেষে সুরাটে বদলী হয়ে যান এবং জ্ঞানদানন্দিনী সন্তানদের নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন এবং কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোডে বাংলোতে বসবাস শুরু করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়েতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এবং তাঁর তরুণী বধূ মৃণালিনী দেবীর  পরামর্শক হিসেবে ছিলেন তিনি। এই সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চস্থের বিষয়েও সহযোগিতা শুরু করেন তিনি। এই সহযোগিতায় রবীন্দ্রনাথের বাল্মিকী প্রতিভা, কালমৃগয়া, রাজা ও রানী, মায়ার খেলা এবং বিসর্জন ঠাকুর বাড়িতে মঞ্চস্থ হয়েছিল। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ও রাণী নাটকে তার অভিনয়ের নিন্দা তুলে ধরা হয় জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা বঙ্গবাসীতে।

১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে (বৈশাখ ১২৯২ বঙ্গাব্দ) তাঁর সম্পাদনায় শিশু-কিশোরদের জন্য 'বালক' পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। উল্লেখ্য, পত্রিকাটির কার্যাধ্যক্ষ ছিলেন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই পত্রিকা এক বছর চলার পর, ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত অপর একটি পত্রিকা, 'ভারতী ''র সাথে যুক্ত হয়ে যায়। তখন এই নাম দেওয়া হয়েছিল- 'ভারতী ও বালক'। ১২৯৩ থেকে ১২৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত  'ভারতী ও বালক' প্রকাশিত হয়েছিল। পরে এই পত্রিকাটি পুনরায় 'ভারতী' নামেই প্রকাশিত হওয়া শুরু করেছিল।

১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এবং সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রাঁচিতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে যান এবং ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সেখানেই স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেন। 

১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
 

সন্তানসন্ততি