কারাগার
নাট্যকার মন্মথ রায় রচিত একটি নাটক। এই নাটকটি ছিল একটি ফরমায়েসি রচনা। এ বিষয়ে নাটকটির প্রথম সংস্করণের নাট্যকার 'লেখকের কথা' অংশে লিখেছেন-
'নটসূর্য শ্রীযুক্ত অহীন্দ্র চৌধুরী মিনার্ভা থেয়েটারে যোগদান করিয়া তাঁহাদের জন্য একখানি নাটক লিখিয়া দিতে গত জুলাই মাসে অনুরোধ করেন। তদনুযায়ী গত ১২ই আগষ্ট আমি "কারাগার" রচনায় ব্রতী হই, এবং ২৫শে আগষ্ট মধ্যে উহার প্রাথমিক গঠন শেষ করিয়া পাণ্ডুলিপি শ্রীযুক্ত অহীন্দ্র চৌধুরীর হস্তে সমর্পণ করি। নানা কারণে মিনার্ভা থিয়েটারে উহার অভিনয় সম্ভব হয় না।'
এরপর প্রায় মাস দেড়েক পরে (১৭ই নভেম্বর ১৯৩০), মনোমোহন থিয়েটারের সর্বাধ্যক্ষ প্রবোধচন্ত্র গুহ নাটকটি মঞ্চস্থ করার উদ্যোগ নেন। এরপর মন্মথ রায় নাটকটির পরিমার্জনায় হাত দেন। তিনি ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে নভেম্বর থেকে ১৩ই ডিসেম্বর পর্যন্ত একটানা কাজ করে, নাটকটিকে মঞ্চস্থ করার উপযোগী করে দেন। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে ডিসেম্বর (বুধবার ৯ পৌষ ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ) নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল।

এই নাটকের গানগুলো রচনা করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং হেমেন্দ্র ৮টি গান ব্যবহৃত  হয়েছিল। তবে নজরুল কবে নাগাদ গানগুলো রচনা শুরু করেছিলেন, তার সুনর্দিষ্ট তারিখ পাওয়া যায় না। তবে ইঙ্গিত পাওয়া যায় নাট্যকারের 'লেখকের কথা' থেকেই। নাট্যকার এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন-
'গান রচনায় আমি অক্ষম। কিন্তু আমার এই অক্ষমতা সার্থক হইয়াছে সেই এক পুণ্যপ্রভাতে যেদিন সারা-বাঙলার দুলাল-কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমার হাত দু'খানি পরম স্নেহে ধরিয়া বলিয়াছিলেন, "আপনি আপনার নাটকের জন্য আমাকে দিয়া গান লেখাইয়া না লইলে আমার অভিমানের কারণ হইবে।'' যে আন্তরিক স্নেহে তিনি "মহুয়ারৰ কণ্ঠে গান দিয়াছিলেন, এবারও আমার "কারাগারে"র জন্য তেমনি আন্তরিক স্নেহে তিনি গান রচনা করিয়াছেন। রাজদণ্ডে দণ্ডিত হইবার পূর্ব মূহুর্তেও তিনি "কারাগারে"র জন্য শুধু গান রচনা করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, পরমোল্লাসে উহাতে স্বয়ং সুরযোজনা করিয়াছেন..."
এখানে 'রাজদণ্ড' একটি বিশেষ অর্থে নাট্যকার ব্যবহার করেছেন। মন্মথ রায় যখন 'কারাগার' নাটকটি রচনা করছিলেন, সে সময়ে নজরুলের 'প্রলয়শিখা' গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত এবং তাঁকে গ্রেফতার করার পাঁয়তারা চলছিল। ১৫ ডিসেম্বর (সোমবার ২৯ অগ্রহায়ণ ১৩৩৭), আদালতের রায়ে ৬ মাসের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। মন্মথ রায়ের উক্তি অনুসারে, অনুমান করা যায় যে, নজরুল কারগার নাটকের গানগুলো রচনা এবং তাতে সুর সংযোজনা করেছিলেন- ১৫ই ডিসেম্বরের দিকে। অবশ্য ইতিমধ্যে 'তিমির -বিদারী অলখ-বিহারী' গানটি জয়তী পত্রিকার 'কার্তিক-পৌষ ১৩৩৭' সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। সব মিলিয়ে ধারণা করা যায়, এই নাটকের গানগুলো তিনি রচনা করেছিলেন ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে।

১৮টি অভিনয়ের পর, ব্রিটিশ সরকার নাটকটির অভিনয় বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে, নাট্যনিকেতনে অভিনীত হয়েছিল ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ আগষ্ট (শনিবার ২৩ শ্রাবণ ১৩৩৮)  তারিখে।

সেকালের মঞ্চ নাটকের একটি অন্যতম আকর্ষণ ছিল গান। মন্মথ রায় এই নাটকের জন্য কোনো গান রচনা করতে পারেন নি। তিনি এই ভার দিয়েছিলেন নজরুল ইসলাম এবং হেমেন্দ্রকুমার রায়ের উপর। এ বিষয়ে নাট্যকার 'লেখকের কথা' অংশে লিখেছেন-

'ধরিত্রীর গানগুলো শ্রীযুক্ত নজরুল ইসলাম রচনা করিয়াছেন এবং বাকী গানগুলি শ্রীযুক্ত হেমেন্দ্রকুমার রায়ের। গানগুলিতে সুর যোজনাও তাঁহারাই করিয়েছেন।'

এই নাটকে ধরিত্রী চরিত্রে ৬টি গান ব্যবহৃত হয়েছিল। এর প্রত্যেকটি গানের কথা ও সুর রচনা করেছিলেন নজরুল। বাস্তবে ধরিত্রী চরিত্র ছাড়াও আরো দুটি নজরুলে গান ব্যবহৃত হয়েছিল। গান দুটি হলো- চন্দনার কণ্ঠে 'নীরন্ধ্র মেঘে মেঘে অন্ধ গগন'  এবং কঙ্কণ ও কঙ্কার গান- 'আজি শৃঙ্খলে বাজিছে মাভৈঃ'নিচে নাটকে ব্যবহৃত সমুদয় গানের তালিকা তুলে ধরা হলো-

কারাগার নাটকে ব্যবহৃত গানের তালিকা: